বক্কুমিয়া চলে গেছে সে সাত দিনও পেরোইনি। এরই মাঝে হটাৎ এক বিকেলে মোটামত গোল্লাগাল্লা চেহারার লাল টকটকে পাড়ের গরদের শাড়ি পরা এক মহিলা এসে নামলেন আমাদের বাড়ির দূয়ারে। রিক্সা থেকে নেমে উনি রিক্সাওয়ালার সাথে ভাড়া নিয়ে বাক বিতন্ডায় মেতে উঠলেন। সেই চেঁচামেচি হই হট্টগোলে সকলেই ছুটে আসলো সেই স্থানে। ঐ মহিলা তখন সকলের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু। বাড়ির কাজের লোকজন ছেলেবুড়ো প্রায় সকলেই জড়ো হলো তামাশা দেখতে বড় গেইটটার কাছে। বাড়ির মহিলারা এবং আশে পাশের প্রতিবেশীরাও সব উঁকি ঝুকি দিতে শুরু করলেন। শেষ পর্যন্ত মান সন্মান বাঁচাতে ত'চাচা বেশি ভাড়া দিয়ে বিদায় করলেন রিক্সাওয়ালাকে। কিন্তু কে ঐ মহিলা!
বেশভুষায় সম্ভ্রান্ত কিন্তু রিক্সাওয়ালার সাথে উনার বাক্যি ব্যবহারের নমুনায় তো উনাকে মোটেও সুবিধার মনে হচ্ছিলো না। রিক্সাওয়ালাকে বিদায় করতেই উনার অমন রনচন্ডিনী চেহারা বদলে হাসি হাসি গদগদ মুখ হয়ে উঠলো দু মিনিটের মাঝেই। ত'চাচাকে সাক্ষী মেনে হাসি হাসি মুখে বললেন, দেখলে তো বাবা কি রকম এইসব চোটলোকেদের দল! এই ঘোপের মোড় থেকে তালতলা এই টুকুন রাস্তার ভাড়া কিনা চাইচে দুইগুনো! কলিকাল কলিকাল আর কত দেখবোরে মমিন! মমিন কে, কে জানে উনার ছেলের নাম নাকি স্বামীর নাম জানা হয়নি আমার কখনও। কিন্তু ঐ সর্বনাশী মহিলাকে ভেতর বাড়িতে ঢুকতে দেখে মা আমাকে চোখের ইশারায় ভেতরে যেতে বললেন। আমার তো যাবার মোটেও ইচ্ছা ছিলো না। কারণ সকল নাটকীয় ঘটনাবলী নিজচোখে দেখার আর তার রস আস্বাদনের শখ আবার আমার ছোটকাল থেকেই। কিন্তু মায়ের রক্তচক্ষুর ইঙ্গিতে সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই নবাগতা আশ্চর্য্য মহিলার কান্ডকীর্তির কারণ দর্শন আর হলো না আমার।
কিন্তু আমি কি আর এত সহজেই দমে যাবার পাত্রী যে বাড়ির ভেতরে পাঠিয়ে দিলেও এই মহিলার সার্কাস অদর্শনে বিরহে থাকবো? আমিও পর্দার ফাক ফোকর দিয়ে উঁকি ঝুকি অব্যাহত রাখলাম। সেই মোটা মতন মহিলাকে ললিতা মাসী বারান্দাতেই একখানা জলচৌকি এনে দিলো আর তাতেই আমার বোধগম্য হলো যে উনি যতই তসর গরদের শাড়ি পরে আসুক না কেনো মোটেও কোনো সম্ভ্রান্ত মহিলা নন। কারণ আমাদের বাড়িতে জলচৌকি বরাদ্দ ছিলো ঝি চাকর শ্রেনীর লোকজনদের জন্য আর হাতলবিহীন বা হাতলওয়ালা বড় চেয়ারগুলি ভদ্রলোকেদের জন্য। ঝি চাকরদের ভুলেও সেসব চেয়ারে বসার কোনো অধিকারই ছিলো না। সে যাইহোক জলচৌকিতে বসে উনি উনার পান দোক্তার কৌটাটি খুলে বসলেন কোলের উপর। তারপর মাকে বললেন, কেমন আছো মেজোবউ? শ্বাশুড়িমাকে একবার ডাকো দিকিনি। আমার নাক উঁচু স্বভাবের মা একটু তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, কেনো? কার জন্য সন্মদ্ধ নিয়ে এলে লেবুর মা? লেবুর মা! মানুষের নাম লেবু! আমার দম ফেটে হাসি এলো। তবুও অনেক কষ্টে মুখ চেপে হাসি সহ্য করে দাঁড়িয়ে রইলাম। লেবুর মায়ের জবাব দেওয়া হলো না মায়ের প্রশ্নের।
তার আগেই দাদীমা এসে বসলেন বারান্দায় পেতে দেওয়া কাজ করা সিংহমুখী হাতলের চেয়ারটাতে। মা চাচীরা সব দাঁড়ি্যে রইলেন। ঐ পান দোক্তা খাওয়া লেম্বুবাবাজানের মা এক গাল হেসে দাদীমার পা ছুঁয়ে সালাম করে বললেন,
- মা জননী কেমন আছেন? অনেকদিন পর দেখলাম আপনাকে। বুড়ো হয়ে যাচ্ছেন মা।
দাদীমাও এক গাল হেসে বললেন, বুড়ো হবো না! তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকলো।
লেবুর মা গলা নীচু করে বললেন,
- একখানা ভালো সন্মদ্ধ আছে। ছেলে ডাকতর। বিদেশ থেকে পাস করে এয়েচে। ঢাকায় বাড়ি আচে। গাড়ি আচে। বাবারও আচে, ছেলেরও আচে। অনেক বড় বংশ হেনো তেনো। তো তোমাদের বাড়ির মেয়েও তো ডাগর হয়ে উঠিচে। ছেলের মামা আমাদের এই জেলারই ডিসি। তো ডিসি সাহেবের বৌ আমাদের নীরু মামনীকে দেখিচেন । উনিই আমারে ডেকে জানতি চেয়েচেন যে আপনারা মেয়ে বিয়ে দেবেন কিনা।
এতক্ষন পর্দার আড়ালে এই অদ্ভুত রমনীর সকল কান্ড কারখানা কথা বার্তায় বড় কৌতুক বোধ করছিলাম আমি বিশেষ করে তার চে চি চো শুনে শুনে। হঠাৎ তার এ হেন কথা শুনে আমি হিম হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। মা কিছু বলার আগে দাদীমাই বললেন,
- ভালো ঘর, ভালো বর এসবই তো চাই আমরা। তো তোমার ডিসিদের বাড়ি কনে?
- রাজশাহী। উনারা রাজশাহীর লোক।
আমার মাথা বো বো ঘুরছিলো। কি সর্বনাশ! এই মহিলা তো জেকে বসেছেন। দাদীমাকে তো প্রায় বশই করে ফেলেছেন। মাও বেশ চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে। আমার বুকের মধ্যে হাতুড়িপেটা শুরু হলো।
আমি এক দৌড়ে ছাদে গেলাম। এই ভর বিকেলে খোকাভাই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। আমি গিয়ে ধাক্কা দিয়ে জাগালাম।
- খোকাভাই! খোকাভাই! ওঠো শিঘ্রী....
আমার ধাক্কা খেয়ে চমকে উঠে বসলো খোকাভাই। তারপর চোখ রগড়ে রাগ করে ধমক দিলো,
- কি হয়েছে শুনি? এইভাবে ডাকছিস কেনো?
- সর্বনাশ হয়েছে খোকাভাই..... আমি কাঁদো কাঁদো গলায় বললাম।
- কি সর্বনাশ! কেউ মারা গেছে! খোকাভাই বিস্মিত হয়ে জানতে চাইলেন।
- আরে না ! মারা যায়নি। নীচে একজন মহিলা এসেছে। আমি তখনও রিতীমত হাপাচ্ছিলাম।
- তো কি হয়েছে! মহিলা কি খুনি? এত ভয় পাচ্ছিস কেনো?
- আরে ভয় পাবার কারণ আছে তো।
- কি কারণ?
- ঐ মহিলা আমার বিয়ের সন্মদ্ধ এনেছে।
- আনুক। তো কি হয়েছে! খোকাভাই অবাক হয়ে জিগাসা করলো।
আমি খোকাভায়ের কথা শুনে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। বলে কি? আমাকে বিয়ে দিয়ে দেবার যড়যন্ত্র চলছে আর খোকাভায়ের তাতে বিন্দুমাত্র চিন্তা নেই!
- আমি বললাম কি হয়েছে মানে? মানে মানে.....
আমি আসলে বলতে চাচ্ছিলাম আমরা দুজনকে ভালোবাসি কিন্তু সেটা জানার পরেও তুমি বুঝতে পারছোনা কি হয়েছে? কিন্তু এ কথাটা বলতে পারছিলাম না। খোকাভাই হেসে ফেললো আমার বিস্ফারিত চোখ আর হা করে তাকিয়ে থাকা ভাবনা দেখেই মনে হয়, তারপর বললেন,
- দূর পাগলী! এই বিয়ে হবে না । যা চিন্তা করিস না।
আমি খোকাভায়ের এত মনোবল আর ভবিষ্যৎবাণী দেখে অবাক হলাম। বললাম তুমি জানলে কেমনে! খোকাভাই বললো,
- আমি জানি হবে না.....
নীচে তখন আরও কি ষড়যন্ত্র চলছিলো জানিনা। আমি ফুপিয়ে উঠলাম। তারপর খোকাভায়ের বুকে কান পেতে শুনছিলাম তার হৃদস্পন্দন নীরু নীরু নীরু.......
মহিলা বিদায় নিলেন খানিক পরেই। কিন্তু রাতে খাবারের সময় বাবা আর দাদুর সাথে দাদীমা ফের তুললেন সেই কথা এবং জানালেন ডিসি সাহেবের বউ আর তার বড় ননদ মানে পাত্রের ফ্যামিলী আগামী রোববার আসতে চান আমাদের বাড়িতে। আমাদের ছোটদের তখন খাওয়া শেষ। মানে বাড়ির মুরুব্বীরা আমাদের পরে খেতে বসেছিলেন। আমি তখনও আড়ি পেতে শুনছিলাম, আমার মনে কু ডাক ডাকছিলো। তারপরও অনেক আশা ছিলো দাদীমা আর মায়ের এই প্রস্তাব দাদু উড়িয়ে দেবেন। কিন্তু সব শুনে দাদু বললেন, আমরা বিয়ে দেবো কি দেবোনা পরে ভেবে দেখবো এখন উনারা আসতে চেয়েছেন আসতে বলো। আর যত্নের যেন কোনো ত্রুটি না হয় সেই দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
সারা রাত ঘুম এলো না আমার। কি যে ভীষন ভয় লাগছিলো। চিনিনা জানিনা কোথাকার কোন ডিসি সাহেবের বউ কোথা থেকে দেখলো আমাকে আর এই প্রস্তাব নিয়ে আসলো! আর আসলো তো আসলো এমন সময়েই যখন মা মুখিয়ে আছেন আমাকে বিয়ে দিয়ে তাড়াবার ইচ্ছায়। এসবই মনে হয় বক্কুমিয়া আর তার বাবার অভিশাপের ফল। নইলে এমন হবে কেনো! যে আমি জীবনে কখনও কোনো অভিশাপ বা সত্যিকারের সাপকেও ভয় পাইনি সেই আমি ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। ললিতা মাসী প্রায়ই বলতো এই সব করুনি বাপু, মানুষির শাপ লাগপে। মানুষির শাপ বড়ো শাপ। মানুষির মনে দাগা দিতি নেই। এতে অলুক্ষুন হয়। বিরাট সব্বোনাশ হয়! এখন আমার এই বিরাট সব্বোনাশ ঠেকাবে কে!
পরদিন থেকেই শুরু হলো। মা চাচী আর দাদী মিলে কন্যাদান প্রস্তুতিমূলক সকল আয়োজন। সকালে উঠে ছোটচাচী বললেন, আজ থেকে রোদে যাওয়া বারণ। গাছে চড়া, মাছ ধরা, বাগানে টইটই, ছাদে পই পই কোথাও যাবি না। আমি তো হা করে সেই লেকচার শুনছিলাম। গাছ মাছ বাগান সবই ঠিক ছিলো কিন্তু ছাদ!!! ছাদের কথা শুনে মানে ছাদে যাওয়া বারণ শুনেই আমার মাথার তার টং করে ছিড়ে গেলো। আমি চিৎকার করে উঠলাম, চুপ থাকো! আমি কি ফাঁসীর আসামী যে আমার এখানে বারণ,সেখানে বারন এই দিকে যাবিনা, ঐ দিকে যাবিনা বলে আদেশ দিচ্ছো! মানিনা, মানিনা আমি এইসব তোমাদের ঢং! অনেক সহ্য করেছি।
আমার চেচামেচিতে চাচীরা দাদীমা অন্য সকল ছেলেপুলেরা কাজের লোকজন প্রায় সবাই মনে হয় সেখানে হাজির হয়েছিলো। আর মা
তার বিস্ফারিত দৃষ্টিতে চোখে আগুন ঝরিয়ে এসে দাঁড়ালেন আমার সামনে। তারপর এলোপাথাড়ী চড় থাপ্পড় মারতে মারতে বলতে লাগলেন, খুব বৃদ্ধি হয়েছে না? গাছের মগডালে উঠেছো তুমি? আদর পেয়ে পেয়ে তাল গাছে ওঠা বাঁদর হয়েছো? যত বড় মুখ নয় তত বড় কথা! তোরে আমি আজকে শেষ করে জেইলে যাবো তবুও তোর ....... উন্মাদের মত চিল্লাচ্ছিলেন মা, অবিশ্রান্ত বাক্য বর্ষনে তার মুখে ফেনা উঠছিলো। আমার হাঁটু সমান চুল একটু যেন না ঝরে তার জন্য সেই ছোট্টবেলা থেকে দাদীমার নিজের হাতে গাছের নারকেল পেড়ে, তা আবার রোদে শুকিয়ে জ্বাল দিয়ে বানানো খাঁটি নারিকেল তেল তাতে হরতকী, আমলা মিশিয়ে আমার চুলে লাগাতেন, সেই চুল উঠে আসলো মায়ের হাতে তবুও মায়ের কোনো ভ্রুক্ষেপ ছিলো না। মা বা ও বাড়ির কেউই বাবা মায়ের কথার অবাধ্যতা করলেই তার শাস্তি কি হয় তার একটা মাত্র উদাহরনই আমি দিয়েছিলাম মীরা আপার ঘটনায় কিন্তু অমন অনেক হাজার লাখো উদাহরন ছিলো ও বাড়ির যা বাইরের আর কেউ কখনও জানেনি।
সেই রাতে আমি সেজোচাচীর কাপড় সেলাই মেশিনের কৌটা থেকে বিশাল একখানা কাঁচি লুকিয়ে বের করে আনলাম। তারপর নিজেকে না কাকে যে শাস্তি দিতে আমার সেই দীঘল চুল কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম জানিনা। এরপর বিছানার মশারীর মধ্যে লুকিয়ে বসলাম ঠিকঠাক প্রস্তুতি নিয়ে। কাকে শিক্ষা দিতে জানিনা বটে তবে আমার সেই অতি যত্নের দীর্ঘ কেশ নিয়ে মা চাচী দাদীদের যে গর্ব ছিলো সব ছাঁপিয়ে মনে হয় মাকেই শিক্ষা দিতে এ কাজের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি যার পরিনতি আমার জানা ছিলো না....
কিন্তু হঠাৎ কাঁচিসহ আমার হাত চেপে ধরলো রুনি.....
- মা মা, চাচী চাচী দাদী..... সবাই আসো শিঘ্রী নীরুপা কাঁচি দিয়ে নিজের গলা কাটছে....... আমি তো ঘটনার আকস্মিকতায় অবাক! বলে কি গলা তো কাটতে চাইনি। আমি তো চুল কাটতে চাচ্ছিলাম ওদেরকে শিক্ষা দিতে।
সে যাইহোক আমার কাজে ও ভাবনায় ছেদ পড়লো। মুহুর্তের মাঝেই ঐ ঘরের লাইট ফটাফট জ্বলে উঠলো ঘর ভর্তি বাড়ির সকল মানুষজন হা করে চেয়ে আছে আমার দিকে। নচাচী টান দিয়ে মশারীর দড়ি ছিড়ে ফেলেছে। ত চাচী মনে হয় সেটা গুটিয়েও নিয়েছে। আমি হা করে কাঁচি হাতে বসে আছি আর আমার হাত ধরা রুনি......
সেজোচাচী এসে এক টানে আমার হাত থেকে কাঁচি নিয়ে নিলো আর মাকে ধরে রেখেছিলো বোধহয় ছোটচাচী। নইলে মনে হয় সেই রাতে আমার চুল কাটতে চাওয়ার বাসনাই শুধু পুরন হত না...... সত্যিই রুনির কথা মোতাবেক মা আমার গলাটাই কেটে নিতেন......
আগের পর্ব
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই অক্টোবর, ২০২২ সকাল ১১:০৩