ঢাকার বাড়িতে এসে সবচেয়ে যে জিনিসটি আমাকে মুগ্ধ করেছে তা আমার শ্বশুরমশায়ের শখের লাইব্রেরটি। তার বইপ্রীতির নমুনা তার সেই শখের লাইব্রেরী ছাপিয়েও বাড়ির অন্যান্য ঘরে ঘরে এসে ঢুকেছে। আমার শোবার ঘরটারও একটা দেওয়াল জুড়ে বই আর বই। সে সব মোটেও আমার স্বামীর নয়। সেও শ্বশুরমশায়েরই বিশাল বই কালেকশন সাম্রাজ্যের একাংশ। আমার স্বামী ও একমাত্র ননদিনী তারা কেউই সে সব বই পড়ে না। সবই আমার শ্বশুর মশায়ের শখের বই।
এই বাড়ির ড্রইং রুমের বুকসেল্ফেই আমি দেখেছিলাম আমার জীবনের প্রথম এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা। অমন সুন্দর শক্ত কাভারে মোড়ানো সোনালী রঙের বেড়ি ডিজাইন আমি আগে কখনও আর কোনো বই এ দেখিনি। আমার শ্বাশুড়ি সেই প্রথম দিনটার মতই ভ্রু কুচকে বলেছিলেন। এসব সুদূর ভিয়েনা থেকে বয়ে এনেছেন আমার শ্বশুরমশায়। এই সব বই যেন তেন বহি নহে। আমি যেন সমীহের চোখে দেখি তিনাদেরকে এমনই ভাব সাবে ভ্রু কুচকে বুঝাচ্ছিলেন তিনি আমাকে। আমার চোখে তখন রাজ্যের কৌতুহল। কি আছে সেই বই এর ভেতরে? একটু নেড়ে চেড়ে দেখার উপায় ছিলো না। সেই বইগুলি ছিলো তালাবদ্ধ বুকসেল্ফে। মাঝে মাঝে আমার শ্বশুর তালা খুলে সেসব বই নেড়েচেড়ে দেখতেন। সে সব বই কত হাজার টাকা খরচ দিয়ে এনেছেন উনারা। এসব ধরা ছোঁয়ার বাইরে তায় নতুন বউ আমি। ইচ্ছে থাকা সত্বেও চেয়ে নিয়ে পড়তে বা একটু আধটু খুলে দেখতে পারিনি।
সেই এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার মধ্যে কি আছে জানা হলোনা বটে। তবে আমার রুমের বইগুলির মাঝে আমি পেয়ে গেলাম আরেক আনন্দের জগৎ। আমার মায়েরও বড় উপন্যাস পড়ার শখ ছিলো। আর আমার বাবার ছিলো বই কেনার অভ্যাস। কিন্তু তিনি নিজে সেসব বই কোনোদিন পড়েননি। আমি বাবাকে কোনোদিন কোনো বই পড়তে দেখিওনি। এর কারণ জিগাসা করলে বাবা বলতেন যখন অবসর জীবন হবে তখন পড়বো তাই জমাচ্ছি। কিন্তু হায় অবসর জীবনের বহু আগেই এই মায়ার ধরিত্রী ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন তিনি।
যাইহোক মায়ের আলমারীতে ছিলো আমার এক অনেক প্রিয় গল্পের বই তার নাম ছিলো কলকাতার কাছেই। আর এর পরের পর্ব ছিলো উপকন্ঠে। মা বলতেন কেনো যে এই ১ ও ২ খন্ডের নাম একই না দিয়ে দুই রকম দিলো পাগলা লেখক আল্লাহ জানে। কিন্তু আমি আজ জানি লেখক কলকাতার কাছেই আর উপকন্ঠে বলতে আজ যেমন উপশহর বলা হয় তেমনই বুঝিয়েছিলেন। কিন্তু সে সময়টাতে আমিও এই নামাকরণের সার্থকতার উত্তর খুঁজে মরতাম। সেই বই এর দুই পর্ব পড়ার পর জেনেছিলাম আরও একটি পর্ব আছে পৌষ ফাগুনের পালা। কিন্তু আমাদের মফস্বল শহরে আমার মা কখনও সেই বইটা খুঁজে পায়নি। তাই আমারও আর পড়া হয়নি কিন্তু বিয়ের পরেই সেই এক দেয়াল জোড়া বিশাল বই এর আলমারীর সামনে দাঁড়িয়ে আমি এক এক করে বই এর নামগুলো পড়তাম। কতগুলো আমার পড়া আর কতগুলো পড়া নয় সেই হিসেব মেলাতাম।
হঠাৎ একদিন পেয়ে গেলাম পৌষ ফাগুনের পালা। আমার মনে কি যে এক আনন্দ! কলকাতার কাছেই আর উপকন্ঠে পড়ার পর ঐ শ্যামা ঠাকুরণ আর নরেন কিংবা মহাশ্বেতা ঐন্দ্রিলার কি হলো জানার জন্য আমার প্রাণ আকুপাকু করতো তো সেই পৌষ ফাগুনের পালা পেয়ে গিয়ে সেই আনন্দে আমি আত্নহারা হয়ে উঠলাম। আমার কখনই বিশ্বাস হত না এসব শুধুই লেখকের কল্পনার চরিত্র। আমি আজ নিজে লিখতে গিয়ে জেনে গেছি বাস্তব বর্ণনা শুধু তখনই সম্ভব যখন লেখক নিজে তা উপলদ্ধি করে, নিজের জীবনের অমন ঘটনার মুখোমুখি হয়। মোট কথা বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া আসলে কিছুই হয় না।
আমাকে ঢাকায় কলেজে ভর্তি করে দেওয়া হলো। কিন্তু রোজ রোজ এত অনুষ্ঠান, বাড়িতে মেহমান, পার্টি শ্বাশুড়িআম্মার সাথে ঢাকা ক্লাব, অফিসার্স ক্লাবের হাউজি, লেডিস পার্টি এসবে যেতে যেতে আমার মনে হয়েছিলো পড়ালেখার প ও বুঝি আর হবে না আমার জীবনে। কিন্তু আমার শ্বশুর! সেই মহাজ্ঞানী মহাজন আমাকে ডেকে বললেন একদিন,
- শোনো বৌমা। তুমি কি শুধুই এসএসসি পাস হয়েই থাকতে চাও?
আমি নিরুত্তর রইলাম। তিনি আবারও বললেন,
- একটা কথা মনে রেখো। আজ ব্যস্ততা সংসার সামাজিকতা নিয়ে ভাবছো কিভাবে পড়বে বা আর পড়বেই না। তবে এই ভাবনাটাই একদিন তোমার চরম অনুশোচনার কারণ হবে। এট লিস্ট গ্রাজুয়েশন করো সেটাও আমি বলবো না। আমি বলবো তোমাকে মাস্টার্স করতেই হবে। পারলে তারপরের উচ্চতর শিক্ষা।
আমার মা আমার পড়ালেখা নিয়ে আর ভাবছিলেন না। যেন বিয়ে দেবার জন্যই তিনি আমাকে এই কটা দিন পড়িয়েছিলেন। আমার স্বামীরও আমার পড়ালেখা নিয়ে কোনো মাথা ব্যথা দেখিনি। রোজ সন্ধ্যায় ফিরে তিনি আমার গল্প শুনতেন। আমি সারাদিন কি কি আশ্চর্য্য আবিষ্কার করলাম তাই শুনাতাম তাকে। আমার ঘরের সেই বিশাল বই এর আলমাারী তে পৌষ ফাগুনের পালা আবিষ্কার থেকে শুরু করে আমার রুমের তিন আয়নাওয়ালা ড্রেসিং টেবিলের সামনে সাজুগুজু করে বসে আমার কেমন নিজেকে যাদুর দেশের রাজকন্যা মনে হলো সেসবই অনর্গল বলতাম আমি তাকে। তিনি চুপ করে আমার কথা শুনতেন। পরম কৌতুহলে তাকিয়ে থাকতেন আমার দিকে। আমি এমন ভালো একজন শ্রোতা পেয়ে মহানন্দে তাকে শুনাতাম সেসব দিনের সকল নতুন অভিজ্ঞতার কথা।
উনি তো চলে যেতেন সাত সকালে হসপিটালে আর তারপর সারাটা দিন আমি বাড়িতে। সকাল থেকে আমার শ্বাশুড়ির হম্বি তম্বি কাজের লোকজনদেরকে নানা রকম ইন্সট্রাকশন এটা কর সেটা কর দেখে দেখে আমার দিন কেটে যেত, কিন্তু দুপুর ছিলো অলস দুপুর।
আমি আমার বিয়েতে পাওয়া সব গয়নাগাটি কসমেটিকস শাড়ি এবং বাক্সবন্দি সকল উপহার যে সব আমার শ্বাশুড়ি আমার ঘরেরই আরেক দেওয়াল আলমারী জুড়ে রেখেছিলেন সে সব খুলে খুলে দেখতাম আমি।
একা একা বসে বসে সাজতাম। খেলতাম আমার পুতুলখেলা আমার নতুন শাড়ি কাপড় গয়নাগুলি নিয়ে। যেন নতুন এক পুতুলের রাজ্য হয়েছে আমার। আমাদের যশোরের বাড়ির ফেলে আসা ঘর দূয়ার শান বাধানো চক মিলানো উঠান, দাদীমার ঘরের জানালার সেই এক চিলতে আকাশ সেই সব দুপুরগুলোতে খুব মনে পড়তো আমার আর মনে পড়তো খোকাভাইকে। কোথায় আছে আমার একলা এবং বিষন্ন খোকাভাই? এই সব প্রশ্নগুলো গুমরে মরতো আমার বুকের ভেতরে। আমি সেই সব চাপা দিয়ে রাখতাম। তালাবদ্ধ করে রেখে দিতাম আমার হৃদয়ের গোপন সিন্দুকে।
আমার ননদও তখন একেবারে ছোটো নয়। আমারই সমবয়সী তবে তার এক আলমারী পুতুল ছিলো নানা দেশে ও বিদেশের। সে সব পুতুলগুলোও আমাকে মুগ্ধ করেছিলো। কিমোনো পরা জাপানী পুতুল বা নিল ঝিকিমিকি ড্রেস পরা গিটার হাতে সিঙ্গার বারবি ডলটি তো আমাকে যাদু করে ফেললো। আমি ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম তার নিল আইশ্যাডো দেওয়া ঠিক যেন এক জীবন্ত মানুষের চেহারার বারবিটার দিকে।
আর হ্যা ঐ এক বাড়ি বই এর মাঝে নানা দেশী বিদেশি মহা মূল্যবান সব বই থাকা সত্ত্বেও আমার ননদিনীকে দেখতাম আর্চীজ পড়ে হেসে কুটি কুটি হতে। আমি ভেবেই পেতাম না এমন এক রত্নভান্ডার থাকা সত্ত্বেও সে কেনো শুধু আর্চিজই পড়ে!
আমার শ্বশুর উনাকে বিজ্ঞানী সন্মোধন করা হত। উনি এই দেশের এক বিশাল কৃতিত্বের সাথে জড়িত ছিলেন। তার নামে স্মারক ডাকটিকেটও আছে। অনেকটা বছর কাটিয়েছিলেন অ্স্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে। অস্ট্রেলিয়ার নাম শুনেছিলাম আমি কিন্তু অস্ট্রিয়া! সেটা আবার কোন দেশ! আর ভিয়েনাই বা কি?
আমি তো পড়েছিলাম রাশান রুপকথার ছড়া-
আলিউনুশা দিদিরে সাতরে আয় নদীরে ...
আগুন জ্বলে ভিয়ানে ....
আর ভিয়ান মানে তো চুলা। ভিয়েনা নামেও পৃথিবীতে দেশ আছে তাইলে। নানান রকম নতুন আবিষ্কারে এবং বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে রই আমি। আমার ফেলে আসা শহর, শৈশব কৈশোর, কৈশোর পেরুনো দিনের ভালোবাসা খোকাভাই সকলই চাপা পড়ে রয় আমার হৃদয়ের গহীনে। অনেকেই ভাববে কি স্বার্থপর মেয়েরে বাবা। এই তোর মনুষত্ব! এই তোর ভালোবাসা! এই তুই কিনা খোকাভাইকে নিয়ে এত কথা বলিস! হা হা জানি মানুষ এমনই বলবে! কারণ মানুষ কখনও কারো হৃদয়ের গভীরে চিরে দেখে না। তারা জানবেও না কখনও একজন নিরুপমা বা বাংলাদেশের শত শত নিরুপমারা এমনই অসহায় হয়েই নতুন জীবন যা জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হলো তা মেনে নিতেই জোর করেই নিজেকে নতুন বিস্ময় নতুন জগতের সাথে মানিয়ে তোলে। জোর করে ভুলে যেতে চায় সকল না পাওয়ার বেদনা।
বাংলাদেশের মেয়েদের তো আসল বাড়ি শ্বশুর বাড়িই বা তার স্বামীর বাড়ি তাই না? জন্মদাত্রী মা বাবাবর বাড়ি পর হয়ে যায় বিয়ের সাথে সাথেই।
আগের পর্ব
মে থেকে সেপ্টেম্বর - ডেঙ্গু জ্বরের এখুনি সময় আর এখুনি সময় সাবধানতার...... করুনাআপুর অনুরোধে এরপর থেকে সকল পোস্টে এই লিঙ্কটি জুড়ে দেওয়া হবে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই নভেম্বর, ২০২২ রাত ৯:২৫