আমি একটা বট গাছ । নদীর ধারে জন্মে গায়ে হাওয়া বাতাস লাগিয়ে কি সুন্দর করে বেড়ে উঠছি । গায়ে রোদ পড়ছে । পাতার ফাঁকে সেই রোদে ছায়া তৈরি করতে করতে আমি বেড়ে উঠছি । নদীর জলের মৃদু গর্জনের শব্দ শুনতে শুনতে এক প্রশান্তি নিয়ে আমি বেড়ে উঠছি । আমার ঝুরি হয়েছে , পাতা গুলো দিন দিন বাড়ছে । ক'মাস বয়স থেকে আমি এখন ধীরে ধীরে একটা বছর পার করে ফেলছি । আমার আনন্দ হয় । নদীর স্রোতের মত সে আনন্দ এসে আমাকে ধাক্কা দিয়ে যায় । বিকেলের নরম আলোয় আমি বড় হচ্ছি । আমার উচ্চতা বাড়ছে । রাতের জ্যোৎস্নার সাথে সাথে এই পৃথিবীর প্রতি এক মুগ্ধতা নিয়ে আমি দিনকে দিন বড় হচ্ছি । আমি জানি আমি আরও বড় হব । আমার বিস্তৃতি এই মাটির নিচে ছড়িয়ে পড়বে , আমার পাতায় পাতায় , শিরায় শিরায় দুপুরের কড়া রোদ আটকে থাকবে । আমি রোদ নিয়ে খেলব । দুরে আকাশের নীল এসে মাঝে মাঝে আমাকে ছুঁয়ে যাবে , দিগন্তের সমস্ত সবুজ রঙ আমার পাতার সাথে মিশে যাবে , আমি নিঃশ্বাস নেব বিশুদ্ধ বাতাসে । বছর পেরিয়ে যায় । আমি বাড়তে থাকি । আমার সামর্থ্য বাড়তে থাকে । সূক্ষ্ম ঘাসকে এখন আর কিছু মনে হয় না । ওরা বাতাসে দুলতে থাকে , আমি ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি মাথা উচু করে । সামান্য বাতাসকে এখন আর কিছু ভয় লাগেনা । আমি এত সহজে নুয়ে পড়ার কেউ নই । নিজেকে বড় বড় মনে হয় । রাতের অন্ধকারে আমি ঘুমিয়ে পড়ার মত দুর্বল নই । আমি সারারাত জেগে থাকি । নিজেকে মাঝে মাঝে এই অন্ধকারে নিঃস্ব মনে হয় । খুব করে স্বপ্ন দেখি আমার পাশে বেড়ে উঠছে আমার মত আরেকটা বট গাছ । দুজনের পাতায় পাতায় বাতাসের গুঞ্জনে গান খেলে যাবে , আমাদের দুজনের ছায়ায় আমাদের লালিত স্বপ্ন বেড়ে উঠবে । মাঝে মাঝে মনে হয় কি দরকার ভাববার ? আমি নিজেই তো স্বাবলম্বী । আমার সামর্থ্য আছে ভালো থাকবার । এত সহজে ভেঙ্গে পড়ে নুয়ে যাবার মত দুর্বল আমি নই । দিন যায় । আমি বেড়ে উঠি । কখনো মনে হয় ওই দূরের আকাশ আমি চাইলেই ছুঁতে পারি ! সময় যেতে থাকে । অনেক সময় । কেন যেন বড় বড় পাতাগুলোয় বয়সের ছাপ পড়তে থাকে , শাখা গুলো আগের মত শক্তি নিয়ে ছড়িয়ে থাকতে পারেনা । মনে হয় এই আলো , বাতাস , সামনের বিশাল নদীর ঢেউ আরও তো অনেকদিন থাকবে , আমার বিস্তৃতির সাক্ষী হয়ে থাকবে এই মাটি । আমি তবে যাব কোথায় ? আমার গন্তব্য কই ? সেই ভাবনায় রাতে আমি মাঝে মাঝে ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠি । এক সাধারণ বিকেলে শেষবারের মত পাতার ফাঁকে শেষ বিকেলের আলো দেখতে দেখতে আমি শেষনিঃশ্বাস ছেড়ে দেই । তারপর? জানিনা ।
চার পেয়ে মানুষ গুলো ঠিক এভাবেই প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি , সুপ্তি-ব্যাপ্তি , স্বাদ - বিস্বাদ , আনন্দ - বিষাদ , কল্পনা - বাস্তব , কর্তব্য - ধর্তব্য , কাজ-অকাজ এর সমন্বয়ে কোন অনন্তের পথে যাত্রা করে । তাদের আত্মকাহিনী কি তারা নিজেরাই লিখবে ?