যাত্রীদের অপেক্ষা-ঘরে সবচেয়ে পিছনের সারিতে বসে অনেকক্ষন ধরে তাকিয়ে আছি ছেলেটার দিকে , চেহারা টা কোথায় যেন দেখেছি বলে মনে হয় , অথচ কোনো ভাবেই মনে করতে পারছি না , অবশ্য অনেক বছর বাইরে থাকলে যা হয় ... অতি কাছের পরিচিত মানুষরাই সব অপরিচিত হয়ে যায় আর এ আর কে হবে ? ... তবুও মনে মাঝে খচখচানী টা থেকেই গেল বেশ কিছুক্ষন ... এর পর ব্যাস্ত হয়ে পড়লাম নিজের কাজে .... ঢাকার বাস স্ট্যান্ড গুলোতে বেশ ভীড় দেখা যায় , যদিও এটা ঈদের মৌসুম না , তবুও ... পথ চলতি মানুষের যেন অভাব নেই , আর বাসা থেকে বেরুনোর সময় গুরুজনদের সতর্কবানী --- এদ্দিন পর ঢাকায় এসেছ আগের মত সব কিছু চাইলেই সম্ভব না , সাবধানে থেক , নিজের ব্যাগ নিজেই রক্ষা কোরো ... ইত্যাদি ইত্যাদি ... সুতরাং পাশের সিটে রাখা ব্যাগটার দিক থেকে দৃষ্টি এড়ানো সম্ভব না ... অবশ্য ওতে দামী কিছু নেই শুধু একটা জিনিস ছাড়া ... নানুর অনেক শখের একটা শাড়ী আছে এত আবদার যে করতে পারে বুড়ীটা না দেখলে বুঝার উপায় নেই, শাড়ীটা কেনার পর থেকে তিনি অপেক্ষা করে বসে আছে কখন সেটা হাতে পাবেন , সুতরাং আমার কাজ হলো - ওটা যেভাবে হোক তার হাতে পৌছে দিতে হবে ....
>> আমি কি আপনার পাশে একটু বসতে পারি ?
ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি সেই ছেলেটা , বয়স ২৪ - ২৫ এর মত হবে ... মুখে খুব সুন্দর একটা হাসি .... গায়ের পোশাকে বোঝা যায় বেশ স্মার্ট আছে ... কিন্তু আমার মত আনস্মার্ট মানুষের কাছে এ কি চায় ? ... তবুও ভদ্রটার খাতিরেই বললাম -- জ্বি বসেন
চারদিক সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কেমন যেন আনমনেই হুট করে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতেই চমকে উঠলাম , আরে কি মুষ্কিল , বদ মতলবের মানুষের হাতে পড়ে গেলাম না তো ? ... দেশে তো অনেক বছর ধরে থাকি না , এখন কিভাবে যে মানুষকে ঠকানো হয় তা তো আর জানা নেই ... সুতরাং মুহুর্তের মধ্যে সতর্ক হয়ে একটু কড়া ভাবেই বলে উঠলাম -- এটা কি করছেন ?
কাচুমাচু মুখে পায়ে হাত দিয়ে সালাম টা শেষ করেই গা ঝাড়া দিয়ে সোজা হয়ে দাড়িয়ে ছেলেটি বলে উঠলো
>> আপনাকে অনেক বছর ধরে খুজছি , আজ এভাবে পেয়ে যাব কখনোই ভাবতে পারিনি , তাই সুযোগটা হাতছাড়া করলাম না ... আপনাকে আগে ঠিক যেমনটি দেখেছি তেমন টি আছেন , শুধু একটু মোটা হয়ে গিয়েছেন ....
আমি মনে মনে বলি এই সেরেছে , ভাল মানুষের বক্তৃতা দিয়ে আমাকে ফাঁসাবে না তো ? আমার অবাক হওয়া তার কাছে যেন কোনো কাহিনি ই না ... সে বলেই চলছে
>> জানেন , আমার মা এখনো বেঁচে আছে ... এখনো আপনাকে অনেক মনে করেন আর দোয়া দেন ... আর আমার বিয়ে ও হয়েছে ... ছোট একটা মেয়ে ও আছে বয়স ৫ বছর ... তার নাম আপনার নামের সাথে মিল করেই রেখেছি ....
এবার আমি তো পুরাই কাইত , কাহিনী যে কোন দিকে যাচ্ছে বুঝাই মুষ্কিল ... কোন মা , কোন বৌ আর এই মেয়ে ই বা আসলো কোথা থেকে ? .... তবুও সে বলেই চলেছে ...
>> আপনার দোয়ায় আমি আজকে একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলের ভিডিও এ্যাডিটর হিসেবে কাজ করছি , মাসে ভালই ইনকাম হয়, এখন আমাকে আর টেম্পুতে করে কোথাও যেতে হয়না , আমার নিজের মোটরসাইকেল আছে ....
এইবার আমি আসলেই চিন্তায় পড়ে গেলাম , আরে ঘটনা কি ? ওর কে আছে ... কি আছে তা দিয়ে আমি কি করবো ? ... আর এগুলো আমি তো শুনতেও চাইনি ... পরিচয়টা না দিয়ে এমন বকবক করে যাওয়া ছোকড়া তো এ না .... অন্তত চেহারায় তা মনে হয় না .... কিন্তু .... চিন্তাটা কোথায় গিয়ে যেন বার বার ফেরত আসছে ... কিছু একটা মনে পড়বে পড়বে করেও মনে পড়ছে না ... অন্যদিকে ছেলেটা বলেই চলেছে ...
>> আপনি কবে ফিরবেন ঢাকায় ? গ্রামের বাড়ী যাচ্ছেন ? একলা ? ... এদ্দিন বাইরে থাকার পরে একলা যাচ্ছেন কেন ? জানেন না এ সময়ে একটা যাওয়াটা ঠিক না ? ....
এইবার লাইন টা মনে হয় ধরতে পারছি .... সতর্ক দৃষ্টিতে ছেলেটিকে মাপতে শুরু করলাম ... আর অন্যদিকে সে বলেই চলছে ...
>> আপনি একলা যাবেন জানলে আমি ই আপনার সাথে চলে যেতাম , কিন্তু কি করবো বলেন আমার এক কলিগ কে বাসে উঠিয়ে দিতে এলাম , ছুটিও নেয়া হয়নি, তাই যেতে পারছি না .... অবশ্য এক কাজ করা যায় , বস কে একটা ফোন করে দেই ... উনাকে আপনার কথা বললে দু চার দিনের ছুটি নেয়া কোনো ঘটনাই না ... উনি ও আমার কাছে আপনার কথা শুনেছেন , ওভাবেই উনি আপনাকে বেশ ভালই চিনেন ....
এবার আমি মনে মনে বলি নাহ ; একে আর আগে যেতে দেয়া যায় না , বলে বলে ছক্কা মারতে মারতে এখন তো দেখি এক বলে সেন্চুরী করার চেষ্টা করছে ... সুতরাং তাকে থামিয়েই বলে উঠলাম
-- দেখুন , আপনি কে ? আপনার পরিচয় টাই বা কি ? ... আপনাকে তো আমি চিনতে পারলাম না এখনো ... আর আপনি এসব কথা আমাকেই বা কেন বলছেন ? ....
বিষ্ফোরিত চোখে কথাগুলো শুনতে শুনতে যেন ছেলেটি মাটির সাথে মিশে যেতে থাকলো ... ধরা গলায় বলে উঠলো --
>> কি বলেন ভাইয়া ? আপনি আমাকে ভুলে গেছেন ? ... আপনি আসলেই আমাকে চিন্তে পারছেন না ? ...
-- জ্বি , হয়ত আপনি আমার পরিচিত কিন্তু আমি আসলেই আপনাকে চিনতে পারছি না ...
>> আপনি যখন শুরু থেকেই আমাকে আপনি করে বলছিলেন তখন ই বুঝেছিলাম যে আপনি আমাকে চিনতে পারছেন না , তাই তো আমার সব কথা আপনাকে বলছিলাম যদি এর মাঝে আমাকে আপনার মনে পড়ে ... আচ্ছা ... মনে করে দেখেন তো ... ১৯৯৮ সাল , পঙ্গু হাসপাতালে এক মায়ের অপারেশনের জন্য দুই ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন ছিলো , শহরে নতুন আসা তার ছেলেটা কি করবে বুঝে উঠতে পারছিলো না ... খালি এদিক সেদিক ডাক্তার আর নার্সদের মাঝে দৌড়ে বেড়াচ্ছিলো ..... তখন একটা কলেজে পড়া মানুষ তার অপরিচিত একজন রোগীর জন্য দু জন ডোনার এনেছিল ... একজনের রক্তে কাজ হয়ে গিয়েছিল দেখে চলে যাওয়ার সময় ছেলেটার কান্না দেখে আরেকজন ডোনার সহ নিজের রক্ত দিয়ে ঐ মায়ের অপারেশনের ব্যাবস্হা করে , আর চলে যাওয়ার সময় জিজ্ঞেস করে বাড়ী কে কে আছে , কোথা থাকি কিভাবে আসি হাসপাতালে .... শনির আখড়া থেকে বেশ কয়টা বাস আর টেম্পু পাল্টে আসতে হতো হাসপাতালে ... বাবা নেই, মায়ের উপার্যনে সংসার চলে , তিনিও অসুস্হ ... তাই অনেক সময় বাড়ী থেকে হেটে হাসপাতাল আসি শুনে মানুষটা আমাকে দুই সপ্তাহের টেম্পু ভাড়াও দিয়েছিলো ... আর আমরা হাসপাতাল থেকে চলে আসার সময় ডাক্তারের কাছে জানতে পেরেছিলাম ঐ লোকটি আমার মায়ের চিকিৎসার সব বিল নিজে দিবেন বলে গিয়েছেন ... লোকটা আর কখনো আসেননি তবে শুনেছি আমার মায়ের চিকিৎসা ঠিকমতো হচ্ছে কিনা সে খবর তিনি প্রায় ই ঐ ডা্ক্তার সাহেবের কাছ থেকে নিতেন ... এর পরে একে একে কেটে গেছে ১৪ টা বছর ... এর সময়ের মাঝে প্রতিটি দিন , প্রতিটি ক্ষন আমি ঐ মানুষটাকে আর একটা বার দেখার জন্য অপেক্ষা করেছি ....
আর শুনতে পারলাম না .... ঝাপসা চোখে তাকে বুকে টেনে নিয়ে শুধু এতটুকুই বললাম -- সেই মায়ের জন্য আমার অন্তরের অন্তঃস্হল থেকে অপরিসীম শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা যে তার ছেলেকে এভাবে , সত্যিকারের মানুষ হিসেবে তৈরি করেছেন ....