somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ক্রীড়া, ক্রীড়াবিদ অথবা ক্রীড়নকেরা

০৭ ই অক্টোবর, ২০১১ সকাল ১০:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বিজ্ঞপ্তি
সকলের অবগতির জন্যে জানানো যাচ্ছে যে, আগামী চব্বিশ ঘন্টার জন্যে অনিবার্যকারণবশত মৃত্যুর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে। মুমূর্ষু অথবা অর্ধমৃত রোগী, আত্মহত্যাউন্মুখ তরুণ-তরুণী, সবাইকে বেঁচে থাকার নির্দেশ দেয়া হল। এর অন্যথা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
আদেশক্রমে
একজন সাধারণ নাগরিক

আমি
সকালে ঘুম থেকে উঠে বিজ্ঞপ্তিটা আমার ঘরের পাশের দেয়ালে টাঙানো দেখে আমি উৎফুল্ল বোধ করি। ইতঃমধ্যে রেডিওতেও প্রচারিত হবার কথা। আমার নিজস্ব রেডিও অন করার দরকার পড়লো না। আশপাশ থেকেই শোনা যাচ্ছে, একটি পুরোনো গানের সাথে কথাগুলো মিশ্রিত করে চমৎকার বিজ্ঞাপন তৈরী করেছে...
"এই শোনো খবর
আজ কবর খোঁড়া বন্ধ আছে
তাই মরছি না আর মরবো না..."

ডিয়ার লিসেনারস, কেমন হত একটা দিন কোন মৃত্যু না থাকলে? বেঁচে উঠুন উইথ আ লট অফ এনার্জি!

সকলের অবগতির জন্যে জানানো যাচ্ছে যে, আগামী চব্বিশ ঘন্টার জন্যে অনিবার্যকারণবশত মৃত্যুর ওপর নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়েছে। মুমূর্ষু অথবা অর্ধমৃত রোগী, আত্মহত্যাউন্মুখ তরুণ-তরুণী, সবাইকে বেঁচে থাকার অনুরোধ করা হল। এর অন্যথা করবেন না অনুগ্রহ করে।
জনস্বার্থে
সাধারণ নাগরিক ফোরাম


মৃত্যুবিষয়ক নিষেধাজ্ঞা প্রচার আমাদের একটা বড় পরিকল্পনার অংশ। আমার মত এরকম আরো অনেককেই সাথে নিয়েছি, যাদের মধ্যে একটা হতবিহবল ভাব কাজ করে জীবন এবং মৃত্যু বিষয়ক আপেক্ষিক দর্শনে। বেঁচে থাকাটা কী আদতেই গুরুত্বপূর্ণ? হলে কতটা? আমরা বেঁচে থেকে কী অর্জন করছি? বেঁচে আছিই বা কেনো? আমরা ক্রমশঃ মৃত্যুর দিকে এগুচ্ছি। মরে গেলেই বা কি হবে! কী এসে যাবে! এসব ভাবতে ভাবতে একদিন আমি এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে যাই, যখন মৃত্যু অথবা জীবন, যেকোন একটা বেছে নেয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না। সেসময় আমি আমার মত আরো মানুষজনের সাথে পরিচিত হই, এবং আমাদের একটি সংঘ তৈরী হয়। তারপর অন্যান্য সংঘের সাথে মিত্রতা এবং মতৈক্য হওয়ায় সংখ্যায় বেশ বেড়ে উঠি। তারপর আমরা মহাপরিকল্পনাটা করি। যার প্রথম অংশ আপনারা জানেন। আমরা ঠিক করলাম একটা দিন কাউকে মরতে দেবো না। তারপর দিনক্ষণ ঠিক করি। পোস্টারিং, রেডিও-পেপার-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন, বাসনাশূন্য মানুষগুলো বেশ একটা মজা পেয়ে যায় মনের মত একটা কাজ পেয়ে। পোস্টারিং এর ক্ষেত্রে অবশ্য আপনারা দেখেছেন একটু ভিন্ন ভাষা প্রয়োগ করা হয়েছে। ওটা আমি একাই গোঁ ধরে করেছি। মাস্টারপ্ল্যানের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে একটু স্বৈরাচারী মনোভাব দেখিয়ে আত্মতুষ্টি পাওয়া, আপনি ভেবে দেখুন, জনগণকে 'আদেশ' দেয়া হচ্ছে এবং আদেশ লঙ্ঘন করলে 'কঠোর ব্যবস্থা' নেবার হুমকি- নিজেকে ঈশ্বর অথবা ওয়ার্ড কমিশনার মনে হয়! যাহোক, এতদিনের পরিকল্পনা আজকে ঠিকঠাকমতই বাস্তবায়িত হচ্ছে আশা করি। প্রচারণা ভালোভাবেই চলছে। প্রতিক্রিয়াও আশা করি আশানরূপই হবে।

প্রতিক্রিয়া
কোন সে অমোঘ প্রক্রিয়ায় একদল মানুষের ঘোষিত প্রস্তাবে, যারা বেঁচে থাকা বা না থাকায় কিছু এসে যায় না সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে শাসনতন্ত্রের সর্বাধিক আধিপত্য বিস্তারকারী বিষ্ঠামন্ডলী বিস্তারিত জেনেও দমন বা নিপীড়ন করতে আগ্রহী হয় না, কিছুক্ষণ পর যখন তারা জানতে পারবে যে তাদের মধ্যে অনেককেই আমাদের পরিকল্পনায় স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অংশগ্রহণ করতে হবে,তখন হয়তো বা তারা এরকম নির্লিপ্ত প্রতিক্রিয়া নাও দেখাতে পারে!

আশি বছর বয়স্ক একজন লিভার সিরোসিসের রোগী যখন মৃত্যুশয্যায় শুয়ে কায়মনোবাক্যে যন্ত্রণাপূর্ণ জীবনের অবসান চাচ্ছিলো দীর্ঘদিন রোদ না আসায় তার বিছানার রঙ ফ্যাকাশে হয়ে উঠেছিলো, আচমকা হইচই শুনে সে তার ফাইফরমাশ খাটা ছোকড়াটাকে জানালা খুলে দিতে বললে এক ঝলক রোদের সাথে আমাদের প্রচারণার মাইকিং তার মধ্যে চিত্তচাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। ঘরের মধ্যে দুষ্টু শিশুর মত খেলে বেড়ানো বাতাস এবং প্রিয়ংবদা রোদের স্নেহশীলা প্রিয়জনের মত বসে থাকা তার পঁচে যাওয়া লিভারে জীবনের অনুরণন তৈরী করে।

কার্যক্রমের প্রথম ধাপ অনুযায়ী আমাদের দল পৌঁছে যায় হাসপাতালের পয়জন ওয়ার্ডে, বার্ন ইউনিটে, আইসিইউতে, মূলত এসব জায়গাতেই মৃত্যুদূতেরা ওৎ পেতে থাকে আর রোগীরাও অসহায়ভাবে নিজেদেরকে সমর্পণের জন্যে প্রস্তুত থাকে। এসব জায়গায় বেতারের মাধ্যমে মনোরঞ্জণ বা প্রচারপত্র বন্টনের সুব্যবস্থা না থাকায় আমাদের ছোট ছোট দল পৌঁছে যায় আজকের বিশেষ ঘোষণা এবং পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে জানাতে।

থেমে যায় কিডনী ডায়ালিসিস।
স্টোমাক ওয়াশের কষ্টকর প্রক্রিয়া স্থগিত থাকে।
ইসিজি মেশিনের গ্রাফগুলোর কোন অর্থ থাকে না।

আমরা একটা কনডেম সেলেও যাই! দুদিন পরে তার জীবনাবসান ঘটবে। তাকে নিয়ে নেই জীবন্মৃতদের দলে। দেখা যাক তার মাঝে কতটা প্রাণ অবশিষ্ট আছে এখনও!

পরবর্তী কার্যক্রম

এতক্ষণে আপনারা আমাদের পরিকল্পনার এক তৃতীয়াংশ জেনেছেন মাত্র। এবং সেটা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। আমরা মুমূর্ষুদের মধ্যে থেকে বিশজন বাছাই করেছি, যাদের আজকেই মৃত্যু হবার জোরালো সম্ভাবনা ছিলো। কিন্তু অবাক ব্যাপার, আমাদের মত সাধারণ মানুষদের সাংঘটনিক কার্যক্রমে কেউই বাধা দিচ্ছে না। নিরাকার ইশ্বর থেকে সাকার ইশ্বর, মৃত্যুদূত থেকে গুন্ডাদল, সবাই গভীর আগ্রহে অবলোকন করছে। চব্বিশ ঘন্টার জন্যে এই অপ্রত্যাশিত ছাড় পাবার জন্যে আমরা কোন বিশেষ ব্যবস্থা নেই নি, বা তদবীর করি নি এমন কী মাথায়ও আসে নি যে কোন বিপত্তি হতে পারে, তাই আমরা মহড়া দিয়ে গেছি গত ক'মাস নিরুদ্বিগ্ন ভাবে। আর তাই মহাপরিকল্পনার প্রথম অংশ ঠিকঠাক হয়ে যাওয়াতে মোটেও বিস্মিত হই নি।

এবার দ্বিতীয় অংশ,
এই অংশটি অপেক্ষাকৃত সহজ। অনেক সহজ। আগেরটার মত বিশাল প্রচারণা চালাতে হবে না, কারো মুখ থেকে অক্সিজেন মাস্ক খুলে মৃত্যুর প্রতি সমন জারী করা লাগবে না। কয়েকজন প্রাণোচ্ছল এবং ভীষণভাবে জীবিত মানুষকে বেছে নিতে হবে কেবল। ভীষণভাবে জীবিত মানুষে।

requirements
১/বয়স আঠার থেকে ত্রিশ।
২/ফুসফুস, হৃৎপিন্ড সহ শরীরের অন্যান্য অংশ ভালো অবস্থায় থাকতে হবে।
৩/জীবনকে উপভোগের রীতিতে বিশ্বাসী হতে হবে।
৪/সারাদিন প্রচুর হাসতে হবে এবং বিশাল বন্ধুবৃত্ত থাকতে হবে।

এরকম আরো কিছু। মোট কথা, যারা বেঁচে আছে এবং বেঁচে থাকাটা উপভোগ করছে। আমাদের মত জীবনের মানে খুঁজে হাপিত্যেশ না করলেও জীবন ঠিকই তাদের মধ্যে নিজের মানে খুঁজে পাচ্ছে। তো এরকম মানুষ খুঁজে বের করাটা অনায়াসসাধ্য না হলেও কষ্টকরও না। এজন্যে অবশ্য আমাদের শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে যেতে হয়েছিলো। যেতে হয়েছিলো সবুজ গ্রাম এবং ঝর্ণাআদুরী পাহাড়ে। এখন পর্যন্ত সর্বমোট পনের জন ভীষণভাবে জীবিত মানুষ যোগাড় করা হয়েছে।

তারা হাসছে। অফুরন্ত দম নিয়ে সুউচ্চ পাহাড়ের দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে পানি সংগ্রহ করে নিয়ে আসা উপজাতি রমণী হাসতে পারে, কারণ তাদের বাসভূমের পাশেই একটা ঝর্ণা আছে। তারা সেখানে স্নান করে, জীবনসুধা পান করে আপ্লুত হয়। এবং তারা বেঁচে থাকে। হাসছে সেই গ্রাম্য পানের দোকানদার, সারাদিন যার কাটে আড্ডা মেরে। সে হাসতে পারে, কারন প্রতিদিন রাতে বেচাকেনা শেষে একটা জ্বীন তার পথপ্রদর্শক হয় এবং তাকে ভয় দেখায় না। পরদিন সেই গল্প সে তার ক্রেতাদের সামনে বলে তার পানের দোকানে যত মশলা আছে তার চেয়েও বেশি মশলা মিশিয়ে। বারেবার শোনা গল্পটির নতুন সংস্করণ ক্রেতাদের মধ্যে কখনই বিরক্তি সৃষ্টি করে না, তারাও হাসে, ভয় পায়, এবং বেঁচে থাকে। খুব বেঁচে থাকে।
শহরের অংশ থেকে আমি কয়েকজনকে বেছে নেয়েছি, তারা ব্যায়ামাগারে যায়, উন্নত খাদ্য খায়, তারা অবনত মস্তকে কারো সামনে দাঁড়ায় না। তাদের আছে প্রিয়জন, সন্তান-সন্তদি এবং প্রেমিক/প্রেমিকা। তারা সপ্তাহান্তে পার্টি দেয় এবং মাসান্তে বনভোজন করে।

আর কয়েকজনকে লাগবে। আর পাঁচজন। এই পাঁচজন অন্যদের থেকে আলাদা হবে। বাকিরা হাসি-খুশী, প্রাণোচ্ছল এবং জীবনের সাথে ভীষণ বন্ধুতা করে ফেলেছে। কিন্তু এই পাঁচজন প্রবলভাবে জীবিত হলেও জীবনের সাথে বন্ধুত্ব করার চেয়ে ফ্লার্ট করতেই বেশি পছন্দ করে। তাদের কেউ কেউ নাইন মিমি কোমড়ে গুঁজে ঘুরে বেড়ায়। মানুষজন তাদের দেখে ভীত হয়। তারা জীবন এবং মৃত্যুকে কখনও পাঁজাকোলা করে প্রেমিকার মত, কখনও ছুড়ে ফেলে দেয়। মোট কথা, তারা ভীষণভাবে জীবিত। আমাদের মত সাধারণ মানুষেরা তাদেরকে দেখলে এড়িয়ে চলে। কিন্তু আজ এই বিশেষ দিনে, আমরাই সবচেয়ে ক্ষমতাধর। জাস্ট গো এ্যান্ড সে টু দেম! তারা সাগ্রহে আমাদের অনুসারী হবে। আরেক ধরনের মানুষ নেবো, প্রতিনিয়ত যাদের কাছে আমাদের ধর্ণা দিতে হত, আমাদের নীতি নির্ধারক তারা। আমাদের জীবন তাদের কাছে বন্ধক দেয়ায় তাদের জীবনপাত্র উছলিয়ে পড়ছে! তাই তারা ভীষণভাবে জীবিত। তাই তারা আমাদের এই দলের অন্তর্ভুক্ত।

প্রেস কনফারেন্স এবং একটি খেলা

"খেলাটি হবে জীবন্মৃত এবং ভীষণভাবে জীবিতদের মধ্যে।" যাবতীয় প্রচার, সরঞ্জাম সংগ্রহ এবং অন্তর্ভুক্তি শেষে উপস্থিত মুমূর্ষু এবং ভীষণভাবে জীবিতদের উদ্দেশ্যে আমি বলি।
-কী খেলা হবে?
সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করে পাহাড়ী তরুণী।
-এটা হবে এক অসম লড়াই!
ফুসফুস নিঙড়ে কোনমতে কথা বের করে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী।
"হতে পারে অসম। কিন্তু খেলায় হারজিত থাকবেই। আমি সবাইকে ব্যাপারটি স্পোর্টিংলি নেবার অনুরোধ জানাচ্ছি।"
-আপনাদের মাথায় এরকম একটি আয়োজনের চিন্তা কীভাবে আসলো? আর এর উদ্দেশ্যটাই বা কী!
একজন সাংবাদিকের জিজ্ঞাসা।
-মূলত আমার মাথায়ই প্রাথমিক চিন্তাটি আসে। মাস ছয়েক আগে। একটা কথা পড়েছিলাম কোথায় যেন, "আমি জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছিলাম...এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি"। জন্ম বা মৃত্যুবিষয়ক কোন দর্শন আমি খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আমার কেবলই মনে হচ্ছিলো, কিছু মানুষ খুব বেশিরকম জীবন্ত, আর কেউ মৃত্যুদূতের হাত ধরতে প্রস্তুত, সমর্পিত। আমি তাদের কারো মধ্যেই পড়ি না। বেঁচে থাকি, বেঁচে থাকতে হয় বলেই, মরে যাবো একদিন মৃত্যুকে উপেক্ষা করা যায় না বলে। কোনো কিছুতেই কোন কিছু এসে যাবে না। তাই আমি জীবন আর মৃত্যুকে সম্মুখসমরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে একটা ফলাফল দেখতে চেয়েছি। আমার মত সমমনা আরো অনেক মানুষ পেয়ে যাই। হেই! আপনিও তো ছিলেন আমাদের দলে! যাহোক, সবাই মিলে একটা পরিকল্পনা দাঁড় করাই। আর কিছুক্ষণের মধ্যে খেলা শুরু হবে। চলুন সবাই স্টেডিয়ামের দিকে রওনা দিই! তার আগে সবাই খেলার নিয়মকানুন দেখে নিন।

আমাদের দলের স্বেচ্ছাসেবকেরা সবার কাছে হ্যান্ডবিল বিলি করতে শুরু করে।

নিয়মাবলী
*উভয় দলে বিশজন খেলোয়াড় থাকতে পারবে।
*খেলা হবে যেকোন আউটডোর গেম এর নিয়মানুযায়ী। অর্থাৎ ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, রাগবী সবকিছুর সংমিশ্রণে খেলা চলবে, এবং যে কেউ যেকোন সময় যেকোন খেলার যেকোন নিয়ম প্রয়োগ করতে পারবে।
*একজন রেফারি থাকবে, তবে সে খেলার মধ্যে কোনরকম হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। সে শুধু খেলার শেষে ফলাফল জানাবে।
*খেলার সময়কাল হবে দুইঘন্টা।

খেলা

জীবিত বনাম জীবন্মৃত দলের মধ্যে খেলা শুরু হবার আগে স্বাভাবিকভাবেই জীবিতদের দলটিকে বেশ আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে। জীবন্মৃতদের ফিটনেস ট্রেইনার তাদের অক্সিজেন মাস্ক, পেসমেকার, নকল দাঁত এবং ইনসুলিন সরবরাহ এবং মেরামত করতেই ব্যস্ত।

এখন সবার কাছে তুলে দেয়া হচ্ছে ক্রীড়া সরঞ্জমাদী। বেসবল ব্যাট, ফুটবল, ক্রিকেট ব্যাট, হকিস্টিক, যাবতীয় রকম গ্লভস, গার্ড ইত্যাদি।

স্টেডিয়াম সাজানো হয়েছে অত্যন্ত মনোরমভাবে। সবুজের বেষ্টনী চারিদিকে। আবহাওয়াটাও চমৎকার। সূর্যের মোলায়েম আলো আর ঠান্ডা বাতাস, প্রাণ জুড়ানো ঠান্ডা বাতাস!

"বাঁচো,
প্রাণভরে শ্বাস নাও
এসবই তোমার..."

কনডেম সেল, পয়জন ওয়ার্ড বা আইসিইউ থেকে যারা এসেছে এখানে, তারা বহুদিন সূর্যের আদর আর বাতাসের আদিখ্যেতা দেখে নি। পেসমেকার লাগানো বুকে জীবন স্পন্দিত হতে থাকে, চঞ্চল হতে থাকে। যাও, জিতে আসো! জেতা বা না জেতায় কী এসে যায়! এতদিন পরে একটুকরো জীবন দেখতে পেলাম, এইতো অনেক! সম্মিলিতভাবে চিন্তা করে অসুখী, রোগী এবং দন্ডপ্রাপ্তরা। আর ভীষণভাবে জীবিতেরা তাদের প্রাণশক্তিকে আরেকটু পরখ করে নেয় এই ফাঁকে। মাঠে নামার জন্যে ছটফট করছে তারা।

খেলা শুরু হয়।
প্রথম দশ মিনিটে প্রাণশক্তিতে ভরপুর দলটি ফুটবল নিয়ে ছুটতে থাকে মাঠের এ মাথা থেকে ও মাথা। তাদের সাথে পেরে ওঠার সাধ্য কী অশক্ত-দূর্বল বৃদ্ধদের! তরুণদের দলটি ড্রিবলিং করে। কারিকুরি দেখায় ইচ্ছেমত। মন চাইলে দুয়েকটা গোল দিয়ে ফেলে। বৃদ্ধেরা দৌড়ে পারা যাবে না বুঝে প্রস্তাব দেয় ক্রিকেট খেলার। এবং তারা টসে জিতে ব্যাটিং নেয়। ছ ফুট লম্বা প্রতিপক্ষের বোলার বিশাল রান-আপ নিয়ে ছুটে এসে তীব্র গতিতে বল ছুড়ে দেয়। সুচতুর কিডনী রোগী ব্যাকফুটে গিয়ে ডিফেন্স করে। ওভারের প্রতিটা বল সে ডাক করে অথবা ডিফেন্স করে আউট হওয়া থেকে নিজেকে রক্ষা করে। দ্বিতীয় ওভারটিও একজন গতিসমৃদ্ধ বোলার করতে আসে। ওদের দলে কোন স্পিনার ছিলো না। ওরা শুধু বোঝে গতি। এবং দ্বিতীয় ওভারেও প্রথম ওভারের পুনরাবৃত্তি ঘটে। তৃতীয় ওভারটি করার জন্যে পুনরায় ছ-ফুট লম্বা গতিদানবকে ডাকলে সে অস্বীকৃতি জানায়।
-আধা ঘন্টা ধরে ফুটবল নিয়ে দৌড়ুলাম, এরপর একশ মাইল বেগে এক ওভার বোলিং করলাম, আমার বিশ্রাম দরকার।

ফুটবল ক্রিকেট মিলিয়ে এক ঘন্টা খেলা হয়ে গেছে। ভীষণভাবে জীবিতদের দলটা অতিরিক্ত সক্রিয়তা দেখাতে গিয়ে হাঁপিয়ে গেছে। ওদের দম ফুরিয়ে আসছে। আর তাদের প্রতিপক্ষ, তারা জানে এটা একটা বিশেষ সুযোগ। এই সবুজবেষ্টিত, রৌদ্রালোকিত স্টেডিয়ামে আর কখনও আসা হবে না। গ্যালারিতে প্রিয়মুখদের চিয়ার্স শোনার সুযোগ হবে না আর কখনও। মরণমুখো মানুষগুলো বুঝতে পেরেছে একটা সেকেন্ড, একটা ঘন্টা, একমুঠো সৌন্দর্যের জন্যেও বেঁচে থাকা যায়। তারা খেলাটি উপভোগ করা শুরু করে ধীরে ধীরে। মরণকে পাশ কাটিয়ে জীবনের দিকে ছুটতে শুরু করে তারা। আর যারা ছিলো ভীষণভাবে জীবন্ত, তারা ক্রমশঃ নেতিয়ে পড়তে থাকে।
-কী, আমার পেসমেকারটা লাগবে?
-আমার ইনহেলারটা মনে হয় তোমার দরকার।

তাদের প্রতিপক্ষের কথায় হৃদ্যতা নাকি ব্যঙ্গ কোনটা প্রকাশ পায় ঠিক বোঝা যায় না! তবে তাদের মধ্যে কারো কারো বাস্তবিকই সেগুলোর দরকার ছিলো। কেউ কেউ সংকোচে না করলেও কেউ কেউ ইনহেলার নিয়ে দম ভরে নেয়। কম তো খরচ হয় নি! খেলার বিরতির সময় তাদের একজনের বুকে পেসমেকার স্থাপনের প্রয়োজন দেখা দেয়।

দ্বিতীয়ার্ধে খেলা চলে খুব ঢিমেতালে।

ফুটবল অতিশয় গতিসম্পন্ন খেলা হওয়ায় উভয়পক্ষের সম্মতিতে সেটা বাদ দেয়া হয়।
ক্রিকেটে গতিসম্পন্ন বোলারের অভাব থাকার কারণে সেটাও বাদ দেয়া হয়।
রাগবি খেলার নিয়মকানুন কেউ জানতোনা। তবে পাঁচ মিনিট বল নিয়ে ছোটাছুটি আর মারামারি করার পর সবাই হাল ছেড়ে দেয়।

শেষতক আবার ক্রিকেটেই ফিরে যায় তারা। বল করে উভয় দলের স্পিনাররা।

কোন টার্ন নেই। ঢিমেতালে খেলা চলে।
গুগলি বা দুসরা নেই। রিভার্স সুইপ বা ড্যান্সিং ডাউন দ্যা উইকেটে এসে ছক্কা মারার ইচ্ছা নেই কারো।

জীবন্মৃত আর জীবিতেরা এখন সাম্যাবস্থায় এসেছে। কারা কোন দলের খেলোয়াড়, বোঝা কঠিন। জীবনের খেলায় হয়তোবা একসময় এরকমই হয়। ক্লান্তি এসে ভর করে। হারিয়ে যায় বিপুল দম আর প্রাণশক্তি। আর যারা মৃত্যশয্যায় কাতরাতে কাতরাতে অথবা জেলখানার প্রকোষ্ঠে একা অন্ধকার জীবন কাটাতে কাটাতে সূর্যের আলোর জন্যে মিনতি করে, তাদের আশাবাদের জোর কতটুকু যা তাদেরকে বাঁচিয়ে দেবে?

জীবন্মৃত অথবা মুমূর্ষুদের আশাবাদজনিত শক্তি নিঃশেষের পথে। এখন আর তাদের আলো বা সবুজ কোনটাই চাই না। ইনহেলার চাই। আর জীবিতেরা ড্রিবলিং, পেস অথবা টার্ন কোনটাতেই দক্ষতা দেখাতে পারছে না। তারা ক্লান্ত। তাদের দরকার বিশ্রাম।

অবশেষে দুই দলের অনুনয়ে নির্ধারিত সময়ের ত্রিশ মিনিট আগেই খেলার সমাপ্তি টানার অনুরোধ করা হয়। আমরা, আমাদের আয়োজনকারী দলটার এখন গিয়ে ম্যাচের ফলাফল ঘোষণা করার কথা। এতক্ষণে আমরাও আয়োজনপরবর্তী ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন। কম তো ধকল যায় নি গত কয়েকমাসে! আমরা ধীরপায়ে এগুতে থাকি। সূর্যের আলো কমে আসছে। মেঘ এসে গ্রাস করছে সূর্যকে। সেইসাথে আমাদেরকেও, অন্ধকার। মাঠের মাঝরেখায় এসে পৌঁছেছি যখন, অবসন্ন সবাই শুয়ে পড়েছে। এই আঁধারে কাউকে চেনা যায় না আলাদাভাবে। আমরাও, ক্লান্ত আয়োজনকারীরা শুয়ে পড়ি, মিশে যাই তাদের সাথে। কে কাকে জয়ী ঘোষণা করবে!

জানি আজ রাতে প্রচন্ড ঝড়-বৃষ্টি হবে। ধুয়ে মুছে যাবে সব পোস্টার। আর আমরা, সমন্বয়কারীরাও একে অপরের থেকে দূরে সরে যাবো। সরে যাবো জীবন অথবা মৃত্যুর কাছ থেকে। আবারও শুধু বেঁচে থাকার জন্যেই বাঁচবো, মরে যাবার জন্যে প্রস্তুতি নেবো। যারা ভীষণভাবে বেঁচে আছে, অথবা নিকৃষ্টভাবে মারা যাচ্ছে, তাদের নিয়ে নতুন কোন খেলা আয়োজন করা কখনও হবে না আমাদের। কারণ আমরা জেনেছি দিনশেষে সবাই ক্লান্ত।

অথবা

সবকিছুই অর্থহীন!


সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১১ রাত ১২:১১
১৪২টি মন্তব্য ১৪০টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×