somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মূল্য এক টাকা মাত্র

২১ শে অক্টোবর, ২০১৩ সন্ধ্যা ৬:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ঘুম থেকে উঠে দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে নাস্তা গলাধঃকরণের পর পেপারটা হাতে নিয়ে দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে চিন্তা করার মতো সুঅভ্যাস আমার কখনই ছিলো না। অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে মায়ের গজগজানি আর বাবার হুমকি শুনে ঝিমুনি কাটিয়ে পাশের চায়ের দোকানটায় গিয়ে এক কাপ চা আর সিগারেট দিয়েই না দিনটা শুরু করতে হবে! বেলা পর্যন্ত ঘুমোবার ফলে আমার ক্লাশ মিস হয়, প্রেমিকার সাথে ডেটিং অবশ্য মিস হয় না। ওসব বিকেল বা সন্ধ্যায়ই মানায় ভালো। বেলা পর্যন্ত ঘুমোবার ফলে আমার মায়ের সাথে কথা বলার সুযোগ থাকে না, বাবা অফিসে যাবার সময় আমার বন্ধ ঘরের দরজায় কড়া নেড়ে সাড়া না পেয়ে চলে যান। আমি দুপুরে চা-সিগারেট খেয়ে বাসায় ফিরে দিনের শুভ উদ্বোধন করি ব্রাঞ্চ দিয়ে। ব্রাঞ্চ মানে হলো ব্রেকফাস্ট+লাঞ্চ। তারপর আবারো ঘুরে ফিরে বেড়ানো। বন্ধুদের সাথে আড্ডা, সিগারেটের চেয়েও উচ্চমানের ধূম্র উদগীরণ আর লেটেস্ট সেলিব্রেটি পর্নো ভিডিও নিয়ে মেতে থেকে সময় বেশ কেটে যায়। এর ফলে আমার সামাজিকতা রক্ষা তেমন হয়ে ওঠে না। বিকেলে কেউ বাসায় বেড়াতে এলে রাত এগারটার পর বাড়ি ফিরে গল্পই শুনতে পারি কেবল। বাবা-মা'র আমাকে নিয়ে অনেক অভিযোগ, কিন্তু আমার বাবা মাকে নিয়ে কোন অভিযোগ নেই। কারণ দুজনের কাছ থেকেই চলার জন্যে মাসোহারা পাই আমি। পাড়ার চায়ের দোকানে আমার হিসেবের খাতা খোলা আছে। চা-সিগারেটের দাম অন্যসব বিলাসদ্রব্যের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম হলেও অতিরিক্ত সেবনের ফলে তার সর্বমোট মূল্য হাজার ছাড়িয়েও বহুদূর চলে যায় প্রায়ই। দোকানদার আনিসুর ভাই খুব তাগাদা দিচ্ছে ইদানিং বিল পরিশোধ করতে। বাসা থেকে বেরুনোর সময় মায়ের কাছ থেকে বাবার দেয়া এ্যালাউন্সটা নিয়ে প্রথম কাজটাই হবে আনিসুর মিয়ার বিল শোধ করা। কানের কাছে বারবার ঘ্যানঘ্যান করতে থাকলে কাঁহাতক ভালো লাগে!
-গতমাসের বিল কত হইসে আনিসুর মিয়া? আইজকা সব শোধ কইরা দিমু।
ভরা মানিব্যাগে তাড়িয়ে তাড়িয়ে আদর করে আমি গৌরববোধক প্রশ্নটা করি।
-আপনের হৈসে টুটাল...খাড়ান হিসাব কৈরা লই। মোট ১৭৯৩ টাকা।
-১৭৯৩ টাকা! বল কী! এত কেমনে হইলো?
-সিগারেটের দাম বাড়সে জানেন না? গত মাসে তো ধুমাইয়া সিগারেট খাইসেন।
সিগারেটের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টা আমার জানা ছিলো না। আমি আবার একটু বড়লোকী সিগারেট টানি। বেনসন সুইচ। প্রতিদিন দোকান থেকে ৬-৭টা সিগারেট খেলে মাসে হয় প্রায় দুইশটা। আট আনা দাম বাড়লেও একশ টাকা বেশি দিতে হয়। নাহ ব্যাপারটা খতিয়ে দেখতে হচ্ছে!
-সুইচের দাম কত এখন?
-দশ টেকা।
-তাইলে এক টাকা বাড়সে?
বলে আমি নীরসমুখে সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা নিয়ে ধরাই।
-হ ভাই। আর এখুন থিকা নিউ নিয়ম। বাকি বাদ। বাকি দিয়া পোষায় না ভাই।
-আইচ্ছা যাও তোমারে নগদই দিমু।
বিরক্তির সাথে তার দিকে আমি একটা দশ টাকার নোট বাড়িয়ে দেই।

জগৎ সংসারের সাথে আমার সম্পর্কটা হিংসুটে সৎ মায়ের সাথে জেদী ছেলের মত অনেকটা। অনেক কিছুই চোখে পড়ে না, এড়িয়ে যাই। এড়িয়ে যাই ভালোবাসায় এগিয়ে দেয়া হাত, নির্ভরতার বাহু, শনির গ্রাস-রাহু, সংসদ অধিবেশন, মালীবাগে গনপিটুনি, ফতুল্লায় গণধর্ষণ ইত্যাদি। সেক্ষেত্রে এক টাকা মূল্যবৃদ্ধি আমার প্রাত্যহিক জীবনে কোন ব্যত্যয় ঘটাবে না এটাই স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু মাঝেমধ্যে হয়না এরকম... কোন কারণ ছাড়াই মেজাজটা খিচড়ে যায়, সবাইকে দোষ দিতে ইচ্ছে করে, মনের ভেতর সহিংসতার চারাগাছ লতিয়ে ওঠে! আমারও ঠিক তেমন হলো এবার। এক অদ্ভুত দার্শনিক বোধ। মনে হচ্ছিলো যে ঐ এক টাকা আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে আর বলছে, দেখো তুমি কতটা অপটু বাস্তব জীবনে! আমার মেজাজ আরো খিঁচড়ে গেলো। আমি বাকি এবং নগদ সব দাম পরিশোধ করে আনিসুর মিয়াকে অযথাই চায়ে চিনি বেশি দেয়ার অপরাধে ভর্ৎসনা করে বেরিয়ে এলাম। আজকে আর বাসায় গিয়ে খেতে ইচ্ছে করছে না। কী মনে করে যেন কলেজের দিকে রওনা হলাম। আমাদের সরকারী কলেজটা অতি প্রসিদ্ধ হলেও ক্লাশ করা না করার ব্যাপারে ছাত্ররা পূর্ণ স্বাধীনতা পেয়ে থাকে। সময়মতো শিক্ষকবৃন্দ সাজেশন দিয়ে দিলেই আমাদের বিদ্যার্জন সাফল্যের সাথে শুভসমাপ্তির দিকে এগোয়। আজ বিকেল তিনটায় ফিজিক্স ক্লাশ আছে। যদিও ফিজিক্স ক্লাসটা খুব বোরিং, একজন হোৎকামুখো ভারী ভুড়ির কর্কশকন্ঠা প্রৌঢ় নেন। তাতে কী! তার ক্লাশ নেবার মূল্য নিশ্চয়ই এক টাকার চেয়ে বেশি! আনিসুরের দোকানে যত সময় কাটাবো তত একটাকা করে লোকসান হতে থাকবে, এর চেয়ে ফিজিক্স ক্লাসে গিয়ে একটা ঘুম দিয়ে নেয়া যায়। পথে একটা বার্গার খেয়ে নেবো। তারপর ভরপেটে আরামের ঘুম। স্প্যানিশরা যাকে বলে সিয়েস্তা।

ফিজিক্স ক্লাশে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ! কোথায় হোৎকামুখো স্যার! অপ্সরার মতো রূপবতী একজন শিক্ষিকা ক্লাশ নিচ্ছেন। ক্লাশে ছাত্র উপস্থিতিও সে কারণে আজ অনেক বেশি। আমি কোনকর্মে শেষের দিকের একটি বেঞ্চিতে ঠেলেঠুলে বসার জায়গা করে নিলাম। ম্যাডাম ব্ল্যাকবোর্ডে একের পর এক জটিল সমীকরণ লিখে যাচ্ছেন। কারো সেদিকে মনোযোগ নেই। আমিও সিগারেটের দামবৃদ্ধির ব্যাপারটা ভুলে গিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি নিষ্পলক। চল্লিশ মিনিট যেন ঝড়ের বেগে চলে গেলো। ক্লাশ শেষ হবার পর আমি কিছুটা বেদনার্তই হলাম বলা যায়। পাশে বসে থাকা সহপাঠীকে জিজ্ঞেস করলাম,
-ইনি কবে থেকে পড়াচ্ছেন?
-প্রায় এক মাস তো হবেই! দোস্ত! তুই এতদিন কি মিসটাই না করছিস! মাঝেমধ্যে এমন পাতলা শাড়ী পরে আসে, সব দেখা যায় ম্যান!
একমাসে কত কিছুই না ঘটে যায়! সিগারেটের দাম বাড়ে এক টাকা। ভোম্বলমার্কা শিক্ষক হয়ে যায় অপ্সরা শিক্ষয়ত্রী। পরের ক্লাশ ম্যাথমেটিকস। জ্যামিতি আর বীজগণিতের জটিল ধাঁধায় হাবুডুবু খাওয়ার সময় এটা না। ক্লাশ ডাম্প করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। কিন্তু ম্যাডামের সৌন্দর্যজনিত বিহবলাতাই আমার কাল হলো। সময় মতো পেছনের দরজা দিয়ে বেরুতে পারলাম না। ইতিমধ্যেই ম্যাথের টিচার এসে উপস্থিত। সিগারেটের মূল্য এক টাকা বৃদ্ধির মাশুল আমাকে বেশ ভালোভাবেই দিতে হবে দেখছি! অনেকেই অবশ্য বের হয়ে গেছে। আমাদের বেঞ্চিটাতো পুরোই ফাঁকা। শুধু আমি আর গত ফিজিক্স ক্লাশে ম্যাডাম সম্পর্কে কামনামদির বাক্য প্রক্ষেপ করা ছেলেটি আছে। আমাদের কলেজের এই এক ভালো নিয়ম, কোনদিন দেখা না হলেও পাশাপাশি এক বেঞ্চে এক পিরিয়ড বসলেই একে অপরের বন্ধু হওয়া যায়!

স্যার তখন ক্লাশে পরাবৃত্তের সমীকরণ শিখাচ্ছেন। আর আমি খোশগল্পে মত্ত পাশের ছেলেটার সাথে।
-জানিস সিগারেটের দাম এক টাকা বেড়েছে? বেনসন সুইচ।
-হু জানি তো।
-সিগারেটের দাম বাড়াতে আমি খুবই হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি জানিস!
-কেন কেন!
উৎসুক প্রশ্ন তার।
-আর বলিস না, সিগারেটের দাম এক টাকা না বাড়লে আমি রাগ করে টং দোকানের আড্ডা থেকে সরে আসতাম না। আর তাহলে এই বিদঘুটে ম্যাথ ক্লাশও করতে হতো না!
-দোস্ত, বিড়ির দাম বাড়াটা আসলেই দুঃখজনক। দুঃখজননীও বলতে পারিস। থাক মন খারাপ করিস না।
-আসলে সমস্যাটা "বিড়ির দাম এক টাকা বেড়েছে" এত সরল না। বেড়েছে এক মাস আগে, অথচ আমি টেরই পাই নাই! যেটা না হলে আমার চলে না তাকে আমি এতটা অবমূল্যায়ন করেছি ভেবে খুব খারাপ লাগছে।
কথা বলতে গিয়ে আবেগে আমার কন্ঠস্বর একটু উচ্চগ্রামেই উঠে যায়। তা নজর এড়ায় না অংক শিক্ষকের।

-এই, এই যে তোমরা দুইজন, কী কথা হচ্ছে ক্লাশ বাদ দিয়ে? দাঁড়াও! স্ট্যান্ড আপ!
আমরা বিনাবাক্যব্যয়ে দাঁড়ালাম।
-এখন বলো কী সমস্যা। মন কোথায় আছে?
-স্যার, সমস্যা খুবই গুরুতর। গত একমাসে বিড়ির দাম বেড়ে গেছে এক টাকা, নতুন সুন্দরী ফিজিক্স ম্যাডাম ক্লাশ নিয়ে গেছে, আমি কিছুই জানতে পারি নি। আর কত কিছু হয়েছে কে জানে!
ফুঁপিয়ে উঠি অপারগতার বর্ণনা দিতে গিয়ে। অংক শিক্ষকটিকে যতটা কদাকার দেখা যায়, আদতে সে তা না। তার কন্ঠে আমার প্রতি সহানুভূতিই প্রকাশ পেলো।
-বিড়ির দাম বেড়েছে তো কী হয়েছে! বৃত্তের কেন্দ্র থেকে ব্যাসার্ধের দূরত্ব সর্বত্রই সমান। তার তো কোন পরিবর্তন হয় নি।
এবার আমি ফুঁসে উঠি,
-আপনি তো খালি আছেন ওই এক অংক নিয়ে। বৃত্তের কেন্দ্রের সমীকরণে কী এসে যায়! ওটা তো ধ্রুব। পৃথিবীতে সবচেয়ে ছ্যাবলা এবং বোকা জিনিসগুলো কখনও পরিবর্তিত হয় না। জ্যামিতির সুত্রগুলোও ওরকম।
-তুমি কিন্তু বেয়াদবি করছো ছোকড়া! ওয়াচ ইয়োর টোন।
-দেখুন স্যার, গণিতের সাথে দর্শনের সম্পর্ক সবসময়ই বিদ্যমান। আপনি যদি আমার দিক থেকে ভেবে দেখেন, তাহলে কথাগুলো মোটেই অর্বাচীনতা বা বাচালসুলভ মনে হবে না।
-কী বলতে চাও তুমি?
-বলছি যে, গত এক মাসে অনেককিছুই পরিবর্তিত হয়েছে। এখন বিড়ির দাম বৃদ্ধিকে যদি কেন্দ্র হিসেবে ধরে একটা বৃত্ত আঁকি, তাহলে আমরা বৃত্তের প্রতিটি বিন্দুতেই কিছু না কিছু স্থানাঙ্ক পাবো স্পর্শক আঁকার যোগ্য। আমার মাথার ভেতর এখন ঘুরছে সিগারেটের দাম বাড়ার ব্যাপারটা। ফিজিক্স ম্যাডামের স্লিভলেস ব্লাউজ, আপনার একঘেয়ে বক্তৃতা, ক্যান্টিনে সকালের বানানো স্পেশাল চপ মিস করা, সবই আবর্তিত হচ্ছে এই সিগারেটের দাম বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে। আমার যেমন সিগারেট, আপনারও নিশ্চয়ই তেমন কিছু আছে যার মূল্য পরিবর্তনকে কেন্দ্র হিসেবে ধরলে আপনিও আপনার নিজের বৃত্ত খুঁজে পাবেন।
স্যার নিজের মনেই বিড়বিড় করতে থাকেন,
-জর্দার দাম বেড়েছে, পানের সাথে জর্দা না থাকলে ধক পাই না।
উনাকে এই অবস্থায় রেখে আমি ক্লাশরুম থেকে বের হয়ে যাই। ক্যান্টিনে সকালের স্পেশাল চপ মিস হয়ে গেছে, সমস্যা নেই। নতুন কিছু খুঁজে বের করবো, স্পেশাল।
ক্যান্টিনটা কেমন যেন নিস্তব্ধ। খাবার টেবিলের সামনে সবাই শোকগ্রস্ত হয়ে বসে আছে। যেন খুব কাছের কেউ মারা গেছে। যেন এটা ক্যান্টিন না গীর্জা, শেষকৃত্য অনুষ্ঠান পালন করা হচ্ছে। সব মুখ অচেনা। একমাস পরে এলাম এখানে। একমাসে এতকিছু পাল্টে যায়? কাউকে যে জিজ্ঞেস করবো সেই ভরসাটাও পাচ্ছি না। সবার মুখে এতটাই ছাপ ফেলেছে বিষাদ। ফিজিক্স ম্যাডামও দেখছি বিষণ্ণমুখে বসে আছে সেখানে। সেও কি ধূমপান করে? সিগারেটের মূল্যবৃদ্ধিতে ব্যথিত? আমি চেয়ার টেনে ম্যাডামের পাশে বসলাম সাহস করে। উদ্দেশ্য, তার রুপবর্তী হবার পাশাপাশি গ্রেডিংয়ের ব্যাপারেও কিছুটা তোয়াজ করা। আমাকে বসতে দেখে তিনি অভিব্যক্তিহীন কন্ঠে সুধোলেন,
-বিড়ির দাম বেড়ে গেছে, তাই না ছেলে?
তার বলার মধ্যে এমন একটা কিছু ছিলো, তার দৃষ্টি এমন তীর ছুড়ছিলো ম্যাডাম সম্পর্কিত কামনাতুর ভাবনা পুরোপুরিই রহিত হয়ে যায়।
-বিড়ির দাম বাড়ার সাইড এফেক্ট কিন্তু ব্যাপক।
বলে তিনি তার শাড়ী এক ঝটকায় সরিয়ে ফেললেন। পরনে শুধু ব্লাউজ আর সায়া।
-একটাকা মূল্য বৃদ্ধি তোমাকে এতদূর নিয়ে এসেছে, কিছু রঙ্গ না দেখালে কেমন হয়! হিহিহি!
তিনি হাসতে থাকলেন ঘোরগ্রস্থের মতো।
-ঐ যে দেখো, তোমাদের অংক টিচারও ক্লাশ শেষে উপস্থিত। হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটছে। বিড়ির দাম বাড়ার এটাও একটা এফেক্ট। সিগারেটের দাম বাড়লে উঠতি বয়সের ছেলেরা বিষণ্ন হয়। সেখান থেকে রাগ, তা থেকে ক্ষোভ, তারপর কেউ কেউ বেপরোয়া সাহসী হয়ে ওঠে, শিক্ষকদের সাথে হম্বিতম্বি করে ছাত্ররা। যেমনটা তুমি তার সাথে করেছিলে আজকের ক্লাশে। তাই তিনি এখন তার উচ্চাসন বর্জন করে সারা ক্যাম্পাস হামা দিয়ে বেড়াবেন। আর আমি শাড়িহীন, তার ওপর চড়ে টগবগ টগবগ করে দাপিয়ে বেড়াবো। তোমরা তো তাই দেখতে চাও, না? বিড়ির দাম বেড়েছে বাবা, সোজা কথা তো নয়! হুহু।
গণিত শিক্ষক ততক্ষণে হামা দিয়ে আমাদের টেবিলের কাছে উপস্থিত। ম্যাডাম তার পিঠের ওপর বসে চাবুক মারার ভঙ্গি করলেন, আর স্যার ঘোড়ার মতো চিহিহি শব্দ করে এগুতে থাকলেন। তা দেখে ক্যান্টিনের শোকগ্রস্থ বালকেরা উঠে দাঁড়ালো সবাই। নেতাগোছের একজন বললো,
"এখন হবে এক মিনিট নীরবতা। সিগারেটের দাম বাড়ার ফলে যে শোকাতুর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তার প্রতি সম্মান দেখানোর জন্যে সবাই এক মিনিট দাঁড়িয়ে থাকবে"

বাধ্য হয়েই আমাকে এক মিনিট নীরবতা পালন করতে হলো দাঁড়িয়ে।

"এখন আমরা এই শোকাতুর দিনে দেখবো গত একমাসে কী কী খারাপ ঘটনা ঘটেছে এই ক্যান্টিনে"
বলা শুরু করে সে,
"সিঙ্গারা পুড়ে গেছে একাধিকবার, সমুচা এখন আর বানানো হয় না, একাধিক চায়ের কাপ এবং প্লেট নিহত হয়েছে, ফ্রায়েড রাইসের দাম বাড়ানো হয়েছে..."

মনটা খারাপ হয়ে গেলো আমার। কত নিষ্ঠুর এই পৃথিবী! বেঁচে থাকার জন্যে কত সংগ্রাম! ফিজিক্স ম্যাডাম শাড়ি খুলে ফেলে, অংকের স্যার হামাগুড়ি দেয়, সিঙ্গারা পুড়ে যায়, সমুচা বানানো হয় না, সিগারেটের দাম বাড়ে এক টাকা...

বিষণ্ণচিত্তে আমি ক্যাম্পাস থেকে বের হই। কলেজে মোবাইল ফোন ব্যবহার করা নিষেধ। এখন ইচ্ছেমত রেডিওতে গান শুনতে শুনতে পথ চলা যাবে। কিন্তু রেডিওর সবগুলো চ্যানেলে এখন সরকার নিয়ন্ত্রিত বেতারের খবর প্রচারিত হচ্ছে-
"রাজধানীর সবুজবাগে এক শিশু ট্রাক চাপায় নিহত। কুড়িগ্রামে খেতে না পেয়ে সন্তান বিক্রী করেছে বাবা মা। কুমিল্লায় দুই পক্ষের সংঘর্ষে পচিশজন আহত, নিহত পাঁচ। মেঘনায় লঞ্চডুবিতে একশজন নিহত..."
খবর কখন শেষ হবে! বিরক্তির সাথে ধৈর্য্যের পরীক্ষা দেয়ার প্রস্তুতি নিই আমি। পথিমধ্যে একটা সিগারেটের দোকান দেখে হু হু করে ওঠে বুকটা। এক টাকা বেড়ে গেছে দাম। অথচ আমি জানতেই পারি নি!

সন্ধ্যা নেমেছে। এই সময়টায় আমরা ধানমন্ডি লেকের ধারে আড্ডা দেই। কিন্তু আজ কিছুই হলো না। সবারই মন খারাপ। সিগারেটের মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে মাসাধিককাল আগে, কিন্তু তরুণ সমাজে তার প্রভাব রয়ে গেছে এখনও। যেই ছেলেটা দিনের পর দিন সঞ্চয় করে এক ক্যান বিয়ার খায়, তার সাথে সিগারেট লাগবে না প্রচুর? যে মেয়েটা শখ করেছিলো সিগারেট ঠোঁটে গুজে ধোঁয়া ছেড়ে একটা অসামান্য প্রোপিক বানাবে তার কথা কে ভাববে? যাকগে, সবকিছুই প্রতিস্থাপনযোগ্য। এটা আমি জীবনের সত্য দর্শন মনে করি। এবং এই দর্শনে জীবন পরিচালিত করে বেশ লাভবানও হয়েছি এটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। সিগারেটের দাম বেড়েছো বলেই তো ফিজিক্স ম্যাডামের ক্লাশে থাকতে পারলাম, সিগারেটের দাম বেড়েছে বলেই তো অংক স্যারের মুখের ওপর ওভাবে কথা বলতে পারলাম! ফিজিক্স ম্যাডামকে দেখছি শুধুমাত্র ব্লাউজ আর পেটিকোট পরে অংক স্যারের পিঠে চড়ে শহর প্রদক্ষিণ করছে। তবে তাদের দিকে কেউ তাকাচ্ছে না আমি ছাড়া। এই মুহূর্তে এখানে আমাদের কলেজের আমি ছাড়া আর কেউ নেই। ব্যক্তিগত মূল্যসূচকের পরিবর্তনে যে দৃশ্যমন্ডল সৃষ্টি হয় তা শুধুমাত্র সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিই দেখতে পাবে এটাই স্বাভাবিক। ম্যাডাম আমার কাছে এসে বলেন,
-কাল থেকে আমি আর ক্লাশ নিবো না! তোমাকে আর পড়িমরি করে ছুটে এসে আমার ক্লাশ ধরতে হবে না! আমি ছুটিতে যাচ্ছি। ছুটি ছুটি ছুটি ছুটি ছুটি ছুটি ছুটির দুপুরে দুপুরে! সেখানে সিগারেটের দাম বাড়বে না কখনও।
-জর্দার দামও না।
যোগ করেন অংকের শিক্ষক।
-না ম্যাডাম, আপনি যাবেন না!
কাতর অনুরোধ করি আমি।
-তুমি তো ভালো করেই জানো সবকিছুই প্রতিস্থাপনযোগ্য। বিড়ির দাম বাড়লে মেজাজ খারাপ হয়, সেটা ঝাড়তে ক্লাশে এসে সুন্দরী ম্যাডামের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়, জগৎটা চলছেই তো এই লুপে!
-তা অবশ্য ঠিক। গুডবাই ম্যাডাম।

ম্যাডাম শাড়ি ঠিক করে চলে যান। স্যারও সোজা হয়ে দাঁড়ান। বাসার কাছাকাছি এসে গেছি। এত তাড়াতাড়ি বাসায় যাবার কোনো পরিকল্পনা ছিলো না আমার। এই দুজনের সাথে কথা বলতে গিয়ে কখন যে চলে এসেছি খেয়ালই করি নি। আজকে সন্ধ্যা থাকতে থাকতে বাসায় ফেরার ফলে কিছু অপরিচিত প্রতিবেশীকে দেখলাম ড্রয়িংরুমে। মা তাদের সাথে গল্প করছেন। সম্ভবত প্রতি সন্ধ্যায়ই এখানে আসর বসে। ভালোই লাগে দেখতে।
-এত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরলি যে? সুমতির কারণটা কি শুনি?
হাস্যোজ্বল মুখে মায়ের জিজ্ঞাসা। খুশি লুকিয়ে রাখতে পারছেন না তিনি কোনভাবেই। অবশ্য তার সেই ইচ্ছেও নেই। আমি দুচোখ ভরে দেখি মায়ের হাসি, পাশের ফ্ল্যাটের পিচ্চিটাকে; বেশ বড় হয়ে গেছে, নতুন আসা বউটাও সংকোচ কাটিয়ে সাচ্ছন্দ্যে গল্প করছে। এক মাসে সিগারেটের দাম বাড়ে এক টাকা। বদলে যায় মানুষগুলোও। অবশ্য সিগারেট বা মানুষ সবই প্রতিস্থাপনশীল!
-বস না এখানে। দেখ ওরা কী দারুণ কেক বানিয়ে এনেছে আমার জন্মদিন উপলক্ষ্যে!

আজকে মা'র জন্মদিন ছিলো! দিব্যি ভুলে বসে ছিলাম। সিগারেটের দাম মাঝেমধ্যে বাড়া ভালো। তাহলে মেজাজ খারাপ করে ঘরে ফিরে এমন সুন্দর দৃশ্য দেখা যায়। মা'র জন্মদিনটা মিস হয়ে গেলে তো আর ফিরে পাওয়া যেতো না। সবকিছু কী প্রতিস্থাপন করা যায়! টিভিতে তখন লঞ্চডুবিতে নিহতের সংখ্যা দেখাচ্ছিলো। আহারে বেচারা মানুষগুলো! আনন্দের মধ্যেও মন খারাপ হয় আমার।

গল্পটি লেখার অনুপ্রেরণা নম্রতার স্মোকি কবিতাটি। তাকে ধন্যবাদ।

সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ৮:৩৩
৬৯টি মন্তব্য ৬৯টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

= দাওয়াত বা কোন অনুষ্ঠানে খাবার গ্রহণের সময় যে কটি বিষয় আপনার বিবেচনায় রাখা দরকার =

লিখেছেন এমএলজি, ১৪ ই অক্টোবর, ২০২৪ ভোর ৪:২৩



১. দ্রুত খাবার গ্রহণের অভ্যাস থাকলে তা কিছুটা ধীর বা প্রলম্বিত করার চেষ্টা করুন যাতে অন্য সবার বেশ আগেই আপনার খাওয়া শেষ হয়ে না যায়।

২. কোন আইটেম খুব সুস্বাদু বা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ এবং কিছু কথা......

লিখেছেন জুল ভার্ন, ১৪ ই অক্টোবর, ২০২৪ সকাল ১০:৩০

আমাদের ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ এবং কিছু কথা.........

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমাদের সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার বিষাদময় গ্লানির সঙ্গেই বোধকরি বেশি সম্পর্ক। কদাচিৎ কোনো বড় দলকে পরাজিত করার পর আমরা পুরো বাংলাদেশ এখনো আবেগে আপ্লুত... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ্‌ সাহেবের ডায়রি ।। অন্য দেশে চলে যাচ্ছে গার্মেন্টসের অর্ডার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ১২:২০




এবার বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের অর্ডারের একটি অংশ প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তানসহ অন্য দেশের বাজারে চলে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। রাজনৈতিক অস্থিরতা, সরকার পতন এবং শ্রমিক অসন্তোষের কারণে দেশের সবচেয়ে বড়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন ভারতের উদ্বেগ!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৪ ই অক্টোবর, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩


ভালোভাবেই শেষ হলো সনাতনীদের বৃহৎ উৎসব দুর্গাপূজা কিন্তু দুর্গাপূজা ভালো ভাবে শেষ হওয়ায় অনেকেই বড্ড হতাশ হয়েছে; পূজা নিয়ে তারা ট্রামকার্ড খেলতে চেয়েছিল কিন্তু ট্রামকার্ড খেলার পরও সফল হতে পারেনি।... ...বাকিটুকু পড়ুন

উফ্! কি দারুণ!! WOW!!!

লিখেছেন মন থেকে বলি, ১৪ ই অক্টোবর, ২০২৪ বিকাল ৩:০৬

চোখটা সবে যেই বুঁজেছি, ডাকল হুলো 'মিঁয়াও'।
মাথায় এলো আজিব টপিক - আরি সাবাশ! WOW!!

ল্যাংটাকালে 'আমার বই'-য়ে,
আঁকল ছবি কোন আঁকিয়ে?
তালগাছেতে উলটো ঝোলে কানাবগির ছাও।
সেটাই ছিল প্রথম অবাক, প্রথম বলা - WOW!!

আরও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×