somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এ হাওয়া আমায় নেবে কত দূরে...

০২ রা আগস্ট, ২০২২ রাত ১২:০৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হাওয়ার ট্রেইলার যখন দেখলাম, তখন মনে হচ্ছিলো এটা কি লাইফ অফ পাইয়ের মতো কিছু? লাইফ অফ পাই আমার দেখা ভিজুয়ালি সবচেয়ে স্টানিং সিনেমাগুলির মধ্যে একটি। এই সিনেমার সাথে একটা বাংলাদেশী সিনেমা তুলনায় এসে যাচ্ছে, ব্যাপারটাই তো অবাস্তব! হাওয়া অন্তত ট্রেইলারের মাধ্যমে হলেও সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে।
সিনেমা কী উপায়ে বানালে সুন্দর লাগে আমি আসলে জানি না। সমুদ্র তো অনেক সিনেমাতেই দেখেছি, কিন্তু এরকম অনুভূতি সব সিনেমা দিতে পারে নি কেন? ভিজুয়ালি চমৎকার একটা এক্সপেরিয়েন্স হবে এটা অনুমেয় ছিলো। গল্প কেমন হতে পারে তা নিয়ে ছিলাম ধোঁয়াশায়। আমার "লাইফ অফ পাই" প্রভাবিত প্রিভিউ ছিলো এমন, হাওয়া হবে একটি মেটাফর হেভি চলচ্চিত্র, যেখানে নানারকম ভাবনার বিষয় লুকায়িত থাকবে। সিনেমা দেখতে গিয়ে সতর্ক ছিলাম কিছুটা, কিছু আবার মিস করে ফেলি না কি!
না, তেমন কিছু আসলে পাই নি। হাওয়ার গল্প বেশ সরল। যদিও প্রথম অর্ধেক দেখে মতিগতি বুঝতে পারি নি ঠিক কোনদিকে যাচ্ছে।
যাই হোক, সিনেমা শুরুর আগে কয়েকজনের আলাপচারিতায় শুনলাম যে এটা না কি একটা মেটাফর হেভি চলচ্চিত্র হতে যাচ্ছে। সিনেমা শেষ হবার পরেও কেউ কেউ বললো এই ছবি সাধারণ মানুষের মাথার ওপর দিয়ে যাবে, কারণ এটায় অনেক মেটাফর। রিভিউগুলিতেও দেখলাম সবাই মেটাফর মেটাফর করছে। কিন্তু কী মেটাফর ব্যবহার করা হয়েছে এটা নিয়ে বিস্তারিত কোনো কথা নেই, বিশ্লেষণ নেই। আমি যথেষ্ট সতর্ক দৃষ্টিতে দেখেও তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু পাই নি। মেটাফর না থাকা কোনো দোষের কিছু না। মেটাফর ছাড়াও অনেক মাস্টারপিস ছবি আছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, সাধারণ একটা কাহিনীর সাথে বহুল প্রচলিত ফোক ফ্যান্টাসির মিশেলকে ‘হাইলি মেটাফরিক” বলে মহত্ব আরোপ করার চেষ্টা কেন?
হাওয়া সাধারণ মানুষের উপভোগ করার মত করেই বানানো হয়েছে। এখানে কোনো লুকানো নকশা নেই। এতে জেলেদের জীবন সংগ্রাম আছে, তাদের হাসি-আনন্দ-কাম-লোভ যাবতীয় অনুভূতির চিত্রায়ন আছে, গান আছে, ভায়োলেন্স আছে, হিউমার আছে, মোট কথা উপভোগ করার উপযোগের কমতি নেই। এটা সাধারণ মানুষের ভালো লাগার উপযোগী করেই বানানো। বোদ্ধা বা বিশ্লেষকরা “সাধারণ মানুষ”কে অতিমাত্রায় সরলীকরণ এবং তুচ্ছ করে চলচ্চিত্রটিকে ধরা ছোঁয়ার বাইরের জগতে নিয়ে যেতে চাইছেন, এই প্রয়াস সমর্থনযোগ্য না।
হাওয়া সিনেমাটিতে ক্রমাগত জনরা শিফটিং আছে। প্রথমে এটি ছিলো জেলেদের জীবনের সংগ্রামের কাহিনী। পরে তাতে রহস্য যোগ হয়। শেষের দিকে আছে স্ল্যাশার সিনেমার উপাদান। আর যে উপাদানটা ইমোশনকে কানেক্ট করতে এবং টুইস্ট দিতে ব্যবহার করা হয়েছে, সেটা হলো একটা ফোক ফ্যান্টাসি। এরকম আপনারা এর আগেও দেখেছেন হয়তো। আগের দেখার সাথে এবারের দেখার পার্থক্য যেটা হবে তা হলো, এর আগে বাংলা সিনেমায় এ ধরণের প্রতিশোধ এবং রূপান্তর আপনার মধ্যে হয়তো হাস্যরসের উদ্রেক করেছিলো, আর এবার ট্রাজিক পরিণতি এক ধরণের আচ্ছন্নতা সৃষ্টি করতে পারে (হয়তো, যদি আপনি সংবেদনশীল হন)।
হাওয়ার সিনেমার দুর্দান্ত ভিজুয়ালের কথা সবাই জানেন। পানির গভীরে নোঙরের পিছু নেয়া ক্যামেরার এক্সট্রিম ক্লোজআপ প্রায় থ্রিডি মুভি দেখার অনুভূতি দিয়েছিলো। রাতের বেলার সমুদ্রকে লেগেছে রহস্যময়, আর দিনের বেলা মনে হয়েছে প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। অভিনেতাদের সত্যিকারের সমুদ্রের মানুষ মনে হয়েছে। তাদের রুক্ষ চুল, ত্বক আর চোখ বলে দিয়েছে এরকম হতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে । মেকআপ আর্টিস্টের কয়েক ঘন্টার কসরতে এত ভালো কাজ করা সম্ভব না। একটা সিনেমার জন্যে কেউ কত কষ্ট করেছে বা কত সময় দিয়েছে দর্শকের কাছে আসলে এসবে কিছুই যায় আসে না। তারা দেখবে সব মিলিয়ে জিনিসটা কেমন দাঁড়িয়েছে। হ্যাঁ, তাদের কষ্ট সার্থক হয়েছে এটা বলা যায়। অভিনয়শিল্পীরা নোনাজল আর মাছেদের জীবন ধারণ করতে পেরেছেন সফলভাবেই।
আমার একটা অভিযোগ আছে শিল্পীদের একসেন্ট নিয়ে। এই সিনেমার জেলেদের খুলনা-বাগেরহাট অঞ্চলের খাস অধিবাসী হিসেবে দেখানো হয়েছে। খুলনা অঞ্চলের ভাষা রপ্ত করা খুব সহজ। করিছি, করতি পারলি, করিছিস, এই তো! যে কেউ একটু চর্চা করলেই পারবে, তাই না? হু। কিন্তু নিখুঁত অনুকরণের জন্যে আরো সতর্কতা প্রয়োজন ছিলো। এই যেমন গালি দেয়া হয়েছে “খানকির পোলা” বলে। খুলনার আদি অধিবাসীরা কেউ “খানকির পোলা” বলে না। এর পরিবর্তে বেশি প্রচলিত গালিগুলি হলো- নটির ছেলে, নটির ছাওয়াল, খানকির ছেলে বা খানকির ছাওয়াল। ‘পোলা’ পুরোপুরি ঢাকা এবং আশেপাশের জেলার শব্দ। তারপর ধরুন ‘হোগা’ , এটাও ঢাকাইয়া গালি। খুলনায় শব্দের প্রথমে ওকার থাকলে সেটাকে উকার হিসেবে বলার প্রচলন আছে। হোগার বদলে হুগা, মোটার বদলে মুটা, ঘোড়ার বদলে ঘুড়া ইত্যাদি। আর এত গালি দেয়া হলো, অথচ খুলনার লোকাল গালিগুলি, শাউয়া/শাউয়ো, বাড়া, ছামা এগুলি দেয়া হলো না! আরো কিছু ভাষাবিষয়ক অসঙ্গতি নোট করেছিলাম, মনে পড়ছে না এখন। ভালো আর মাস্টারপিসের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, সেখানে এসব ক্ষুদ্র ডিটেইলের দিকেও নজর দেয়া হয়।
মেঘদলের মাস্টারপিস “এ হাওয়া” গানটি প্রমোশনাল টুল হিসেবে খুবই শৈল্পিক এবং যুৎসই ছিলো। তবে এ সিনেমাতে এই গানটি নেই। না থাকাতেই ভালো হয়েছে। প্রান্তিক মানুষের জীবনের গল্পের অতি কাব্যিক এবং নাগরিক গান মোটেই মানাতো না। “ন ডরাই” ছবিতে যেমন কক্সবাজারের লোকাল তরুণ-তরুণীর মনোবেদনা দেখাতে অতি আধুনিক শিল্পী মোহন শরীফের ইংরেজি উচ্চারণের গান বেখাপ্পা এবং হাস্যকর লেগেছিলো (গানটা কিন্তু আমার খুব প্রিয়)।
সিনেমার প্রথমার্ধে দর্শককে আনন্দিত করার মতো অনেক উপকরণ আছে। অশ্লীল ইঙ্গিত, সোশাল মিডিয়ায় জনপ্রিয় গান (নুরুর হ্যান্ডল মারা), তাহেরি হুজুরের সংলাপ (পরিবেশটা সুন্দর না?), আর সাদা-সাদা-কালা-কালা গান তো আছেই! অনেকেই বলেছে তাদের না কি শুরুর দিকে স্লো মনে হয়েছে সিনেমাটা। আমার কাছে তেমন লাগে নি একদমই। প্রতিটা ফ্রেমই ব্যস্ত আর এনগেইজিং লেগেছে। প্রথমার্ধের হাস্যরস আর প্রাণপ্রাচুর্য মিলিয়ে যেতে থাকে দ্বিতীয়ার্ধ থেকে। রহস্য ঘনীভূত হবার সাথে সাথে আসতে থাকে নানারকম বিপদ-আপদ। ধাক্কা দেয়ার মতো ব্যাপার ঘটা শুরু হয়। শেষতক একটা সুখী জলযানের চরম ট্রাজেডি চিত্রায়িত হয়েছে যথেষ্ট নির্দয়তায়। তবে পরিচালক দর্শকের মনোবেদনা অথবা নিজের স্পর্শকাতরতা, কোন কারণে জানি না, খুনোখুনি শেষে একটু ইমোশনাল করার চেষ্টা করেছেন দর্শককে, যার জন্যে প্রেক্ষাপট তৈরি যথেষ্ট শক্তিশালী ছিলো না, আবার প্রেক্ষাপট তৈরি করতে গেলে ক্লিশে হয়ে যেত। সেদিক থেকে চিন্তা করলে পরিচালকের পরিমিতিবোধ আর শৈল্পিক মননই জয়যুক্ত হবে।
সিনেমায় মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্বের পাশাপাশি জৈবিক সংকটও দেখানো হয়েছে। এ ধরণের পরিস্থিতি সিনেমায় থাকলে বেশ উপভোগ করি। তবে নারী ঘটিত মনস্তাত্বিক দ্বন্দ্ব ছিলো অনুমেয়। সেটা কিছুটা একঘেয়ে লেগেছে। এরচেয়ে নৌকায় হঠাৎ তৈরি হওয়া জৈবিক সংকট (মাছ ধরা না পড়া, ক্ষুধা, ক্ষত, মৃত্যু) যথেষ্ট উপভোগ্য ছিলো।
বারবার কারিগরী শক্তিমত্তায় দৃশ্যায়নের সৌন্দর্যের কথা বলা হলে পরিচালকের শিল্পীমনকে খাটো করা হয়। বেশ কিছু দৃশ্যে কাব্যিক সুষমা আছে। কোটি টাকা আর ভালো ক্যামেরা থাকলেই এসব দৃশ্য তৈরি করা যায় না। এর জন্যে যে শৈল্পিক মনন লাগে মেজবাউর রহমান সুমনের তা আছে।
চূড়ান্ত মূল্যায়ন-
--হাওয়া কি বৈশ্বিক মানদণ্ডে মাস্টারপিস?
-না।
-হাওয়া কি বৈশ্বিক মানদণ্ডে ভালো ছবি?
-হ্যাঁ
-এটিকে ঘিরে যে হাইপ তৈরি হয়েছিলো তার যোগ্য?
-হ্যাঁ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০২২ রাত ১২:০৯
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামায়াত শিবির রাজাকারদের ফাসির প্রতিশোধ নিতে সামু ব্লগকে ব্লগার ও পাঠক শূন্য করার ষড়যন্ত্র করতে পারে।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৪৯


সামু ব্লগের সাথে রাজাকার এর সম্পর্ক বেজি আর সাপের মধ্যে। সামু ব্লগে রাজাকার জামায়াত শিবির নিষিদ্ধ। তাদের ছাগু নামকরণ করা হয় এই ব্লগ থেকেই। শুধু তাই নয় জারজ বেজন্মা... ...বাকিটুকু পড়ুন

হাওরের রাস্তার সেই আলপনা ক্ষতিকর

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:৫৯

বাংলা বর্ষবরণ উদযাপন উপলক্ষে দেশের ইতিহাসে দীর্ঘতম আলপনা আঁকা হয়েছে কিশোরগঞ্জের অষ্টগ্রাম হাওরের ‘অলওয়েদার’ রাস্তায়। মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ এই আলপনার রং পানিতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছবির গল্প, গল্পের ছবি

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:১৫



সজিনা বিক্রি করছে ছোট্ট বিক্রেতা। এতো ছোট বিক্রেতা ও আমাদের ক্যামেরা দেখে যখন আশেপাশের মানুষ জমা হয়েছিল তখন বাচ্চাটি খুবই লজ্জায় পড়ে যায়। পরে আমরা তাকে আর বিরক্ত না করে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×