somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভালোবাসার গল্প- 'নীল'

৩০ শে জানুয়ারি, ২০২৩ সকাল ৮:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমরা গিয়েছিলাম শিল্পকলা একাডেমিতে। সেখানে চলছিলো একটি আঁভা গার্দ জাতীয় এক্সপেরিমেন্টাল মঞ্চ নাটক। চরিত্র ছিলো একটিই। পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারে আক্রান্ত একজন যুবক। তার মধ্যে ছিলো আত্মহত্যার প্রবণতা। সমাজের নানারকম বিভৎস এবং বিধ্বংসী সহিংস আচরণ তাকে অসুস্থ করে তুলছিলো। সে দর্শকদের উদ্দেশ্য করে, একরকম দোষারোপ করেই চালিয়ে যেতে লাগলো তার ঝঞ্ঝামুখর একাঙ্কিকা। ধর্ষিত হয়ে ভাল্লুকের পেটে সেঁধিয়ে যাওয়া মেয়েটার উপকথা শোনালো সে আমাদের। আমরা বিব্রত এবং শঙ্কিত মুখে তাকিয়ে রইলাম। সে আরও বললো ভবনধ্বসে মৃত নরনারীদের প্রেতাত্মার কথা, যারা না কি এখনও পচা লাশের গন্ধ ঢাকতে দেয়া পারফিউমের গন্ধ পেলে চিৎকার করে শাপ শাপান্ত করে। বললো সেই অভিশপ্ত ফোনকলের কথা যার একপ্রান্তে ছিলো একজন বাবা আর অস্ত্রধারী আজরাঈল, অন্যপাশে মা, মেয়ে আর তাদের আর্তনাদ আর কান্না।

এসবই আমরা খবরের কাগজে পড়েছি। ফেসবুকে দেখেছি, শুনেছি। আমার কাছে এই এক্সপেরিমেন্টাল আভা গার্দ পরিবেশনাটি যতটা না শৈল্পিক গুণে ঋদ্ধ তার চেয়ে বেশি মনে হচ্ছিলো বিষয়বস্তুর এক্সপ্লয়েশনে ভারভারন্ত। হ্যাঁ, ডিস্টার্বিং তো বটেই, আর আধুনিক নাগরিক জীবনে আমরা কে না ডিস্টার্বিং বস্তু ভালোবাসি! উদভ্রান্ত আর ক্ষিপ্ত অভিনেতাটি দৌড়ে দর্শকদের কাছে এসে জবাবদিহিতা চাইছিলো মারমুখী ভঙ্গিতে। তার প্রশ্নের উত্তর দিতে আমাদের অপারগতায় তাচ্ছিল্য করছিলো। আর অবশেষে কারো কাছে উত্তর না পেয়ে উপায়ন্তর না দেখে ফিরে গিয়েছিলো প্রিয়তম সিজোফ্রেনিয়ার কাছে গায়েবী কণ্ঠের আহবানে আত্মহত্যা করতে।

মঞ্চে প্রস্তুত ছিলো আংটা, টুল আর দড়ি। সে বিপদজনকভাবে দড়িতে গলা সেঁধিয়ে দিয়ে ঝুলে থাকার ভঙ্গি করেছিলো।

আর এই রুদ্ধশ্বাস শৈল্পিক জটিলতার মধ্যে আমার পাশ থেকে ফোঁসফোঁস করে কেঁদে উঠলে তুমি। ওহ, এত সংবেদনশীল তোমার মন? হ্যাঁ, তোমাকে দেখে যে কেউ বলে দিবে যে, “ঐ দেখো, দেখছো না ঐ মেয়েটিকে? সে ভীরু, লাজুক এবং নার্ভাস। যে কেউ তার সেনসিটিভিটি ব্যবহার করে সহজেই নার্ভাস ব্রেকডাউন ঘটিয়ে দিতে পারো।”
তুমি পরে ছিলে একটা বিষণ্ণ নীল জামা। তোমাকে জড়িয়ে ধরে ছিলো একটা লাল ওড়না। তুমি ওড়নাটি গলা থেকে নামিয়ে দিলে। ঠেসে বসেছিলো খুব? আমি জানতাম না তোমার অ্যাংজাইটির সমস্যা আছে। তুমি হাঁ করে নিঃশ্বাস নেয়ার চেষ্টা করছো। আমার সংকোচ হচ্ছে তোমার হাত ধরতে। কিন্তু আমি নিশ্চিতভাবেই জানি আমার হাতটা তোমার কাঁধে রাখতে হবে, এখনই!

ওদিকে চিৎকার করে চলেছে ডিস্টার্বড নাট্যকর্মী। সে নিশ্চয়ই একজন মেথড একটর। অনেকদিন ধরে এই শো’য়ের জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করেছে। নিজের শরীরের মধ্যে বুনে দিয়েছে অস্বস্তি আর অরাজকতার বীজ। শিল্পের জন্যে সে নিজেকে ধ্বংস করে দিতে চাইলে দিক। কিন্তু তুমি তো শুধু চেয়েছিলে একটা সুন্দর সান্ধ্যসময় কাটাতে, তাই না? যদিও প্রবেশদ্বারে লেখা ছিলো সহিংস বিষয় সম্পর্কে সতর্কতা, তুমি তা গ্রাহ্য করো নি তোমার আনমনা চপলতায়। আমি আগে জানলে বলতাম নিশ্চয়ই?

টেনে টেনে নিঃশ্বাস নিচ্ছো তুমি। কুঁকড়ে যাচ্ছো ভিতরে ভিতরে। এখান থেকে তোমাকে বের করে নিয়ে যেতে হবে। তোমার কি এটা মুখ ফুটে বলারও শক্তি নেই? চুলোয় যাক সমাজ, রাষ্ট্র, প্রশাসন, শিল্পমগ্নতা। অল আই কেয়ার ইজ, তোমার এখন প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছে, তোমাকে দিতে হবে বিশুদ্ধ বাতাসের স্পর্শ। হাত ধরো, চলো এখান থেকে। মানুষের পা মাড়িয়ে যেতে হবে, তারা বিরক্ত হবে, এগুলি নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। আমি আছি তোমার সাথে। তোমার কোনো ভয় নেই।


আপাতত অডিটোরিয়াম থেকে বেরিয়ে আমরা ছাদেই বসি, ঠিক আছে? এখানে তাজা বাতাস পাবে। আমি পানির বোতল নিয়ে আসছি। মঞ্চ নাটক শুরু হতে দেরি হয়েছিলো বলে নাট্যদলের লোকেরা দিয়েছিলো পানির বোতল আর বিস্কুট। সেগুলি হারিয়ে ফেলেছো বলে আবার উদ্বিগ্ন হচ্ছো? আরে, বাদ দাও না! ধাতস্থ হও। আমি পানি নিয়ে আসছি। চা খাবে? না। ক্যাফেইনে সমস্যা হবে। আমি জুস পেলে নিয়ে আসবো। ফিরে আসার পর আমরা গল্প করবো পিঠাপুলি আর পৌষ উৎসব নিয়ে। আসলেই, কেন যে এই হেমন্তের বিকেলে পিঠা উৎসবে না গিয়ে এই ডিস্টার্বিং নাটকটা দেখতে এলাম! এর পর থেকে এরকম সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে আমাদের আরও বিবেচক হতে হবে।

জল আর হাওয়ার সংস্পর্শে তুমি ধীরে ধীরে ফিরতে লাগলে স্বাভাবিক পার্থিবতায়। ভয়ের জগৎ তোমার থেকে দূরে সরে যেতে লাগলো। কালো ডানা মেলে ধরা দানবেরা বিষণ্ণ মনে চলে গেলো অন্য কারও মধ্যে ভীতি সঞ্চার করতে। ওরা আমার কাছে কেমন হেরে গেলো, দেখলে তো? তোমার চোখের ঘোলাটে ভাব কেটে যাচ্ছে। জড়ো হচ্ছে আলোর পাখিরা। তুমি হয়ে উঠছো দীপ্তিময়ী। তুমি ঢকঢক করে পানি পান করছো। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি উষর প্রান্তরে সবুজের লতিয়ে ওঠা।

কিছু খাবে? ভাজাপোড়া অথবা প্রসেসড ফুড ছাড়া স্বাস্থ্যকর কিছু পাওয়া যাবে না অবশ্য। ভালো হতো, যদি পেতাম ফল অথবা ফসল। আমাদের সুস্থ খাদ্যাভ্যাস কিন্তু মানসিক এসব ক্লেদ দূর করতে খুব ভালো ভূমিকা রাখে, জানো নিশ্চয়ই? জানো সবই। বোঝোও, কিন্তু মানতে চাও না। এরকম হলে কীভাবে হবে? ঐ হতচ্ছাড়া নাটকটা দেখতে ফিরে যাবে না কি আবার? দরকার নেই। চলো আমরা চলে যাই। এখান থেকে নেমে আমরা যাবো মৎস ভবনে। তারপর বাস ধরে চলে যাবো আমাদের গন্তব্যে। এখন আমরা হাঁটবো মৃদু পায়ে। যদিও জোরে হাঁটলে ক্যালরি বেশি পুড়বে, এবং আমরা এগিয়ে যাবো সুস্থতার পথে, তবুও’ থাকুক। আবার প্যালপিটিশন হতে পারে তোমার। প্যানিক অ্যাটাক থেকে রিকভার করতে খানিকটা সময় লাগে। আস্তে হাঁটো, অত বাহাদুরি দেখিও না।

স্ট্রিটল্যাম্প জ্বলছে তারার মতো। লাউড স্পিকারে ভেসে আসছে মনোমুগ্ধকর সঙ্গীত। বেলুন বিক্রেতার কাছ থেকে সওদা করছে মাঝবয়সী গুঁফো পিতা। তার আঙ্গুল ধরে আছে এঞ্জেল বেবি। ফুলবিক্রেতার দোকানের সামনে ভীড়। প্রেমিক তরুণেরা বেছে নিচ্ছে তার সিনোরিতার জন্যে সুন্দরতম ফুলটি। দেখলে তো, সন্ধ্যারা কীভাবে সুন্দর হয়ে যায়! এসবই ম্যাজিক। আমি এমন অনেক ম্যাজিকের কৌশল জানি।

বাস এসে গেছে। হ্যাঁ, ওটাতে সিট খালি পাবে। উঠে যাও…


আমি জেনে রাখলাম, তুমি নেমে যাবে কাওরানবাজার থেকে এয়ারপোর্টের মাঝের কোনো স্টপেজে। আর কিছুই জানার উপায় রইলো না। হুশ করে বাসটা ছেড়ে দিলো। জানা হলো না তোমার নাম, তুমি কোথায় পড়ো বা চাকরি করছো না কি, জানি না তুমি পছন্দ করো কোন রঙের চুলের ফিতা, জানা হলো না তোমার প্রিয় গান, সিনেমা, গল্পের বই, অলস দুপুরে রোদের মধ্যে বারান্দায় চুল এলিয়ে বসে থাকতে ভালো লাগে কি না, জানা হলো না তোমার পিতার নাম, জিলা, উপজিলা, কোন ঠিকানায় চিঠি লিখলে পৌঁছুবে, জানা হলো না তোমার নিয়মিত ঔষধ আর পরিচর্যার বিষয়ে।

বাসটা মিলিয়ে গেলো ম্যাজিকের মতো, তুমিও। আজকে জ্যাম নেই, ভীড় নেই। ঘড়ি দেখলাম। এখনও নাটকের বাকিটা দেখার সময় অবশিষ্ট আছে। আমি ফিরছি শিল্পের কাছে অথবা জীবনের কাছে অথবা বাস্তবতার কাছে, তুমি নেই এই নিশ্চিত সত্যিটাকে মেনে নিয়ে। তাই হোক।

তুমি নাই বা থাকলে , এসেছিলে কিছু সময়ের জন্যে এই বা কম কী!

ছবি- Midjourney Ai



সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে জানুয়ারি, ২০২৩ সকাল ৮:৫৯
৮টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুড়ি শব্দের গল্প

লিখেছেন করুণাধারা, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:১৭



জলে ভাসা পদ্ম আমি
কোরা বাংলায় ঘোষণা দিলাম, "বিদায় সামু" !
কিন্তু সামু সিগারেটের নেশার মতো, ছাড়া যায় না! আমি কি সত্যি যাবো? নো... নেভার!

সানমুন
চিলেকোঠার জানালায় পূর্ণিমার চাঁদ। ঘুমন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×