(১)
দিঠির সাথে আমার ভীষণ মন কষাকষি হয়েছে । এরকম হলে আমার মধ্যে জেগে ওঠে ধংসাত্মক প্রবণতা। আমার চলে যেতে ইচ্ছা করে রাতের বাস ধরে দূরের কোনো জেলায়। সাতক্ষীরা অথবা পঞ্চগড়। আমার অফিসের সামনেই আছে বাসের কাউন্টার। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে অফিসে ঢোকার বা বের হবার সময় তারা আমাকে প্ররোচিত করার চেষ্টা করে- “কই যাইবেন স্যার? চট্টগ্রাম? কক্সবাজার? এসি গাড়ি আছে। পাঁচ মিনিট পরেই ছাড়বে”।
কিন্তু এই রাতের বেলা কোথায় যাবো? আরাম করে শুয়েছি বিছানায়। গোসল করে এসে নরম বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি। এই সময় আমাদের বাকবাকুম করে সাংসারিক আলাপ করার কথা। চাইলে হালকা করে পেঁচিয়ে ধরে রাখতে পারি তার কাঁধ। অথবা সে আমার বুকে এলিয়ে দিতে পারে মাথা। কিন্তু তা না, সে গজগজ করছে। আমার পাশেই বসে আছে। সে চাচ্ছে ঘুমানোর আগে শান্তিমতো একটা ঝগড়া করতে। আমি চুপ করে আছি দেখে তার রাগ বেড়ে যাচ্ছে আরো। পরিস্থিতিটা অসহনীয় হয়ে উঠছে। আমি শান্তিমতো অ্যাশেজের হাইলাইটস দেখতে পারছি না। এমতাবস্থায় আমি কেমন আচরণ করবো তার ওপর নির্ভর করছে আজকের রাত এবং আগামীকল্য দিন কেমন যাবে। আগামীকল্য ছুটির দিন হওয়াতে একটু সমস্যা। কারণ, সারাদিন একসাথে থাকতে হবে। দুইজন দুইজনের অফিসে থাকলে এই অস্বস্তিকর অবস্থা ভুলে থাকা যেতো।
আমার এখন যেটা ইচ্ছা, সেটা হলো পা নাচাতে নাচাতে ইন্টারনেট থেকে হাস্যরসাত্মক ভিডিও আর খেলার হাইলাইট দেখে তারপর শারীরিকভাবে ঘনিষ্ঠ হয়ে ঘুমিয়ে পড়া। আপাতত দ্বিতীয়টার সম্ভাবনা নেই বলেই মনে হচ্ছে। আমার পুঁতে দেয়া নীরবতার মাইনে একসময় দিঠির পা পড়বেই, এবং সে বিস্ফোরণ ঘটাবে। আমি এই অপেক্ষাতেই আছি।
আমি ভান করছি একদম নিজের মধ্যে ডুবে আছি- এমন একটা ধারণা তার মধ্যে তৈরি করে দিতে। যদিও মাঝেমধ্যে আড়চোখে তাকাচ্ছি তার দিকে। সেও ফোনে কী যেন একটা সিনেমা দেখার ভান ধরেছে। স্প্যানিশ বা ইতালিয় কথাবার্তা চলছে। ওদিককার কথা শুনে মনে হচ্ছে ওখানেও দুই পক্ষের মধ্যে ব্যক্তিত্বের ব্যাপক দ্বন্দ্ব চলছে এবং আলোচনার মাধ্যমে তারা তা নিরসনের চেষ্টা করতে গিয়ে আরো ঘোঁট পাকিয়ে ফেলছে। এই রাতের বেলা ভাবগম্ভীর কন্ঠে ইউরোপিয়ান ভাষায় চাপান-উতোর শোনার মানে হয় না। আমিও গান ছেড়ে দিলাম -
“ভালো লাগে জোৎস্নায় কাশবনে ছুটতে…”
-গানটা একটু আস্তে দাও। রাত হয়েছে এখন।
সে হিমশীতল গলায় বললো।
আহা, মওকা পেয়ে গেছে। ওর আশা আমাকে পূরণ করতে হবে। মনমতো ঝগড়া করে বের করে নিতে হবে সমস্ত নেগেটিভ এনার্জি।
-গান আস্তেই চলছে। অন্তত তোমার ঐ বিজাতীয় ভাষার সিনেমার চেয়ে এই গানের শব্দ আশেপাশে ছড়িয়ে পড়লে মানুষজন তৃপ্তি পাবে।
-রাত বারোটার সময় কী করা যায় না যায় সে ব্যাপারে তোমার ভাবা উচিত।
-রাত বারোটার সময় সপ্তাহান্তের রাতে চুমু আর সঙ্গম করতে হয়। এমনটাই আমি জেনে এসেছি।
বলে আমি তাকে কাছে টেনে নেয়ার চেষ্টা করলাম।
সে ঝটকা দিয়ে আমাকে ছিটকে ফেলে দিলো।
-তুমি সবসময় শুধু ঐ একটা জিনিসের কথাই ভাবো, তাই না? আমি কি একটা মাংসের পিন্ড? তোমার খেলার উপকরণ?
এখন আমি যদি এই বিষয়ে তর্ক শুরু করি, তাহলে অবস্থা বেগতিক হয়ে যাবে। এসব বিষয়ে আদতে আমরা দুজনেই প্রায় একইরকম ধ্যানধারণা পোষণ করি। তারপরেও, বায়োলজিক্যাল একটা পার্থক্য তো থাকেই নারী আর পুরুষের। তার জের ধরে একটা মানসম্পন্ন ঝগড়া করা সম্ভব। এখন কথা হচ্ছে আমি ওকে উশকে দিবো কি না। আমার মনে হলো সেটা করাই শ্রেয় হবে।
-আমি নিজেও তোমার অনেক অপ্রেশন সহ্য করেছি। বন্ধুবান্ধবদের সাথে আড্ডা দেই না, বিড়ি সিগারেট খাই না, লক্ষীমন্ত ছেলের মতো অফিসে যাই, বাসায় আসি, তারপরেও যদি এইসব বিপ্লবী কথা শুনতে হয়, তাহলে তো আসলে সমস্যা।
-অফিস তুমি একা করো? আমি করি না? সমস্যা শুধু তোমার হয়? আমার হয় না?
-তোমার সমস্যাটা কি একটু বলবা?
-এক কথা আর কতবার বলবো? বারবার বলার পরেও তোমার মনে থাকে না। আর কতবার বলা যায়!
এসব শুনে আমার রাগ হয়। আমি আসলেই একটা সমাধানে পৌঁছুতে চাইছিলাম। মনের রাগটা চুকিয়ে না ফেললে তো শরীরের রংকে তুলি দিয়ে আঁকা যাচ্ছে না!
আমি আবারও চুপ করে গেলাম। সে কিছুক্ষণ গজগজ করে আবার ইউরোপিয়ান নন ইংলিশ সিনেমার জটিলতায় মন দিলো। এভাবে কেটে গেলো আরও মিনিট দশেক। এই খেলার নিয়ন্ত্রণ মনে হচ্ছে আমার কাছ থেকে চলে যাচ্ছে। এতক্ষণ আমি ছিলাম নিরুদ্বেগ, সে ফুঁসছিলো। এখন মনে হচ্ছে সে সামলে নিয়েছে। আর তাই আমার মনের মধ্যে ঝড় চলছে। এখন আর আমার রাতের বাসে করে দূরের জেলায় চলে যেতে ইচ্ছা করছে না। আমার ইচ্ছা হচ্ছে তাকে জড়িয়ে ধরতে। কীভাবে সেটা করা যায়? গায়ে হাত দিলেই তো বলবে “তোমার ঐসব ছাড়া আর কিছু মাথায় নাই?”।
সেইসময় একটা চমৎকার ব্যাপার ঘটলো। টানটান পরিস্থিতিকে এড়িয়ে গিয়ে কথা বলার একটা মওকা পাওয়া গেলো। ফেসবুকে দেখলাম আমাদের প্রিয় ব্যান্ড জলতরঙ্গের কনসার্টের পোস্টার। তাও আবার কালকেই।
-এই দেখো, শুক্রবারে জলতরঙ্গের কনসার্ট। আগারগাঁওয়ে। তিনটার সময়। আমরা যেতে পারি, কী বলো?
-শুক্রবারে? মানে কালকে?
তার গলার হিমশীতল ভাঁপটা একটু কেটে গিয়ে সেখান থেকে গরম ভাতের ধোঁয়া আসছে। এখন আমাকে সেটা প্লেটে তুলে নিতে হবে।
-হ্যাঁ, শুক্রবার মানে তো কালকেই। কালকে যেহেতু আমাদের আর কোনো কাজ নেই, তাই আমরা যেতে পারি।
-সে যেতে পারি, কিন্তু ঐ ব্যাপারটার কী হবে?
-কোন ব্যাপারটার যেন?
-যে ব্যাপারটা নিয়ে আজকে ঝামেলা।
আমি আসলেই ভুলে গিয়েছিলাম কোন ব্যাপারটা নিয়ে এ সমস্ত মানসিক টানাপোড়েনের শুরু।
-কোন ব্যাপারটা নিয়ে যেন ঝামেলা?
ভীতু ভীতু কন্ঠে আমার সরল জিজ্ঞাসায় সে রাগ করার বদলে হেসে ফেললো। আর সেই সুযোগে আমি তাকে চুমোয় চুমোয় ভরিয়ে দিলাম।
(২)
দিঠি বেশ কায়দা করে সাজছে। ধবধবে সাদা শরীরে একের পর এক লালের পরত চাপাচ্ছে। লাল লিপস্টিক, লাল শাড়ি, লাল ব্লাউজ, উফ! আমি বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকলাম। সে বেশ উপভোগ করছে আমার এই তাকিয়ে থাকা, বুঝতে পারছি। এইভাবে খোলা পেট আর মন ভোলানো সাজ দেখতে ভালোই লাগছিলো, কিন্তু তিনটার মধ্যে তো পৌঁছুতে হবে! যদি টিকেট না পাওয়া যায়?
-হলো তোমার? একটু চালিয়ে করো না!
এমনভাবে বললাম,যাতে অসহিষ্ণুতা প্রকাশ পায়, বিরক্তি না। এই বের হবার সময়টায় মানসিক অবস্থা খুব অস্থিতিশীল থাকে। দেখা যাবে যে বলে দিতে পারে, “থাক তুমিই যাও। আমার আর দরকার কী”।
তবে সাজগোজের পাশাপাশি গানবাজনাও তার পছন্দ, আর দুজনের প্রিয় ব্যান্ড বলে কথা! তাই সে হিসাবমতোই সব শেষ করে লালচে দেবী হয়ে আমার বাহুলগ্না হয়ে বের হতে প্রস্তুত হলো। রাতের বেলা ঝগড়া করে থাকলে দিনের বেলা যেই ধরণের পরিবেশে ঘুরতে ইচ্ছা হবে, এটা ঠিক তেমনই একটা সময়। মিরপুর রোড ফাঁকা। কল্যাণপুরে ইতস্তত ঘুরছে আচারওলারা। শ্যামলীতে উড়ে বেড়াচ্ছে শালিকযুগল। আর আগারগাঁওয়ের বিশাল রাস্তার দুপাশের অতিকায় এবং শৈল্পিক স্থাপনাগুলি স্বাগত জানাচ্ছে হন্টন আর উদযাপনের জন্যে! তিনটা বাজার পনেরো মিনিট আগেই চলে এসেছি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। এখানেই হবার কথা সেই কনসার্ট। এখন আমাদের খুঁজে বের করতে হবে অডিটোরিয়াম এবং টিকিট বিক্রির স্থান।
-মানুষজন তেমন নেই। আমরাই কি সবার আগে এলাম?
-আরে এই দেশের তিনটা মানে শুরু হতে হতে চারটা বাজাবে। তুমি অযথাই অত তাড়াহুড়া করছিলে।
আমার প্রশ্নের জবাবে দিঠি বললো।
তা হবে হয়তো! আমি ওর কথা মেনে নেই। দুজনে মিলে চারপাশে এক চক্কর দিয়ে আসি। মেঘ করেছে আকাশে। টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। ফাঁকা রাস্তা। হাত ধরে হাঁটলে কেউ চোখ রাঙাবে না। আর রাঙালেই বা কী! হাওয়া দিচ্ছে। চুল উড়ছে আমাদের। দিঠি নানান ভঙ্গীমায় দাঁড়িয়ে পড়ে দুই গাছের ফাঁকে অথবা দেয়ালের সামনে। আমি তার ছবি তুলে দেই। আমি গলা খাকরি দিয়ে গাইতে শুরু করি জলতরঙ্গের প্রিয় গান। দিঠি মুগ্ধ হয়ে শোনে।
-দশ বছর আগে টিএসসিতে যখন জলতরঙ্গের গান শুনছিলাম আমরা, তখন ওদের তেমন কেউ চিনতো না। আমাদের বন্ধুবান্ধবদের মধ্যেই গুটিকতক গান ঘুরে ফিরে চলতো।
দিঠি বললো।
-এই সময়ে ওদের কত নতুন গান এলো, কত মানুষ ওদের চিনলো, অথচ আমরা এতই ব্যস্ত হয়ে গেলাম যে আর একবারও ওদের গান সামনাসামনি শোনা হলো না! আজকেও শোনা হতো না যদি কালকের ঝগড়াটা না হতো।
-তাই কি?
-হ্যাঁ। তুমি বলতে “বাসায় অনেক কাজ আছে, ঘর পরিষ্কার করতে হবে, পর্দা মুছতে হবে, জামাকাপড় ধুতে হবে- না অন্য একদিন” আর আমিও তা মেনে নিয়ে শুয়ে বসে কাটিয়ে দিতাম দিনটা।
দিঠি নীরব হয়ে আমার কথা মেনে নিয়ে কিছুটা অপ্রতিভ হয়ে যায় মনে হয়। পরক্ষণেই ছবি তোলার জন্যে চমৎকার একটা জায়গা ঠিক করে ফেলে।
-সময় হয়ে এসেছে। এবার চলো। টিকেট বিক্রয়ের লোকেরা মনে হয় চলে এসেছে।
আমি বলি।
-দাঁড়াও, ঝিলিকদেরকে ছবি পাঠিয়ে দেই। ওরা যা হিংসা করবে না!
আমরা বন্ধুদের গ্রুপে “কনসার্ট দেখতে এসেছি” শিরোনাম দিয়ে গর্বিত ভঙ্গীতে ছবি পাঠাই।
সন্তুষ্ট চিত্তে হাঁটতে হাঁটতে অডিটোরিয়ামের সামনে চলে আসি আমরা। টিকেট মনে হয় এখনই বিক্রয় শুরু হবে। ঐ সময় ফোন করে ঝিলিক।
-কোন কনসার্টে গেছো তোমরা?
-ঐ যে জলতরঙ্গের কনসার্ট।
-সেটা কয় তারিখে?
-অ্যাঁ! কয় তারিখে তা তো জানি না। শুক্রবারে দেখলাম…
-ভালোমতো তারিখটা দেখে আমাদের জানাও।
বলে সে ফোন রেখে দিলো।
আমরা ভালোমতো তারিখটা দেখলাম। হ্যাঁ, শুক্রবারেই বটে, তবে আজ থেকে দুই সপ্তাহ পরে।
আমি দিঠির দিকে বোকার মতো তাকিয়ে হাসলাম।
সেও হাসলো। হাজার হোক, সে নিজেও তো এই বোকামির একজন গর্বিত অংশীদার! আমাকে দোষ দিয়ে ঝগড়া শুরু করার মতো সুবিধাজনক অবস্থানে সে নেই।
-এসেই পড়েছি যখন, চলো অডিটোরিয়ামে ঢুকেই দেখি কীরকম। দুই সপ্তাহ পর তো আবার আসবোই।
-তা ঠিক। চলো।
অডিটোরিয়ামের ভেতরে রাজ্যের কেজো লোক। আজ বিকেল সাড়ে চারটায় একটা অনুষ্ঠান আছে পরিসংখ্যান অধিদপ্তরের। সেটার আয়োজন চলছে। কোট-প্যান্ট পরা লোকজন তোড়জোড় করে বেড়াচ্ছে। মাইক সাজাচ্ছে, শব্দ পরীক্ষা করছে “অ্যালো অ্যালো মাইক্রোফোন টেস্টিং, অ্যালো অ্যালো” “সামাদ মিয়া তুমি যেখানেই থাকো না কেন এখনই চলে আসো”।
আহা, যেখানে আজ জলতরঙ্গের মোহনীয় সুরে বুঁদ হয়ে থাকার কথা ছিলো আমাদের, সেখানে “অ্যালো, মাইক্রোফোন টেস্টিং?”
-দাঁড়াও দেখাচ্ছি!
বলে আমার হাত ধরে কোমড়ে শাড়ি গুঁজে ধাঁইধাঁই করে স্টেজে নিয়ে গেলো দিঠি। মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে সে গাইতে শুরু করলো,
“কষ্টগুলো উল্টে পাল্টে দ্যাখো,
দ্যাখো তোমার নিভৃত কিংখাব।
আলোয় ভাষা পড়তে যদি পারো
বাজাও তবে গাঢ় অন্ধকার।”
আমিও পরের অংশ গেয়ে নিলাম
"ফুটতে যদি পারো পঙ্ক জলে,
মৃগনাভির গন্ধ নিয়ে ফোটো।
উড়িয়ে দিয়ে আবহমান ঠুলি
তনুর তীরে তৃষ্ণা-তরী বাঁধো”
বিকট কিছু ঘটে যাওয়ার আশঙ্কায় একজন হর্তাকর্তাগোছের লোক আরেকটি মাইক্রোফোন নিয়ে আরো আকুলভাবে সামাদ মিয়ার সাহায্য প্রার্থনা করে যাচ্ছে। ডাকাবুকো সামাদ মিয়া এসে আমাদের স্টেজ থেকে নামিয়ে দেয়ার আগে আমরা গানটা যতদূর পারি গেয়ে নেই!
জীবন তো আর সবসময় আমাদের দেবে না এমন গাইবার অবসর!
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই জুলাই, ২০২৩ সকাল ৯:০৯