রুহিন,
২০১৪ সালে যখন সেই হৃদয় ভাঙার ঘটনাটি ঘটলো, মারিও গোটশে বুক দিয়ে বল রিসিভ করে অ্যাক্রোবেটিক নৈপুণ্যে বল পাঠিয়ে দিলো জালে, তখন তুমি পৃথিবীতে আসো নি। তোমার সাথে পরবর্তীতে জীবনের অনেক মুহূর্ত আমাকে ভাগ করে নিতে হয়েছে। তোমাকে আমি দিয়েছি আশ্রয়, চিকিৎসা, খাদ্য আর খেলনা। তোমার সাথে খেলেছি ঘোড়া ঘোড়া অথবা গাড়ি গাড়ি। একটি স্বাভাবিক পিতা-পুত্র সম্পর্ক। স্নেহের, ভালোবাসার, বন্ধনের। তুমি হয়তো বড় হয়ে বাবা দিবসে আপ্লুত হয়ে ফেসবুকে আমার ছবি দিয়ে বলবে “পৃথিবীর সেরা বাবা”, যেরকমটা সবাই বলে থাকে। তোমার বয়স এখন ৮ পুরোলো কেবল। তোমার জগৎ আর আমার জগৎ আলাদা। আমাদের মধ্যে কমন জিনিস খুব কম, যেই অনুভূতিটা দুজনে মিলে শেয়ার করে নিতে পারবো। সেটা এত তাড়াতাড়ি আশাও করি নি। তুমি এখনও আমার কাছে একটা ছোট্ট পাখির মতো। আদর আর শাসন দিয়ে আমি তোমাকে উপহার দেই আনন্দ আর উৎকণ্ঠা, এর বিনিময়ে দেখি পৃথিবীর জল-হাওয়ায় তোমার নিজেকে প্রকাশিত হতে দেখার আনন্দময় দৃশ্যটি।
তোমাকে আমি কখনও বলি নি ২০১৪ এর ট্রাজিক মুহূর্তের কথা। বলার প্রয়োজনও পড়ে নি। ২০১৪ এর পর ২০১৮ এসেছে, আর্জেন্টিনা অতটা দুঃখ না দিয়েই সহজ, স্বাভাবিকভাবে বিদায় নিয়েছে, এর আগে মেসির পেনাল্টি মিসের জেরে কোপা আমেরিকায় হেরে গেছে, এসব আমাদের আলোচনার বিষয়বস্তু ছিলো না। কিন্তু ২০১৮ এর বিশ্বকাপ চলার সময় তিন বছর বয়সী তুমি কীভাবে যেন আর্জেন্টিনা আর মেসি ভক্ত হয়ে গেলে। এমন না যে আমি তোমাকে প্ররোচিত করেছিলাম। আমি কখনই তোমাকে বলি নি আর্জেন্টিনা পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো দল, আর মেসিকে ভালো না বেসে পারা যায় না। তারপরেও টিভির সামনে বসলে তো সমর্থন এসেই যায়। আর সেটা দেখেই তোমার মনের মধ্যে কী ঘটে গেলো আমি জানি না। তুমি হয়ে উঠলে মেসির পাঁড় সমর্থক। “বাবা, মেসি কি জিতেছে?” উত্তর হ্যাঁ সূচক হলে তোমার আনন্দ, আর “মেসি কেন হেরে গেলো” কাঁদো কাঁদো কন্ঠে তোমার করা এই প্রশ্নের জবাব দেয়াতে আমার অপারগতার চেয়ে যেটি আমাকে শঙ্কিত করেছিলো, সেটি হচ্ছে তুমিও কি আমার মতো আর্জেন্টিনা সমর্থনের অভিশাপচক্রে পড়ে গেলে? সারাজীবন কি এই আক্ষেপ বয়ে বেড়াতে হবে? ৯০ সালে ম্যারাডোনার কান্না দেখে একটা স্থায়ী বিষাদের বোধ সৃষ্টি করেছিলো আমার ভেতরে। তোমার ক্ষেত্রেও যে সেটা হতে যাচ্ছে, আমি নিশ্চিত ছিলাম। আর এরজন্যে নিজেকেই দায়ী মনে হচ্ছিলো। কিন্তু ২০২২ সাল এসে সিদ্ধান্ত নিলো, “অনেক হয়েছে, আর না। এবার একটু বেচারাদের মুখে হাসি ফোটানো যাক! আর সেটা কী উপায়ে সম্ভব হলো তা তো দেখেই ফেলেছো!”।
২০২২ এর ১৮ই ডিসেম্বর আমি ছুটিতে ছিলাম। সারাদিন কাটিয়েছি অলসতায়। সময়টা কোনোভাবে কাটিয়ে দেয়ার চেষ্টা। আর্জেন্টিনা যেহেতু ফাইনালে উঠেছে, তাহলে তো হারবে অবশ্যই! এ ব্যাপারে কি কোনো সন্দেহ থাকা উচিত? বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়ে আড়মোড়া ভাঙার পর থেকে একটা অনুভূতিহীনতা আর অমঙ্গলের অনুভূতি পেয়ে বসলো। আমার ভেতরের ডিফেন্স মেকানিজম কাজ করা শুরু করলো- “অত আশা করে থেকো না, এবারও হারবে”। তাই আমি প্রস্তুতি নিতে শুরু করলাম আরেকটা হার্টব্রেকের। এই আপাত অনুভূতিহীনতা আসলে অনুভূতিহীনতা না। এটা একটা বাজে অনুভূতি। আশা অথবা সুখের অনুপস্থিতি কখনই ভালো কিছু দেয় না। সন্ধ্যায় তোমাকে নিয়ে যেতে হলো ডেন্টিস্টের কাছে। বসে থাকতে হলো দীর্ঘক্ষণ। রাত আটটায় খেলা, সাড়ে সাতটায় যখন তোমাকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম, তখন আরো জনা তিনেক রোগী বসে আছে। আহা, এই কর্তব্যপরায়ন ডাক্তারের মতো নির্বিকার হতে পারতাম যদি! শুরু থেকে খেলা ধরতে পারবো না, এটা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে গেলাম। দেরি হবে দুই থেকে পাঁচ মিনিট। আমি চেষ্টা করলাম অস্থির না হবার। ডাক্তারের চেম্বার থেকে বের হয়ে তোমাকে নিয়ে চললাম বাসার উদ্দেশ্যে। পাঁচ মিনিটের পথ। এর মধ্যেই আমরা দেখতে পেলাম জটলাবদ্ধ নীল-শাদা মানুষের উল্লাস আয়োজন, শুনতে পেলাম ভুভুজেলা আর বাজীর শব্দ। আমার আরোপিত বৈরাগ্যের তখন পলায়নপর। রক্তে নাচন অনুভব করছি। তুমিও অস্থির হয়ে উঠেছো।
বাসায় গিয়েই তুমি জার্সি পরে নিলে। আমাদের খুব বেশি দেরি হয় নি। প্রায় প্রথম থেকেই দেখতে পেরেছি। ড্রয়িংরুমে চেয়ার পাতা হলো। আমরা সবাই বসে গেলাম খেলা দেখতে। আমাকে সবাই বললো জার্সি পরতে। আমি অস্বীকৃতি জানালাম। আয়োজন করে হারতে চাই না।
ফার্স্ট হাফে আমরা ২-০ গোলে এগিয়ে গেলাম। আমার শরীর জুড়ে তখন ফুটতে শুরু করেছে নক্ষত্রচূর্ণ। নিশ্চিত হয়ে গেলাম, এবার আর কোনোভাবেই আমাদের হারানো যাবে না। এই বিশ্বকাপের মতো ভাগ্যের সহায়তা কখনই পাই নি। এবারের চিত্রনাট্য ঈশ্বরের নিজ হাতে লেখা। জার্সি পরে নিলাম। উদযাপনের আয়োজন এখন শুরু করা যেতে পারে।
৭০ মিনিট পর্যন্ত খেলা দেখলাম একদম নির্ভার হয়ে, ইউফোরিয়াতে উড়ে। ফ্রান্সের প্রথম গোলটা হবার ঠিক আগে সবাই মিলে একটা সেলফি তুলে আত্মীয়দের গ্রুপে শেয়ার করলাম। আর তখনই গোলটা খেয়ে বসলো। এর জন্যে নিজেকেই দায়ী মনে হলো।
আমি যদিও খুব যুক্তিবাদী মানুষ, কিন্তু খেলার ক্ষেত্রে এসব পুরোনো কুসংস্কারের আছর থেকে বেরুতে পারি না।
এরপর কী হলো তুমি দেখেছো। পৃথিবীর সবাই জানে, একটা একঘেয়ে একাধিপত্য বিস্তার করা খেলা কীভাবে সর্বকালের সেরা খেলায় রূপান্তরিত হলো।
আজ এক বছর হলো। আনন্দের অনুভূতিগুলি ফিকে হয়ে এসেছে। কিন্তু তীব্রতা কমলেও তাৎপর্য কমে নি। তীব্র আনন্দ একসময় স্বাভাবিক জীবন প্রক্রিয়ায় মিশে যায়, অর্জনের তৃপ্তি হিসেবে রয়ে যায়। এই ৪২ বছর বয়সে এসে এভাবেই কাজ করার কথা ব্যাপারগুলির।
রুহিন,
সেদিনের ম্যাচের অনেক দৃশ্য, অনেক গল্প অনেকদিন স্মৃতিতে রয়ে যাবে, আমরা যতদিন বেঁচে থাকবো, ততদিন এ নিয়ে আমাদের কথা হবে, তুমি একটা সময় বুঝতে পারবে, এই রাতটা ঠিক কতটা অসাধারণ ছিলো। তোমার সাথে গল্প করার প্রসঙ্গ পরিবর্তন হতে যাচ্ছে সামনে!
তীব্রতর মুহূর্তগুলি ঝাপসা হয়ে আসে, কিন্তু একটা মুহূর্ত আমি এখনও চোখ বন্ধ করলেই অনুভব করতে পারি, যেন সেটা এখনই ঘটছে, এই মুহূর্তেই। সেই মুহূর্তটা আমি যেকোনো সময়, যেকোনো জায়গায় বসেই রিক্রিয়েট করতে পারবো। মূলত সেই মুহূর্তটা ধরে রাখার জন্যেই এই লেখাটা, সেই মুহূর্তটার জন্যেই এত কথা। তোমার মাকে বলেছিলাম সেই মুহূর্তটার কথা। সে আমাকে বলেছিলো একটা কিছু লিখতে। এতদিন পর অবশেষে সেটা লেখা হতে যাচ্ছে!
সেই মুহূর্তটা তোমাকে নিয়ে, রুহিন। অথচ তুমিই জানো না। তোমাকে এখনও আমরা “ছোটো বাবু” বলেই ডাকি। কোন প্রাণীর কত শক্তি, বিজ্ঞানবাক্সের কোন এক্সপেরিমেন্ট কীভাবে করে, এসব নিয়ে আবর্তিত তোমার জগৎ, যা থেকে ছিলাম আমি ৩৩ বছর দূরত্বে, সেই মুহূর্তে অনুভব করলাম, সেই দূরত্ব ঘুঁচে গেছে। তুমি শীঘ্রই পুত্র থেকে আমার বন্ধু হয়ে উঠবে। সেই মুহূর্ত চলমান। প্রক্রিয়া শুরু।
অতিরিক্ত সময়ে যখন আর্জেন্টিনা তৃতীয় গোলটা দিলো, মেসির দ্বিতীয়, তখন পাগলের মতো চিৎকার করতে গিয়ে খেয়াল করি নি যে আমার পেছনে বসে তুমি কাঁদতে শুরু করেছো। তোমার মা আমাকে ডেকে দেখালো ব্যাপারটা। তোমাকে আমরা জানি কিছুটা কম এক্সপ্রেসিভ আর চুপচাপ হিসেবে। তুমি তোমার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদছো, সুখের দমক সামলাতে না পারার কান্না। তোমার কান্না যেন আমার বুকের ভেতরটা ওলোটপালোট করে দিলো। আমি প্রার্থনা করলাম মনে মনে, আজকে রাতে যেন তোমাকে কষ্ট পেতে না হয়। তখন আমার মূল চিন্তা ক্ষণিকের মধ্যে পরিবর্তিত হলো এভাবে- আর্জেন্টিনা জিতছে না কি হারছে তা না, আর্জেন্টিনা হারলে আমি কীভাবে তোমাকে বোঝাবো। আমি তোমাকে কাছে টেনে নিলাম, জড়িয়ে ধরলাম, তুমি তখনও ফোঁপাচ্ছো।
এই মুহূর্তটাই, রুহিন।
তোমার এই কান্নাবিজড়িত সুখের মুহূর্তটাই রয়ে গেলো অক্ষয় হয়ে। এর চেয়ে বিশুদ্ধতম অনুভূতির প্রকাশের মুখোমুখি আমি অনেকদিন হই নি।
আমি চোখ বন্ধ করলে এখনও অনুভব করতে পারি, সেই মুহূর্তটা আর বুঝে নেই যে আমার অনুভূতিগুলি তোমার সাথে মিলে গিয়েছিলো সেদিন।
সামনে আরও অনেক আনন্দের দিন আসবে, দুঃখের দিন আসবে, একসাথে লড়াই করার প্রয়োজন পড়বে, আর সবকিছুর সাথে জড়িয়ে থাকবে এই দিনটার প্রাসঙ্গিকতা।
তুমি বড় হয়ে উঠছো রুহিন, আর আমি একটা নতুন ধরণের বন্ধুত্বের জন্যে অপেক্ষা করছি, যা আগে কখনও আমার আস্বাদ করা হয় নি।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৩ দুপুর ১২:২০