নভেম্বরের ২ তারিখ, ২০২৩ সাল। সেদিন আমার হোম অফিস ছিল। বাসায় বসে কাজ করছিলাম। বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাই নি কোনো কারণে। তিথি গেছে অফিসে। একটা সুন্দর,স্বাভাবিক দিন। হঠাৎ করে একটা ভয়াবহ দুর্ঘটনা সব এলোমেলো করে দিলো। আমার ছোটভাইয়ের ১১ মাস বয়সী ছেলে রঙিনের গায়ে গরম পানিসহ কেটলি পড়ল। তার পেট আর পায়ে ডিপ বার্ন হলো। মামনি এসে যখন আমাকে বললেন এই কথাটা, সেটা প্রক্রিয়া করতেই আমার বেশ খানিকটা সময় লেগে গেল। আমাকে বলা হলো হাসপাতালে যাবার জন্যে রেডি হতে। আমি রেডি হতে হতেই রঙিনকে নিয়ে যাওয়া হলো। আমি বাচ্চাদের নিয়ে বাসায় বসে ক্রিকেট খেলা দেখতে লাগলাম। রঙিনের ১৫% বার্ন হয়েছিল। ছোট একটা বাচ্চার জন্যে যা অনেক বেশি। তারপরেও সে দ্রুতই সুস্থতার দিকে যাচ্ছিল। এইচডিইউ থেকে কেবিনে নেয়ার কথাও হচ্ছিল। সেইসময় তার শরীরে ইনফেকশন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। সেপটিসেমিয়া হয়ে যায়। এর অর্থ, দ্রুত এই সংক্রমণ থামাতে না পারলে তার শরীরের সব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ আক্রান্ত হবে। তাকে আর বাঁচানো যাবে না। ১০ তারিখে অবস্থার চূড়ান্ত অবনতি হলে তাকে আইসিইউতে নেয়া হয়।
ভেতরের খবর কিছু জানা যাচ্ছিল না। তবে পরিচিত আত্মীয় এবং বন্ধু ডাক্তারদের মাধ্যমে ভেতরের খবর পাচ্ছিলাম। কেউ কোনো আশার কথা শোনাতে পারছিল না। রঙিনের মাকে ডাক্তার জিজ্ঞেস করেছিল “আর কোনো বাচ্চা আছে না কি”। আরেকজন ডাক্তার বলেছিল ১০% এর মতো সম্ভাবনা আছে বাঁচার। আইসিইউ এর বাইরে দুটো আসবাববিহীন ঘর আছে। একটায় থাকে পুরুষরা, আরেকটায় নারীরা। এমন একটা জায়গা, যেখানে কেউ হাসে না। ক্রমাগত কান্না আর বিলাপ চলতে থাকে। মাঝেমধ্যে হন্তদন্ত হয়ে ডাক্তার বা নার্স এসে কাউকে ডেকে নেয়,”অমুক রোগীর অবস্থা ভালো না, মন শক্ত করেন”। প্রায় প্রতিদিনই কেউ না কেউ মারা যায়। কান্না আর বিলাপ শেষ করারও সময় পায় না আত্মীয়স্বজনরা। মৃতকে নিতে হয় পোস্টমর্টেমের জন্যে। আগুনে পুড়ে মারা গেলে পুলিসি কেস হয়। কাটাছেড়া করে তারপর লাশ দেয়া হয়।
এরমধ্যে জানতে পারলাম, প্রথম দফায় যেসব এন্টিবায়োটিক দেয়া হয়েছিল, তার কোনোটাই কাজ করে নি। ঔষধ কাজ না করলে সংক্রমণ ছড়াতে থাকবে। আজরাইল এগিয়ে আসতে থাকল দ্রুতগতিতে। রঙিনের হাত-পা ফুলে গেল, শ্বাস নিতে পারত না সে অক্সিজেন সাপ্লাই ছাড়া। শরীরের একটা সমস্যা কমে গেলে আরেকটা শুরু হয়। প্লাটিলেট কমে যায়, রক্ত দিতে হয়, সেটা ঠিকঠাক হয়, তখন আবার পটাসিয়াম বেড়ে যায়। প্রতিদিন অবস্থার অবনতি হতে থাকে।
তিনদিন চলে যাওয়ার পর দ্বিতীয় রিপোর্টে অবশেষে জানা গেল যে একটা এন্টিবায়োটিক কাজ করছে। তখন থেকে তার অবস্থার একটু উন্নতি হতে লাগল। দীর্ঘ দুই সপ্তাহ আইসিইউতে থাকার পর তাকে এইচডিউতে নেয়া হয় আবার, তার দুইদিন পর কেবিনে। অবশেষে গতকাল সে বাসায় ফিরেছে।
এই দীর্ঘ সময়ে তার তিনটা মেজর অপারেশন হয়েছে, বাম পায়ের সবগুলি আঙ্গুলের কিছু কিছু অংশ চেছে ফেলতে হয়েছে। ওগুলিতে গ্যাংগ্রিন হয়ে গেছিল। অসহ্য যন্ত্রণাময় ড্রেসিং করতে হয়েছে অনেকবার। এত কষ্ট, এত ব্যথা সহ্য করে অবশেষে সে ফিরতে পেরেছে বাসায়। তার শরীরে কিছু Deformity রয়ে গেছে এখনও। ক্ষতিগ্রস্ত বাম পায়ের চামড়া ফেলে দিয়ে পিঠ থেকে চামড়া নিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হয়েছে। ফলে তার বাম পা এখনও কিছুটা বাকা হয়ে আছে। এটা ঠিক করতে বিশেষ ধরণের জুতা পরতে হবে। চেছে ফেলা আঙ্গুলগুলি জোড়া লেগে গেছে একে অপরের সাথে। এর জন্যে বছর কয়েক পর অপারেশন করতে হবে। এতকিছুর পরেও তাকে এই ঘটনার চিহ্ন সারাজীবন বহন করে নিতেই হবে শরীরে। তাতে কিছু এসে যায় না আমার। তার যখন জীবন সংকটাপন্ন, আমি শুধু চেয়েছিলাম সে যেন প্রাণে বেঁচে ফিরে আসে। অঙ্গহানি হলে হোক। হাত-পা ছাড়াও তো মানুষ বাঁচে, এবং সফল হয় জীবনে। আর এ তো আঙ্গুলের কিয়দংশ কেবল, আর কিছু বদখত পোড়া চামড়া। জীবনের বিপুল শক্তি আর সৌন্দর্যের কাছে ওসব কিছু না।
রঙিন যতদিন যুদ্ধ করে চলছিল মৃত্যুর সাথে, ততদিন আমি অনুভব করেছি আশার শক্তি। ওকে যখন আইসিউতে নেয়া হলো, তখন থেকেই আমার এই আশাবাদের শুরু। আমার বারবার মনে হতো, আইসিউতে নিয়েছে, এখন সার্বক্ষণিক ভালো চিকিৎসা পাবে, ও সেরে উঠবে, অন্তত বেঁচে ফিরবে। ভেতরে তো ঢুকতে পারতাম না, ওর বাবা-মা ঢুকে বের হবার পর তাদের মুখের ভঙ্গি , কথা বলার ধরণ, ফোনে কন্ঠ কখন কেমন শোনাচ্ছে, এর ওপর ভিত্তি করে নানারকম জল্পনা কল্পনা করতাম। একটু গম্ভীর মুখ দেখলেই পেয়ে বসত হতাশা আর আশঙ্কা, আর একটু স্বাভাবিকভাবে কথা বললে আমার মধ্যে বেঁচে থাকার আর কাজ করার শক্তি জড়ো হতো। ১০% সম্ভাবনা আছে বেঁচে ফেরার শুনলে মনে হতো, এখনও তো আছে সে, হারিয়ে যায় নি, যাবেও না এত তাড়াতাড়ি কোথাও।
এই কদিনে আমি বুঝতে শিখেছি, বেদনাকে অনুভব করতে হয়, এর মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়, এর থেকে আমরা কেউ পালিয়ে বাঁচতে পারব না। আমার মনে পড়ছে পাখি নামের সেই মেয়েটার কথা। পাঁচ বছর বয়স ছিল তার। রান্নাবাড়ি খেলতে গিয়ে আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছিল। কত কান্না, কত আহাজারি, কত আফসোস তাদের! মনে পড়ছে সায়েন্স এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে আগুনে পুড়ে যাওয়া ক্লাস এইটে পড়া সেই ছেলেটার কথা। তাকে লাইফ সাপোর্টে দেয়া হয়েছিল। বাঁচানো যায় নি। তার মাকে লাইফ সাপোর্টে দেয়ার কথা বলা হয় নি। তিনি বলছিলেন ঢাকা মেডিকেলে নিতে। ওখানে ভালো চিকিৎসা হবে। বৈদ্যুতিক তারে পুড়ে যাওয়া লোকটা কয়েক সপ্তাহ লাইফ সাপোর্টেই ছিল। তার সেই অবস্থায় ডায়ালিসিস চলছিল। জানি না সে বেঁচে আছে কি না। এক মা তার ছেলের মৃত্যু নিশ্চিত জেনে তাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে গিয়েছিল। যেন সে মরে যাবার পর লাশ নিয়ে মর্গে কাটাছেড়া করতে না হয়। যে কদিন বেঁচে আছে,মায়ের কাছে থাকুক।
এবার জরুরী কিছু কথা বলি। রঙিন ছিল শেখ হাসিনা প্লাস্টিক সার্জারি এন্ড বার্ন ইউনিটে। বাংলাদেশে এটাই একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল এই বিষয়ে। পুরো পৃথিবীতেই এরকম হাসপাতাল হাতে গোণা। এই ধরণের কেসে অবশ্যই এই হাসপাতালে নিয়ে আসবেন,আর কোথাও নিয়ে সময় নষ্ট করবেন না। বার্নের আইসিইউ এবং চিকিৎসা ব্যবস্থা আর মাত্র একটা হাসপাতালে আছে, সেটা হলো লালমাটিয়ার সিটি হসপিটাল। এখানেও নিতে পারেন। খরচ বেশি পড়বে। জটিল কেসে কখনই এই দুই হাসপাতাল ছাড়া অন্য কোথাও নিবেন না।
অগ্নিদগ্ধদের প্রাথমিকভাবে বাসায় স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি দিবেন। ঠান্ডা দেয়া যাবে না, গরম পানির তো প্রশ্নই ওঠে না।
আর সর্বোপরি, আগুন নিয়ে খেলবেন না। আগুনের সাথে পারবেন না। এখানে আইসিইউতে আসা রোগীদের একটা বড় অংশই শিশু। বেশিরভাগ দুর্ঘটনাই সাবধান হলে এড়ানো যেত। রঙিনের গায়ে পড়েছিল ইলেকট্রিক কেটলির গরম পানি, আর এর উত্তপ্ত নলটা। এসব জিনিস বাচ্চাদের থেকে নিরাপদ দূরত্বে রাখবেন। বাচ্চাদের ইলেকট্রিক সুইচ, মাল্টিপ্লাগ এসব থেকেও দূরে রাখবেন। আমরা আরাম আর আলস্যের কারণে নিরাপত্তাকে গুরুত্ব দেই না। বেশিরভাগ সময় কিছু হয়ও না। যেদিন হবে, সেদিন হয়তো বা এর মুল্য পরিশোধ করার সামর্থ্য আপনার থাকবে না। কোনোকিছুর বিনিময়েই না।
গত দুই মাসের বেশি সময় একটা ভয়াবহ বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। সেই বিপর্যয়টা কেটে গেছে। জীবন আবারও স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। আর আমার মধ্যে এনে দিয়েছে একটা স্থায়ী পরিবর্তন। আসল দুঃখ আর নকল দুঃখের মধ্যে পার্থক্য বুঝেছি আমি। বুঝতে শিখেছি জীবনের কোন বিষয়গুলি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বই পড়ে বা সিনেমা দেখে এসব শেখা যায় না। এর জন্যে এই ধরণের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়। আমরা যতই সুখ এবং শান্তিতে থাকি না কেন, একদিন এর ব্যত্যয় ঘটবেই। বেদনা এসে ছোবল দেবেই। এর থেকে আমাদের কারোই মুক্তি নেই। তবে আমি যেভাবে এর মুখোমুখি হয়েছিলাম, সেই অভিজ্ঞতা যেন কারো না হয় এটাই প্রার্থনা।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জানুয়ারি, ২০২৪ রাত ১১:৫৯