somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

টিনেজারের চিঠি

৩০ শে আগস্ট, ২০১৪ বিকাল ৩:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মা/বাবা,
হ্যাঁ, আমার ভীষণ অস্থির অস্থির লাগে। যখন তোমাদের সেটা বলতে চেষ্টা করি, তোমরা বল "তো কী করা যাবে!!" আমার ইচ্ছা করে চিৎকার করে তোমাদের বলতে "আমার সত্যিই ভীষণ অস্থির লাগে!!" কিন্তু তোমরা তো শুনবে না, তাই না?
হ্যাঁ আমার বয়সটা নাকি তোমরাও পার করেছো– তোমাদের নাকি এমন লাগেনি। নানা নানী, দাদা দাদী কারুর এত সময়ও ছিল না তোমাদের জন্য, আর তোমাদেরও মনেহয়নি যে বাবা মায়ের সাথে এসব বলা যায়। আচ্ছা, তোমরা কি আমার কথা শুনতে পাও?? আমি কিন্তু আমার কথা বলছি, তোমাদের ছোটবেলার কথা না!! তোমাদের বারো বছরে তোমরা আই ফোন নিয়ে কথা বলতে না। চোদ্দতে জানতে না abortion করানো কী জিনিস। আমরা কিন্তু বলি। আর, জানিও! এখন বল, তোমরা আর আমি কি এক??
ক্লাসের ছেলে মেয়েদের সাথে নাকি মিশতে পারবো না। অমুকের বাবা মার ব্যাকগ্রাউন্ড খারাপ, তমুকের পরিবার ভালো না। আরেকজনকে নাকি দেখলেই বুঝতে পারো ওর পরিবারে প্রবলেম আছে। আচ্ছা, কারুর সাথেই যদি মেশা যাবে না, আমাকে এই স্কুলে রেখেছো কেন?? কোথাও রাখবে আবার বলবে কোনও ফ্রেন্ড থাকতে পারবে না– কেন?? তোমরাও তো আমার সাথে কথা বল না, ভাইয়া আপাও কথা বলতে গেলে রুম থেকে বের করে দেয়। আমি কোথায় যাবো বলতে পারো??
মা বলে "আজীবন করে গেলাম, আদর করে প্রমাণ করতে হবে নাকি যে বাচ্চাদের ভালবাসি??" হ্যাঁ করতে হবে প্রমাণ। মাঝে মাঝে আমার জানতে মন চায় আমি তোমাদের কাছে দামী। বুঝতে মন চায় যে তোমরা আমাকে ভালবাস! আমি ভুল করলে তো তোমরা আমার মাঝে অকৃতজ্ঞতা দেখতে পাও, দেখতে পাও আমি বেয়াদব। তোমরা সারাক্ষণ বকো আমাকে– সুন্দর করে একটু কথা বল না। তবু আমাকে তোমাদের দেয়া ধমকেই তোমার ভালবাসা আছে সেটা মানতে হবে??
তোমরা বল আমাকে নাকি অনেক বিশ্বাস কর, অথচ কেউ ফোন করলেই রাগারাগি কর "এত কিসের কথা?!" আমাকে যদি বিশ্বাসই কর, তাহলে এমন কর কেন?? বারান্দায় আজীবন গিয়েছি, সেদিন যেতেই বাবা ইরা আর সুমনের সামনে ধমক দিল "তোর এখনো বারান্দায় দাঁড়িয়ে তারা দেখার বয়স হয়নি, ভেতরে যা!!" কেন, ওদের সামনে কেন– আমি কি মানুষ না?? ওরা আমার ছোট না??
আমি বায়োলজি মিসের কথা কিচ্ছু বুঝি না। রেজাল্ট খারাপ হল। মিস বললেন "এই বয়সটা একটু খেয়াল রাখবেন" আর তোমরা এসে বলেই ফেললে আমি প্রেম করছি! এই নিয়ে কত কথা বলে ফেললে। জানতে চেয়েছিলে এর আগে বা পরে একটা বারও, যে সব বিষয়ে ভালো করার পরও এই একটাতে কেন খারাপ করলাম?? প্রেম করলে তো সবগুলোতেই সমস্যা হওয়ার কথা?? জানো তোমরা, সেদিন রাতে আমি দাদীর ঘুমের ওষুধ চুরি করে খেয়েছিলাম? দশটা খাওয়ার সাহস হয়নি, পাঁচটা খেয়েছিলাম। কিছু হয়নি, তিন দিন ঘুমিয়েছি কেবল। সেটা নিয়েও বকেছো– সারারাত কী করি যে সারাদিন ঘুমাই। হয়ত আমি মরে গেলে বরং আমার জন্য একটু কাঁদতে তোমরা, তাই না?
সবসময় আমাকে বল তোমরা আজীবন আমার জন্য এই এই করেছো, আমি তার বদলে এত অশান্তি করছি। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে– আমি যখন ছোট ছিলাম, ফটোতে দেখেছি আমার পা ফেলা দেখে মা হাত তালি দিচ্ছেন। মায়ের ওই হাসিটা কি আনন্দের হাসি ছিল নাকি সেটাও আমার জন্য মায়ের "কর্তব্য" ছিল? আমি কি তোমাদের কোনদিন আনন্দ দেইনি, হাসাইনি?? আমার জন্য কি তোমাদের জীবনটা আনন্দে ভরে যায়নি কোনদিন যেমন সুমি আপু বলে তার ছেলেটা নাকি তার জীবন ভরে দিয়েছে আনন্দে?? তাহলে সবসময় এমন করে কেন বল যেন আমি তোমাদের জন্য বোঝা, আজীবন বোঝাই ছিলাম?? আমাকে কি তোমরা ভালবাস না??
তোমরা বল তোমরা নাকি আমাদের কথা বুঝ না। ফ্রেন্ডদের মুখে শুনেছি এটাকে নাকি জেনারেশান গ্যাপ বলে। বাবা মা আর বাচ্চাদের মাঝে নাকি ওটা থাকেই। তাই যদি হয়, তাহলে ফুপু কেন তার ছেলে মেয়েদের সাথে বন্ধুর মত কথা বলে?? গ্যাপ তো তখন হয় যখন কথা বলার চেষ্টা করার পরও কিছু বুঝা যায় না। তোমরা কোনদিন আমার সাথে কথা বলেছ যে গ্যাপের প্রশ্ন আসবে অথবা প্রশ্ন আসবে আমাকে না বুঝার? তোমরাই তো বল বাবা মা নাকি সন্তানের মন খুব ভালো বুঝে– তাহলে আবার বল কেন আমাকে বুঝতে পারো না?? বুঝার চেষ্টা কোনদিন কর নাই, তাই বুঝতে পারো না। বুঝতে চাও না তোমরা!!
আমার অস্থির লাগে। মনেহয় তোমরা আমার আসল মা বাবা না। তোমরা কেউ আমার আপন না। আমার পালিয়ে যেতে ইচ্ছা করে। মাঝে মাঝে মরে যেতেও মন চায়। আমাকে কেউ ভালবাসে না। কেউ না! হ্যাঁ আমি বেয়াদব, আমি খারাপ, আমি তোমাদের ওপর বোঝা। আমি কই যাই, কী করি এই নিয়ে তোমাদের অনেক চিন্তা। আমি খারাপ, খুব খারাপ! শুধু আমি ছাড়া এই বাসায় আর কেউ জানে না আমিও একটা মানুষ! আমারও মন আছে, কথা আছে!! আমার ইচ্ছা করে আমাকে কেউ বুঝুক!
না, তোমাদের কাছে আমি মানুষও না, মনেহয় তোমাদের সন্তানও না। তোমাদের শত্রু আমি! হ্যাঁ, আমিও তাই সুন্দর করে কথা বলতে পারিনা তোমাদের সাথে, আমারও তোমাদেরকে শত্রু শত্রুই মনেহয়! খালি মাঝে মাঝে যখন রাতে একা একা কাঁদি, খুব মনেহয় মা যদি একটা বার আমাকে জিজ্ঞেস করত আমার মন খারাপ কেন, আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতাম!! সত্যি কথাটা তোমরা কোনদিন স্বীকার কর না, করবেও না– যে কেবল তোমরা আমাকে ভালবাস না, আমিও তোমাদেরকে ভালবাসি!! সত্যিই ভালবাসি!
ইতি–
"আমি"
————————————————————————————–
যদি আপনাদের মনেহয় কথাগুলো বড্ড বেশী কাল্পনিক হয়ে গেল, তাহলে বলতে বাধ্য হব যে আপনারাও হয়ত উঠতি বয়সের বাচ্চাদের সমস্যাগুলো কোনদিন "রিয়েল" বলে ভাবেন না! আমি প্রচুর টিনেজারের সাথে কথা বলেছি। নিজের ওই বয়সটাও মনে আছে, মনে আছে ফ্রেন্ডদের কথাও। আর আজকাল আমার ছোট্ট মেয়েটাকে দেখেও এই কথাগুলোই মনেহয়।
একটা কথা মনে রাখতে হবে যে আমাদের যেমনই মনে হোক, ওদের কাছে ওদের সমস্যাগুলো কিন্তু অতি মাত্রায় বাস্তব। আর আমাদের চোখে ওরা ছোট বাচ্চা হলেও ওদের নিজেদের চোখে ওরা একেকজন বিশিষ্ট মানুষ!! এবং বিশ্বাস করুন, উপরের চিঠিটি কাল্পনিক না!! বিভিন্ন টিনেজারের সাথে কথা বলে বলে ওদের মন নিয়ে যেই ধারণা পেয়েছি তাতে আমার মনে হয়েছে যে ওরা যদি কথা বলত এই নিয়ে, এভাবেই বলত!! ওদের মনে অনেক কথা আছে, আছে অসংখ্য ব্যথা!! আপনার কাছে সেগুলো "সেন্স" না রাখলেও, ওদের কাছে রাখছে!! তাই ওদেরকে বুঝার চেষ্টা করতে হবে!! কিভাবে– সে নাহয় আবার কখনো এই নিয়ে লেখার সুযোগ হলে বলবো– এক কথায় বলাও সম্ভব না এসবের সমাধান! কিন্তু আসুন অন্তত একটা কথা আমরা বুঝতে চেষ্টা করি– যে সমস্যা সত্যিই আছে। কেবল ওদের না, বাবা মা হিসেবে আমাদেরও। ওদের সেই সমস্যাটাকে দাম না দেয়াটাই আমাদের প্রধান সমস্যা!! যখন আমরা বুঝবো ওরা কী ভাবে, কিভাবে ভাবে, তখনই কেবল আমরা সমাধান খুঁজবো, তাই না?
এই চিঠিটা অতিকাল্পনিক তো নয়ই, বরং আমি কমই তুলে ধরতে পেরেছি ওদের মনের কথা। যেসব পরিবারে বাবা মায়েরা ভাবেন যে ওদের আলাদা মনোযোগের প্রয়োজন নেই, সাধারণত সেসব পরিবারের বাচ্চারা এভাবে ভাবে! এবং এক্সট্রিম কাজগুলোও করে বসে, যেমন সুইসাইড করার চেষ্টা! অনেকেই আমরা মনে করি বাচ্চা বড় করা মানেই যত্ন নেয়া। সত্যিই তাই– কেবল যত্নটা খালি পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন এ শরীরে গেল কিনা আর ক্যালসিয়াম পেল কিনা ওতেই থাকে না, যত্নটা মনেরও নিতে হয়! অসংখ্য টিনেজার দেখেছি এমন যারা ছোটবেলায় অবহেলা পাওয়ার কারণে বড় হয়েও বাবা মায়ের প্রতি সম্মান রাখতে পারে না। ব্যাপারটা দুঃখজনক। না, অবশ্যই ওদের বাবা মায়েদের ভালবাসায় এতটুকু কমতি ছিল না। কমতি ছিল বাবা মেয়ের এই উপলব্ধির যে তাঁদের ছোট্ট পাখির বাচ্চাগুলো এখন বড় হচ্ছে, ওদেরকে আর ছোটদের মত সামলানো যাবে না, ওদের পাশে দাঁড়াতে হবে! ওদের অর্থহীন ব্যথায় হাত বুলাতে হবে, হঠাত ফুলে ফেঁপে ওঠা আত্মসম্মানবোধকে মাথায় রাখতে হবে। ওদের "বিশাল" (!) সব সমস্যাকে সমস্যা হিসেবেই দেখতে হবে!! আর সবচেয়ে আগে বুঝতে হবে যে ওদের সমস্যা হচ্ছে!!
এড়িয়ে গিয়ে, উড়িয়ে দিয়ে কোনও সমস্যার সমাধান আসে না!! তাই সবার আগে আমাদের মেনে নিতে হবে যে এই সমস্যাগুলো বাস্তব, এবং they need to be addressed।
নাহলে, এমন দিন আসতে পারে যেদিন প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে, কথায় হোক বা লেখায় অথবা কাজে, আপনার আমার সন্তান এমন একটি চিঠি আপনার আমার উদ্দেশ্যে রচনা করে বসবে! বাবা মা হিসেবে এমনটা কল্পনা করলেও পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যায়, তাই না? না, সেদিনটি আমাদের কল্পনা করার দরকার নেই ইনশাআল্লাহ। আসুন তার আগেই আমরা সচেতন হই আমাদের ভবিষ্যৎ "টিনেজার" সন্তানদের ব্যাপারে!
- নায়লা নুযহাত

১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

নারী একা কেন হবে চরিত্রহীন।পুরুষ তুমি কেন নিবি না এই বোজার ঋন।

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ রাত ১২:৫৪



আমাদের সমাজে সারাজীবন ধরে মেয়েদেরকেই কেনও ভালো মেয়ে হিসাবে প্রমান করতে হবে! মেয়ে বোলে কি ? নাকি মেয়েরা এই সমাজে অন্য কোন গ্রহ থেকে ভাড়া এসেছে । সব... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুসলিম কি সাহাবায়ে কেরামের (রা.) অনুরূপ মতভেদে লিপ্ত হয়ে পরস্পর যুদ্ধ করবে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৯




সূরাঃ ৩ আলে-ইমরান, ১০৫ নং আয়াতের অনুবাদ-
১০৫। তোমরা তাদের মত হবে না যারা তাদের নিকট সুস্পষ্ট প্রমাণ আসার পর বিচ্ছিন্ন হয়েছে ও নিজেদের মাঝে মতভেদ সৃষ্টি করেছে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদে মসজিদে মোল্লা,ও কমিটি নতুন আইনে চালাচ্ছে সমাজ.

লিখেছেন এম ডি মুসা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

গত সপ্তাহে ভোলার জাহানপুর ইউনিয়নের চরফ্যাশন ওমরাবাজ গ্রামের এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। লোকটি নিয়মিত মসজিদে যেত না, মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েনি, জানা গেল সে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসী ছিল, স্বীকারোক্তিতে সে... ...বাকিটুকু পড়ুন

=সকল বিষাদ পিছনে রেখে হাঁটো পথ=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৮



©কাজী ফাতেমা ছবি

বিতৃষ্ণায় যদি মন ছেয়ে যায় তোমার কখনো
অথবা রোদ্দুর পুড়া সময়ের আক্রমণে তুমি নাজেহাল
বিষাদ মনে পুষো কখনো অথবা,
বাস্তবতার পেরেশানী মাথায় নিয়ে কখনো পথ চলো,
কিংবা বিরহ ব্যথায় কাতর তুমি, চুপসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিরোধী মতের কাউকে নীতি মালায় নিলে কি সত্যি আনন্দ পাওয়া যায়।

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৪ ঠা মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৮

ব্লগ এমন এক স্থান, যেখানে মতের অমিলের কারণে, চকলেটের কারণে, ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে অনেক তর্কাতর্কি বিতর্ক কাটা কাটি মারামারি মন্তব্যে প্রতিমন্তব্যে আঘাত এগুলো যেনো নিত্য নৈমিত্তিক বিষয়। ব্লগটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×