somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাবাদা 'কালো'; আর আমরা 'বর্ণবাদী'

২৫ শে জুলাই, ২০১৫ দুপুর ১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এদেশের রাজনৈতিক হানাহানির সময় আমি খুব ভয়ে থাকি। আমার ভয় লাগে এই জন্য যে, আমাদের নোংরা রূপটা যেন দেশের বাহিরে প্রদর্শিত না হয়। অপরাধ করার অবাধ সুযোগ পেলে আমাদের মানুষগুলো কেমন থেকে কেমন হয়ে যায়, রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে আমরা যেসব পাশবিকতার চর্চা করি- সেগুলো শুধু আমাদেরই জানা থাক। বাংলাদেশের বাহিরের মানুষজন যেন সেগুলো না জানে।
তাই ভারত-বাংলাদেশ পারস্পরিক সম্পর্কের কথা উঠলে যখন কোলকাতার রাজনীতিকরা বাংলাদেশের টালমাটাল রাজনৈতিক অবস্থাকে কটাক্ষ করে উক্তি দেন, তখন অপমানে আমার মাথা নিচু হয়ে যায়, সারাদিন আর কারও কাছে মুখ দেখাতে ইচ্ছে করে না।

যখনই বাংলাদেশে কোন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলুড়ে দল সফরে আসে, তখনই আমার মনে একটা শঙ্কার জন্ম নেয়। এই ভীনদেশী মানুষগুলোর মর্যাদা আমরা দিতে পারবো তো? আমাদের মানুষগুলো যতটা বেপরোয়া- এরা পুলিশ-র‌্যাব কাউকেই তো ভয় করে না। সফরে আসা ক্রিকেটারদের সাথে যদি আমরা এরকম কিছু একটা হঠাৎ করে বসি? সম্মানটা তাহলে কোথায় থাকবে?

তারথেকেও বড় ভয় লাগে, যখন ভাবি- এরকম কোন কাজের জন্য ক্রিকেট বিশ্বে আমাদের অবস্থা যদি পাকিস্তানের মত হয়ে যায়? আমাদের উন্মাতাল লোকজন সফরকারীদের উপর হামলা করে বসল। সফরকারীরা নিরাপত্তার অযুহাতে সফর বাতিল করে দেশে চলে গেল। তারপর আইসিসি বাংলাদেশকে নিরাপত্তাহীনতার কারনে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ আয়োজন করা থেকে নিষিদ্ধ করল! গায়ে কাটা দেয়ার মত চিন্তা আমার!

অভিযোগ উঠেছে দক্ষিণ আফ্রিকা দলে একজন খেলোয়াড়, কাগিসো রাবাদাকে বাংলাদেশের দু’জন দর্শক `Black` বলে কটাক্ষ করেছে। এটা নিঃসন্দেহে বর্ণবাদী আচরণ। যারা এটা করেছে তারা নাকি আবার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। অবাক হবার মাত্রাটা বোধহয় তাই বেড়েও যাচ্ছে। গোটা পৃথিবীতে আজও এই বর্ণবাদ নিয়ে কি পরিমাণ আলোচনা এবং সহিংসতা হয়, তা হয়ত আমাদের অনেকের কাছেই অজানা। এই বর্ণবাদী সহিংসতা আর বিতর্ক থেকে যুক্তরাষ্ট্রও কিন্তু পরিত্রাণ পায় না। আমেরিকার বাল্টিমোর শহরে এবছর এপ্রিলে পুলিশ এক কৃষ্ণাঙ্গকে মেরে ফেলে। তারপর থেকেই সেখানে চলে বিভৎস প্রতিবাদ আর সহিংসতা। আমেরিকার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সে প্রতিবাদ দমাতে পারেনি। যুক্তরাষ্ট্রের মত একটি সভ্য দেশের লোকজনও বন্য হয়ে উঠতে পারে। কেন? বর্ণবাদ ইস্যুতে। এরপর The Atlantic এ Letter To My Son নামের একটা লেখা প্রকাশিত হয়। লেখাটা পড়লে যুক্তরাষ্ট্রীয় বর্ণবাদীতার অন্ধকার জগৎটা পরিষ্কার হবে বলে আশা করা যায়।

তাই যুক্তরাষ্ট্রে থাকলেই একজন মানুষ বর্ণবাদ নিয়ে খুব সচেতন হবে বা এমন কোন আচরণ করবে না, এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে বর্ণবাদের সবথেকে কালো রূপটা দেখেছে এই দক্ষিণ আফ্রিকাই। এরাই একসময় বলেছিল, কালোদের বিপক্ষে ক্রিকেট খেলবে না। ফলে ১৯৭০ থেকে ৯১, একুশ বছর নিষিদ্ধ থাকে এরা। আবার এদেরই একজন সারাজীবন বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়ে গেছেন। তাঁর নাম আমরা সবাই জানি। পৃথিবীতে যে অল্পসংখ্যক মানুষকে বিনাবাক্যে সবশ্রেণীর মানুষ শ্রদ্ধা করে, তিনি তাদের মধ্যে একজন- তিনি নেলসন ম্যান্ডেলা।


এসব অনেক পরের কথা। আমরা কোন প্রেক্ষাপটে `Black` বলে গালি দেই, সেটা একটু ভাবা দরকার। বাংলাদেশের মানুষজন ইংরেজদের মত ধবধবা ফর্সা না। বরং অনেকেই কালো। অনেকক্ষেত্রেই আমরা যাদেরকে ফর্সা বলি, পশ্চিমা বিশ্বের কাছে সেটা তেমন কোন ফর্সা রঙ নয়। সেই বিচারে কিছু ব্যতিক্রম বাদে আমরা মোটামুটি কালো মানুষেরই দেশ। তাই আমাদের অন্যদেরকে `Black`বলে গালি দেয়াটা সবদিক থেকেই অনুচিত। তার থেকেও বড় অনুচিত কাজ এমন নোংরা মানসিকতা ভেতরে পোষণ করা। যে মানুষ আরেকজন মানুষকে `Black` বলে গালি দিল, তার মনটাই তো সবথেকে বড় কালিমায় ভরা। আমাদের সমস্যাটা আসলে এত গভীরে না। আমরা পশ্চিমা বিশ্বের মত বর্ণবাদী না। এমন মনোভাব আমরা পোষণও করি না। তবে এটা ঠিক যে আমরা বর্ণবাদের মত একটা সেনসিটিভ ইস্যু সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞানও রাখি না। আমরা হরহামেশাই একে-ওকে ‘কালো’ বা এর কোন সমার্থক নামে গালি-গালাজ করি। কিন্তু বিদেশী একজন খেলোয়াড়কে `Black` বলে গালি দেয়া মানে ঠিক কি বা তার প্রভাব কতদূর বিস্তৃত হতে পারে- তা আমরা জানি না।

আর এই অজ্ঞানতার সুযোগ আমাদের বন্ধুপ্রতীম প্রতিবেশী দেশগুলোর ততোধিক বন্ধুসুলভ মানুষেরা কতটা নোংরাভাবে গ্রহণ করছে, তা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মাধ্যমে প্রকাশিত খবরের নিচের মন্তব্যগুলো পড়লেই বোঝা যায়। কেউ কেউ বলছে, ‘Bangladesh is a land of terrorist’, আবার কেউ লিখছে, ‘ICC should ban Bangladesh’- এই জাতের অনেক কিছু। সেগুলো দেখে মন খুব খারাপ হয়ে যায়। আবার মজার ব্যাপারও ঘটে। যেমন, বাংলাদেশকে যে লোকটি 'land of terrorist' বলে কটাক্ষ করেছে সে নিজে একজন পাকিস্তানি। একজন পাকিস্তানি মানুষ বাংলাদেশকে 'land of terrorist' বলছে। ব্যাপারটা সত্যিই হাস্যকর। এদিক থেকে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষজন যথেষ্ট ভালো। ওয়ানডে সিরিজ হারের পর কোথাও বাংলাদেশ নিয়ে তাদের কোন কটাক্ষ দেখা যায় নি। বরং তারা বাংলাদেশকে প্রশংসাতেই ভাসিয়েছে।


খেলোয়াড়দের গাড়িতে ঢিল মারা, নাসির-সাকিবের ফেইসবুক পোস্টে বাজে মন্তব্য করা- এগুলো সত্যি আমাদের দীনতার পরিচয় দেয়। আর এগুলোর সুযোগ নেয় আমাদের তথাকথিত বন্ধুরা। সুধীর গৌতমের উপর আদৌ কোন হামলা হয়েছিল কি না, তার কোন প্রমাণ নেই, লোকটি নিজেও বলেছেন যে এমন কিছু হয় নি, কিন্তু ভারতীয় মিডিয়ায় খবরটি শতভাবে প্রচারের একাংশও বাদ থাকেনি।

আমাদের ক্রিকেটই আমাদেরকে আন্তর্জাতিক মাধ্যমে পরিচিত করে তুলেছে। আমরা যত বেশি আন্তর্জাতিকতা লাভ করব, আমাদের ব্যবহারের উপর তার প্রভাব তত বেশি করে পড়বে। আগে আমরা কি করলাম না করলাম, সেটা নিয়ে খুব বেশি মানুষ মাথা ঘামাতো না। কিন্তু এখন বাংলাদেশী কেউ কোন মন্তব্য করলে তা অনেক গুরুত্ব নিয়ে পড়া হয়, ভাবা হয়। মাঠে আমরা কি করি না করি, সেগুলো নিয়ে আন্তর্জাতিক আঙ্গিনায় অনেক আলোচনা হয়। অর্থাৎ, ক্রিকেটে আমরা যত উন্নত হব, আমাদের আচরণও তত উন্নত হতে হবে; ক্রিকেট আমাদেরকে যত মাহাত্ম্য এনে দেবে, আমাদের কথা-বার্তার গুরুত্বও তত বাড়বে। এটাই স্বাভাবিক। এই বোধটুকু দ্রুত আমাদের ভেতরে গেঁথে নেয়া খুব প্রয়োজন। আমাদের একটা কথা এখন গোটা দেশকে প্রতিনিধিত্ব করছে। সেই একটা কথা আমাদেরকে সবার শ্রদ্ধার পাত্র করতে পারে, আবার সেই একটা কথাই আমাদেরকে ‘বর্ণবাদী’ তকমা দিয়ে দিতে পারে। আর তার ফলাফল হতে পারে খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। রাবাদাকে ‘Black’ বলার জন্য ম্যাচ রেফারি যদি সত্যি সত্যি চট্টগ্রাম টেস্ট বন্ধ করে দিতেন, তার প্রভাব কতদূর গড়াত তা ধারণাও করা যাচ্ছে না। অনেকটা সময় গড়িয়ে গেছে, আমাদের জন্য এই ভুলগুলো এখন শুধু ভুল নয়, রীতিমত অপরাধ। বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য এই অপরাধের বৃত্ত থেকে যেভাব্ হোক আমাদের বের হয়ে আসতেই হবে।।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:৫৪
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×