somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সন্ধ্যেবেলার গল্প

৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গল্প ১

নীলা স্কুল থেকে ফিরে দেখতে পেল তাদের ঘর-বাড়ি কারা যেন তছনছ করে দিয়েছে। ঘরের থালা-বাসন থেকে শুরু করে বাক্স-পেটরা সব নিয়ে পালিয়েছে কিছু লোক। শুধু তাদের বাড়ি নয়, আশেপাশের যে ক’টি হিন্দু পরিবার ছিল, সবক’টি পরিবারেই এমন আকাল। কোথায় গিয়ে থাকবে, সে সাহায্য করবে- কেউ জানে না। নীলার বাবা বলছে- কি লাভ সম্পত্তি বাড়িয়ে এখানে। চলো, চলে যাই। বলতে বলতে কেঁদে ওঠে সে। পাশের বাড়ি থেকে এক মহিলা এসে ধমক দিল- কি করেছ তোমরা যখন ওরা তোমাদের বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে দিল? তোমরা কি পারতে না লাঠি নিয়ে বেরোতে? প্রতিবাদ করতে? পঞ্চাশটা ঘরে কি পঞ্চাশটা পুরুষও ছিল না?

আবার রাত হল। ভাঙ্গা ঘর-দোর। তাতেই মাথা গোঁজা। আবার আক্রমনের ভয়।

গভীর রাতে মাইক থেকে আওয়াজ হল। “… এরা শত্রু। এরা কাফের। এরা গণিমতের মাল। এদেরকে ধ্বংস করা পবিত্র দায়িত্ব…”
নীলার বাবার মনে পড়ল একাত্তরের কথা। তখন এমন কথা শোনা যেত। প্রতিবাদ করার কেউ ছিল না। আজও নেই। অথচ আমরা স্বাধীন।


গল্প ২

আক্কাস সাহেবের হার্টের রোগ। আঘাত সহ্য করতে পারেন না। তবে একটা অলৌকিক ব্যাপার ঘটে গেছে এর মধ্যেই। তার বড় মেয়েকে রাস্তায় একটা বখাটে ছুড়ি দিয়ে খুন করে ফেললেও তার হার্ট এখনও বেশ শক্ত আছে। খারাপ কিছু হয় নি।

ছোট মেয়ে, রূপা, ঘটনার পর থেকে তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ। ঘরেই কাজ, ঘরই পৃথিবী। রূপার এ বদ্ধ জগৎ সহ্য হয় না। সে প্রজাপতির মত স্বাধীনতা চায়। কিন্তু বাবার কড়া বারণ। আর বাহিরে বখাটের ভয়। তাহলে কি বিয়েই ভরসা? একটা রঙ্গিন জীবনের স্বপ্ন কি এভাবেই শেষ হয়?

রূপা বাড়ি থেকে বের হবে। সে মানবে না কোন ভয়ের হুংকার। তার বড় বোনের হত্যাকারীকে ধরা হয়েছে। কিন্তু হত্যাকারীর সাঙ্গ-পাঙ্গরা এতে খুব খেপেছে। রূপা তা জানে। তবুও তার ভালো লাগে না ঘরে বসে থাকতে। সে পৃথিবীর সাথে চলতে চায়। এভাবে বেঁচে থাকা যায় না। এটা কোন জীবন না।

রূপা ভয়ে ভয়ে ঘর থেকে বেরোয়। আশে-পাশে কেউ নেই। পথ চলতে লাগল একা একা। কি আনন্দ, শান্তি! রোদের আলো কত মধুর! রূপার ইচ্ছে হল লাজ-লজ্জা ভুলে ছুটতে। কতদিন পর আজ সে স্বাধীন। স্বাধীনতার কি শান্তি!

রাস্তার মোড়েই ছিল সন্ত্রাসীরা। রূপা ছুটছে। প্রাণপণে। স্বাধীনতার জন্য নয়। বাঁচার জন্য। হঠাৎ সে আছড়ে পড়ে। ঠোঁট ফেটে নোনা রক্ত জিহ্বায় লাগে। পেছনে ঘিরে আসে কিছু জানোয়ার। তারপর সব অন্ধকার।


গল্প ৩

অফিস থেকে ফেরার পথে হঠাৎ জাহাঙ্গীর আলমের ফোন বেজে ওঠে। তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। অবস্থা ভালো নয়। প্রচুর রক্ত দরকার। লিকুইড ক্যাশ দরকার। জাহাঙ্গীর সাহেবের মাথা আর কাজ করছে না। পাবলিক বাসের গ্যারান্টি নেই। রাস্তায় অসম্ভব জ্যাম। বাস থেকে নেমে তিনি টেক্সি ক্যাব ভাড়া করলেন। কিন্তু আজকে রাস্তায় যেন জ্যামটা অস্বাভাবিক। এমন তো হয় না। তবে আজ কেন এমন হল, আর আজই হতে হল? জাহাঙ্গীর সাহেবের কপালে হাত। ফোনে যোগাযোগ করে রক্ত জোগানোর চেষ্টা করছেন। এই সময়ে স্ত্রীর পাশে থাকার কোন বিকল্প নেই তার জন্য। কিন্তু কি করে যাবেন? পায়ে হেঁটে তো আর যাওয়া যায় না। রাস্তায় শত-শত গাড়ি-বাস, কেউ নড়ছে না। আধা ঘন্টা হয়ে গেল। আসলে হয়েছে কি?

জানা গেল, বিদেশ থেকে কে যেন দেশে আসছেন, অনেক টাকা-পয়সা নাকি তিনি দেবেন, বিশাল ব্যাপার-স্যাপার। তাঁর আগমন উপলক্ষে রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে পুলিশ। তিনি যতক্ষণ না যাবেন, ততক্ষণ এভাবেই থাকতে হবে সবাইকে।

জাহাঙ্গীর সাহেবের মাথায় ঘাম পায়ে পড়ছে টপটপ করে। চারপাশটা এত গোলমেলে আর অসহ্য এর আগে কখনও লাগে নি। টেক্সি ক্যাবের ছোট্ট ঘরটিতে তিনি ছটফট করছেন। বুকের বাঁ পাশে একটা চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। মাথাটা খুব ধরেছে। মোবাইলটা বিশ্রী স্বরে বেজে উঠল। তিনি কথা বলার শক্তি পেলেন না। সামনটা অন্ধকার হয়ে এল তার।

নিজেকে আবিষ্কার করলেন বাড়ির বিছানায়। তখনও শরীরটা বেশ দুর্বল। মাথাটা ধরে আছে। কষ্টে উঠলেন। মনে পড়ে গেল তার সবকিছু। জানলেন, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে প্রাণে বাঁচেননি তার স্ত্রী। সময়মত যথেষ্ট রক্ত জোগানো সম্ভব হয় নি। তবে তার চাঁদের মত ফুটফুটে একটি মেয়ে হয়েছে। সেই মেয়েটিকে বুকে জড়ালেন জাহাঙ্গীর সাহেব- শপথ নিলেন, ‘ও চাঁদের কণ্যা, তোমাকে আমি এখানে রাখব না। এই রাস্তায় তোমাকে আমি মলিন হতে দেব না।’

পরের বছর জাহাঙ্গীর সাহেব সব বেঁচে বিদেশে পাড়ি জমালেন। বলা বাহুল্য, তিনি আর কখনও এদেশে ফিরবেন না। দেশের কি কি উন্নয়ন হল, সেগুলো তিনি ও তার চাঁদের কণ্যা নিজ চোখে কখনও দেখবেন না।

……………………………………………………………………………………………………………………………..



এটা ২০১৬’র সন্ধ্যেলগ্ন। হাতে আর একদমই সময় নেই। অল্প কয়েক ঘন্টা পরেই ২০১৭। শেষবেলাতে মন বিষন্ন হয়, সবারই। অনেক চাওয়া-পাওয়ার হিসেব মেলাতে গিয়ে নিজেকে খুব অসহায় লাগে। সেই অনুভবের হীনমন্যতায় আজকের এই গল্পগুলো। দেশের উন্নতি হচ্ছে, উন্নতি হোক- এ আমাদের সবার চাওয়া। যান-মালের নিরাপত্তা কিংবা অবাধ চলাচলের স্বাধীনতা হরণ করা জাতির আত্মায় উন্নয়ন হয় না। রাস্তা-ঘাট বা ব্রিজ নির্মান যাতায়াতের সময় কমায়, কিন্তু চেতনার শক্তি বাড়ায় না। আমি কোন অত্যাচারিতের নাম বলব না। কোন ঘরহারা সংখ্যালঘুর বর্তমান অবস্থাও বলব না। বলছি শুধু আমাদের একেবারে মৌলিক আদর্শগুলির কথা, দেশ স্বাধীনের পর প্রত্যেকটি বাংলাদেশী নাগরিক যা মনে-প্রাণে ধারণ করেছিল। ২০১৭ অনেক সম্ভাবনার- সব দিক থেকেই। আমি আশা হারাই না। ২০১৭’র সন্ধ্যে বেলার গল্পগুলো নিশ্চয়ই কান্নামাখা হবে না।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে ডিসেম্বর, ২০১৬ রাত ৯:১৫
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×