ইউরোপের শিল্পোন্নত দেশ জার্মানির দিকে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ান-আফগান-ইরাকি শরণার্থীদের স্রোতের মতো ছুটে আসার সঙ্গে সঙ্গে অনেক সুযোগসন্ধানী বাংলাদেশিরাও এই দেশে এসে পড়েছেন। বিভিন্ন দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে এসে তারাও অন্যদের মতো রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছেন। জার্মানিতে আগত অবৈধ বাংলাদেশিদের সঠিক সংখ্যা জানার কোনো সুস্পষ্ট উপাত্ত পাওয়া না গেলেও ধারণা করা হচ্ছে সংখ্যাটি প্রায় ১০ হাজার। তারা সাময়িক আশ্রয় নিয়েছেন প্রধানত বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। যেমন; পশ্চিম জার্মানির ব্যস্ততম শহর ডর্টমুন্ড, ফ্রাঙ্কফুর্ট কিংবা বন্দর নগরী হামবুর্গে অথবা পূর্ব জার্মানির প্রধান শহর বার্লিন ও ড্রেসডেনে
এদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রায় সবাই এখানে এসেছেন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য। কিন্তু জার্মান সরকারের কাছে তাঁরা দাবি করছেন দেশের প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতির স্বীকার হয়ে তারা এখানে এসেছেন। আমজাদ হোসেন নামের একজন বললেন, দেশে চাকরিবাকরি নাই, ফ্যামিলি চালাইতে পারি না, সন্তানদের মুখ দেখলে খুব কষ্ট লাগে। কি আর করুম তাই গ্রিস-মেসিডোনিয়া সীমান্ত পাড়ি দিয়া এ দেশে চইলা আইছি। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো বাংলাদেশিদের একটা বড় অংশই আবার এসেছেন জার্মানির পার্শ্ববর্তী দেশ ইতালি, গ্রিস বা পর্তুগাল থেকে। অন্য দেশ ছেড়ে এ দেশে কেন আসলেন প্রশ্নের জবাবে সবাই অকপটে স্বীকার করলেন জার্মানিতে ভালো অর্থ আয় করা যাবে এই ভেবেই তারা দলবেঁধে ছুটে এসেছেন।
অনেক চড়াই উতরাই পেরিয়ে জার্মানিতে আসার কিছুদিন পরেই শুরু হয় রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের প্রক্রিয়া। অবৈধ বাংলাদেশিরা প্রথমে তার শহরে থাকা শরণার্থী বিষয়ক অধিদপ্তরে যোগাযোগ করেন। এ ক্ষেত্রে সাধারণত তারা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখেন ও নিজেকে রোহিঙ্গা কিংবা আফগান এবং কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে চরম নির্যাতিত বাংলাদেশি বলে দাবি করেন। সঙ্গে এও দাবি করেন যে বাংলাদেশে ফেরত গেলে জীবনহানি হতে পারে। এরপর আশ্রয়প্রার্থীরা নির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে মামলা করেন জার্মান আদালতে। নতুন আইন অনুযায়ী তিন মাস সময়ের মধ্যেই সাধারণত রায় হয়ে যায়, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আরও অনেক সময় লেগে যায়। যা কয়েক বছরও হতে পারে। জার্মান সরকারের তালিকায় বাংলাদেশ নিরাপদ হিসেবে স্বীকৃত। তাই শরণার্থীরা বাংলাদেশ থেকে আগত, তা জানলে জার্মান আদালত কোনোভাবেই রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে চায় না কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া। মামলার রায় পক্ষে এলে জার্মানিতে দীর্ঘ মেয়াদে থাকার পথ সুগম হয়ে যায় কিন্তু উল্টো হলেই দুঃসহ-যন্ত্রণার অনিশ্চিত জীবন শুরু হয়ে যায়। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে ব্যক্তির গোটা পরিবারের ওপরেই। আগে এখানে মামলা প্রত্যাখ্যান হলেও কাউকে বাংলাদেশে জোর করে ফেরত পাঠানো হতো না। কিন্তু নতুন আইন অনুযায়ী মামলা প্রত্যাখ্যান হওয়ার পরে যেকোনো সময় যেকোনো জায়গা থেকে ধরে তাৎক্ষণিক ফেরত পাঠানো হচ্ছে। এ প্রক্রিয়ায় এ পর্যন্ত কয়েক শ বাংলাদেশি আশ্রয়প্রার্থীকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে এবং আরও অনেককেই পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে।
অবৈধভাবে থাকা বাংলাদেশিদের সম্পর্কে স্থানীয় বাংলাদেশিদের মধ্যে দুই ধরনের মতামত পাওয়া যায়। কেউ কেউ তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করলেও বেশির ভাগই বিষয়টিকে নেতিবাচক হিসেবে দেখেন। কারণ তাদের মতে এমন ব্যক্তিরা বিভিন্ন ছলচাতুরী ও মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করেন। তাদের আরও অভিমত, আর্থিক উন্নতি সাধনের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বেআইনিভাবে এ দেশে প্রবেশ না করে বরং টেকসই ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশেই বৈধভাবে ব্যবসা কিংবা চাকরি লাভের চেষ্টা করাটাই মঙ্গলজনক। সর্বোপরি, রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী বাংলাদেশিদের মনে রাখা দরকার, অনিশ্চিত অজানা গন্তব্যে যাত্রার চেয়ে নিজের দেশে মেধা ও শ্রমকে কাজে লাগিয়ে সুদৃঢ় ভবিষ্যৎ গড়া আরও সম্মানজনক ও সুচিন্তার পরিচায়ক।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০১৬ ভোর ৬:২১