মেঘালয়ে সলো ট্যুরের একটা গল্প বলি। যদিও বন্ধু-বান্ধবের বিশাল বহর নিয়ে মেঘালয় ভ্রমণে যাওয়ার কথা ছিল। তবে যাওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে দেখা গেল আমি ছাড়া আর কেউই যেতে পারছে না বিভিন্ন কারণে। অগত্যা একাই যাত্রা করলাম। রোজার ঈদের পরদিন রবিবার সকাল ৯ টায় ডাউকি বাজার পৌঁছাই। রবিবার ভারতে সাপ্তাহিক ছুটির দিন। ছুটির দিন যে এত ভয়ানক ভাবে উদযাপন করা হয়, নিজের চোখে না দেখলে বুঝতাম না। সব ধরনের দোকানপাট বন্ধ। গাড়ি প্রায় নেই বললেই চলে। যে কয়েকটা গাড়ি আছে তারা শিলং যেতে তিনগুণ ভাড়া দাবি করছে। এরমধ্যে নামল ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি। এখানে বৃষ্টি শুরু হলে আর থামবে না, তাই শেষমেশ তিনগুণ ভাড়া দিয়েই শিলং-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলাম। ইমিগ্রেশনে ৪ জন বাংলাদেশী ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়েছিল। তাদের সাথেই গাড়ি শেয়ার করে পথ চলা শুরু করি।
ডাউকি বাজার ছাড়িয়ে কিছুদূর যেতেই রাস্তায় গাড়ির জানালার পাশেই মেঘের দেখা পাওয়া শুরু হলো। সাথে প্রচন্ড বৃষ্টি। বৃষ্টি যে এত সুন্দর হতে পারে, এখানে না আসলে বুঝতে পারতাম না। আকাশ থেকে মনে হচ্ছিল যেন সৃষ্টিকর্তা নিজে সবুজ রঙ ঢালছেন। ফেব্রুয়ারীতে যে পাহাড়গুলোকে দেখেছিলাম লালচে বিবর্ণ, সেগুলো যেন সবুজে নতুন জীবন পাচ্ছে। প্রতি মিনিটে যেন এক হাজার বালতি বৃষ্টি পড়ছে আকাশ থেকে। বিশাল পাহাড়গুলো যেন প্রতি মিনিটে নিজের সবুজ রঙ গাঢ় থেকে আরও গাঢ় করে নিচ্ছে। নিজের চোখে না দেখলে সে দৃশ্য বিশ্বাস করা কঠিন।
এভাবে কিছুদূর যাওয়ার পরেই পুলিশ গাড়ি থামিয়ে দিল। পাহাড়ধ্বস হয়েছে। আপাতত সব ধরনের গাড়ি চলাচল বন্ধ। ড্রাইভার গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যেতে চাচ্ছিল। অনেক বুঝিয়ে তাকে বসিয়ে রাখা হল। পুরো মেঘালয় রাজ্য পাহাড়ে ঘেরা হওয়ায় পাহাড়ধ্বস এখানে স্বাভাবিক ঘটনা। পুলিশ এসব কাজের জন্য প্রস্তুতি নিয়েই রাখে। রাস্তা ক্লিয়ার হতে সময় লাগল না। ১৫ মিনিটের মধ্যেই বিশাল ক্রেন এসে পাথর সরিয়ে রাস্তা চলাচলের উপযোগী করে দিল। কিছুদূর যেতেই শুরু হলো প্রচন্ড ঠান্ডা। ঠান্ডা আর বৃষ্টি উপভোগ করতে দুপুর ১ টার দিকে পৌঁছে গেলাম শিলং শহরে।
মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলং চমৎকার শহর। খুব সুন্দর আবহাওয়া, সব সময় ঠান্ডা। শীতের কাপড় সারা বছর অত্যাবশ্যক। এর সাথে বোনাস হিসেবে আছে কোনো ধরনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই সারা বছর বৃষ্টি। বিন্দুমাত্র কোলাহল নেই। একদম যেন “Listen to the silence” টাইপ শহর। সবুজে সয়লাব ছোট ছোট বিল্ডিংগুলো দেখতে অসাধারণ লাগে। শিলং শহর আমার খুব মনে ধরল।
থাকার জন্য একটি হোটেল নিয়ে শিলং ঘুরতে বের হলাম। ছোট ছোট বাড়িঘর। প্রচুর খাবারের দোকান। এর মধ্যে এক মিষ্টির দোকানে আমার চোখ আটকে গেল, নাম “দিল্লি মিষ্টান্ন ভান্ডার”। সেখানে হানা দিলাম। রসমালাই আর মালাইরোল খেলাম। এরকম মজার রসমালাই আমি এর আগে খাইনি। এর থেকে বেশি স্বাদের রসমালাই হয়তো বেহেশতেই পাওয়া সম্ভব।
বিকেলের পর থেকেই অসম্ভব ঠান্ডা পড়তে শুরু করল। রাতে ডবল কম্বলমুড়ি দিয়ে ঘুম। রাত ৮ টায় পুরো শহর ঘুমিয়ে যায়। কোন শব্দ নেই। নিজের নিঃশ্বাসের শব্দও যেন শোনা যায় এরকম অবস্থা।
পরদিন শিলং এর আশেপাশে ঘুরলাম। ওয়ার্ডস লেক, স্টেট মিউজিয়াম, এলিফ্যান্ট ফলস, রবীন্দ্রনাথের বাড়ি ঘুরলাম। তারপরদিন গেলাম চেরাপুন্জি। এবার দেখা মিলল সেই বিখ্যাত সেভেন সিস্টার্স ফলস এর। বৃষ্টি হলেই সেভেন সিস্টার্স ফলস নিজেকে মেঘের মধ্যে লুকিয়ে ফেলে। তখন শুধু শব্দ শোনা যায় বিশাল ঝর্ণার। যেন শব্দ দিয়ে বুঝিয়ে দিতে চায় এখান দিয়ে তারা একত্রে বয়ে যাচ্ছে।
নোহকালিকাই ফলসও যেন বৃষ্টিতের তার নিজের পূর্ণরূপ খুঁজে পেয়েছে। চেরাপুন্জির কিছু জায়গা থেকে বাংলাদেশ দেখা যায়। থাংখারাং ফলস, এই ঝর্ণাটি বর্ষাকালে সিলেটের বিছনাকান্দি থেকেও দেখা যায়। বিদেশের পাহাড় চূড়ায় বসে নিজের দেশ দেখার সময় অসাধারণ এক অনুভূতি কাজ করে। মেঘালয় ঝর্ণার রাজ্য। চলতি পথে নাম না জানা আরও অনেক ঝর্ণার দেখা পাওয়া যায়।
সেভেন সিস্টার্স ফলস যেখান থেকে শুরু, সেখানে একটি ইকো পার্ক আছে। সেভেন সিস্টার্স ফলস এ পানির সোর্সের উপর হেঁটে বেড়িয়েছি। এখান থেকে দেখা যায় বাংলাদেশের সাদা পাথর এলাকা। অসাধারণ এক অনুভূতি।
এশিয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার গ্রাম হিসেবে পরিচিত মাউলিনলং-এ গেলাম একদিন। ছবির মতো সুন্দর। শুধু একটি গ্রাম পরিচ্ছন্ন, এটিকে তারা যেভাবে ব্র্যান্ডিং করছে সেটি অবাক করার মতো। ট্যুরিজম তাদের আয়ের প্রধান উৎস হওয়ায় খুব ভালোভাবে সবগুলো স্পটের দেখভাল করে তারা। মেঘালয়ের আরেকটি আশ্চর্য হচ্ছে “Living root bridge”. জীবন্ত গাছের শেকড় দিয়ে ব্রীজ আছে বেশ অনেকগুলো গ্রামে। দেখার মতো জিনিস বটে। প্রকৃতিকে অনেকটা নিজের মতোই রেখে দিয়ে মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় রাস্তা তৈরী করে নিয়েছে। অভিভূত হয়েছি দেখে।
মেঘালয়ের অর্থনীতির প্রায় পুরোটাই ট্যুরিজম নির্ভর। যার কারণে এখানে খুব কম পয়সায় যেমন থাকার ব্যবস্থা আছে, তেমনি রাজার হালে থাকার ব্যবস্থাও আছে। প্রচুর হোমস্টে আছে যেখানে ৪০০-৫০০ রুপি দৈনিক ভাড়ায় বেশ ভালো পরিবেশে থাকা যায়। ৪ দিনে রাজার হালে মেঘালয়ের এমাথা-ওমাথা ঘুরে আমার ১০ হাজার রুপির মতো খরচ হয়েছিল।
ইচ্ছা ছিল এবার লাইটলুম ঘুরে দেখার। তবে শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়নি, সময় সুযোগ থাকার পরেও। সলো ট্রাভেলিং ব্যাপারটা ভারতে খুব জনপ্রিয়। বিভিন্ন বয়সের বেশ কয়েকজন ভারতীয় ব্যক্তির সাথে পরিচয় হয়েছে যারা প্রায় ১ মাসের বেশি সময় ধরে ভারতের এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্য ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সলো ট্রাভেলিং এর আলাদা একটা মজা আছে। এখানে পুরো সময়টাই নিজের। প্লানিং নিয়ে আহামরি কোন টেনশন নেই। যখন যা ইচ্ছা করে ফেললেই হলো। অনেক জায়গা ঘুরলেও মেঘালয়ের লাইটলুম ক্যানিয়নে এবারও যাওয়া হয়নি। শুধু এই লাইটলুম ক্যানিয়নে যাওয়ার জন্যেই আরেকবার মেঘালয় যাব ইনশাআল্লাহ।
ট্যুরের কিছু ছবি-
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই জুলাই, ২০২৩ সন্ধ্যা ৬:৪৯