পত্রিকা অফিসে আমার অবরুদ্ধ জীবনের আজ দুই মাস পূর্ণ হচ্ছে। ডিসেম্বরের ১৩ তারিখে ক্ষমতাসীন মহল বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশের ‘অপরাধে’ আমার বিরুদ্ধে একটি বানোয়াট দেশদ্রোহের মামলা দায়ের করেছে। একই বিষয়ে গত মাসে মন্তব্য প্রতিবেদন লেখার কারণে মামলার খুঁটিনাটিতে আজ আর যাচ্ছি না। শুধু এটুকু আমার প্রিয় পাঠকদের জানিয়ে রাখছি যে, কোনো আদালত অদ্যাবধি আমাকে জামিন দেয়ার আগ্রহ দেখাননি। এর মধ্যে একবার উচ্চ আদালতে গেলেও নিরাশ হয়েই ফিরতে হয়েছে। আইনের শাসনবিহীন বাংলাদেশে এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের কোনো প্রত্যাশাও আমার নেই।
অপরদিকে শাসকদেরই ইঙ্গিতে দেশে উন্মত্ত জনতার তাণ্ডবের সংস্কৃতি (mob lynching culture) সৃষ্টির পাঁয়তারা চলছে। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর ঢাকার রাজপথে এই তাণ্ডব আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এবার জায়গা বেছে নেয়া হয়েছে শাহবাগ চত্বরে। গণজাগরণের নামে আওয়ামী বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের প্রত্যক্ষ মদতে তরুণ প্রজন্মের একাংশকে বিভ্রান্ত করে সেখানে ভয়ঙ্কর ফ্যাসিবাদে দীক্ষা দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের তাবত্ মিডিয়া সেই গড্ডলিকায় গা ভাসিয়ে রাষ্ট্রে সহিংসতা উসকে দেয়ার কাজে ব্যবহৃত হলেও আমার দেশ ইনসাফের দর্শন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে অনমনীয় থেকেছে।
ইতিহাস পড়লেই জানা যাবে, জনগণের আবেগকে মুন্সিয়ানার সঙ্গে ব্যবহার করেই বিশ্বের সর্বত্র ফ্যাসিবাদ বিকশিত হয়েছে। হিটলারের জার্মানিতে ইহুদি সংখ্যালঘু এবং কমিউনিস্টদের ওপর অবর্ণনীয় নিগ্রহ, নির্যাতন চালাতেও একইভাবে সে দেশের তরুণদের গত শতাব্দীতে ব্যবহার করা হয়েছিল। এডলফ হিটলারের চরম বর্ণবাদী ঐন্দ্রজালিক বক্তৃতায় মোহিত হয়ে আবালবৃদ্ধবনিতা Hail Hitler বলে গর্জে উঠতো। তারা স্লোগান দিতো, ইহুদি ও কমিউনিস্টদের যেখানে পাও ধরো এবং হত্যা করো। ইতালির মুসোলিনির সঙ্কীর্ণ জাতীয়তাবাদী অথচ উত্তেজক আহ্বানে সাড়া দিয়ে মহিলারা তাদের গায়ের গহনা অকাতরে খুলে দিয়ে সে সময় ফ্যাসিস্ট বাহিনীর সৈন্যদের ব্যয় নির্বাহ করেছে। বাংলাদেশেও গত এক সপ্তাহে সেই ফ্যাসিবাদেরই পদধ্বনি শুনতে পাওয়া গেছে। প্রগতিশীলতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীরা নিষ্পাপ শিশু-কিশোরদের মুখ দিয়ে যেভাবে ফাঁসি চাই কিংবা জবাই কর মার্কা বর্বর স্লোগান দেওয়ানোর আয়োজন করেছে, তার মধ্য দিয়ে তাদের বিকৃত মানসিকতাই প্রতিফলিত হয়েছে। এই একবিংশ শতাব্দীতেও বিনাবিচারে ফাঁসির দাবি কোনো সভ্য রাষ্ট্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় উঠতে পারে, ভাবা যায় না।
সেই জঙ্গি সমাবেশ থেকে আমার দেশকেও হুমকি দেয়া হয়েছে, জান্তব উল্লাসে পত্রিকা পোড়ানো হয়েছে। শুধু ঢাকাতেই নয়, চট্টগ্রাম এবং আরো কয়েকটি জেলাশহরে আমার দেশ পত্রিকার কপিতে আগুন দিয়েছে উন্মত্ত আওয়ামী ও সরকার সমর্থক বামের নেতা-কর্মীরা। এগুলোই ফ্যাসিবাদের অবধারিত লক্ষণ। মহাজোট সরকারের চার বছরে এদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতার যে অবনমন ঘটেছে, সেটি রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার, সিপিজে এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সংগঠনের জরিপে উঠে এসেছে। আর আমরা যারা প্রতিনিয়ত নিগৃহীত হচ্ছি, তাদের ক্ষেত্রে দেশের অবস্থা বোঝার জন্য ব্যক্তিগত দৈনন্দিন অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট, বিদেশি জরিপের প্রয়োজন নেই।
আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করার লক্ষ্যে সরকার হেন কৌশল নেই, যা তারা গত চার বছরে অবলম্বন করেননি। প্রশাসনিক আদেশে পত্রিকা বন্ধ করার সুযোগ বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ সেই ১৯৯১ সালে রহিত করে গেলেও ২০১০ সালের ১ জুন নব্য বাকশালি সরকার প্রশাসনিক আদেশেই আমার দেশ বন্ধ করে দিয়েছিল। প্রায় ছয় সপ্তাহ বন্ধ থাকার পর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে আমার দেশ পুনঃপ্রকাশিত হয়। আমি তখন কারাগারে বন্দী থাকলেও সহকর্মীদের কাছ থেকে আমার দেশ-এর পাশে জনগণের দাঁড়ানোর বীরোচিত কাহিনী শুনে উদ্দীপ্ত হয়েছিলাম। গত ডিসেম্বরে হাইকোর্টের একজন চরম বিতর্কিত বিচারপতি সরকারের ইন্ধনে আবারও আমার দেশ বন্ধের অপচেষ্টা করে ব্যর্থ হন। এবার তরুণ প্রজন্মের অনিয়ন্ত্রিত আবেগকে পুঁজি করে বর্তমান সরকারের শাসনামলে তৃতীয় বারের মতো একই গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। আমার দেশ পরিবার আশাবাদী যে, পাঠকদের অপরিসীম ভালোবাসায় সিক্ত জাতীয় দৈনিক পত্রিকাটি ইনশাআল্লাহ্, সব বাধাবিঘ্ন মোকাবিলা করেই সত্যের পথে তার লড়াই অব্যাহত রাখতে সক্ষম হবে।
আমরা অবগত আছি যে, আওয়ামী সমর্থক সংবাদকর্মীদের একাংশও আমার দেশ বন্ধের অপতত্পরতায় দুর্ভাগ্যজনকভাবে জড়িত রয়েছেন। এদের মধ্যে আমার গ্রেফতার ত্বরান্বিত করার জন্য যারা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কলকাঠি নাড়ছেন, তাদের পরিচয়ও আমাদের জানা। আশা করি, প্রতিবেশী বিশেষ রাষ্ট্রের দূতাবাসের ক্রীড়নক এসব ব্যক্তির শুভবুদ্ধির উদয় হবে এবং ১৯৭৫ সালে সব পত্রিকা বন্ধের দুঃখজনক পরিণতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে শেষ পর্যন্ত গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষেই তারা অবস্থান নেবেন। সবচেয়ে বড়কথা হলো, জেল-জুলুমের ভয় দেখিয়ে যে কোনো ফায়দা হবে না, সেটা এতদিনে তাদের বুঝে যাওয়া উচিত ছিল। গত পরশুও সারাদিন ধরে আমাকে গ্রেফতারের পুলিশি পাঁয়তারা দেখে আধাবন্দী অবস্থাতেই যথেষ্ট কৌতুক বোধ করেছি।
এতক্ষণ ফ্যাসিবাদী ক্ষমতার জোর খাটিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে সবচেয়ে সোচ্চার এবং অনাপস কণ্ঠ আমার দেশ বন্ধ করার অপচেষ্টার কাহিনী সংক্ষেপে বর্ণনা করলাম। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে অর্থনৈতিকভাবেও আমাদের পঙ্গু করবার অব্যাহত আয়োজন চলছে। সরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে অলিখিত নির্দেশনা দিয়ে আমার দেশ-এ বিজ্ঞাপন প্রদান বন্ধ রাখা হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগ তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, ‘সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন বিতরণে বৈষম্যমূলক নীতি, দলীয়করণ বন্ধ এবং সংবাদপত্রকে শিল্প হিসেবে বিবেচনা করে তার বিকাশে সহায়তা প্রদান করা হবে’ (দিনবদলের সনদ, ১৯.৩)। চার বছরে সেই প্রতিশ্রুতি মহাশূন্যে মিলিয়ে গেছে। সরকার আমার দেশ-এ বিজ্ঞাপন প্রদানের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে, তার প্রভাব বেসরকারি খাতেও পড়েছে। বিজ্ঞাপনদাতারা তাদের অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে বলেছেন, এই পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিলেই নাকি বিশেষ এজেন্সি থেকে তাদের কাছে ফোন যায়, সরকারের অন্যান্য সংস্থাও ব্যবসা পরিচালনায় নানাভাবে হয়রানি করে। বিজ্ঞাপন ছাড়া একটি পত্রিকার বেঁচে থাকা যে কত কঠিন, সেটি ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। পরিবারের আয়ের একমাত্র উত্স সিরামিক কারখানাটি আমার কারাবন্দী অবস্থায় বিক্রি করে তারই টাকা দিয়ে এতদিন আমার দেশ টিকিয়ে রেখেছি। আমার আর কোনো ব্যবসা নেই, পড়ন্ত বেলায় নতুন করে চাকরি করার সুযোগ নেই, গণবিরোধী করপোরেট স্বার্থের ধামাধরা হয়ে পত্রিকা চালানোও আমার নীতিবিরুদ্ধ।
এদিকে কাগজ, কালিসহ ছাপার প্রতিটি উপকরণের মূল্য প্রতি মাসেই হু হু করে বেড়ে চলেছে। সরকার ইতোমধ্যে সাংবাদিকদের জন্য যে ৫০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা ঘোষণা করেছে, সেটা বৈধ-অবৈধ পথে অর্জিত বেশুমার ধন-দৌলতের অধিকারী মালিকদের পত্রিকায় অদ্যাবধি কার্যকর করা না হলেও আমার দেশ কর্তৃপক্ষ সাংবাদিকদের স্বল্প আয়ে জীবনযুদ্ধের বিষয়টি বিবেচনা করে জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকেই বেতন বৃদ্ধি করেছে। সব মিলিয়ে আমার দেশ চরম আর্থিক সঙ্কটে পতিত হয়েছে। এ অবস্থায় কেবল টিকে থাকার প্রয়োজনে ফেব্রুয়ারি মাসের ১৫ তারিখ থেকে পত্রিকাটির দাম ২ টাকা বাড়িয়ে ১২ টাকা করতে বাধ্য হচ্ছি। আমি জানি, ২০ কিংবা ২৪ পাতার রঙচঙে অনেক দৈনিক পত্রিকার দাম এখনও ৮ টাকা। কিন্তু সেসব পত্রিকার মালিকরা অগাধ অর্থবিত্তের অধিকারী। বিজ্ঞাপন পেতেও তাদের ওপর কোনো সরকারি বাধা নেই। শুনেছি, অনেকে নাকি বিভিন্ন পন্থায় বিদেশি সূত্র থেকে নানারকম সহায়তাও পেয়ে থাকেন। সুতরাং, তারা যেটি পারেন সে কাজ আমাদের পক্ষে করা সম্ভব হয় না।
আমি বুঝি, ক্রেতার পক্ষে ১২ টাকা দেয়াটাও একটা উটকো ঝামেলার ব্যাপার। অনেক সময় পকেটে খুচরো দু’টাকার নোট থাকেও না। এই বাস্তবতা জানা সত্ত্বেও একান্ত নিরুপায় হয়ে পাঠক হারানোর ঝুঁকি নিয়েও আমাকে এই অপ্রিয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হচ্ছে। পাঠকদের ওপর অতিরিক্ত এই বোঝা চাপানোর জন্য দুই হাত জোড় করে ক্ষমা চেয়ে রাখছি। যেসব পাঠক বর্তমানের বৈরী পরিস্থিতিতেও সত্য সংবাদ প্রকাশের লড়াইয়ে রত দৈনিকটিকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রতিদিন দুটি করে টাকা অতিরিক্ত খরচ করবেন, তাদের কাছে আগাম কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমার আবেদন সমাপ্ত করছি। আল্লাহ্ আপনাদের হেফাজত করুন।
—মাহমুদুর রহমান