পূর্ণিমাকে কখনো প্রাণভরে দেখিনি,
ভয় ছিল; যদি তোমার প্রতিদ্বন্দ্বী হ’তে চায়!
কিন্তু আজ আমি জেনে গেছি সত্যখানি---
পূর্ণিমার আলো- আবেগ- অপ্রতুলতা সবই আছে,
তবু যেখানে সে মৃয়মাণ, সেই বাস্তবতার দীপ্তি
শুধুই তোমার আছে।
প্রায় এক ঘন্টা যাবৎ নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে দেখে আছি ওর দিকেই। অথচ কি আশ্চর্য! দীপ্তর সমস্ত অবয়বে বিন্দুমাত্র অস্থিরতা বা অতৃপ্ততার প্রকাশ খুঁজে পেলামনা। বরং, বারবার প্রশ্নতাড়িত হচেছ আমারই মনটা মানসিক ভারসাম্যহীনতার পরিচয় বহন করে এই যুবক কতোটা প্রশান্ত ও প্রতিবাদহীন, অথচ আমাদের মত মুক্ত পৃথিবীর মানুষগুলো সুস্থতার অহংকারে কতোটা অস্থির ও আপোষহীন! তাহলে কি মিথ্যে সুখের অভিনয় করে আমরাই নিজেদের বিবেকটাকে বাধ্য করি ‘পাগল’ অপবাদটা লুকিয়ে রাখার জন্য; অথচ প্রকৃত সুখী দীপ্তর মত এই চার দেয়ালের ছোট্ট পৃথিবীতে আবদ্ধ মানুষগুলোই?
কি জানি; কি হলো (?) মানুষের জীবনে ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক ঘটনাগুলোর তথ্য সংগ্রহ করে নিজের গল্প লেখার বিষয় করে তুলি। আর তাইতো কখনো ছুটে গিয়েছি সেই মানুষটির অনুভূতি জানতে, যে হঠাৎ চল্লিশ লক্ষ টাকার লটারী জিতে দিনমজুর থেকে নাম লিখিয়েছে ধনীদের খাতায়, অথবা সেই অপরিণামদর্শী ধনীর কাছে যাকে জুয়ার আসর ছুঁড়ে দিয়েছে প্রাসাদের চূড়া থেকে বস্তির আঙ্গিনায়, কখনো ছুটেছি কোন মেধাবী তরুণের জীবনে বেকারত্বের অভিশাপে জেগে ওঠা মেধার বিড়ম্বনা অনুভব করতে। আবার কখনোবা কোন বিদগ্ধ প্রেমের বিচেছদের নিষ্ঠুরতা দেখতে।
এমনি কতো অস্বাভাবিকতার ঘটনা উল্লেখ করব। বাড়ির বাইরে পা রাখলেই অস্বাভাবিকতা, প্রতি পদে অপেক্ষা করে থাকে অস্বাভাবিকতা। এভাবেই আনন্দ আর আবেগের টানাটানিতে ‘‘অস্বাভাবিকতা’’ শব্দটি যেন ক্রমশই ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচেছ অণু, পরমাণু আর আয়নের পরিমাপে। আর ছড়িয়ে পড়ছে এই বস্তুবাদী পৃথিবীর টানাপোড়েনে কিষ্ট অসহায় মানুষগুলোর মাঝেই, যেন এক অদৃশ্য রোগজীবাণুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে এই ‘‘অস্বাভাবিকতা’’!
তেমনি-ই কোন অজানা অস্বাভাবিকতার শিকার আজ আমিও হয়তোবা। তা নাহলে এমন সম্মোহিতের মত কেন চেয়ে রয়েছি দীপ্তর দিকে , অজানা একটা আন্দোলন দানা বাঁধছে মনে, অথচ বিবেকটা পারছেনা সঠিক দিক-নির্দেশনা দিতে (?) এখানে আসার পূর্বে যে শারীরিক ও মানসিক গতিময়তা ছিল, তা যেন ক্রমশঃ লোভাতুর হয়ে একটা অসহায়ত্ব স্বীকার করছে দীপ্তর প্রশান্ত চাহনির প্রতি।
হঠাৎ করেই একটা হাতের স্পর্শে সামলে নিতে লাগলাম নিজের অচেতন বোধশক্তিটাকে। দেখি, এই মানসিক হাসপাতালেরই মেট্রোন হুমায়ুন সাহেব ইশারায় আমাকে দীপ্তর কাছ থেকে দূরে সরে আসতে বলছেন।
বললাম, এ আমি কি দেখছি হুমায়ুন সাহেব-------? এই যুবকটি কি সত্যিই পাগল------? তাহলে আমরা ------------!
স্মিত হেসে হুমায়ুন সাহেব বললেন, কেবলই তো এলেন, তাই এতো শীঘ্রই রহস্যের গভীরে নাই-বা গেলেন। আজ বরং বিশ্রাম নিন, আগামীকাল সকাল থেকেই নিজের সব প্রশ্নগুলোর সমাধান আপনা-আপনিই পেতে শুরু করবেন।
জানলাম, হাসপাতালের ইনচার্জ বিখ্যাত মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ মাহমুদের কোয়ার্টারে আমার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
হাসপাতালের বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতেই প্রশ্ন করলেন হুমায়ুন সাহেব, ক'দিনের সময় নিয়ে এসেছেন আপনি?
বললাম, তেমনিভাবে কিছুই নির্ধারণ করিনি, তবে ভাবছি আনুমানিক তিন দিনের মধ্যেই সবকিছু গুছিয়ে নিতে হবে।
আপনি ব্যক্তিগত জীবনে লেখালেখি ছাড়াও অন্যকিছু করেন কি?
জি-হ্যাঁ, একটি বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করি। আসলে লেখালেখিটা আমার পেশা নয়, বলতে পারেন জীবনের জটিলতা থেকে নিজেকে আড়াল করবার মত একটা বিকল্প অবলম্বন......... !
এবার আমি হুমায়ুন সাহেবকে প্রশ্ন করলাম, আপনি কত দিন থেকে রয়েছেন এখানে?
তা প্রায় পনের বছর হবে। এই হাসপাতালের সূচনা থেকেই আমি এর সাথে জড়িত বলা চলে।
তাহলে তো অনেক ভাঁঙ্গা-গড়ার ইতিহাসেরই প্রত্যক্ষ স্বাী আপনি।
হ্যাঁ.... অনেক; এতো ইতিহাস যে -----! থাক সেসব কথা কেমন যেন অন্যমনস্ক ভাবেই কথাগুলো বললেন হুমায়ুন সাহেব নিজের দীর্ঘশ্বাসটাকে সামলে নিয়ে।
এমনিভাবে স্বাভাবিক কথাবার্তার মধ্য দিয়েই এক সময় এসে পড়লাম গেটের কাছে। একজন মাঝবয়সী পিয়নকে আমার সাথে দিয়ে হুমায়ুন সাহেব নিজের দায়িত্ব পালন করতে পুনরায় ভেতরে ফিরে গেলেন।
‘মন’ কে দিয়েই যে মানুষ বিধাতার সমস্ত সৃষ্টির মাঝে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে, সেই মনেরই অসুস্থতা বা অস্বাভাবিকতা তাকে করে তোলে পরিহাস আর পরিত্যাগের পাত্র। -এর চেয়ে নির্মম বাস্তব আর কি-ইবা হতে পারে! আর তাই, এই নির্মমতার রহস্য উন্মোচনের এক অজানা আগ্রহেই ছুটে এসেছি রংপুর থেকে পাবনার হেমায়েতপুরে এই মানসিক হাসপাতালে।
প্রথমে ভেবেছিলাম, তিনদিনের দীর্ঘ সময়টি এই অপরিচিত পরিবেশের অস্বাভাবিকতায় বেশ কষ্টকর হবে। কিন্তু দীপ্তর সাথে সূচনাপর্বটা আমার ধারণা পাল্টে দিল। যাত্রার সমস্ত কান্তি যেন বদলে যেতে শুষ¦ করেছে একটা আবিস্কারের আনন্দে।
কোয়ার্টারে পৌছে প্রথমেই পরিচিত হলাম ডাঃ মাহমুদ এবং তার সহধর্মিনীর সাথে। পঞ্চাশের কাছাকাছি বয়সী এই বিশেষজ্ঞের সাথে দেখা হবার পূর্ব-মূহুর্তেও বুঝতে পারিনি তাঁর সহজ, স্বাভাবিক আন্তরিকতাকে। মনের চোখে ভাসছিল এক বিশৃঙ্খখল, কান্ত ও রাশভারী ব্যক্তিত্বের চেহারা। মিসেস মাহমুদের বেলাতেও এই রকম সায় দিল মনটা। এই হাসপাতালের সীমানার বাইরে যে ধারণা ছিল, যে ভয় ছিল এবং নিঃসঙ্গঁতার গ্লানি ছিল - সবই যেন পরাজিত হতে লাগল সীমানার ভিতরের এই অনাকাঙ্খিত আতিথেয়তার সূচনায়। আমার অস্বাভাবিক ঘটনা প্রবাহের ঝুলিতে এই প্রাপ্তিটিও একটি সুন্দর অভিজ্ঞতা হিসেবে স্থান পাবার যোগ্যতা রাখে।
হয়তো আমার উপস্থিতি-ই আজ রাতের খাবার সময়টা পিছিয়ে দিয়েছে এই পরিবারটির জন্য। অনেকটা আমার পারিবারিক নিয়মের মতই, সবাই একসাথে খাবার টেবিলে বসার ব্যাপারটি বেশ ভাল লাগল। তবে ডাঃ সাহেবের পাঁচ বছরের মিষ্টি মেয়ে চমক এই অনিয়মটাকে মেনে নিতে পারেনি, ঘুমিয়ে পড়েছে। বড় ছেলে ঝিনুক আমার পাশেই বসেছে। পরিচয়ের সুবাদেই জানতে পারলাম, ঝিনুক খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক¤িপউটার বিজ্ঞানের মেধাবী ছাত্র। সে এসেছে ছুটি কাটাতে। খেতে খেতেই স্বাভাবিক কথোপকথনের মাঝে প্রশ্ন করলেন ডাঃ মাহমুদ, আচছা, একজন লেখক হিসেবে আপনি উপাদান সংগ্রহ ও সত্য প্রকাশের মধ্যে কতটা সমতা রাখতে পারেন?
বিজ্ঞ মানুষটির এই সুন্দর প্রশ্নটি আমাকে বেশ আকৃষ্ট করল। তাই মোটামুটি আলোচনার ভঙ্গিঁতেই উত্তর দিলাম, আসলে সাহিত্য বিষয়টাই অলংকরণ নির্ভর। এখানে উপাদান ও সত্যকে কিছুটা আপেকি করে মানুষের কল্পনাকে বিস্তারে সাহায্য করা হয়। তবে সময়ের প্রয়োজনে উপাদানের সত্যতা, আদর্শ বা নিছক আনন্দকে অগ্রাধিকার দেয়ার স্বাধীনতাটাও সাহিত্যের একটা অনন্য বৈশিষ্ট্য।
এবার ঝিনুক তার বাবার কথার সূত্র ধরেই জানতে চাইল, তাহলে এই হাসপাতালে আসার কারণ হিসেবে আপনি কি বেছে নিয়েছেন নিছক আনন্দ, নাকি সত্য প্রকাশকে?
বুদ্ধিদীপ্ত এই তষ¦ণের প্রশ্নের উত্তরে শুধু এটুকুই বলতে পারলাম যে, মানুষ হিসেবে এই হাসপাতালের সীমানার ভিতরের অসহায় মানুষগুলোর প্রতি একটা মানবিক দায়িত্ব পালন করতেই আমি এসেছি।
পরিচছন্ন ব্যক্তিত্বের এই মহৎ মানুষটির অর্থাৎ ঝিনুকের বাবার নিজস্ব মতামতটা তাঁর নিজের মুখ থেকে শোনার একটা অজানা আগ্রহ মনের মাঝে উঁকি দিতে লাগলো। তাই তাঁকে প্রশ্ন করলাম, - শহরের পরিচিতি নির্ভর সহজ ও শোভন জীবনযাপনকে উপো করে সুদীর্ঘ দশ বছরের এই ব্যতিক্রমধর্মী জীবনকে আপনি কিভাবে মেনে নিতে পারলেন ?
অত্যন্ত গোছানো ভাষায় ডাঃ সাহেব বলতে লাগলেন, কিছুটা জীবনের প্রতি কর্তব্য-বোধে অর্থাৎ প্রয়োজন-নির্ভর পেশার কারণে, আর বাকীটা আপনারই মত কোন ব্যতিক্রমধর্মী নেশা হবে হয়তবা, যার মূল্য অনুভব করি ওদের-ই মত রক্ত মাংসের মানুষ হিসেবে।
ডাঃ সাহেবের কথাগুলো যেন দ্বিতীয়বারের মতই সম্মোহিত করল আমাকে - একটা সজীব আদর্শ, আবেগ, উদারতা আর শ্রদ্ধার মায়াজালে। আমার সাহিত্যের সুনিপুণ সংলাপও যেন হার মেনে নিয়েছে তাঁর সাবলীল সত্যের আঘাতে।
সত্যিই, আজ আমি তৃপ্ত!
ক্রমশঃ প্রকাশ্য
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে সেপ্টেম্বর, ২০০৯ বিকাল ৪:১৬

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




