ভর্তি পরীক্ষাকে কেন ভর্তিযুদ্ধ বলা হয় তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো কুয়েট এডমিশন টেস্ট ২০১৭। সারা বাংলাদেশ থেকে প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী আজ ২০ অক্টোবর জড়ো হয়েছিল ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে। কিন্তু অস্বাভাবিক রকমের বৃষ্টিপাতের কারণে তাদের অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
এডমিশন টেস্ট শুরুর এক সপ্তাহ আগেই ক্যাম্পাসে বিভিন্ন রকমের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। বিভিন্ন ডিপার্টমেন্ট ব্যস্ত হয়ে পরে নিজ ডিপার্টমেন্টের নাম দিয়ে স্ট্রিট পেইন্ট আর পোস্টার ডিজাইন করতে। KUET ADMISSION INFORMATION DESK নামের ফেসবুক গ্রুপটি ব্যস্ত হয়ে যায় পরীক্ষার্থীদের বিভিন্ন রকম সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য। বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক, ডিপার্টমেন্টভিত্তিক আর কলেজভিত্তিক এসোসিয়েশনগুলো কুয়েট রোডে তাদের নিজস্ব স্টল স্থাপন করে অভিভাবক আর পরীক্ষার্থীদের বসার জন্য। প্রত্যেক বছর এ কাজগুলোর সিংহভাগের দায়িত্ব পরে ক্যাম্পাসের সবচেয়ে জুনিওর ব্যাচের উপর। আর তারা প্রবল উৎসাহে বিভিন্ন রকম কাজে লিপ্ত হয় যাতে তাদের জুনিওর ব্যাচের প্রথম কুয়েট পরিদর্শন একটা সুখকর অভিজ্ঞতা হয়।
কুয়েটের ছাত্র হিসেবে এটা আমার দেখা প্রথম এডমিশন টেস্ট। এক সপ্তাহ ধরে আমরা বিভিন্ন রকম প্রস্তুতির অংশ ছিলাম। স্ট্রিট পেইন্ট, পোস্টার ডিজাইন, স্টল প্লেসমেন্ট, ভলান্টিয়ার আইডি কার্ড তৈরী, ব্যানার তৈরী ইত্যাদি ইত্যাদি। সিনিওররা আমাদের নানা রকম পরামর্শ দেন যে তাদের সময় কি রকম সমস্যার মুখোমুখি তারা হয়েছিলেন। তাদের দিকনির্দেশনা ও নিজেদের প্রবল উৎসাহ পুঁজি করে আমরা প্রস্তুতি নিতে থাকি।
পরীক্ষার আগের এক সপ্তাহ ক্যাম্পাসে বৃষ্টির কোনো ছিটেফোটা ছিলো না। আমাদের তাই সমস্যা হয়নি কাজগুলো করতে। কিন্তু পূর্বপ্রস্তুতি ঠিকই ছিল। স্টলে প্যান্ডেলের উপর ত্রিপোল বসানো হয়েছিল যাতে ভিতরে বৃষ্টির পানি না আসে। ইট দিয়ে উচু করে দেওয়া হয়েছিল স্টলগুলো। কিন্তু কপাল আমাদের এতটাই খারাপ যে বৃষ্টির প্রকোপ স্বাভাবিকের তুলোনায় অনেক বেশি ছিল। পরীক্ষা দিতে আসা ছাত্র-ছাত্রী আর তাদের অভিভাবকদের তাই বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
আমার এ পর্যন্ত কুয়েট লাইফের সবচেয়ে উত্তেজনাময় দিনটি ছিল এই দিন। বৃষ্টি বাড়ার সাথে সাথে সবাই ক্যাম্পাসের মেইন গেট থেকে শেষ মাথা পর্যন্ত ভাগ হয়ে যায়। ক্যান্ডিডেটরা একে একে আসতে থাকে আর আমরা তাদের পৌঁছে দেই। প্রবল বৃষ্টি। এমন বৃষ্টিতে ছাতা মোটেই যথেষ্ট না। যেসব ভলান্টিয়াররা ছাতা মাথায় দিয়ে সাহায্য করছিল তাদেরও সমানে ভিজতে হয়েছে। একে একে ছাত্র-ছাত্রী ভিতরে ঢুকতে থাকে আর আমরা এগিয়ে দেই। এমন আবহাওয়া দেখে অভিভাবকদের আশংকা বেড়ে যায়। অনেক ক্যান্ডিডেটদের কাছে ছাতা ছিল না। তারা কাকভেজা হয়ে হাতে এডমিট কার্ড নিয়ে ভিতরে আসতে থাকে। আমরা সাথে সাথে তাদের মাথার উপর ছাতা দিয়ে কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছে দেই। রাস্তায় পানির পরিমাণ অনেক বেড়ে যায়। প্লাস্টিকের ফাইল দিয়ে মাথা ঢেকে ক্যান্ডিডেটরা একে একে ঢুকতে থাকে। তাদের চোখে-মুখে অনিশ্চয়তা আর কিছুটা বিরক্তি।
ভর্তি পরীক্ষার সময় একজন পরীক্ষার্থীর সবচেয়ে বেশি যেটা প্রয়োজন তা হল মাথা ঠান্ডা রাখা। কিন্তু সবসময় পরিবেশ আমাদের অনুকূলে থাকে না। একে তো লম্বা জার্নির ক্লান্তি থাকে শরীরে আর তার উপর এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হলে মাথা ঠিক রাখাটা আসলেই দুস্কর হয়ে পড়ে। কিছু ঘটনা দেখে মন অনেক খারাপ হয়ে যায়। যেমন- ইলেক্ট্রিকাল বিল্ডিংয়ের দিকে যাওয়ার সময় একটা ছেলে স্লিপ কেটে এডমিট কার্ডের ফাইল সমেত পানিতে পড়ে যায়। মা তার ওড়না দিয়ে মেয়ের মাথা ঢেকে ভিজে ভিজে মেইন গেট পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। এমন আরো অনেক দৃশ্য ছিল যা বলে শেষ করা যাবে না।
অনেক পরীক্ষার্থীরই প্রস্তুতি ভাল থাকা সত্তেও বৈরী আবহাওয়ার কারণে ভাল পরীক্ষা দিতে পারে নাই। আমাদের নিজেদের চেষ্টার কোনো কমতি আমরা রাখতে চাই নি। ড্রেন ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে এক ছেলের ভুলে পা ড্রেনে পড়ে যায়। তার একটা স্যান্ডেল ড্রেনের পানিতে ভেসে চলে যায়। এ অবস্থা দেখে আমাদের ব্যাচেরই এক ছেলে নিজের স্যান্ডেল জোড়া তাকে পড়িয়ে পরীক্ষার হলে নিয়ে যায়। অভিভবকদের যাতে কোনো সমস্যা না হয় এ জন্য সকল স্টল অনেক তৎপর ছিল। পকেট গেটে ভলান্টিয়ার অনেক কম ছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে অনেকে গেস্ট হাউজ, মেকানিকাল বিল্ডিং খুঁজছিল। আমি নিজেই সেখান থেকে ৬-৭ জনকে ভিতরে ক্যাম্পাসে নিয়ে আসি। মেয়েরাও কষ্ট কম করে নাই।আমার নিজের ডিপার্টমেন্টের মোটামুটি সবাইকেই আমি রাস্তায় দেখেছিলাম। তারাও ভিজে ভিজে সবাইকে এগিয়ে দিচ্ছিল এক্সাম হল পর্যন্ত। এক ছেলের হারানো এডমিট কার্ডের ফাইল নিয়ে ১৬ ব্যাচের দুই মেয়ে তার কেন্দ্রে চলে যায়। তাদের আশংকা ছিল ছেলেটা হয়ত কেন্দ্রে আসবে না। কিন্তু কিছু সময় পর সে এসে পরীক্ষা দিতে পারে। গত বছর সারা বাংলাদেশে আমি এডমিশন টেস্ট দিতে গিয়েছিলাম আর এটুকু হলপ করে বলতে পারব যে এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এত আন্তরিকতা আর কোনো ভার্সিটিতে পাওয়া যাবে না।
কুয়েট কর্তৃপক্ষের এই দিন অনেক অবদান ছিল। এই বৈরি আবহাওয়ায় পরীক্ষার্থীদের আসতে দেরী হতে থাকে। তাই পরীক্ষা আধ ঘন্টা পিছিয়ে দেওয়া হয়। ৯:৩০ এর বদলে ১০:০০ টায় পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। যেকোনো সময় পরীক্ষার হলে ঢুকলেও তাদের পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। ভুল করে কেউ অন্য হলে ঢুকলে আলাদা উপস্থিতিপত্রে তাদের সাক্ষর নেওয়া হয়। এগুলো প্রশংসার দাবিদার।
আজকের দিনে কুয়েটের সব স্টুডেন্টই ছিল ভলান্টিয়ার। সবাই নানাভাবে আজকের দিনে ভূমিকা রেখেছে। আর এ কাজগুলোর স্বীকৃতিও আমরা অভিভাবকদের কাছ থেকে পেয়েছি। রশীদ হল থেকে পকেট গেটের দিকে আমি যাচ্ছিলাম। সেখানে চায়ের দোকানে কয়েকজন আংকেল বসেছিলেন। আমাকে ডাক দিলেন। ভিজে তখন আমার অবস্থা খারাপ। এক আংকেল আমার দিকে এক প্যাকেট বিস্কিট আর কলা এগিয়ে দিয়ে বললেন," বাবা, এইগুলা খাও"।
"না আংকেল, থাক। আপনারা খান। আর কোনো সমস্যা হলে আমাদের জানাবেন"।
আরেকজন আংকেল আমার গলায় ঝোলানো আইডি কার্ডটা হাতে নিয়ে দেখলেন। তিনি বললেন, "দেখ বাবা তোমরা অনেক কষ্ট করছো আজকে। এটুকু না খেলে আমরা অনেক কষ্ট পাব।"
এ কথাগুলো শোনার পর ভিতরে যে প্রশান্তি আসে তা বলে বোঝানো সম্ভব না। তাদের মন রাখতে হল।
কুয়েটের পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিয়ে অনেককে কথা বলতে শুনেছিলাম। ক্যাম্পাসের ভিতরে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা আছে। কিন্তু বৃষ্টির প্রকোপ এতটাই বেশি ছিল আর ক্যাম্পাসের বাইরে এ ব্যবস্থার ঘাটতির কারণে সমস্যা বেশি হয়েছিল। অন্য ক্যাম্পাসের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে পারত। অনেকেই এত পানির কারণে কুয়েট ক্যাম্পাসের আসল সৌন্দর্য উপলব্ধি করতে পারেনি। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য।
প্রত্যেক ভার্সিটির এডমিশন টেস্টই একেকটা এডভেঞ্চার। কখন পৌঁছাব, কিভাবে পৌঁছাব, কোথায় থাকব, এরকম বেশ কিছু চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়। শুধু প্রশ্নের আর প্রিপারেশনের উপর পরীক্ষার রেজাল্ট নির্ভর করে না। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে কিভাবে চলতে হবে তাও কেন্দ্রের বাইরে পরীক্ষার একটা অংশ।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১২:৩০