somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শ্রদ্ধাঞ্জলি // চে গুয়েভারা: বিশ্ববিপ্লবের নিঃসঙ্গ শেরপা // মাহমুদুজ্জামান বাবু | // অক্টোবর ০৯, ২০১৫ // প্রথম আলো //

০৯ ই অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ২:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের সশস্ত্র যুদ্ধ ১৯৭১ সালে শুরু হয়ে শেষ হয়েছিল মাত্র সাড়ে নয় মাসে। আর এর্নেস্তো চে গুয়েভারা বন্ধু আলবের্তো গ্রানাদোকে সঙ্গী করে প্রিয় মোটরসাইকেল ‘লা পেদেরোসা’য় চড়ে নয় মাস ধরে ঘুরে বেড়িয়েছিলেন লাতিন আমেরিকার প্রান্তে প্রান্তে। ব্যথিত হৃদয়ে, সজল চোখে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী থাবার বিস্তার। শোষণ-নিষ্পেষণে বঞ্চিত মানুষের সরব ও নীরব কান্না গুমরে উঠছে তখন আর্জেন্টিনা, পেরু, চিলি, কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলায়। মোটরসাইকেল ডায়েরি পাঠ করে করে পরে পৃথিবী জানতে পারে যে চে’র এই ভ্রমণ প্রমোদভ্রমণ ছিল না। চে নিজে বলেছেন, ‘এ ভ্রমণকাহিনি অবিশ্বাস্য কোনো নায়িকপনার নয়।’ আসলে তিনি লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে ভেতর থেকে বুঝতে চেয়েছিলেন। সংকটের উপাদানগুলো ব্যবচ্ছেদ করে দেখতে চেয়েছিলেন। কিংবা কে জানে, তিনি হয়তো মানুষ হিসেবে সময়ের চাহিদা অনুযায়ী নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য-দায়বদ্ধতা অনুসন্ধানে নেমেছিলেন। দুই বন্ধুর যাত্রা শুরু হয়েছিল আর্জেন্টিনার আটলান্টিক তীরভূমি বরাবর, গন্তব্য মিরানার সমুদ্রসৈকত রিসোর্ট। সেখানে অপেক্ষা করে আছেন বান্ধবী চিচিনা। বিদায় নিতে হবে তাঁর কাছ থেকে। ১৯৫২ সালের ৪ জানুয়ারি যাত্রা শুরুর আগেই চে পরিবারের বেশির ভাগ সদস্যের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন।
চে যখন লাতিন আমেরিকা ঘুরতে বেরিয়েছিলেন, তখন তিনি তরুণ। তখনো তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী। ভ্রমণকালে যে অভিজ্ঞতা তিনি অর্জন করেছিলেন, সেই অভিজ্ঞতার ঝকঝকে আলো তাঁকে এই সিদ্ধান্তে উপনীত করেছিল যে অঞ্চলব্যাপী অর্থনৈতিক বৈষম্যের মূল কারণ হলো মুনাফালোভী একচেটিয়া পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের পররাজ্যগ্রাসী নিষ্ঠুর মনোভাব। চুলচেরা না হোক, সময়ের ঘণ্টাধ্বনি কান পেতে শুনে বিশ্লেষণের পথে হেঁটে চে পৌঁছেছিলেন সেই উপলব্ধিতে, যা তাঁকে স্বপ্ন দেখিয়েছিল বিশ্ববিপ্লবের। এই স্বপ্নমগ্নতায় চে জড়িয়ে পড়েন গুয়াতেমালার সামাজিক সংস্কার আন্দোলনে। ১৯৫৪ সালে গুয়াতেমালার প্রেসিডেন্ট জাকোবো আরবেনক গুজমানকে যখন সিআইএর চক্রান্তে ক্ষমতাচ্যুত করা হলো, তখন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে চে’র বিপ্লবের চেতনা নিশ্চয়ই আরও শাণিত হয়েছিল। তারপর আমরা তাঁকে দেখি মেক্সিকো সিটিতে। এই মেক্সিকো সিটিতেই ফিদেল কাস্ত্রো ও রাউল কাস্ত্রোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল চের। ফিদেল ও রাউল তখন কিউবায় বিপ্লব করার লক্ষ্যে পরিকল্পনা গোছাতে মেক্সিকো সিটিতে বাস করছিলেন।
১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই ফিদেলের নেতৃত্বে কিউবান গেরিলাদের একটি দল কিউবার মনকাদা আর্মি গ্যারিসনে আক্রমণ পরিচালনা করে। আক্রমণটি ব্যর্থ হলে প্রায় ৩০ জন সহযোদ্ধাসহ ফিদেল বন্দী হন। মামলায় অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর তাঁদের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই ব্যর্থ আক্রমণের সময় এবং পরে প্রায় ৬০ জন গেরিলাকে হত্যা করেছিল স্বৈরশাসক বাতিস্তার সেনারা। প্রবল জনজাগরণের পর গণ-আন্দোলনের মুখে ফিদেল কাস্ত্রো ও তাঁর সহযোদ্ধারা মুক্তি পেলেন ২২ মাস পর, ১৯৫৫ সালের মে মাসে। ৭ জুলাই কাস্ত্রো এসে পৌঁছালেন মেক্সিকো সিটিতে। এই জুলাই মাসেই রাউল কাস্ত্রোর মাধ্যমে ফিদেল ও চে’র দেখা হলো সেখানে এবং সূচনা হলো সফল কিউবা বিপ্লবের শুভদিনের।
কাস্ত্রোর গেরিলা দলে নিজেকে জড়িয়ে নিলেন চে। কিউবান গেরিলারাই এর্নেস্তো গেভারা দেলা সের্নার নামটি ভালোবেসে পাল্টে দিলেন। ১৯৫৬ সালের ২৫ নভেম্বর কিউবার উদ্দেশে যাত্রা করল গেরিলাদের যুদ্ধজাহাজ গ্রানমা। গেরিলাদের সঙ্গী হিসেবে চে যাত্রাকালে ছিলেন চিকিৎসক। কিন্তু ১৯৫৭ সালের জুলাইয়ে তিনি প্রথম রেবেল আর্মি কমান্ডার নির্বাচিত হলেন। ২ ডিসেম্বর তীরে ভিড়ল যুদ্ধজাহাজ গ্রানমা। ১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বরে চে এবং কামিলো সিয়েরা মায়েস্ত্রার পশ্চিম ভাগ থেকে দ্বীপটির কেন্দ্রের দিকে আক্রমণ তীব্র করলেন। ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে সান্তাক্লারার যুদ্ধে রেবেল আর্মি জয়ী হলো চে গুয়েভারার নেতৃত্বে। এই জয়ই সমগ্র যুদ্ধের তীব্রতা বাড়িয়ে দিয়েছিল হাজার গুণ। ১ জানুয়ারি, ১৯৫৯। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদদপুষ্ট স্বৈরশাসক বাতিস্তা খুব গোপনে, খুব ভোরে সপরিবারে কিউবা ছেড়ে পালালেন। বিপ্লব আপাতত সফল হলো।
বিপ্লব-পরবর্তী কিউবার পুনর্গঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন চে। কখনো জাতীয় কৃষি সংস্কার বিভাগের প্রধান, কখনো ন্যাশনাল ব্যাংকের সভাপতি আবার কখনো বা শিল্প মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী। ১৯৬৪ সালে কিউবার পক্ষে জাতিসংঘে ভাষণ দেন চে গুয়েভারা। কিউবা তখন নব আনন্দে জাগছে। জেগে উঠলেন এবার চে গুয়েভারাও আর এক নতুন প্রত্যয়ে। আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশে তখনো সাম্রাজ্যবাদের স্বৈরতন্ত্রের সর্বনাশা সভ্যতাবিনাশী পীড়ন ও দুঃশাসন চলছে। চে ছুটে গেলেন আফ্রিকার কঙ্গোতে। অপ্রস্তুত কঙ্গো থেকে ১৯৬৫–এর ডিসেম্বরে আবার কিউবায় ফিরলেন। এবার তাঁর গন্তব্য লাতিন আমেরিকার দেশ বলিভিয়া। কাস্ত্রো জানলেন। আরও কয়েকজন ঘনিষ্ঠ কমরেড জানলেন। ছদ্মবেশ নিয়ে, বেনামি পাসপোর্ট করে বিশ্ববিপ্লবের স্বপ্নব্যাকুল চে গুয়েভারা কিউবা ছাড়লেন অকুতোভয়ে। চে ছিলেন একজন আর্জেন্টিনীয় মার্ক্সবাদী। ছিলেন বিপ্লবী, লেখক, গেরিলা নেতা, বুদ্ধিজীবী, সামরিক তত্ত্ববিদ, কূটনীতিবিদ আর কিউবা বিপ্লবের অন্যতম প্রধান নেতা। ১৯৬৭ সালের ৮ অক্টোবর, বলিভিয়ার দুর্গম অরণ্যে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে তিনি লড়েছেন সরকারি সেনাদের বিরুদ্ধে। খাবার ফুরিয়ে গেছে, কার্তুজ ও গুলি শেষ, আজন্ম সঙ্গী হাঁপানির ওষুধ নেই, সেই অবস্থায় গুরুতর আহত হলেন প্রতিপক্ষের গুলিতে এবং বন্দী হলেন। বন্দী অবস্থাতেই নির্জন এক স্কুলঘরে একাধিক গুলি চালিয়ে খুন করা হলো তাঁকে। তারিখটি ছিল ৯ অক্টোবর, ১৯৬৭।
চে’র মৃত্যুতে সেদিন নিশ্চয়ই হাঁফ ছেড়েছিল সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী। ভেবেছিল, বিপ্লবের মৃত্যু হলো। আদতে, মৃত্যুর ৪৮ বছর পর জীবিত চে গুয়েভারার চেয়ে মৃত চে গুয়েভারা এখন আরও অনেক শক্তিশালী। আলোকচিত্রী আলবের্তো কোর্দার তোলা তাঁর মুখাবয়বের প্রতিকৃতি এখনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে সব প্রতিবাদে-জমায়েতে আপসহীনতার প্রতীক। পৃথিবীর সেরা কবিরা তাঁকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন, লিখছেন। গায়ক-গীতিকার কার্লোস পাবেলো ১৯৬৫ সালেই ‘আস্তা সিয়েম্প্রে কমানদান্তে চে গুয়েভারা’ শিরোনামের যে গানটি গেয়েছিলেন, তা ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে, হচ্ছে বিশ্বব্যাপী শিল্পীদের কণ্ঠে কণ্ঠে। কারণ, চে বিশ্ববিপ্লবের পথে পা বাড়িয়েছিলেন। বিপ্লবীর কোনো স্বদেশ থাকতে নেই। বিপ্লবেরও স্বদেশ থাকে না। চে এখনো, এখানেও, বিজয়ের পথে হাঁটছেন। হাঁটবেন অনাদিকাল। কারণ, বিশ্ববিপ্লব হয়নি আজও। আজও তমস কাটেনি। মানুষের মুক্তি, স্বপ্ন, সভ্যতা নিয়ে তামাশাও শেষ হয়নি।

মাহমুদুজ্জামান বাবু: গায়ক ও সংস্কৃতিকর্মী।
[email protected]
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই অক্টোবর, ২০১৫ দুপুর ২:০৩
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×