somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

স্বপ্নকন্যা

২৮ শে জুন, ২০১৭ বিকাল ৩:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সত্যের কাছাকাছি

গভীর রাতে ঘরে ফিরছি। প্রায়ই আমাকে এ সময়টায় ফিরতে হয়। আমার মটরবাইকের হেডলাইটের আলোয় আশেপাশের ঘরবাড়িগুলো মাঝে মাঝে প্রতিভাত হয় , এবং অবলুপ্ত অতীতের মত ক্ষনেই তারা হারিয়ে যায়। চারপাশে গাড় অন্ধকার । আমার গাড়ির আলো যেন করাতের মতো সে আঁধার কেটে সামনে এগুতে চায়। ক্ষণিকের জন্য হয়ত কাটে, কিন্তু যেটা দেখিনা সেটা হলো পরাক্ষনেই পুনঃস্থাপিত হওয়া পশ্চাতের সেই ঘন অন্ধকার। অন্ধকারের ঘনত্তের সাথে আমি আশেপাশের ঘরবাড়ির ভেতর জমাট, গুমো্ট এক অন্ধকারের আবির্ভাব বুঝতে পারি। হঠাৎ বুঝতে পারি ঘরবাড়ি, নামফলক আর পরিত্যক্ত রমনীরা শুধু চায় জীবন কে মহিমান্নীত করতে। কিন্তু মানুষেরা সুপ্তিমগ্ন রয়। কেউ হয়ত ঘুমায় নিরুদ্দেগ, শান্তিপূর্নভাবে । আবার কেউ উদ্বিগ্ন , জরাগ্রস্থ আর ইথারগ্রস্থ হয়ে। হঠাৎই টেরপাই এত সব রহস্যকে আমার পেছনে কাঁধের ঠিক ডান পাশটায় কার যেন একটা হাত । স্পষ্ট কাঁচের চুড়ির আওয়াজ আমার কানে মধুর এক ভয়মিশ্রিত গুঞ্জনের সৃষ্টি করল। সাথে সাথেই ব্রেক কষে পেছনে ফিরলাম । ওমা! এ কী! এ যে স্ম্পূর্ন আমার খুকির চেহারা। আমার অতি আদরের একমাত্র কন্যা উর্মি। আপাদমস্তক সে এক অপরুপ বধূর সাজে সজ্জিত। সমস্ত চেহারায় ঐশ্বরিক এক দুত্যির ছটা। চোখ থেকে দু ফোঁটা অস্রু গড়িয়ে পড়ছে । আমার স্পষ্ট অনুভব হল ওই দু ফোঁটা জল যেন আমার হৃৎপিন্ডে ঢেলে দেয়া হয়েছে। আর তা গড়িয়ে পড়ছে হৃৎপিন্ডের উপর দিয়ে। আমি বিচলিত আর কিছুটা অযৌক্তিক ভাবেই যেন জিজ্ঞাসা করলাম,
“এত রাতে? তুই কখন পেছনে বসলিরে মা?”
উর্মির চোখে স্পষ্ট আমি তার ভেতরে দেবে থাকা অজস্র অস্রুকনা দেখতে পেলাম। এ জগৎ সংসারকে তলিয়ে দেয়ার জন্য এর চোখের পানিই যথেষ্ট। অদ্ভুত এক চিত্র ফুটে উঠল ওর চোখে । মনে হল, সে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা লাভাগ্রস্থ কোন লোকালয় থেকে পালিয়ে এসেছে বা পালানোর জন্য তার অসমাপ্ত কোন চেষ্টা। আমি কোন কথা না বলে এক টানে তাকে ঘরে নিয়ে এলাম। অপুর্ব লাগছে আমার এ মেয়েকে । স্বয়ং হেলেনও হয়ত তাকে দেখে লজ্জা পেত বাঙালি রমণীর বধূসাজ দেখে। মনেপড়ে এর পূর্বে এমন আর একজন কে দেখে আবিভূত হয়েছিলাম । উর্মির মাকে। সে পরম মুক্তি পেয়েছে সে আজ পাঁচ বছর হল।দেয়ালে ঝুলে থাকা উর্মির মায়ের ছবিটা দেখলাম। আশ্চর্য ! সে চোখেও আজ ভিন্ন এক অশরীরি সৌন্দর্যতা প্রকাশ পাচ্ছে-এক করুন অর্তনাদের। উর্মির মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞাস করলাম,
“কিছু খাবি?”
কোন উত্তর নেই। দু’হাতে আমাকে প্রাণপণে জড়িয়ে ধরল। সে হাতের ভাষা নিষ্পাপ, আর্তির । সে ভাষা মাংস ভেদ করে হৃৎপিন্ডে গিয়ে ধরা দেয়। অজস্র রক্তের স্রোতধারা নিশ্চুপ ভাবে জানিয়ে দেয় তাকে কি করতে হবে।

হঠাত আমার মনে হয় ঊর্মিকে কাল রাতেই আমি বিয়ে দিয়েছি। কোন এক সম্ভ্রান্ত উচ্চবিত্তের সাথে । তাহলে ? তাহলে সেখানেও কি একই অন্ধকার? বিরাট ঐশ্বর্য, ধনসম্পদ , অতিকায় দালান ও তার ঝাড়বাতি কি পারেনি সামান্যতম আলো জ্বালতে? ঊর্মি কেন আলোর সন্ধানে আজ তার বাবার পেছনে ঘন অন্ধকারে বসে রইল? আমিও কি তাহলে একই কাজ করেছি? আমিও কি কালের চলমান সুগভীর এ নর্দমায় নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছি? আমিও কি আজ সেই গোড়া বিচ্যুত প্রাণী?
কেন্দ্র কি আজ আমায় আর ধ্রে রাখতে পারছে না? বুঝে উঠতে পারলাম না, একি আমার ব্যর্থতা নাকি মহাকালের। হয়তঃ মহাকাল আমার চোখে ‘নিঃস্তব্ধতা’ নামক এক অদৃশ্য শেকল বেঁধে ফেলে দিয়েছে আজ এ কেন্দ্রহীন খেলাঘরে।
আমার ভেতর এ খেলাঘরে আজ ভিন্ন এক সাজ নিতে ইচ্ছে হল-সেই সাজ যা মানুষ একবার কম নেয়। কিংবা নিতে চায় না। দেয়ালে ঝোলান রবিঠাকুরের ছবিটা, কেন যেন দেখলাম, তিনি তাঁর হাতের লাঠিটা পায়ের কাছে সহাস্য দু’বার আঘাত করলেন। নীরব চিরন্তন এক সমর্থন মনে হল তা আমার কাছে । আমি আমার ভেতর পরিবর্তনের এক বারুদ পোড়া গন্ধ পেলাম। উপলব্ধি করলাম নিজের ভেতরকার এক নিঃশব্দ ভাঙন । ঘন অন্ধকার এর মায়া , মোহের আয়না প্রতিশব্দ করতে করতে আমার সামনে ভেঙ্গে পড়ল। আমি দেখতে পেলাম আমার আসল রূপ। যেন হেমলকের মত দীর্ঘদিন তা রাখা ছিল তা মাটির তলায়–– চির হিমায়িত, ঝঁঝাল আর রক্তলাল তার বর্ণ। আমি স্বম্বিত ফিরে পেলাম। প্রতিমাস্বরূপ আমার এ কন্ন্যাকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। না আজ আর কন অজানার পথে নয়। অনেক হেঁটেছি অজানায়। আর নয়। আমি এখন জানি আমার গন্তব্য কথায়। ঊর্মি কোথায় যেতে চায়। আমি জানি কোথায় আমার সেই নন্দনকানন ।

দরজা খুলে দাঁড়াতেই দেখলাম একটা ফুলসজ্জিত সাদা রঙের পাল তোলা নৌকা পানিতে ভাসছে। সাদা পাল। আশ্চর্য ! কিছুক্ষণ আগেও এখানে নদী ছিল না । ছিল ধুলিময় পথ যার বুক চিরে এসেছিল আমার এক বাহনযন্ত্র । এখন আর তা নেই। রবিঠাকুরের কথা মনে পড়ল। তিনি ই বলেছিলেন, ‘আমার কল্পনার রঙে পান্না হল সবুজ’
আমি আর ঊর্মি ভেসে যাচ্ছি কোন দূরদেশে। সউদ্দেশ্যক সে যাত্রা। মনে নেই কোন শঙ্কা, কোন ভয়। আমার ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে গেল। অনেকদিন এমন দৃশ্য দেখা হয় না । চারিদিকে পানি আর পানি। একধারে সাদা বক এক পা তুলে দাঁড়িয়ে আছে। কারো কারো সরু ঠৌঁটে আবার শোভা পাচ্ছে দু;একটা মাছ। কয়েকটা মাছরাঙা সাঁই করে একসাথে ডুব মারল পানিতে। আবার , পলকেই উঠে এলো গুটিকয়েক মাছ নিয়ে । ছেলেবেলায় অগুলোই ছিল আমাদের কল্পিত অস্পৃশ্য কোন খেলনা। যেন কেউ মেলা থেকে কিনে এনে তাদের নদীতে ছেড়ে দিয়েছে। উপরে তাকালে মুগ্ধ হয়ে যাই। কী অনন্ত এ আকাশ ! শরতের সাদা সাদা মেঘরাশি উড়ে যাচ্ছে। কী অপুর্ব এ দূরত্ব ! আকাশ আর মাটির এ দূরত্ব আমাদের চোখে রেখে যায় কত না বিচিত্র স্বপ্ন ! কত না মোহ !
আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকি। চারিদিকে পানি আর পানি, আর তাতে খেলা করে যায় ছোট ছোট ঢেউ আর সূর্যকিরণ; আর সাথে বয়ে যায় আমার দু’চোখের অজস্র স্বপ্ন। এইতো আমি, এইতো খুঁজে পাচ্ছি নিজেকে।

হঠাৎ ঊর্মির দিকে তাকাই। কালো রেশমি একগুচ্ছ চুল আর ওই মলিন মুখটা আমার কোলে পরম শান্তিতে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। মানুষের মনের কষ্ট অতি স্পষ্টভাবে তার চেহারায় প্রতিফলিত হয় আর তাতে তার প্রাকৃতিক এক করুন মাধূর্যের সৃষ্টি হয়। আমি ঊর্মির মাথায় একটা হাত রেখে পরম স্নেহে তা বুলিয়ে দিই।ঊর্মির ঠোঁটের কোণে স্মিত একফালি হাঁসি উঁকি মেরে যায়। হঠাৎ ই নজর পড়ে অদূরে অবস্থিত সেই সুপ্রতিক্ষীত দ্বীপটাতে। সেখানে, দ্বীপের অভিমুখে , লরেল পাতায় সুসজ্জিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন স্বয়ং যিশু, স্মিতহাস্যে হাতে একটা মালা নিয়ে স্বাগতম করার জন্য । পাশেই দেখতে পেলাম আমার সেই মহামানব রবিঠাকুরকে। তার পেছনে অনেক ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বন্য পাতায় আর সুন্দর জঙ্গলিফুলে সুসজ্জিত হয়ে আনন্দের গান গাইছে। আমাদের নৌকাটি তীরের কাছাকাছি আসতেই রবিঠাকুর সহাস্যে তার সেই লাঠি নিয়েই এগিয়ে এলেন আর একটা হাত বাড়িয়ে দিলেন আমার ঊর্মীর দিকে আর মনের আনন্দেই গাইতে লাগলেন ––
“এসো নীপবণে ছায়াবীথিতলে, এস কর স্নান নবধারাতলে।।
... ...ঘনবরিষনে জলকলকলে এসো নীপবণে ছায়াবীথিতলে।।”

ঊর্মি তাঁর হাত ধরে দ্বীপে পা রাখা মাত্রই আকাশ হতে ঝিরিঝিরি বারি বর্ষিত হতে থাকল। সে জলকনা আমাদের সকলকে যেন পূতঃপবিত্র করার পবিত্র সংকল্পবদ্ধ। আমার দেহে এক ফোঁটা জলকনা যেন কী এক অসাধারন স্বপ্ন দিয়ে গেল ।


আমার মুখে অবারিত পানির ফোঁটা পড়েই চলেছে । হঠাৎই চোখের পাতাদুটি একসাথে লাফ দিয়ে মেলে ধরল আমার দৃষ্টিকে । বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে। কতক্ষণ কে জানে। আমি জানালা খুলে রেখে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি তাই বা কে জানে? আমার বিছানার পাশেই শুয়ে আছে ঊর্মি তার ছোটখাটো এ বাসস্থানটিতে––তার দোলনায়। আমি এগিয়ে গিয়ে অনেকটা আত্মবিশ্বাস, আর কিছুটা ভয় নিয়ে দোলনার ভেতর উঁকি দিলাম। ওর ছোট্ট মাথাটায় আমার একটা হাত রাখলাম। ঊর্মির ঠোঁটের কোনায় ছোট্ট একটা হাসিঁ চিত্রিত হল। এ হাঁসিটা একটু আগেই আমি দেখেছি। এ যে ঘুমের মাঝে প্রস্ফুটিত এক আত্মবিশ্বাসের হাঁসি। এ কি আমার অনেক সুপরিচিত, অনেক আপন।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১৭ বিকাল ৩:৩১
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জীবনের গল্প

লিখেছেন ঢাকার লোক, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৩৫

মাত্র মাস দুই আগে আমার এক আত্মীয়ের সাথে দেখা আমার এক বোনের বাড়ি। তার স্ত্রী মারা গেছেন তার সপ্তাহ দুই আগে। মক্কায় উমরাহ করতে গিয়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমান

লিখেছেন জিনাত নাজিয়া, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১০:১২

" অভিমান "

তোমার ঠোঁটে বোল শিখেছি
তুমি আমার মা, কেমন করে
ভুলছ আমায় বলতে
পারিনা। এমন করে চলে
গেলে, ফিরে ও এলেনা। হয়তো
তোমার সুখেই কাটছে দিন,
আমায় ভাবছ না।

আমি এখন সাগর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার কিছু ভুল!

লিখেছেন মোঃ খালিদ সাইফুল্লাহ্‌, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮

১। ফ্লাস্কে চা থাকে। চা খেতে টেবিলে চলে গেলাম। কাপে দুধ-চিনি নিয়ে পাশে থাকা ফ্লাস্ক না নিয়ে জগ নিয়ে পানি ঢেলে দিলাম। ভাবছিলাম এখন কি করতে হবে? হুঁশ ফিরে এল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের লোকসংস্কৃতিঃ ব্যাঙের বিয়েতে নামবে বৃষ্টি ...

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:০০



অনেক দিন আগে একটা গল্প পড়েছিলাম। গল্পটা ছিল অনেক এই রকম যে চারিদিকে প্রচন্ড গরম। বৃষ্টির নাম নিশানা নেই। ফসলের মাঠ পানি নেই খাল বিল শুকিয়ে যাচ্ছে। এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশি ভাবনা ও একটা সত্য ঘটনা

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৪ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১০:১৭


আমার জীবনের একাংশ জুড়ে আছে; আমি চলচ্চিত্রাভিনেতা। বাংলাদেশেই প্রায় ৩০০-র মত ছবিতে অভিনয় করেছি। আমি খুব বেছে বেছে ভাল গল্পের ভাল ছবিতে কাজ করার চেষ্টা করতাম। বাংলাদেশের প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

×