somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শব্দ- ছোট গল্প

০১ লা জুলাই, ২০১৬ রাত ৮:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[এই লেখকের উপরের গল্পটি ১৯৭২ সালে ‘দৈনিক বাংলার রোববারের সাহিত্য পাতায়’ প্রথম প্রকাশিত হয়। বহুদিনের পুরানো লেখা, বর্তমান পাঠকেরা সম্ভবত: কেউ পড়েননি, কোন বইয়ে ছাপা হয়নি,‘দৈনিক বাংলা’ ও এখন বিলুপ্ত তাই নতুন দিনের পাঠকদের ভালে লাগবে ভেবে এই ব্লগে পূণ: প্রকাশ করলাম।]

শব্দ
রেজাউদ্দিন চৌধুরী
শব্দকে অনুসরণ করেছে রুণি সব শব্দ যন্ত্রণারহিত নয় জেনেও। তিক্ততার মূহুর্ত প্রলম্বিত হলে অপেক্ষা করেছে শব্দের প্রবল সঞ্চরন।চেতনার অতীত কোন এক কাল থেকে শব্দ গন্ধ আর স্পর্শকে অবলম্বন করে বেঁচে আছি আমি।
পায়ের তলায় মাটির স্পর্শ সঠিক অবস্থান বলে দিতে পারে। কক্ষান্তরে যেতে পারে রুনি অনায়াস একাকীত্বে। গন্ধ শুঁকে বলতে পারে রুনি পুকুরের কোন পারে ফুটেছে বর্ষার প্রথম কদম। আরো পারে রুনি।খুব ভোরে ঘুম কখনো ঘুম থেকে উঠে বৃষ্টি ভেজা মাটির গন্ধে বলে দিতে পারে কখন উপুড় হয়ে মেঘ ঝরেছিল।
আর শব্দ? শব্দ আমাকে মুক্তি দেয় অন্ধকারের যন্ত্রণা থেকে। শব্দময় নিজস্ব পৃথিবীতে নিয়ত রুণির নি:শব্দ পদসঞ্চার। এক একটা শব্দকে আমি মনের চোখে দেখতে পারি অবচেতন অন্ধকারে।এক একটা শব্দ অন্ধকার পর্দায় এক একটা ছবি হয়ে ভাসে।প্রতিটি শব্দের রূপ আলাদা, কিন্তু সবক’টিই অপরূপ। কষ্ট দেয়, যন্ত্রণা বীভৎস ছবি হয়ে ফুটে ওঠে এমন শব্দ ও বিরল নয়।তবু বেশীর ভাগ শব্দ রুণির ভাল লাগে। আমি ভালবাসি সেই সব শব্দ যারা হৃদয়ের খুব কাছাকাছি চলে আসে। রুণি ভালবাসে নি:শব্দ একাকীত্বে বৃষ্টির শব্দ - টিনের চালে, বাইরের উঠোনে, পুকুরের নিথর নিথর জলে বৃষ্টি যখন বৃষ্টি হয়ে নামে। বৃষ্টি যেন খুব সুন্দরী এক মেয়ে। রূপকথার কোন না দেখা পরীর গলায় গান গায়, তাদের পুকুর পারে, বকুল তলায় .. .. ঠিক কার গলায় যেন, .. ঠিক .. । মা কখনো ‘রুণি’ বলে ডাকলে এমনি শব্দ আমি শুনতে পাই।মায়ের গলায় অনেক নূপূর যেন এক সাথে বেজে ওঠে। অন্ধকারে এ ছবির কোন তুলনা পায় না রুণি – তখন উত্তর না দিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে। ছোট বোন শম্পা আর ছোট ভাই রোকন এক সাথে কখনো হেসে উঠলে এমনি আনন্দের শিহরণ সঞ্চারিত হয় নেই কাজ শ্রান্ত দুপুরে।
রুনির ভাল লাগে ঠান্ডা নির্জনতায় অসংখ্য পাখীর গলার শব্দ।পাখীর গলার শব্দে মন ভরে থাকে হিমেল কোন ভোরে। আর ভাল লাগে দূর থেকে ভেসে আসা বাঁশীর শব্দ – গাছের পাতায় বাতাসের শব্দ। কিন্তু বাঁশীর শব্দ কাছে এলে আর ভাল লাগে না। মন চোখ বুঁজে থাকে – রূপ হারিয়ে যায়, শব্দ তখন যন্ত্রণার মত কানে বিঁধে। আর সবচেয়ে ভাল লাগে শব্দহীনতার শব্দ। ছোটবেলায় গল্প বলতে বলতে মা ঘুমিয়ে পড়লে শব্দহীনতার শব্দ শুনতে পেত রুনি। তখন রাত্রির গভীরতা কান পেতে শোনা যেত। মায়ের নাকের কাছে হাত নিয়ে নি:শ্বাসের গভীরতা অনুভব করত রুণি হাতের পাতায়।রাত্রি শব্দহীন ঝংকার তুলত রুণির কানে।তারপর নৈ:শব্দ স্তিমিত হয়ে এলে ঘুমিয়ে পড়ত এক সময়। শব্দময় পৃথিবীতে রুণী আরো একটা শব্দের অপেক্ষা করে আছে অথবা ছিল, অন্তত: আজ সকাল পর্যন্ত, যে শব্দ তার প্রথম শাড়ীর খস খস থেকে অনেক স্পষ্ট, প্রত্যক্ষ, মধুর।যে শব্দ একটি কন্ঠস্বর, তারুণ্যে দীপ্ত, পৌরুষে সবল। রুণী, যে তার প্রথম শাড়ী উপহার পেয়েছে আজ থেকে দু’বছর আগে, শব্দ, স্পর্শ, গন্ধের জগতে যে নির্বাসিতা, অথচ যাকে দেখে মনে হয়না তার কোন অসম্পূর্ণতা আছে, আকাঙ্খিত শব্দ শোনার আগে আজ মাঝরাতে তুমুল শব্দের এক ঝঞ্ঝা তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পড়তে শুনেছে। এখন বিছানায় মা’র পাশে উঠে বসেছে রুণি। বাইরে মহাপ্রলয়ের শব্দ ঘরের দেয়ালে দেয়ালে আছড়ে পড়েছে। মা নি:শব্দে সুরা আবৃত্তি করছেন। শম্পা, রোকন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, চীৎকার করে কাঁদার সাহস তারা হারিয়েছে। ঘর অন্ধকার অনুভব করতে পারে রুণি। বাবাকে হাতড়ে হাতড়ে চেয়ারে বসতে শুনল রুণি। ছাড়া ছাড়া ভাবে কথা বলছেন বাবা।
 কাঁদছিস কেন শম্পা, রোকন? ওরা আমাদের তো মারতে আসছে না? প্রচন্ড গর্জনে সারা আকাশ, যাকে কোনদিন আমি দেখিনি, যেন টুকরো টুকরো হয়ে পড়ছে। অন্ধকার পর্দায় কালো বিভৎস ছবি এলোমেলো নাচছে।
 বাবা, বাজের মত কিসের শব্দ হচ্ছে? রুণি প্রায় অনুচ্চারিত গলায় জানতে চাইল।
 জানিনা, হয়ত মেশিন গান। বাবার গলা ক্লান্ত, বিষন্ন। বিস্ফোরনে ঘর কেঁপে কেঁপে উঠছে।
 শেলিং হচ্ছে কামান থেকে। বাবা আবার বললেন।
 রুণি নীচে নেমে মাদুরে বসো।রুণির মা’ও নেমে এসো।দেয়াল ভেদ করে গুলি চলে আসতে পারে।
এখন মাদুরে গুটি সুটি বসে রুণি শব্দের দিক পরিবর্তন হতে শুনল। রোকন কান্না থামিয়ে রুণির কোলের কাছে বসল। শম্পাও কাছ ঘেঁসে বসল। মা’র সুরেলা গলা বাইরের গর্জনে ডুবে যাচ্ছে। মাঝরাতে নৈ:শব্দ ডানা মেলে চলে গেছে। মর্টার, মেশিন গান, কামানের তান্ডব লীলায় বিধ্বস্ত এখন শহর, অনুভব করল রুণি । শহরতলীতে তাদের ছোট্ট বাসা বার বার প্রকম্পিত হচ্ছে। রুণির গলার কাছে ব্যথার মত একটা কান্না আটকে আছে।
 বাবা মেশিন গান কি?
 বড় বড় যুদ্ধাস্ত্র। যুদ্ধ করছে ওরা।
 ওরা কার সাথে যুদ্ধ করছে বাবা? রোকনের গলা ভয়ে ভেজা।
 আমার সাথে, আমাদের সবাইর সাথে যুদ্ধ করছে ওরা। বাবা কাঁদেননি, কিন্তু নি:শব্দ কান্নায় বাবাকে ভেঙ্গে পড়তে শুনল রুণি।
 কেন বাবা, কেন যুদ্ধ করছে?
 কেন? বাবাকে আর কোন শব্দ উচ্চারণ করতে শুনলনা রুণি, তবু নি:শব্দে বাবাকে বলতে শুনল, ’যুদ্ধ করছে কারণ আমি কেরাণী শহীদ আলী সরকারী অফিসে আট ঘন্টা কলম পিষে দেড়শ টাকা বেতন নিয়ে ন্যূব্জ হয়ে পড়িনি বলে, রাস্তায় নেমে অধিকারের শ্লোগান দিয়েছি বলে।’ শ্লোগান অনেককেই দিতে শুনেছে রুণি। ছাত্র, ফেরিওয়ালা, রিকশাওয়ালা, শিক্ষক, রুণি কখনো বলতে পারেনি কারা যাচ্ছে। কন্ঠস্বরের শ্রেণীবিভাগ নেই। জয়বাংলা এবং আরো অনেক শ্লোগান দিতে দিতে কংক্রীটের রাস্তা ছুঁয়ে অনেক দূর চলে গিয়েছে তারা। শব্দ নৈ:শব্দ মিলিয়ে গেলে জানালার ধার থেকে সরে আসে রুণি। তখন দুপুরের শব্দহীনতার শব্দ ঝংকার তুলেছে তার কানে। একটা সংঘাত এগিয়ে আসছে। ক্লান্ত বাবার কাছে শুনতো রুণি, কিন্তু সংঘাতের রূপ তার জানা ছিলনা। বাবাও কি জানতো?শব্দের আবার দিক পরিবর্তন হয়েছে। অনেক কাছে এগিয়ে এসেছে যেন। ভয়ের শিহরণ সঞ্চারিত হলে রুণির প্রতিটি লোমকূপে। শব্দ আরো বীভৎস ছবি আঁকলো। অনেক রকম শব্দ হচ্ছে - কিন্তু আতংকে অবশ রুণির ইন্দ্রিয় এখন শব্দের শ্রেণী বিভাগ করতে অসমর্থ। শব্দ এখন এলোমেলো ক’টি প্রতিক, ভয়ংকর বিশাল মূর্তি। প্রকান্ড বাঁকানো ঠোঁট দিয়ে তারা ঠুকরে খেতে চাইছে হৃদয়ের সরোবরে লুকনো শান্তি। আমি মুক্তি চাই, একটানা শব্দের গগণবিদারী কারাগার হতে নৈ:শব্দের অতলতায়। আমি ঘুমের মত শান্তি চাই – নি:শ্বাসের মত স্বস্তি চাই। তবু শব্দের ভয়ংকর কারাগার থেকে মুক্তি পেল না রুণি। যন্ত্রণা শুধু কাছে এগিয়ে এল। এখন কালো পর্দায় ভয়ংকর ছবি দেখতে পারে রুণি। ছেলেবেলার প্রায় ভুলে যাওয়া দৈত্যরা কালো বিশাল পায়ে পৃথিবীতে নেমে এসেছে লোকালয়, সভ্যতা চূর্ণ করতে। তাদের অভিশাপের মত নি:শ্বাস রুণি অনুভব করতে পারে। অস্তিত্বের যন্ত্রণায় নির্জীব আমরা অসহায় ক’টি প্রাণী অনেক দৈত্যের আসুরিক হিংস্রতার সীমানায় অলৌকিক কোন শক্তির করুণা প্রার্থী হয়ে বসে আছি। সীমিত বিদ্রোহে রুণির শোণিত শব্দের মহাপ্রাচীর ডিঙ্গোতে চাইল, বর্বর যন্ত্রণার গন্ডি পেরোতে চাইল। মায়ের কোরান আবৃত্তি করা গলা এখন ক্ষীণ হতে হতে ক্রমে থেমে গেছে।বাইরে গোলাগুলির গর্জন এখন ভেতরে বাইরে একাকার। মা চুপ, বাবা নির্বাক। ঘরে ভয়ের নি:সঙ্গ পদপাত। একটানা বাজের গর্জন, যেটাকে বাবা মেশিন গান বলেন এখন খুব কাছে মনে হয়। কখনো মানুষের ভয়ার্ত চীৎকার শোনা যায়। ভয়ার্ত চীৎকার হঠাৎ থেমে যায়। হয়তো মৃত্যু তার বিশাল হাতে স্তব্ধ করে দেয় কোন কন্ঠ। ভয়ার্ত কুকুর কখনো ডেকে ওঠে আচমকা। অবশ্য এ সবই রুণির অনুমাণ মাত্র। এমনটি নাও হতে পারে যে মৃত্যু তার বিশাল বিভৎস হাতে স্তব্ধ করতে এগিয়ে আসছে লক্ষ কন্ঠ।
খুব কাছে একটা গুলির শব্দ শুনল রুণি, একটা চীৎকার মাঝপথে থেমে গেল। হঠাৎ মুত্যুকে অনুভব করল রুণি। কান পাতলে এখন মৃত্যুর পায়ের শব্দ শোনা যায়।
 ওরা আমাদের মানুষ মারছে বাবা।
 মারছে। খুব শান্ত বাবার গলা।
ক্লান্ত রোকন ঘুমিয়ে পড়েছে। শম্পা প্রায় নি:শ্বাস বন্ধ করে রুণিকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।
 আমরা এখান থেকে পালিয়ে যেতে পারি না বাবা?
 কোথায় পালাবো মা? জানোয়ারেরা চারদিক ঘিরে রেখেছে। আগুণ জ্বলছে বাইরে। আমাদের দেয়াল আর টিনের চালের ফাঁক দিয়ে আগুণের আভা আসছে। কোথায় আগুণ জ্বলছে বলতে পারছি না।
আমি জানি বাবা, বাইরে আগুণ জ্বলছে, আগুণের উত্তাপ আমি অনুভব করতে পারি। এখানে আমাদের বুকেও এক নি:শব্দ আগুণ জ্বলছে। আমাদের মানুষ, আমরা সবাই এক অসহায় আগুণে পুড়ে মরছি। তারপর ক্রমান্বয়ে ঘর কাঁপানো বিস্ফোরণ দধিচির হাড়ে তৈরী মানুষের মৃত্যুবাজ, গুলির একটানা আওয়াজ, হঠাৎ থেমে যাওয়া আর্ত চিৎকার এক সময় সহনীয় হয়ে এলে অদ্ভুত সাহস এল রুণির মনে। এখানে এই নগরীর সবাই, যারা আমার মত বদ্ধ ঘরে, সবাই আমারই মত অসহায়, শুধু শব্দকে অনুসরণ করে মৃত্যুর মূহুর্ত গুণছে। মৃত্যু শব্দ হয়ে শহরকে ঘিরে ফেলেছে। আমাদের মুক্তি নেই। তবু আমরা সবাই এখন এক এবং অলঙ্ঘ্য্ শক্তি। শব্দের কারাগারে রুণি যখন প্রায় সমর্পিতা তখন হঠাৎ নৈ:শব্দ নামল যার জন্যে রুণি প্রস্তুত ছিল না।
অনেক দূরে একটা ক্ষীণ শব্দ – বাকি সব নিস্তব্ধ নি:ঝুম। শব্দহীনতা ঝংকার তুলল রুণির কানে। শব্দহীন সোনালী পাখি তার বিশাল ডানায় মুড়ে দিল রুণিকে, তার বাবাকে, মাদুরে শুয়ে থাকা মা আর রোকনকে, প্রায় বুকের সাথে মিশে যাওয়া শম্পাকে। কিন্তু হঠাৎ আতংক তাড়া করে এল, সোনালী পাখি ডানা মুড়ে নিল। হিমরাত্রিতে মাথার উপর থেকে আবরণ সরে গেল। শব্দ হঠাৎ থেমে গেল কেন? কোন ভয়ংকর মতলব নিয়ে চুপ করে আছে নিশাচর দানবেরা কে জানে? নিজস্ব নির্জনতায় বারবার শিউরে উঠল রুণি। শব্দহীনতা এখন নতুন যন্ত্রণার নাম, শব্দহীনতা আরেক অত্যাচার। আমিতো শব্দহীনতায় মুক্তি চেয়েছিলাম, কান ভরে শুনতে চেয়েছিলাম শব্দহীনতার শব্দ - মায়ের গলায় গল্প থেমে যাওয়া রূপকথা রাতের মত, ফেরিওয়ালার হাঁক দূরে মিলিয়ে যাওয়া প্রখর দূপুরের মত। কিন্তু এমন কেন হল? কয়েক ঘন্টার শব্দের কারাগার আমার নৈ:শব্দের শান্তি নিয়ে উড়ে গেল।
দরজার ছিটকিনি খোলার শব্দ শুনতে পেল রুণি।
 বাবা, তুমি কোথায় যাচ্ছ?
 তুমি পাগল হলে নাকি? অন্ধকারে গুলি খেয়ে মরতে চাও? এতক্ষণ নি:শব্দ মা ঝংকার দিয়ে উঠলেন।
 তোমরা একটু চুপ করোতো। কোথাও যাচ্ছি না আমি। এই বাইরে, আমাদের উঠান থেকে দেখছি, কিছু দেখা যায় কি না।
বাবা বাইরে চলে গেলে কি ভীষণ নিস্তব্ধতা নেমে এল। এখন চৈত্র মাস, কিন্তু ঝরাপাতার শব্দ নেই। পাতার সির সির শব্দ, যে শব্দ আমি এত ভালবাসি, তা’ও কোথাও নেই - এমনি ভয়াল নৈ:শব্দ। শম্পা ও ঘুমিয়ে পড়েছে – কিন্তু শম্পার নি:শ্বাসের ভারী শব্দ শোনা যায় না। আমি আর এই নৈ:শব্দ সহ্য করতে পারছি না। কেন তারা মৃত্যুর মত চুপ হয়ে আছে? কান্নার শব্দ আসুক, আমার দু’কান বধির করে হাসির শব্দ বাজুক। হঠাৎ অনেক দূরে ক্ষীণ কান্নার আওয়াজ শুনল রুণি। একটা মাতালের মত উৎকট হাসির শব্দ শুনল। একটা গুলির শব্দ শুনল, ছোট্ট একটা আর্তনাদ শুনল। তারপর নৈ:শব্দ আরো নিঝুম হয়ে নামল।
 ঘুমিয়ে পড় রুণি, শম্পার পাশে। মা উঠে বসেছেন।
আমি ঘুমোতে পারছিনা মা, শব্দহীনতা ভয়ংকর পাথর হয়ে আমার বুকে চেপে আছে। নৈ:শব্দ কালো আর বিশাল মুখ ব্যাদান করে আছে অন্ধকার পর্দায়। আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না।
কিন্তু শব্দ আবারো শুনল রুণি। ভারী মোটা গলায় ভিনদেশী ভাষা শুনল। শহরতলীর কংক্রীটের রাস্তায় শক্ত বুটের শব্দ শুনল। তার একান্ত ভাষায় ভীত বিকৃত গলায় কাকে ক্ষমা চাইতে শুনল।
 ছেড়ে দাও বাবা, মাপ করে দাও। আমি কিছু জানি না।
বুটের শব্দ দূরে মিলিয়ে গেল। শব্দহীনতার আতংক দূর হল না। উৎকন্ঠায় উঠে বসল রুণি। বাবা আসছে না কেন এখনো? নিঝুম রাত আরো বিশাল আর ভীতিকর মনে হল রুণির। মহাপ্রলয়ের আগে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া প্রকৃতির মত মনে হয় ঘরকে। কী নির্জন একাকীত্ব! এ ঘরে মা একা, আমি একা, আমরা সবাই একা – যন্ত্রণার মত নি:সঙ্গ। স্তব্ধতা এখন মস্ত একটা সরিসৃপ, ঠান্ডা হিমে ভরে দিচ্ছে রুণির হৃদয় প্রতি নি:শ্বাসে। রুণির চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে হল। প্রচন্ড আঘাতে টুকরো টুকরো করে দিতে ইচ্ছে হল পাথরের মত স্তব্ধতা। আমি আর সহ্য করতে পারছি না শব্দহীনতার ভয়ংকর শব্দ।
 ভোর হয়ে এসেছে মা?
 না। ছোট্ট নি:শ্বাসের মত শোনাল মা’র জবাব।
বাইরের শিকল খুলে দ্রুত ঘরে ঢুকলেন বাবা। ছিটকিনি তোলার শব্দ শোনা গেল।
 কোথায় ছিলে এতক্ষণ?
 উঠোনে, আমাদের বেড়ার ঝোপের নীচে বসেছিলাম। আমাদের মোড়ের মুদিখানার লোকটাকে সামনের রাস্তা দিয়ে ধরে নিয়ে গেল। ভয়ে বেরোতে পারছিলাম না।
 কে তোমাকে বাইরে যেতে বলেছিল? ঝাঁঝিয়ে উঠলেন মা। বাবা নিশ্চুপ। বাইরে অনেক দূরে দু’একটা গুলির শব্দ। নিস্তব্ধ রাত আবার চেপে বসল।
 আমাদের পশ্চিমে রেল লাইনের ধারে বস্তি পুড়িয়ে দিয়েছে। আগুণ উঠছে উত্তর পশ্চিম দিকে থেকেও। বাবা ফিস ফিস করে বললেন। জমাট বাঁধা রাত্রি বাবার কথা গুলি শুসে নিল। নির্জন অতলতায় শুধু কয়েকটি নি:শ্বাসের শব্দ। আমি যদি বাবার মত ফিসফিস করে কথা বলি, আমার আতংক দূর হবে না। বুকের উপর চেপে থাকা ঠান্ডা পাথর আরো জেঁকে বসবে শুধু। রুণি চুপ করে থাকল। নৈ:শব্দকে স্থির থাকতে দিল। এখন রাত কত? ঘুম একটা নীল ভ্রমর হয়ে মস্তিষ্কের কোষে কোষে ছড়িয়ে দিচ্ছে অবশ গুঞ্জন। তবু ঝড়ের আগে নি:শ্বাস রুদ্ধ হয়ে আছে। ঘুমোতে পারছে না রুণি। শম্পার মৃদু নি:শ্বাসের শব্দে চৈত্রের পাতাঝরা মর্মর শুনতে চাইল রুণি। কষ্ট করে জলের উপর বৃষ্টির শব্দ ভাবতে চাইল। কিন্তু প্রকৃতি এখন রুদ্ধ হয়ে আছে। যে কোন মূহুর্তে প্রচন্ড শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে। আমি কান পেতে আছি। আমি জানি ভয়ংকর একটা কিছু হতে যাচ্ছে। আমি শুনতে পাচ্ছি বিশাল কুশ্রীতার নি:শব্দ পদপাত। অনিশ্চিত আতংক মুখ ব্যাদান করে আছে।
অনেক দূরে আবার ক্ষীণ কান্নার শব্দ, কিছু গুলির শব্দ, ভিনদেশী হল্লার শব্দ শুনল। শব্দ কিছুক্ষণ পরেই মিলিয়ে যাচ্ছে অনিশ্চিত নৈ:শব্দে।
 ভোর হয়েছে, বাবা?
 না, মা, এখনো ঘন্টা দু’এক বাকী।
আমরা কি অনন্ত রাত পার হচ্ছি? অনেক যুগের শব্দের যন্ত্রণা আর নৈ:শব্দের আতংক পেরিয়ে ভোর হতে আরো দু’ঘন্টা বাকী আছে জেনে বিমর্ষ হল রুণি। ভোর হয়ত যন্ত্রণার শেষ নয়, রুণির কাছে অন্ধকারেরও শেষ নয়, তবু কে জানে, না দেখা ভোরের আলোয় হয়ত স্বস্তিতে ফেরা যাবে।
 বাবা, বাইরে কে কাঁদছে যেন?
 কই, কেউ কাঁদছেনা তো!
ভুল শুনেছে রুণি, হয়ত তার আতংক মনের গভীরে কোথাও কান্না হয়ে বেরোত চাইছে।
কিন্তু হঠাৎ নৈ:শব্দ খানখান হয়ে ভেঙ্গে গেল। খুব কাছে একটা প্রচন্ড শব্দে ঘর কেঁপে উঠল। সাথে সাথে অসংখ্য গুলির শব্দ বজ্রের নির্ঘোষে বেজে উঠল। ভিনদেশী গলায় কাকে হুকুম দিতে শোনা গেল। মানুষের গলায় মৃত্যুর আর্তনাদ শুনল রুণি। মা উঠে বসেছেন। আজীবন বিপদে যাকে ডাকে তেমনি কোন শক্তিকে ডাকছেন। মা’র হাত কাঁপছে অনুভব করল রুণি। রোকন, শম্পা রুণির পাশে ফুঁপিয়ে কাঁদছে হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গা আতংকে। একটানা গুলির শব্দ, মেশিন গান, মর্টারের গর্জন। রেল লাইনের উপর ট্রেনের ইঞ্জিন চলার মত শব্দ শুনতে পেল রুণি।
 ও গুলো ট্যাঙ্ক। ফিসফিস করে বললেন বাবা।
 রুণির মা, রুণি, চল, খালের ধার ঘেঁষে আমরা গ্রামেই চলে যাই।
 না, বাবা, আমরা যাব না। ওরা শব্দ নিয়ে আমাদের আক্রমণ করেছে – আমরা আর মরব না। আশ্চর্য্য শান্ত গলায় বলল রুণি।
অনেক প্রতীক্ষার পর কোন পুরুষের সবল কন্ঠ শোনেনি রুণি, শোনেনি কোন পাখির নরম গলার গান অথবা খর নিদাঘের উঠোনে অকাল বৃষ্টির শব্দ, তবু আশ্চর্য্য সাহসে বুক ভরে উঠল রুণির। গোলার আঘাতে আমাদের দেয়াল চূর্ণ হয়ে যাবে, মেশিন গালের গুলি ছিন্নভিন্ন করে দেবে আমাদের – তবু – তবু আমরা বেঁচে থাকব।
নৈ:শব্দের আতংক শেষ হয়েছে। রাত্রির অন্ধকারে এখন কাপুরুষতার সশব্দ অভিঘাত। শব্দ বীভৎস, তবু রুণির এখন স্বস্তিতে ফেরা।

সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুলাই, ২০১৬ রাত ৯:০৫
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ

লিখেছেন হাসান কালবৈশাখী, ০৩ রা মে, ২০২৪ সকাল ৮:০২

গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।


... ...বাকিটুকু পড়ুন

৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ০৩ রা মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০০



১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৯


মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'

লিখেছেন এমজেডএফ, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ

লিখেছেন নীলসাধু, ০৩ রা মে, ২০২৪ রাত ১১:২২

আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×