somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাতের সাথে একান্ত বাতচিত

০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ১১:২০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজকাল বিকালগুলো বড় ছোট। রাত হলে দিনের কর্মব্যস্ততা শেষ । আয়েশ করে চা খাবো , টিভিটা দেখবো , পেপারটা পড়বো, মধ্যবিত্তের সীমিত বিলাসিতা। সন্ধ্যাটা ভালোই কাটে । বদ্ধ জলাশয় থেকে মুক্তি পেলে জলবাসীদের যেমন লাগে । তারপরে ঘড়ি আটটার কাঁটা পেরিয়ে গেলেই অদ্ভূত বিষণ্ণতা ভর করে। রাতের বয়স বেড়ে যাচ্ছে। বয়স বেড়ে গেলে শুধু মানুষকেই অসুন্দর দেখায় না, রাতেদেরও দেখায়। অবশ্য ,রাতের আবার সৌন্দর্য কি? রাত আঁধারকালো , কালোতে কোন সৌন্দর্য থাকে না- এটাই তো সবসময় জেনে এসেছি।মায়ের মেজাজ খারাপ , সচরাচর তাই থাকে । অতএব রুটিন কিছু বকাঝকা শুনে একটু মনখারাপ করি।পৃথিবীর সব মায়েরা সবসময় সন্তানদের শাসন করতে পছন্দ করেন। আগে ভাবতাম , হয়তো খুব খারাপ কিছু করে ফেলেছি, মায়ের ভাষ্যমতে তার অমুক অমুক ভাবীদের মেয়েরা কখনো এমন অকর্মণ্য নয়। পরে শুনি আমার অন্য বান্ধবীদেরও একই অবস্থা। ভালো লাগে না, ভালো লাগে না। যে মানুষটি সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে, সেই কেন সবচেয়ে কম এর প্রকাশ দেখাবে? আমি স্থির করি, কখনো আমার মেয়ে থাকলে,তার সাথে এমনটা মোটেই হবে না।সে সারা বেলা আড্ডা দিলে, কি রাতে একটু ঘুরতে গেলে , কি একটু বেশী শপিং করে ফেললে মোটেই আমি বকবো না। পরক্ষণেই মনে হয়, সেটা হবে না। কারণ- এই যে আমি বিরক্ত হচ্ছি , মাও আমার উপর বিরক্ত । সারাক্ষণ নিঁখুত করে তোলার চেষ্টা থেকে তিরস্কার এটা তো আমার মায়ের মাও তাঁর প্রতি করেছেন। আবার আমার মাও আমাকে। আমিও ভবিষ্যতে এর থেকে বের হতে পারবো না।মায়েরা সবসময় চান তাদের সন্তান সর্বগুণী হবে। তাই এত শাসন বারণ।সব বুঝেও মাঝে মাঝেই কারণে অকারণে চটে যাই। আগে খুব রাগ ধরে রাখতে পারতাম না।এবেলার অভিমান পরের বেলাতে গলে জল।বরফের আয়ু কতক্ষণ যদি উষ্ণতা থাকে? অথচ এখন সপ্তাহ গড়ায় মান পুষে রাখি। একসময় অন্য পক্ষকেই অচলাবস্থা দূর করতে এগিয়ে আসতে হয়।ভালো লাগে না তখন নিজেকেও নিজের কাছে । অথচ আমি এটাও টের পাই যার উপর মনে খুব রাগ তাকে আমি ভালোই বাসি , বিশেষ করে মাকে তো খুবই বেশি, তবু আগের মতো আগে পিছে ঘুরে বলতে বোঝাতে পারি না। বড় হবার উদ্ভট অহম মনে আসে। আবার এটাও তো জানি , মাও আমাকে ভালোবাসেন খুব বেশী ,জানেন আমিও তাকে বাসি অনেক অনেক।তবুও তো...এমন খুটখাট লাগে।কেন?- মাঝে মাঝে মনে হয়, সম্পর্কে শুধু ভালোবাসাটাই বুঝি যথেষ্ট না।


তবে একসময় আমাদের ঠিকই মিটমাট হয়ে যায়। আবার সব আগের মত। রাতগুলো অভিযোগ আনেও, কিন্তু অভিমান ভুলিয়ও দেয়। নিশার আয়ু বাড়লে টিভি রিমোটের টেপাটেপি জোরসে শুরু হয় । অস্থির আঙ্গুলে বিভিন্ন সোপ অপেরায় কিছুক্ষণ।মন বসে না। প্রায় প্রতিটি নায়িকার মুখই একরকম। ক্রন্দসী । চোখের কোনে জল মজুদ করাই থাকে। একঘেঁয়ে বউ শাশুড়ির যুদ্ধ। চমৎকার চৌকস নায়িকা মেয়েগুলোর কোন বড়লোক পরিবারে বিয়ে হয় । ব্যাস তারপরে তার সব শিক্ষা শিকায় তুলে আর সব স্বপ্ন ভুলে শুধু আদর্শ গৃহিনী হয়ে গৃহাস্থালী টানাপোড়েনেই শেষ কাহিনী।সোপ অপেরাগুলোয় বিশেষ আকর্ষণের কিছু নেই তাই ঘুরে ঘুরে বাংলা চ্যানেলগুলোতে যেতে থাকি। মনে খুব পণ নিয়ে, এখন থেকে ছাঁইপাশ ভারতীয় কিছু দেখবো না।একটা অ্যাড শুরু হলেই কিন্তু দেশপ্রেম আর অটুট ধৈর্য শেষ।

বাবাটা আমার বেশ ভালোমানুষ , সন্তানের সাথে বেশ বন্ধুসুলভতা । তাই মায়ের সাথে বাঁধলেই তার কাছে খুব মন খুলে অভিযোগ করি। সেই অভিযোগে বাবার বুঝদার কথার পলিমাটির প্রলেপ পড়লেই মন শান্ত হয়ে ওঠে।তখন মন খারাপ নিয়ে মায়ের কাছে যেতে , করা ,না করা ভুলত্রুটির জন্য মাপ চেয়ে পরিষ্কার হয়ে নিতে ইচ্ছা করে।রাত আরও বাড়লে বেজায় বেখাপ্পা লাগে মুড।অনেক দিন পড়া পড়তে পড়তে বা পড়ার ভান করতে করতে ইদানিং কেমন খালি খালি ভাব। পড়ার শিকল পরতে পরতে অভ্যাস হয়ে গেছে। এখন না থাকলে মুক্তিতেও স্বস্তি নেই। বাবার খুব শখ তার মেয়েটি বড় অফিসার হয়। একরাশ বই এনে দিয়েছেন । ফরম পূর্ণ করার তাগাদায় তাগাদায় না করে উপায় নেই। রাত বয়সী হলে আগের মত খেতে বসি একলা, মায়ের আরেকদফা অভিযোগ-মেয়েটা কেমন অসামাজিক। ঘরে মাত্র তিনটা মানুষ তিনবারে খাবে কেন?একেকবারে খেলে কাজ বেড়ে যায়। কিন্তু পড়ার অছিলায় বিনিদ্র রাতের অজুহাতে সবাইকে চুপ করিয়েও দেয়া যায়। কিন্তু তাতে কি , যখন সবাই ঘুমাতে চলে গেলে নিজেকে নিয়ে বসি -শুধু রাতের বয়সই যে বাড়ে তা তো না, তখন বয়সী রাতের সাথে নিজের মনের ভারও বাড়তে থাকে।ভাবি, বই ছড়িয়ে একা একা কার সাথে ভান করছি ? নিজের সাথে? বাইরে তাকাই। এতক্ষণে রাত এগারোটার কাঁটা পার হয়েছে। সব শুনশান হয়ে এসেছে। রাস্তা পুরোই ফাঁকা।নিঃসঙ্গ রাস্তার দিকে তাকিয়ে অদ্ভূত শান্তি ভর করে। এখন আর কোন চোখ ওখানে তাকিয়ে নেই ভ্রুকুটি তুলে। আগে আমি প্রায়ই জানালা খুলে পর্দা সরিয়ে রাখতাম। ছয়তালায় তাকিয়ে সামনে অনেকটা দূরে আবার অন্য দালান।খোলা জানালায় মৃদু রাতের শীতল হাওয়া আসে। সেই জানালার পাশে ধুমায়িত চায়ের মগ নিয়ে বসতাম।ভালো লাগতো। তারপরে একদিন শুনলাম , মা এসে বলছেন , নিচে দেখা কোন ভাবিরা বলেছেন এভাবে বসলে বাইরে থেকে দেখা যায়, অতএব সমাজের চোখে আপত্তিকর।তাই জানালা খোলা থাকুক, তবে পর্দাটা থাকুক টানা। পর্দা টানা থাকলে তো আকাশের সুন্দর ঝিকিমিকি তারা চাঁদ দেখা যাবে না। যতদিন এই পর্দাটা টানা হয়নি ততদিন পর্যন্ত আকাশের গ্রহনক্ষত্র নিয়ে মাথাব্যাথা আমার ছিল না। নিচের দিকে তাকিয়ে অগণিত গাড়ির চওড়া হেডলাইট , চলন্ত পথচারীর পিঁপড়ের মতো সারিই যথেষ্ট ছিল উদাস তাকিয়ে থাকার জন্য। যখন ট্যাবু আসলো তখন মনে হল , আহা! ঝিরিঝিরি বড় গাছটার পাতার ফাঁকে আকাশে কোনদিন পূর্ণিমাটা আসে তাও ঠিক মতো দেখা হলো না কখনো। এভাবেই মনে হয় আমরা জীবনে সবকিছুকে হারিয়েই শুধু বুঝে পাই , খুঁজে পাই।

তবে , এই গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমাতে গিয়েছে এখন জানালার ছড়ানো পর্দাটা নিশ্চিন্তে সরিয়ে দেই। এখন আর কোন সামাজিক চোখ উঁকি মেরে নেই। ঢং ঢং ঢং করে বাজে না এখনকার ঘড়িরা। নিঃশব্দে বারোটার কাঁটা ছুয়ে যায়। এখন সিন্ডারেলার পোশাক বদলের সময়। আমিও নির্দ্বিধা হই। মধ্যরাত্রিতে দীনহীন ছাইকন্যার মত আমিও অবারিত। ওর মতো আমাকেও আমি যা তাতেই গ্রহণ করতে হবে,সারা পৃথিবীর বাতাস আমাকে ছুঁয়ে যায়। দূরের গ্যালাক্সি,নাম জানা অজানা তারাগুলো থেকে আলো এসে আমাকে স্পর্শ করে। নিস্তব্ধ রাত্রিগুলো না থাকলে কিভাবে যে এত সাহসী হতে পারতাম!রাতের কাছে খুব কৃতজ্ঞ লাগে আমার।

অথচ কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাঁকা রাস্তাগুলো ফিরে ব্যঙ্গ করাও শুরু করে। ফাঁকার রাজ্যের রাণী হয়েও কি লাভ? সাদা মনের কালো মনের ধূসর মনের মানুষে ভরপুর , তা সে যেমনই হোক ,মানুষ না থাকলে মানুষের জগতের চারপাশে একসময় সবই অর্থহীন । এই নিশুতি রাতের সৌন্দর্য, গোছানো নগর চিৎকার করে বলে মানুষ চাই, মানুষের প্রাণচাঞ্চল্য ,ঝগড়া কলহ, উল্লাস, হাসি, গন্ডগোল সব চাই।



বই নিয়ে এই যে আমি এতক্ষণ ধরে পড়া- খেলা করছি, একটা পাতাও কিন্তু উল্টাই নি। কিভাবে উল্টাবো ? অনিন্দিতা এসেছে যে কথা বলতে।বলি, 'না , এখন কথা হবে না ,পড়ছি। ডিস্টার্ব করবি না।'

অনিন্দিতা ঝাঁকিয়ে ওঠে, 'ওরে আমার পড়ুনিরে। বেশি ভাব মারবি না।''তোকে আজকে থেকে চিনি না আমি। '

'আচ্ছা শোন, বাজিরাও মুভিটা দেখেছিস? ঐ যে দীপিকার?'

'না ?!-তুই একটা ক্ষ্যাত ,..আর বোরিং।'

'কি মজা পাস ফালতু বইগুলো মাঝে,এই বইপড়া বিদ্যা নিয়েও এখন তো তোকে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স আর সাধারন জ্ঞানের একরাশ বই দেখতে হচ্ছে, আচ্ছা , বল 'দি সলিটারী রিপার' কার লেখা? '

'জানি না, আমি এত কথার মধ্যে শুধু শেষটার সংক্ষিপ্ততম জবাব দেই।

' তুই কিস্যু জানিস না, দেখিস এটাই আসবে।'

'ভ্যার ভ্যার না করে বিদায় হ।' ধমক দেই।

কান ফাটিয়ে একটা যাচ্ছেতাই হিন্দি গান গাইতে গাইতে বিদায় হয় অনি।-এমন হেঁড়ে গলা , গান তো না মেশিন গান!

আমি আবার একটু টিভি দেখি , একটু আবোলতাবোল গান শুনি, একটা পুরানো বইয়ের দুই পাতা উল্টাই যেটা আগেই অন্তত পাঁচবার পড়ায় এখন এমনকি ক্লাইম্যাক্সগুলোও আকর্ষণহীন। শুধু পাঠ্যটা পড়ে থাকে। একটু অপরাধবোধ জমা হয় মনে। মনে হয়, মা আমার সম্পর্কে যা যা বলছে সব সত্যি,আমি আসলেই একটা অপদার্থ। জনকের ঔদার্য আর স্নেহের, আকাঙ্খার কোন প্রতিদান আমি দিতে পারলাম না , একটা অজ্ঞাতকুলশীল ভিড়ে মিশে যাওয়া কেউ হয়েই নিস্ফলা জীবন পার করতে হবে আমাকে।

খামাখা অনিন্দিতাটার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করলাম। খামাখাই , স-ব। ধ্যুৎ। একসময় গ্লানি মুছে মনে মনে একটা গল্পের আঁক কষতে থাকি। আবার অনেক তথ্য ঠাসা চাকরীর বইগুলো দেখে নতুন নতুন লেখার নানা মশলা দেখতে থাকি মনের চোখে চেখে। এমন সময় রাত্রি আসে। চোখ টিপে ধরে,..'কে কে?' করি। কোন উত্তর নেই।রাত্রিকে চিনে নিতে হয় তার নীরবতায়।

চোখ ছেড়ে দিলে আমি তাকিয়ে ওকে দেখি আর বিরক্ত হই। ও যেন একটা বাহানা আমার কাজ ফাঁকি দেবার সেই ভেবে আশ্বস্তও হ্ই। সব দোষ পরের , খালি ডিস্টার্ব করে আমার ধনুভাঙা পণে ব্যাঘাত ঘটাতে চায়! 'কি ব্যাপার?' খরখরে আমার গলার জিজ্ঞাসার সুরটা গায়েই মাখে না রাত্রি। সে ঘোর পর্দানশীল । নেকাবী মুখে শুধু আওয়াজ শুনি, ' এমনি। আজকে তুমি ফ্রি আছো দেখে এলাম।'

' ফ্রি আছি মানে? 'বই দেখিয়ে আমি ইশারা করি।রাত্রি সোজাসুজি বলে, 'না, তুমি মনে মনে ভাবছো কলেজ পালানো কিশোরী সুমির কথা।'
' কিভাবে জানলে?' আমার এই প্রশ্নেই আমার ভাবনারা স্বীকার হয়ে পড়ে। অবাক হই, আমার মনের কথা রাত্রি বুঝলো কিভাবে? সত্যি আমার গল্পের নায়িকা সুমিই তো। তবে নামটা হয়তো আমি পাল্টেও দিতে পারি, এখনও কিছু ঠিক নেই।

ঠিক তখন রাত্রি বলে,' তবে পাল্টেই দাও, সব পাল্টে দাও , লেখো নায়িকার নাম রাত্রি। গল্পটাও বদলে আমার গল্প লেখো।'

'কি বলছো? তোমার আবার গল্প কিসের ?'

'নেই?' স্পষ্ট টের পাই নেকাবের মধ্যে থেকে সহসা চপলা হয়ে ওঠে রাত্রির ভ্রু।

'মনে আছে, গতদিন তুমি ফিরেছো রাত করে , কারণ রিপোর্ট জমার ডেডলাইন ছিলো। দেখলে একটা দুধসাদা বিড়াল , গলার কাছটা হলদে সোনালী ।একটা ইঁদুর ধরেছে, ওটাকে নিয়ে খেলছে। একবার ছেড়ে দেয় আরেকবার লেজ কামড়ে ধরে ।প্রতিবার ছাড়া পাওয়ার অণুপলটাতেই ইঁদুরটা যেই ভাবে এবার সে বেঁচে গেল - পালিয়ে যেতে ধরে -ঠিক তখনি বেড়ালটা আবার ওর লেজ কামড়ে ধরে।এই চলছে , তুমি ঠায় দাঁড়িয়ে মজা দেখছো। শ্রান্তি ভুলে গেছো।একসময় নতুন একটা গাড়ি ঢুকলো , বিড়ালটা ক্ষণিকের জন্য অপ্রস্তুত হয়ে যেতে ইঁদুরটা দৌড়ে পগারপাড়। বিড়ালটা পুরাই হতভম্ভ ।তোমার মনেও বিড়ালটার জন্য খুব একটু আফসোস হলো। আবার এই তুমিই গত সপ্তাহে হঠাৎ রাতে হাঁটতে বের হলে। একটা ইঁদুর একটা ব্যাঙকে তাড়া করছে। ঝাপটা ঝাপটি চলছে। তুমি কাছেই ঝুঁকে দাঁড়িয়েছো তামাশা দেখতে। ইঁদুরটা টের পেয়ে শিকার ফেলে তোমাকেই আক্রমণ করে আরকি। ভেবেছে তুমিও হয়ত ওর খাবারে ভাগ বসাতে চাও। তুমি ঐ ক্ষুদে ইঁদুরকই ভয়ে পেয়ে দূরে সরে গেলে। ফেরার পথে তোমার কৌতুহল আর যায় না, কে জিতলো এই দ্বন্ধযুদ্ধে? তুমি ফিরে এসে আঁতিপাতি করে সেই জায়গা ঢুঁরে বের করলে- ইঁদুরটা কিছু যেন খাচ্ছে। ব্যাঙটা কোথাও নেই। বুঝতে পারলে, ব্যাঙটা শেষমেষ হেরেই গেল। এই সময়ে তোমার একটা উল্লাস হলো। কেন বলোতো? যুদ্ধ চললেই সবাই একটা পক্ষ ধরে ফেলে।নিরপেক্ষতা মুলত কেতাবি শব্দ। তুমি চাইছিলে ইঁদুরের তুলনায় কুৎসিত ব্যাঙটা ওর খাদ্যবস্তু হয়ে যাক। যেমন আগের সুন্দর বিড়ালটার জন্য তুলনায় কুৎসিত ইঁদুরটা । কেমন ঠিক কি না ?তাহলেই দেখ, হয়ে গেল, দুইটি মাত্র দৃশ্যের জীবননাট্যের ক্ষুদ্র একটি বর্ণবাদী গল্প।'


'আবার দেখ, রাতে এই যে রাতজাগা তুমি, হাস্না হেনার গন্ধ পাওনা? মন কেমন করা?ওর গন্ধে নাকি সাপ আসে। শিউলি শুধু শরতের কিন্তু সারা বছর তোমাদের বাড়ির ঠিক কোনার মাথা খারাপ গাছটা শিউলি ঝরায় । শিউলিকে বলা হয় দুঃখী গাছ, কারণ সে তার ফুলকে ধরে রাখতে পারে না এমনকি একটি রাত্রিও। ঐ শিউলীটা তাহলে শুধু সিজনাল না , সারা বছরের দুঃখী। পরদিন সকালে প্রাতঃভ্রমণী কেউ হয়ত তারিফ করে , বেশীরভাগই গাড়ির নির্মম চাকায় চাপা পড়ে। কত নিঃশব্দ দুঃখের অবদান যেমন এজগতে অনাদৃত থেকে যায় সেরকম.. '

'অথবা ,সচল প্রাণের সাড়া- তোমাদের পাশের যে উঁচু গাছে গতবারের মত কাক দম্পতি বাসা বেঁধেছে। তখন তুমি ওদের ছবি তুলেছিলে বলে এবার আরো উঁচু ডালে আরো ঝুপসি মতো করে- যেন ক্যামেরার চোখ ওখান পর্যন্ত না পৌঁছাতে পারে। দেখলে কেমন প্রাইভেসী বোধ ওদের! মাঝে মাঝে রাতে বিরেতে ডেকে ওঠে সময় ভুলে, কেন বলতো? আবার কঁকিয়ে ওঠে অবিকল মানব শিশুর মত সিঁড়িতে আশ্রয় নেয়া বিড়াল ছানা। ছোট হলে কি হবে সে ভারি ভদ্রলোক , সকাল হলেই নোপাত্তা। তোমরা তো নগরের মানুষ, তবু জানো , আগে এখানে শেয়াল ডাকতো। ওগুলো এখন কোথায় গেল? এখনও এই শহরেই রাত হতে কত নিশাচর প্রাণীর জীবন জেগে ওঠে। তোমরা মানুষেরা আসলে বড় অহংকারী ,কেবল নিজেকে নিয়ে থাকলে কাহিনী পাওয়া যায় নাকি?'

'কিংবা ধর বেশ পোড়া পোড়া গন্ধটা আসছে , ঐ তোমার মোটা পর্দাও ভেদ করে- কোথা থেকে এই শীত শীত রাতগুলোতে? কোথাও হয়ত বারবিকিউ চলছে। আরো দূরে তাকাও , দৃষ্টিটাকে স্রেফ নিজের ঘরে না রেখে। সোনালী আলোর মালা জ্বলছে -দেখ।এ বিয়ের মৌসুম। কান পেতে দেখ,নিভৃত বাসরে বধূর সলাজ প্রতীক্ষার হৃদয়স্পন্দনও শুনতে পাবে। তাতে শঙ্কা আশা আকাঙ্খা অধীরতা আর নতুন জীবনে পা রাখার আনন্দ সব একসাথে বাজে। সমান লাজুক যে বরটি এমনিতে কাব্যের ধার দিয়েও যায় না, কিন্তু বউকে শোনাবে বলে লম্বা একটি প্রেমের কবিতা মুখস্ত করেছে -সেটা ভুলে গিয়েছে বলে তার বেশ বিব্রতভাব। কত হইচই, উচ্ছ্বাস,কোলাহল ...তারপরেও তুমি বলবে আমার কোন কাহিনী নেই?'
রাত্রি থামে না, বলে যেতে থাকে,' আরো শোন মন উদাস করে দেয়া শহরে শীতের আয়োজনের গ্রাম্য বাদ্য , তবলা বাঁশি , রাতভর ওয়াজ, কাওয়ালীর টেনে টেনে চলা সুর, কত কিছু , এই নাগরিক জীবনে অন্য রকম একটা গল্প বলে যেতে পারে ওরাও। কল্পনার চোখেই দেখো সেখানের সমারোহ, একেকটা রাতজাগা মানুষের একেকটা আলেখ্য।'



কতটা সময় কেটে গিয়েছে জানিনা। 'বেশ লাগলো শুনতে তোমার গল্প। এভাবে ভাবিনি কখনো।' আমি বলে ফেলি।

'হুম , তাতো বটেই,এতকাল জীবনটা উল্টা করেই দেখেছো যে।'

'আচ্ছা ,তুমি এখন যাও। আমি আপাতত ব্যস্ত।পড়াশোনা কিছুই হয়নি। কাল সকালে বহুত ঝামেলা। সময় চলে যাচ্ছে।'আমার এ কথা শুনেও রাত্রি যায় না ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।


...........

পরেরদিন -আজ আবার টেবিলে বসি। আজকে কিছু করার নেই । গতকালকের গল্পটা লেখা যাক।এমন সময় রাত্রি কোথ্থেকে আবার অনাহুত উদয় হয়।
'আবার এসেছো? গতকালই না বললাম, পরে। তাছাড়া আমি ভালো লিখতেও পারি না। ' আমি এবার সত্যি ইরিটেটেড ফিল করি।
রাত্রি অম্লানমুখে জবাব দেয়,' তাতে কিছু যায় আসে না। তাছাড়া আমি শুধু তাদের কাছেই যাই যারা রাত্রিগ্রস্ত হবার সময় রাখে। নামী লেখকদের ভিজিট দেবার সামর্থ্যও নেই।'

কি মনে হয়- হঠাৎ রাত্রির সাথে মন খুলে বসি,'জানো আমার মন খারাপ, জানিনা কি পরীক্ষা দিয়েছি।'

'জানি , তোমার মন খারাপ।' সে যখন বলে -ইকোর মতো শোনায়।

কথার পিঠে যোগ করি, ' অনিন্দিতা মেয়েটা কি যে ডেঞ্জারাস -যে যা বলেছিলো ঠিক সেটাই এসেছে পরীক্ষায়, তখন ওর কথা শুনিনি.., শুনলে..অন্তত আরেকটা অ্যানসার কারেক্ট হতো।'

'তাতে কি? তুমি তো চাও না সে পথ। তবে ? হারিয়ে গেলই বা সুযোগ , কি আসে যায়?একটা প্রশ্নে গোটা প্রশ্নপত্রের কতটুকু, আরএকটা গোটা পরীক্ষাও বা জীবনের তুলনায়...ফালতু চিন্তা পুষে রেখো না...' 'তার চেয়ে আমার গল্পটা লেখো।'

আমি পড়ার বই গুলো উল্টাই ওর কথার জবাব না দিয়ে। গতকালকে পড়া কিছু হয়নি।এক্সাম শেষ,আজ আর দরকার নেই। তবে বই উল্টে একটাই লাভ- নতুন লেখার প্লট পেয়েছি।

আমার চিন্তাধারা সবসময়ের মতই বুঝে যায় রাত্রি, কথা বলে যেন সরাসরি আমার মস্তিষ্কের নিউরণের সাথে-' জানি শুধুশুধুই তোমার অত চেষ্টা। নিজেকে প্রতারণা করছো খালি।আমলা হবার যোগ্যতা তোমার নেই। ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। তুমি স্রেফ হাবিজাবি লেখা ছাড়া আর কিছুই পারবে না। সবকিছুতেই সত্য না, গল্প খুঁজবে।'
আমি কষ্ট পেয়ে বলি, 'রাত্রি তুমি বড় নিষ্ঠুর।'

'হতে পারি কিন্তু আমি সত্যবাদী। রাতের আঁধারে এমনকি অপরাধীরাও অবাধ হয়ে ওঠে। ন্যায় অন্যায় শ্লীল অশ্লীলের ভেদ ঘুচে নগ্ন করে ফেলে আমি সেই মাতাল করা কিন্তু ভানহীন রাত।' নেকাবী নারীর অকপট জবাব।
'তাছাড়া অন্তত তোমার বেলায় ,সেই লিখেই তুমি আর কিছু না হোক আনন্দটা তো পাবে। আর জানো, আমার গল্প যেমন কেউ লেখে না ঠিক সেরকম তুমি, অনাম্মী একজন ।'

'বুঝেই বুঝি আমার কাছে এসেছো?''যাক বাদ দাও এসব। 'আমি সমর্পণ করি হারে ,আমাদের তর্কটা তবু শেষ হোক।সাথে অবশ্য জোর ধমক দিয়ে বলি,শোনো, কাল তুমি খুব জ্বালিয়েছো। রাতটাই শেষ হয়ে গেল বকবক করে। রাত চোখ চেয়ে দেখবার জিনিস না, চোখ মুদে আরামের শয্যায় নিদ্রায় ডুবে অনুভব করার জিনিস।'

অতঃপর চাঁদ ঢলে এলে ,হেরে যাওয়া আলাপের শর্ত হিসেবে, রাত্রির সাথে কথোপোকথন যান্ত্রিক পর্দায় লিপিবদ্ধ করতে করতে একবার রাত্রির দিকে তাকাই। মুখঢাকা সে বুঝি হাসে। 'আচ্ছা যাই এখন, তুমি আর আমি , একান্ত আলাপন ধরা রইলো এক অখ্যাত ব্লগে। থাকুক।খুব বেশী লোকে পড়বে না , ক্ষতি কি ? এটাই বরং ভালো। আমি রাত্রি , গোপন থাকারই জিনিস, পর্দানশীন জেনানা।'


আমি রাতজাগা সদ্যসমাপ্ত খসড়ার দিকে তাকাই। কি ছাঁইপাশ হয়েছে, এই মহিলা চলে গেলেই ...- 'মুছো না' বলে ওঠে রাত্রি। আমি অপ্রস্তুত হই ।ভুলেই গিয়েছিলাম ,কিভাবে কিভাবে সে যেন বোঝে আমার মনের কথা, বলার আগেই-
-আমার মনোগত এই জিজ্ঞাসার উত্তরও করে সে,' আমি জানবোনা তো কে জানবে, আমার কাছে কারোর কিছু লুকোচুরি নেই। তস্কর যখন আশপাশে তাকিয়ে নিশুতি সিঁধ কাটে তখনও আমিই শুধু সাক্ষী থাকি। ' তোমরও এত দ্বিধা কিসের ? লুকিয়োনা তুমিও কিছু। যাই হোক। আমার মত অকপট হও।'

'আমার সাক্ষাৎ পেয়েছে অথচ কিছু শেখেনি এমন কারোর হয়না। শিক্ষার্থী শেখে আরো গভীর অধ্যয়ন, তপস্বী শেখে আরো নিবেদিত প্রার্থনা, ডাকাত শেখে লুন্ঠন । তোমাকে দিলাম নিঃসঙ্কোচ প্রকাশ- যদি নিতে পারো-' রহস্যময়ী নারীটি বাক্য পুরো না করেই কথা শেষ করে।

তারপর তুষ্ট আওরত ফিরে যাবার পথ ধরে। কালো আবরণে আবৃতাকে দেখে আমার দেখার তৃষ্ণা মেটে না বুঝেই বুঝি কৃপাভরে মুখের নেকাব একটু সরায় সে ।বিস্ফোরিত চোখে দেখি, অপূর্ব তার রূপ। সে মুখে আবার শুধুই রূপ নেই , আছে কৌতুকও । সে মুখ ফিসফিস করে বলে, 'কি বলছিলে, আমি যথেষ্ট রূপসী নই?'মুগ্ধ বাকহারা আমি- সে চেহারা দেখে- পুরুষ নই তাই কবিতা লিখতে পারবো না, আমার সৌন্দর্য অনুভব নিষ্কাম ও নিষ্পাপ। এবং যেহেতু কবিতায় বর্ণনা করতে অক্ষম অতএব অব্যক্ত থেকে যায়, যাবেও। রাত্রি তাই নিশ্চিত জানে যে তার রূপের শুচিতা অটুট রইলো ।

'বিদায়! আবারও এসো , বারে বারে এসো, তবে নির্ঘুম রাতের আঁখিযুগলের কষ্ট হয়ে না। মোলায়েম স্বপ্ন হয়ে।' শেষ অনুরোধ করি আমি।

রূপের তরঙ্গ তুলে ফিরতি বিদায় জানাবার আগে চোখ টিপে রাত্রি মুখ আবার ঢেকে নেয়।' কথা রইলো।'
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই জানুয়ারি, ২০১৬ দুপুর ১:৩২
৩৩টি মন্তব্য ৩৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইসলামের বিধান হতে হলে কোন কথা হাদিসে থাকতেই হবে এটা জরুরী না

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ১০:৫৫



সূরাঃ ৫ মায়িদাহ, ৩ নং আয়াতের অনুবাদ-
৩। তোমাদের জন্য হারাম করা হয়েছে মৃত, রক্ত, শূকরমাংস, আল্লাহ ব্যতীত অপরের নামে যবেহকৃত পশু, আর শ্বাসরোধে মৃত জন্তু, প্রহারে মৃত... ...বাকিটুকু পড়ুন

লবণ্যময়ী হাসি দিয়ে ভাইরাল হওয়া পিয়া জান্নাতুল কে নিয়ে কিছু কথা

লিখেছেন সম্রাট সাদ্দাম, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১:৫৪

ব্যারিস্টার সুমনের পেছনে দাঁড়িয়ে কয়েকদিন আগে মুচকি হাসি দিয়ে রাতারাতি ভাইরাল হয়েছিল শোবিজ অঙ্গনে আলোচিত মুখ পিয়া জান্নাতুল। যিনি একাধারে একজন আইনজীবি, অভিনেত্রী, মডেল ও একজন মা।



মুচকি হাসি ভাইরাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

জীবন চলবেই ... কারো জন্য থেমে থাকবে না

লিখেছেন অপু তানভীর, ০২ রা মে, ২০২৪ সকাল ১০:০৪



নাইমদের বাসার ঠিক সামনেই ছিল দোকানটা । দোকানের মাথার উপরে একটা সাইনবোর্ডে লেখা থাকতও ওয়ান টু নাইন্টি নাইন সপ ! তবে মূলত সেটা ছিল একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর। প্রায়ই... ...বাকিটুকু পড়ুন

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

×