সামহোয়্যার ইন ব্লগ (বাঁধ ভাঙ্গার আওয়াজ), যেটির আদুরে নাম ‘সামু’। সামু নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বাংলায় কমিউনিটি ব্লগিং এর সূচনাকারী। শুরু থেকেই সামু মুক্ত চিন্তার বিকাশ এবং সামাজিক ঐক্য আনয়নে এটী অসাধারণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সামু পরিবারের নগণ্য একজন সদস্য হতে পেরে আমি ধন্য। অফিসিয়ালি আমি এখানে আছি ১ বছর ৯ মাস হতে চললো। তবে একজন গেস্ট হিসেবে এরও অনেক আগে থেকেই সামুতে আমার যাতায়াত ছিল। প্রায় পৌনে দু’বছর আগে এখানকার কিছু বিষয় আমাকে এত আলোড়িত করেছিল যে, রেজিস্ট্রেশন করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিলাম। যেদিন রেজিস্ট্রেশন করতে যাব সে দিনের উত্তেজনা ছিল দেখার মত। মনে হচ্ছিল জীবনে প্রথমবারের মত কাউকে ‘প্রোপোজ’ করতে যাচ্ছি! এর আগে নিকনেম বাছাইয়ের উটকো ঝামেলা পার হয়ে ‘ওয়াচ’ এর ভয়াবহ ‘সাত দিন’ চক্র ভেঙ্গে গুণে গুণে ঠিক ৮ মাস পরে মডুগণ আমার প্রতি করুণা করলেন! যাইহোক, জেলবন্দি থাকা অবস্থায় বিখ্যাত রাজনীতিবিদরা যেমন নানা ধরনের উচ্চমার্গের লেখালেখি করে থাকেন তেমনি আমিও ‘ওয়াচ’ টাইমে হাতপাত গুটিয়ে বসে না থেকে ছাইপাশ লিখে যেতে মনস্থির করেছিলাম। মজার ব্যাপার হলো, আমার লেখার আধা অংশ ঐ ‘জেল থেকে’ লেখা হাতে গোনা কয়েকজন হয়ত পড়েছে (এখনই কেই বা পড়ে!)।
যাইহোক, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে শুরু হলো আমার ‘সামুগিরি’। কেন সামুতে জয়েন করলাম-এই প্রশ্ন অবশ্যই অনেকেই নিজেকে করেছেন। আমিও মাঝে মাঝেই নিজেকে জিজ্ঞাসা করি, কেন এলাম সামুতে? আমার ক্ষেত্রে অনেক কারণ আছে। মনে পড়ে গত বছর সামু দিবসে আমি একটা পোস্ট দিয়েছিলাম ‘কেন ব্লগিং করি’ যার লিঙ্ক এইখানে এইখানে আজ আপনাদের জানাতে ইচ্ছে করছে ‘কেন ব্লগিং করতে এলাম’। আশা করি আপনাদের কথাও জানাবেন।
ইতিহাসের স্বাক্ষী হতেঃ
ব্লগিং ইতিহাসের এক উত্তাল ও প্রবল উন্মাদনার সময়ে সামুতে আমার আগমন। সামু-র ইতিহাসের সেরা অবদান ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ তখন যুদ্ধাপরাধীদের চোখে প্রলয়নাচন তুলে দিয়েছে। সকল রাজনৈতিক দল যখন যুদ্ধাপরাধ বিষয়টিকে শুধুমাত্র ‘রাজনীতির একটি উপাদান’ বানিয়ে যে যার মত করে এর রস আস্বাদনে ব্যস্ত তখন সামু-র দ্বারা প্রস্ফুটিত এই আন্দোলন এ যাবতকালের সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে এর একটা ‘বিহিত’ করার জন্য এক ‘ওয়ান ওয়ে’ পথ তৈরী করে দিয়েছে যা থেকে ফেরার কোন পথ বোধহয় নেই। যার ফলে বহু দিনের কলংকজনক একটি অধ্যায়ের সফল পরিসমাপ্তি ঘটতে শুরু করেছে। জনাকয়েক ব্লগারদের একটি ছোট্র দল গোটা দেশে এক সুনামি ঘটিয়ে দিয়েছিল। অল রোডস লিড টু মক্কা-র মত গোটা দেশের মানুষ যেন আছড়ে পড়েছিল শাহবাগে। এমন অভাবনীয় ঘটনায় সকল রাজনৈতিক দল একেবারে হতবিহব্বল, বাকরুদ্ধ ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। তারা আসলে যেন বুঝে উঠতে পারছিল না পরিস্থিতি কতটা গুরুতর। আমার জানা মতে, হৃদয়ের গভীর থেকে তৈরী এমন স্বতস্ফুর্ত উত্তাল জনসমুদ্র মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে আর দেখা যায়নি। শাহবাগের ঘটনা না ঘটলে কখনো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাংলাদেশে সম্ভবপর হত না কিনা এ ব্যাপারে আমার যথেস্ট সন্দেহ আছে। ইতিহাসের মোড় ঘুড়ানো এমন এক ঘটনার একজন প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী হতেই মূলত সামুতে আমার যোগদান।
‘শাহবাগ’ বা ‘গণজাগরণ মঞ্চ’ তখন যুগপথভাবে এক প্রেরণা ও ভীতির নাম। টেফনাফ থেকে তেতুলিয়া, সবার মুখে শুধু শাহবাগ, শাহবাগ এবং শাহবাগ। সে সময় ঘরে-বাইরে, অফিস-আদালতে, পাড়ার চায়ের দোকান থেকে অভিজাতদের ফাইভ স্টার হোটেলে, রান্নাঘর থেকে বঙ্গভবন; মানে সকলস্থানে ব্লগ তথা সামু নিয়ে আলোচনা-সমালোচনায় মুখর ছিল মানুষ। এভাবেই চলছিল। হঠাত ঢিল ছুড়াছুড়ি শুরু হলো। নাস্তিক ইস্যু নিয়ে হাজির হলো একটা গ্রুপ। প্রমাণস্বরুপ বেশ কয়েকজনের লেখা রীতিমত পত্রিকায় ছাপিয়ে গোটা দেশের জনগণকে তা জানিয়ে দেয়া হলো। নাস্তিক ইস্যুকে অবজ্ঞা করার কোন সুযোগ নেই। আমি স্বয়ং কিছু কুলাঙ্গারদের লেখার কিছু অংশ পড়েছিলাম। তারা যা লিখেছিল তা সত্যিকারার্থে ক্ষমার অযোগ্য। আই স্ট্রংলি বিলিভ দ্যাট, ওরা কয়েকজন শুধুমাত্র ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য সামুকে স্রেফ ব্যবহার করেছে। ওরা সামু-র বড্ড ক্ষতি করেছে। কারণ ঐ সময় এমন এক অভিনব পরিবেশ তৈরী হয়েছিল যে, ‘আমি ব্লগার’ এই তথ্যটি জানালেই সাধারণ মানুষ ভ্রু কুচকে তাকাত। এর পরিস্কার মানে হলো, ‘ব্যাটা আস্ত একটা নাস্তিক’। খুব দুঃখজনক হলেও সত্য, এর রেশ এখন অবধি রয়ে গেছে; কিছুটা হলেও। এই নেতিবাচক প্রচারণার ফলে ব্লগারদের একটা বিরাট অংশ সরে গেছে। এই নেতিবাচক প্রচারণাকে প্রতিহত করার প্রয়োজনীয়তা আমি বুঝতে পেরেছিলাম যেটিও আমাকে এখানে রেজিস্ট্রেশন করতে উদ্ভুদ্ধ করেছিল।
ভাবনা জুড়ে শুধুই সামুর আনাগোনাঃ
এরপরের সময়গুলো আরো ভয়াবহ অবস্থায় কাটতে লাগলো। সকাল থেকে রাত দুপুর অবধি শুধু ব্লগ, ব্ল্গ আর ব্লগ। ঘুম থেকে উঠেই মনে মনে ভাবি ‘আজ কি নিয়ে লিখব’। অফিসে আসার পথে রাস্তাঘাটে অসঙ্গতি বা উলটা পালটা কিছু দেখলেই মনে মনে বলি, ‘এটা লিখতে হবে’। অফিসে এসে তেলামী, ফাঁকিবাজি বা অন্যায় দেখলেই মনে মনে লেখার পরিকল্পনা দাঁড় করাই। লাঞ্চের বিরতিতে নামাজে যাই। অবাক হলেও সত্য। এখানে এসেও ব্লগ পিছু ছাড়ে না। মসজিদে কিছু ভুয়া নামাজি দেখলে মেজাজ চড়ে যায়। ভুয়া নামাজি বলতে আমি বুঝাতে চাচ্ছি যারা এক বা দু’ মিনিটে চার রাকায়াত নামাজ শেষ করে। অফিস শেষে বাসায় ফেরার পথে স্থানীয় খেলার মাঠে গিয়ে বসি। মাঠে অনেক মজার মজার ঘটনা ঘটে। ওগুলো নিয়েও লিখতে ইচ্ছে করে। রাতে বউয়ের সাথে খুনসুটি, কখনো সাংসারিক যন্ত্রণায় মন যখন বিষিয়ে ওঠে তখনো তাও লিখতে ইচ্ছে করে। এমনকি এমনও হয়েছে, বউয়ের সাথে তুমুল ঝগড়ার সময়েও মনে লেখার ডিজাইন করি। হাহাহাহা। আর রাতে যখন মাথাটা বালিশের স্পর্শ পায় তখন সারাদিনের ছোট্র ছোট্র ঘটনাগুলো গোড়া থেকে সাজানোর চেস্টা করি, ছোট্র ছোট্র আইডিয়াগুলোকে একসুতোয় গাঁথার চেস্টা করি। এমনও হয়েছে, একটা অসাধারণ আইডিয়া মাথায় এসেছে তখন আর ঘুমই আসে না! যদিও এর বেশীরভাগই চিন্তাভাবনা আলোর মুখ দেখে না।
আমার সত্যিকারের মানসিক অবস্থা অনুধাবনের জন্য যাযাবরের 'দৃষ্টিপাত' থেকে কিছু অংশ তুলে ধরছি। “ভালবাসা (আপনারা পড়ুন ব্লগিং)ছাড়া সারা দুনিয়াটাকে রুপহীন, রসহীন, বৈচিত্র-বিবর্জিত মনে হয়। এসময় প্রতিটা প্রভাত আনে নতুন দিনের প্রত্যাশা, প্রতিটা সন্ধ্যায় ঘটে প্রার্থিত সান্নিধ্য। রাত্রিতে থাকে পরবর্তি দিবসের প্রগাঢ় প্রতীক্ষা। কর্মহীন সময়ে নির্জনে ভাবতে ভাল লাগে যে স্মৃতি, তা প্রিয়জনের (ব্লগিংয়ের)। রাত্রির তিমিরস্তব্দ প্রহরে অকস্মাত ঘুম ভেঙ্গে মনে পড়ে যে প্রসংগ, তা প্রিয়জনের(ব্লগিংয়ের)। প্রভাতে প্রথম স্মরণে আসে যে মুখ, তা প্রিয়জনের(ব্লগিংয়ের)। এ এক রহস্য, এক বিস্ময়। আনন্দ-বেদনা বিজরিত এ এক অনির্বচনীয় অনুভূতি”। মোটকথা, আমার সমস্ত কর্মে-চিন্তায়, ধ্যান-ধারনায়, আলোচনায়-সমালোচনায়, স্বপনে-জাগরণে শুধই ব্লগিংয়ের একচ্ছত্র আনাগোনা।
আইডিয়া শেয়ার করা জন্যই আসাঃ
ব্লগে আসার অন্যতম এক উদ্দেশ্য। সামুতে অসাধারণ কিছু লেখক আছেন যাদের লেখা পড়ে আমি প্রতিনিয়ত শিখে যাচ্ছি। এটা আমার কাছে এক ধরণের বিনিময়। মানে আমার বস্তাপচা লেখাগুলোর বিনিময়ে সামুর অসাধারণ কিছু লেখকের লেখা পড়ার এমন সুযোগ হেলায় হারায় কোন বোকারাম। তাছাড়া আমার প্রোফাইল বৃত্তান্তে ছোট্র একটি কথা লেখা আছে, তাহলো, “I have a dream”। রিয়েলি আই হ্যাভ আ ড্রিম। এই ড্রিমের কথা সময়ে সবাইকে জানাবো। সবার মতামত, সহযোগিতা চাইব ইনশাআল্লাহ।
‘ওয়ান মিলিয়ন ফ্রেন্ডস’ পাবার আশায়ঃ
আমি আসলে এখন নিজেই জানি না আমার কত বন্ধু! সহব্লগারদের সকলকেই আমি আমার একান্ত বন্ধু বলে জানি এবং মানি। একজন জনপ্রিয় আমেরিকান কবি Robert Frost তার “Stopping by Woods on a Snowy Evening” কবিতাতে বলেছেন, ‘And miles to go before I sleep’. আমিও বলতে চাই, I want to get one million friends before I sleep.
শেষ হইয়াও হলো না শেষঃ
সব মলিয়ে এভাবেই চলছে আমার ব্লগিং জীবন। এটাকে ম্যানিয়া বলে কিনা জানি না। ম্যানিয়া পেয়ে বসলে মানুষ নাকি তার নিজের অবস্থান বুঝতে পারেনা। নিজেকে অতিরিক্ত সুখী, ধনী কিংবা ক্ষমতাধর ব্যক্তি ভাবে। খুব আশাবাদী হয়ে থাকে, বাস্তবতা বিরোধী কাজ করে। এর বেশীরভাগ সিম্পটম আমার মধ্যে প্রবলভাবে বিদ্যমান। তবে কি আমি ব্লগম্যানিয়াতে ভুগছি???
যা হয় হউক গা। ব্লগিং চলবে। হিহিহি।
অস্টম ব্লগ দিবসে সকলকে অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইল।
শুভ জন্মদিন সামহ্যোয়ারইন ব্লগ।
প্রিয় সামহ্যোয়ারইন ব্লগের ৯ম শুভ জন্মদিনে ব্লগের কর্নধার জানাআপু সহ ব্লগ পরিবার ও ব্লগের সাথে জড়িত সকলকে শীতের উষ্ণ শুভেচ্ছা।
কৃতজ্ঞতায়ঃ ছবিখানি ব্লগার 'মৃদুল শ্রাবন' ভাইয়ের লেখা থেকে নেয়া হয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ১০:১৬