somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আবার পড়ুন - জোঁক (শেষ পর্ব)

২৬ শে অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৩:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ওসমান তামাক খেতে গিয়ে দেখে মালশার আগুন নিভে গেছে। কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি হয়েছিল একপশলা। পাটগাছের ছাইনি বৃষ্টি ঠেকাতে পারেনি। ওসমান এবার ক্ষেপে যায়। গা চুলকাতে চুলকাতে সে একচোট গালাগাল ছাড়ে বৃষ্টি আর পচা পানির উদ্দেশে।তারপর হঠাৎ জমির মালিকের ওপর গিয়ে পড়ে তার রাগ। সে বিড়বিড় করে বলে,—ব্যাডা তো ঢাকার শহরে ফটেং বাবু অইয়া বইসা আছে। থাবাডা দিয়া আধাডা ভাগ লইয়া যাইব। ব্যাডারে একদিন পচা পানির কামড় খাওয়াইতে পারতাম!ওসমান আজ আর কাজ করবে না। সিদ্ধান্ত করবার সাথে সাথে সে জোরে ডাক দেয়,
—তোতারে
—উ
—দুই ডাকের পর ওদিক থেকে সাড়া আসে, আহি—
অ—
—আয়, তোর আহিডা বাইর করমু হনে। পাটের হাতাগুলো এক জায়গায় জড় করতে করতে গজগজ করে ওসমান,—আমি বুইড়্যা খাইট্যা মরি আর ওরা একপাল আছে বইসা গিলবার। তোতা নৌকা নিয়ে আসে। এত সকালে তার আসার কথা নয়। তবুও ওসমান ফেটে পড়ে, এতক্ষণ কি করছিলি, অ্যাঁ? তোরে না কইছিলাম ছুট্টি লইয়া আগে আইতে? ছুট্টি না দিলে পলাইয়া আইতে পারস নাই?
—আগেই আইছিলাম। মা কইছিল আর একটু দেরি কর। ভাত অইলে ফ্যানডা লইয়া যাইস।
—ফ্যান আনছস্? দে দে শিগ্গীর।
তোতা মাটির খোরাটা এগিয়ে দেয়। লবণ মেশান একখোরা ফেন। ওসমান পানির মধ্যে দাঁড়িয়েই চুমুক দেয়। সবটা শেষ করে অস্ফুটস্বরে বলে,—শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। ফেনটুকু পাঠিয়েছে এ জন্যে স্ত্রীকেও ধন্যবাদ জানায় তার অন্তরের ভাষা। এ রকম খাটুনির পর এ ফেনটুকু পেটে না দিলে সে পানি থেকে উঠতেই পারে না নৌকার ওপর। এবার আউশ ধান কাটার সময় থেকেই এ-দশা হয়েছে। অথচ কতইবা আর তার বয়স! চলি্লশ হয়েছে কি হয়নি। ওসমান পাটের হাতাগুলো তুলে ধরে। তোতা সেগুলো টেনে তোলে নৌকায় গুনে গুনে সাজিয়ে রাখে।
পাট তুলতে তুলতে ওসমান জিজ্ঞেস করে ছেলেকে,
—কি রান্ছে রে তোর মা?
—ট্যাংরা মাছ আর কলমী শাক।
—মাছ পাইল কই?
—বড়শী দিয়া ধরছিল মায়।

ওসমান খুশী হয়। পাট সব তোলা হয়ে গেলে ওসমান নৌকায় ওঠে। নৌকার কানিতে দুই হাতের ভর রেখে অতি কষ্টে তাকে উঠতে হয়।—তোমার পায়ে কালা উইডা কী, বা’জান? তোতা ব্যস্ত-সমস্ত হয়ে বলে।
—কই?
—উই যে! জোঁক না জানি কী! আঙ্গুল দিয়ে দেখায় তোতা।
—হ, জোঁকই ত রে! এইডা আবার কোনসুম লাগল? শিগ্গীর কাচিটা দে।
তোতা কাস্তেটা এগিয়ে দেয়। ভয়ে তার শরীরের সমস্ত লোম কাঁটা দিয়ে উঠেছে। ডান পায়ের হাঁটুর একটু ওপরেই ধরেছে জোঁকটা। প্রায় বিঘতখানেক লম্বা। করাতে জোঁক। রক্ত খেয়ে ধুমসে উঠেছে। ওসমান কাস্তেটা জোঁকের বুকের তলা দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়। এবার একটা শক্ত কাঠি দিয়ে জোঁকটা কাস্তের সাথে চেপে ধরে পোচ মারে পা থেকে।
—আঃ বাঁচলাম রে! ওসমান স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে।
—ইস্, কত রক্ত! তোতা শিউরে ওঠে।
ছেলের দিকে তাকিয়ে ওসমান তাড়া দেয়,—নে এইবার লগি মার তাড়াতাড়ি। তোতা পাট বোঝাই নৌকাটা বেয়ে নিয়ে চলে। জোঁক হাঁটুর যেখানটায় চুমুক লাগিয়েছিল সেখান থেকে তখনও রক্ত ঝরছে। সে দিকে তাকিয়ে তোতা জিজ্ঞেস করে,
—বা’জান কেমুন কইরা জোঁক ধরল তোমারে, টের পাও নাই?
—না রে বাজান, এগুলো কেমুন কইরা যে চুমুক লাগায় কিছুই টের পাওয়া যায় না। টের পাইলে কি আর রক্ত খাইতে পারে?
—জোঁকটা কত বড়, বাপপুসরে—
—দুও বোকা! এইডা আর এমুন কী জোঁক। এরচে’ বড় জোঁকও আছে।

জমি থেকে পাট কেটে ফেলার পরেও ঝামেলা পোয়াতে হয় অনেক। জাগ দেয়া, কোষ্টা ছাড়ান, কোষ্টা ধুয়ে পরিষ্কার করা, রোদে শুকানো—এ কাজগুলো কম মেহনতের নয়। পাট শুকাতে না শুকাতেই চৌধুরীদের গোমস্তা আসে। একজন কয়াল ও দাড়িপাল্লা নিয়ে সে নৌকা ভিড়ায় ওসমানের বাড়ির ঘাটে। বাপ-বেটায় শুকনো পাট এনে রাখে উঠানে। মেপে মেপে তিন ভাগ করে কয়াল। ওসমান ভাবে তবে কি তে-ভাগা আইন পাস হয়ে গেছে? তার মনে খুশী ঝলক দিয়ে ওঠে।
গোমস্তা হাঁক দেয়,
—কই ওসমান, দুই ভাগ আমার নায় তুইল্যা দাও।

ওসমান হাঁ করে চেয়ে থাকে।
—আরে মিয়া, চাইয়া রইছ ক্যান? যাও।
—আমারে কি এক ভাগ দিলেন নি?
—হাঁ
—ক্যান?
—ক্যান আবার! নতুন আইন আইছে জান না? তে-ভাগা আইন।
—তে-ভাগা আইন! আমি ত হে অইলে দুই ভাগ পাইমু।
—হঁ, দিব হনে তোমারে দুই ভাগ। যাও ছোড হুজুরের কাছে!
—হঁ, এহনই যাইমু।
—আইচ্চা যাইও যহন ইচ্ছা। এহন পাট দুই ভাগ আমার নায় তুইল্যা দিয়া কথা কও।
—না, দিমু না পাট। জিগাইয়া আহি।
—আরে আমার লগে রাগ করলে কি অইব? যদি হুজুর ফিরাইয়া দিতে কন তহন না হয় কানে আইট্যা ফিরত দিয়া যাইমু।

ওয়াজেদ চৌধুরীর ছেলে ইউসুফ বৈঠকখানার বারান্দায় বসে সিগারেট ফুঁকছে। ওসমান তার কাছে এগিয়ে যায় ভয়ে ভয়ে। তার পেছনে তোতা।
—হুজুর, ব্যাপারডা কিছু বুঝতে পারলাম না। ওসমান বলে।
—কী ব্যাপার? সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বলে ইউসুফ।
—হুজুর, তিন ভাগ কইরা এক ভাগ দিছে আমারে।
—হ্যাঁ, ঠিকই ত দিয়েছে। ওসমান হাঁ করে চেয়ে থাকে।
—বুঝতে পারলে না? লাঙ্গল-গরু কেনার জন্যে টাকা নিয়েছিলে যে পাঁচ শ’।ওসমান যেন আকাশ থেকে পড়ে।
—আমি টাকা নিছি? কবে নিলাম হুজুর?
—হ্যাঁ, এখন ত মনে থাকবেই না। গত বছর কাগজে টিপসই দিয়ে টাকা নিয়েছিলে, মনে পড়ে? গরু-লাঙ্গল কেনার জন্যে টাকা দিয়েছি। তাই আমরা পাব দু’ভাগ, তোমরা পাবে এক ভাগ। তে-ভাগা আইন পাস হয়ে গেলে আধা-আধা সেই আগের মত পাবে।
—আমি টাকা নেই নাই। এই রকম জুলুম খোদাও সহ্য করব না।
—যা-যা ব্যাটা, বেরো। বেশি তেড়িবেড়ি করলে এক কড়া জমি দেব না কোনো ব্যাটারে।

ওসমান টলতে টলতে বেরিয়ে যায় ছেলের হাত ধরে। ইউসুফ ক্রূর হাসি হেসে বলে,—তে-ভাগা! তে-ভাগা আইন পাস হওয়ার আগে থেকেই রিহার্সাল দিয়ে রাখছি। সিগারেটে একটা টান দিয়ে আবার সে বলে,—আইন! আইন করে কি আর আমাদের আটকাতে পারে! আমরা সুচের ফুটো দিয়ে আসি আর যাই। হোক না আইন। কিন্তু আমরা জানি, কেমন করে আইনকে ‘বাইপাস’ করতে হয়। হুঁ হ্ হুঁ। শেষের কথাগুলো ইউসুফের নিজের নয়। পিতার কথাগুলোই ছেলে বলে পিতার অনুকরণে। গত বছরের কথা। প্রস্তাবিত তে-ভাগা আইনের খবর কাগজে পড়ে ওয়াজেদ চৌধুরী এমনি করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলেছিলেন কথাগুলো। আইনের একটা ধারায় ছিল—’জমির মালিক লাঙ্গল-গরু সরবরাহ করিলে বা ঐ উদ্দেশ্যে টাকা দিলে উৎপন্ন শস্যের অর্ধাংশ পাইবেন।’—এই সুযোগেরই সদ্ব্যবহারের জন্যে তিনি ছেলেকে পাঠিয়ে কাগজে কাগজে টিপসই আনিয়েছিলেন ভাগ-চাষীদের।

ফেরবার পথে তোতা জিজ্ঞেস করে,
—বা’জান কেমুন কইর্যা লেইখ্যা রাখছিল? টিপ দেওনের সময় টের পাও নাই?
ছেলের প্রশ্নের উত্তর দেয় না ওসমান। একটা দীর্ঘশ্বাসের সাথে তার মুখ থেকে শুধু উচ্চারিত হয়
—আহ্-হা-রে!
তোতা চমকে তাকায় পিতার মুখের দিকে। পিতার এমন চেহারা সে আর কখনো দেখেনি।

চৌধুরীবাড়ির সীমানা পার হতেই ওসমান দেখে—করিম গাজী, নবুখাঁ ও আরো দশ বারোজন ভাগ-চাষী এদিকেই আসছে। করিম গাজী ডাক দেয়,
—কি মিয়া, শেখের পো? যাও কই?
—গেছিলাম এই বড় বাড়ি। ওসমান উত্তর দেয়,
—আমারে মিয়া মাইর্যা ফালাইছে এক্কেরে। আমি বোলে টাকা নিছিলাম পাঁচ শ’।
কথা শেষ না হতেই নবুখাঁ বলে,
—ও, তুমিও টিপ দিছিলা কাগজে?
—হঁ ভাই, কেমুন কইরা যে কলমের খোঁচায় কি লেইখ্যা থুইছিল কিছুই টের পাই নাই। টের পাইলে কি আর এমুনডা অয়। টিপ নেওনের সময় গোমস্তা কইছিল, ‘জমি বর্গা নিবা, তার একটা দলিল থাকা ত দরকার।’
—হঁ, বেবাক মাইনষেরেই এম্বায় ঠকাইছে। করিম গাজী বলে,
—আরে মিয়া এমুন কারবারডা অইল আর তুমি ফির্যা চল্ছো?
—কি করমু তয়?
—কি করবা! খেঁকিয়ে ওঠে করিম গাজী, চল আমাগ লগে দেখি কি করতে পারি!
করিম গাজী তাড়া দেয়,
—কি মিয়া, চাইয়া রইছ ক্যান? আরে এমনেও মরছি অমনেও মরছি। একটা কিছু না কইর্যা ছাইড়্যা দিমু?

ওসমান তোতাকে ঠেলে দিয়ে বলে,
—তুই বাড়ি যা গা। তার ঝিমিয়ে-পড়া রক্ত জেগে ওঠে। গা ঝাড়া দিয়ে সে বলে,

—হঁ, চল। রক্ত চুইষ্যা খাইছে। অজম করতে দিমু না, যা থাকে কপালে।

সমাপ্ত।

সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে অক্টোবর, ২০১৬ বিকাল ৩:৩৮
৬টি মন্তব্য ৫টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দেশ এগিয়ে যাচ্ছে; ভাবতে ভালই লাগে

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৩


বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। একই বছরে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল প্রায় ১ শতাংশ। ১৯৭৩ সালে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭... ...বাকিটুকু পড়ুন

যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশি নির্মমতা

লিখেছেন এমজেডএফ, ০২ রা মে, ২০২৪ দুপুর ১:১১



সমগ্র যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতে বিক্ষোভের ঝড় বইছে। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিলিস্তিনের পক্ষে বিক্ষোভ কর্মসূচী অব্যাহত রয়েছে। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিক্ষোভ দমনের প্রচেষ্টা চালালেও তেমন সফল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছাঁদ কুঠরির কাব্যঃ ০১

লিখেছেন রানার ব্লগ, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৫



নতুন নতুন শহরে এলে মনে হয় প্রতি টি ছেলেরি এক টা প্রেম করতে ইচ্ছে হয় । এর পেছনের কারন যা আমার মনে হয় তা হলো, বাড়িতে মা, বোনের আদরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

হিটস্ট্রোক - লক্ষণ ও তাৎক্ষণিক করণীয়

লিখেছেন ঢাকার লোক, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:০৭

সাধারণত গরমে পরিশ্রম করার ফলে হিটস্ট্রোক হতে পারে। এতে দেহের তাপমাত্রা অতি দ্রুত বেড়ে ১০৪ ডিগ্রী ফারেনহাইট বা তারও বেশি হয়ে যেতে পারে।

হিটস্ট্রোক জরুরি চিকিৎসা প্রয়োজন। চিকিৎসা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আল্লাহকে অবিশ্বাস করার সংগত কোন কারণ নাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ০২ রা মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৩



সব কিছু এমনি এমনি হতে পারলে আল্লাহ এমনি এমনি হতে সমস্যা নাই। বীগ ব্যাং এ সব কিছু হতে পারলে আল্লাহও হতে পারেন। সব কিছুর প্রথম ঈশ্বর কণা হতে পারলে আল্লাহও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×