বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত টানা ১০ টি ম্যাচে অপরাজীত ভারতকে বাংলাদেশ দল থামাতে পারবে কিনা তা নিয়ে অংকের স্কোরিং শুরু হয়ে গেছে বাংলাদেশ দলের কোয়র্টার ফাইনাল নিশ্চিত হবার পর থেকেই। পরিসংখ্যান বলছে ২৭ অক্টোবর ১৯৮৮ থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ বনাম ভারত আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছে ২৮টি। এর মাঝে বাংলাদেশে খেলা হয়েছে ১৯ টি, ভারতে খেলা হয়েছে ৩টি আর দুদেশের বাহিরে খেলা হয়েছে ৬টি। ভারত মোট ২৪ বার জিতেছে তার মধ্যে বাংলাদেশে ১৬ বার নিজের দেশে ৩ বার আর অন্য দেশে ৫ বার। ১ টি খেলা পরিত্যাক্ত হয়েছিল। আর বাংলাদেশের ৩ টি জয়ের মধ্যে নিজের দেশের মাটিতে ২টা আর নিরপেক্ষ ভেনুতে ১টা।
তবে এসব পরিসংখ্যান নেহায়েতি সময়ের ঘটনা মাত্র। বাংলাদেশ দলটি এখন অনেক কিছু ঘটিয়ে ফেলার ক্ষমতা রাখে। বাংলাদেশ ক্রিকেটের বয়স খাতা কলমে ২০ বছরও হয়নি। ১৯৯৭ থেকে ২০১৫, এই ১৮ বছরে বাংলাদেশের অর্জন প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি এবং ভারত তো দূরে থাক অন্য কোনো টেস্ট প্লেয়িং Nation এত দ্রুত এত অল্প সময়ের মধ্যে এত সাফল্য অর্জন করতে পারেনি।
ভারত যদি ১৯৩২ সাল থেকে ক্রিকেট খেলা শুরু করে থাকে, তবে ২০১৫ সালে এসে ওদের ক্রিকেট খেলার বয়স হচ্ছে ৮৩ বছর। অর্থাৎ আর ১৭ বছর পর খাতা কলমে এক শতাব্দী উদযাপন করবে ভারত। ১৯৫২ সালের আগে একটি টেস্টও ভারত জিততে পারেনি। ক্রিকেট পরাশক্তিতে পরিণত হতে ভারতের সময় লেগেছে ৫১ বছর। প্রথম টেস্ট জয়-১৯৫২ সালে মানে ২০ বছর পর। প্রথম ওয়ানডে জয়-১৯৭২।প্রথম ওয়ার্ল্ড কাপের সবগুলো ম্যাচেই হার ফলে রাউন্ড থেকে বিদায় দ্বিতীয়টায়ও একই অবস্থা ছিল।
১৯৭৭ সালে প্রথম বারের মত বিশ্ব ক্রিকেট সংস্থা-র সহযোগী সদস্যপদ লাভ করে । টেস্ট স্ট্যাটাস পায় ২০০০ সালে। প্রথম টেস্ট জয় করে মাত্র ৫ বছরের মধ্যে ২০০৫ সালে। প্রথম ওয়ানডে জয় কেনিয়ার বিরুদ্ধে ১৯৯৮ সালে ভারতে অনুষ্ঠিত একটি ত্রিদেশীয় প্রতিযোগিতায়।
১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ আই সি সি চ্যাম্পিয়নশীপ এ বিজয়ী হবার মধ্য দিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটের বৃহত্তম আসর “আই সি সি বিশ্বকাপ ক্রিকেট ১৯৯৯” এ খেলবার সুযোগ পায় ।
১৯৯৯ বিশ্বকাপ দিয়েই ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আসরে বাংলাদেশের প্রবেশ হয়েছিল। তখন দল নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা খুব বেশি ছিল না। কিন্তু প্রথমে স্কটল্যান্ড এবং পরে শক্তিশালী পাকিস্তানকে হারিয়ে গোটা দেশকে আনন্দে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল-মিনহাজুল আবেদীন নান্নু ভাইরা। প্রথম বার অংশগ্রহণ করেই বাংলাদেশ দল এনে দেয় শক্তিশালী পাকিস্তান এর বিপক্ষে ঐতিহাসিক বিজয় সাথে স্কটল্যান্ড। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে অধিনায়কত্ব করেন আমিনুল ইসলাম বুলবুল। দলের অসাধারণ ফিল্ডিং এবং খালেদ মাহমুদের ব্যক্তিগত বোলিং (৩/৩১) নৈপুণ্যে বাংলাদেশ ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপজয়ী পাকিস্তানকে ৬২ রানে পরাজিত করে। ম্যাচ সেরা বিবেচিত হন খালেদ মাহমুদ। স্কটল্যান্ড এবং পাকিস্তানকে হারানোর পরও বাংলাদেশ বিশ্বকাপের পরবর্তী রাউন্ডে যেতে ব্যর্থ হয়। কিন্তু এই জয় বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক টেস্ট দলের সদস্য হতে সহায়তা করে।
দ্বিতীয় আসর ২০০৩। বর্নবাদের অভিযোগে ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ হয়েছিল যারা তাদের অবিসংবাদিত নেতা ন্যালসন মেন্ডোলার দেশে আসে বিংশ শতাব্দীর প্রথম বিশ্বকাপ। সাথে দুইসহ আয়োজক জিম্বাবুয়ে ও কেনিয়া। আগের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ২টি ম্যাচ জিতলেও পরের আসরে ৬ ম্যাচের ৫টিতে পরাজিত হয় পাইলটের বাংলাদেশ দল। বাংলাদেশের বিপক্ষে কানাডা জয় পায় ৬০ রানে। বাংলাদেশ এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের মধ্যকার ম্যাচ পরিত্যাক্ত। বাংলাদেশ শেষ খেলায় কেনিয়ার কাছে হারে ৩২রানে। ফলে বি-গ্র“পে সাত দলের মধ্যে সবার নিচে থেকে খালি হাতে বিশ্বকাপ আসর শেষ করে দেশে ফেরে বাংলাদেশ দল।
তৃতীয় আসর ২০০৭। ক্যারিবিয়ান ক্যালিপসো সুরে বিশ্বকে স্বাগত জানায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। বিশ্ব আসরের নবম পর্বে। সবচেয়ে বেশি ১৬ দেশ অংশ নেয় ঐ আসরে। যথারীতি ফরম্যাট বদল। সুপার সিক্সের পর বিশ্ব দেখে সুপার এইট। অঘটনের বিশ্বকাপে শুরুটা বাংলাদেশের। ক্রিকেট বাণিজ্যে নেতৃত্ব দেয়া ভারতকে ৫ উইকেটে হারিয়ে বিশ্বকাপের উৎসব ম্লান করে দেন মুশফিক, মাশরাফিরা। গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিতে হয় ভারতকে। সঙ্গে বারমুডাকে টপকে বাংলাদেশ জায়গা করে নেয় পরের রাউন্ডে, প্রথমবার। সেখানেও মোহাম্মদ আশরাফুলের অনবদ্য ইণিংসে দক্ষিণ আফ্রিকাকে ৮৭ রানে হারিয়ে অব্যাহত ছিল বাংলাদেশের সাফল্য গাঁথা। আরেক গ্রুপে পাকিস্তানকে হারিয়ে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় করে চমকের নাম সহযোগী দেশ আয়ারল্যান্ড। কিন্তু চমক ও রহস্যে ঘনীভূত হয় পরদিন পাকিস্তান কোচ বব উলমারের মৃত্যুতে। হোটেল কক্ষে পাওয়া যায় তার মৃতদেহ। বিশ্বকাপ না জিততে পারার আক্ষেপ নিয়ে ক্রিকেট কিংবদন্তী ব্রায়ান লারা শেষ বিশ্বকাপ খেলেন নিজ দেশে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টানা চার বলে উইকেট নেয়ার রেকর্ড গড়েন শ্রীলঙ্কার লাসিথ মালিঙ্গা। নেদারল্যান্ডসের ড্যান ফন বুনগেসের এক ওভারে পর পর ছয় বলে, ছয়টি ছয় মেরে বিশ্ব রেকর্ড গড়েন হার্শেল গিবস। ম্যাথু হেইডেনের টুর্নামেন্ট সর্বোচ্চ ৬৯৩ রান আর গ্লেন ম্যাকগ্র্যার ২৬ উইকেট অজিদের বিশ্ব শাষণের ধারাবাহিকতা ধরে রাখে। ১০৪ বলে ১৪৯ রানের মহাকাব্যিক এক ইনিংস খেলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট। সঙ্গে রিকি পন্টিং-এর হাতে ওঠে বিশ্বসেরার স্বীকৃতি।
চতুর্থ আসর ২০১১। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সর্বশেষ আসর, স্বাগতিক হিসেবেই বিশ্বআসরে নাম লেখালো বাংলাদেশ। শচীন রামেশ টেন্ডূলকারের বিদায়ী বিশ্বকাপকে স্মরণীয় করে রাখলেন মাষ্টার ব্লাষ্টার বিশ্বকাপকে ঘিরে ২৮বছর পর ভারত জিতল বিশ্ব শিরোপা। উপমহাদেশের ৩য় আসর হলেও স্বাগতিকদের মিছিলে প্রথম নাম লেখায় বাংলাদেশ। আলোকিত হয়ে উঠে পুরোদেশ ১৪টি দল ও ৪৯ম্যাচের টুর্নামেন্টের ৮টি ম্যাচ হয় বাংলাদেশে। মাঠের পার্ফমেন্সে এক্সটা অনুভুতি ছিল দর্শকদের জন্য ভারতের কাছে হার আর ওয়েষ্ট ইন্ডিজের কাছে মাত্র ৫৮ ও দক্ষিন আফ্রিকার কাছে ৭৮রানে অলআউট লজ্জার দুঃখ ভুলে ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড ও নেদারল্যান্ডসকে হারায় বাংলাদেশ।
টুর্নামেন্টে সবচেয়ে বড় অঘটন আয়ারল্যান্ডের কাছে ইংল্যান্ডের হার। দুই প্রতিবেশির লড়াইয়ে কেভিন ওব্রায়েন করে ৫০বলে বিশ্বকাপের ইতিহাসে দ্রুততম সেঞ্চুরীর রেকর্ড। ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে তিলকারত্নে দিলশান ৫০০রান করে সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ও ২১টি উইকেট নিয়ে শহীদ খান আফ্রিদি ও জহির খান হয়েছেন সেরা বোলার। ১৫ উইকেট ও ৩৬২রান নিয়ে টুর্নামেন্ট সেরা হয়েছেন যুবরাজ সিং।
শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ে বাদে বাকি ৮দল উঠে কোয়াটার ফাইনালে। শেষ আট ও চারের গন্ড পেরিয়ে ফাইনালে মুখোমুখি হন ভারত ও শ্রীলংকা, দুই দলেরই ৩য় ফাইনাল। ফাইনালে মাহেলা জয়বর্ধানের সেঞ্চুরী ম্লান করেদেন ভারতের অধিনায়ক মাহেন্দ্র সিং ধনী, অনবদ্য ৯১রান ভারতকে এনে দেয় ২৮বছর পর ২য় শিরোপা।পূর্নতা পায় কিংবদন্তী শচিন রামেশ টেন্ডূলকারের ২০বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ার। ৬ বারের চেষ্টায় বিশ্বকাপের ট্রফি হাতে তুলতে পারেন এই লিটল মাষ্টার। টুর্নামেন্ট জয়ে ২য় সর্বোচ্চ রান ৪৮২রান ভারতকে এনে দেয় সাফল্য।
এবারের বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি হতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আগামী ১৯ মার্চ অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে নয়টায় ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হবে ম্যাচটি। এর আগে বিশ্বকাপে মোট ২বার মুখোমুখি হয়েছে এ দু’দল। এর মধ্যে বাংলাদেশ জিতেছে একটিতে ও ভারত জিতেছে একটিতে পরিসংস্যান ১-১। পরিসংখ্যান যাই হোক না কেন আমাদের এখনকার এই দলটি ভাল খেলার ক্ষমতা রাখে। আর প্রতিবারের মতো এবারো মাশরাফি তার সাফল্য ধরে রাখবে ভারতের বিরুদ্ধে এটা প্রত্যাশা আমাদের। জয় পরাজয় যার হোক না কেন আমরা চাই বাংলাদেশ দলটি তার স্বভাবিক ভাল খেলা উপহার দিক। তাতে আমরা দেশবাসী আত্বতৃপ্ত থাকবো।