ক্রিকেট বিশ্বকাপ। বিশ্বসেরাদের নিয়ে আয়োজিত শ্রেষ্ঠত্বের প্রতিযোগিতা। ফুটবল, আইস হকি, টেবিল টেনিসের বিশ্বকাপের পথচলা শুরু দুই মহাযুদ্ধের মাঝের সময়টায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষের বছর দশকের মধ্যে সে পদাঙ্ক অনুসরণ করে ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, বাস্কেটবল, রাগবি লিগ। ১৯৭১ আসতে আসতে হকিও চলে আসে সেই দলে। কিন্তু ক্রিকেটের বিশ্বকাপ?? বিশ্বের প্রথম সংগঠিত দলীয় খেলা এক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল অনেক। ১৯৭৫ সালের আগ পর্যন্ত কোন ক্রিকেট বিশ্বকাপ হয়নি।
ঠিক বিশ্বকাপ নাম দিয়ে নয়, তবে ১৯১২ সালে ক্রিকেটে ওই ধরনের চেষ্টা হয়েছিল একবার। তখনকার টেস্ট খেলুড়ে তিন দেশ অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে নিয়ে আয়োজিত হয় চ্যাম্পিয়নশিপ। কিন্তু বাজে আবহাওয়ায় বেশিরভাগ খেলা বাধাগ্রস্থ হওয়ায় শুরুতেই ঝরে যায় সেই প্রচেষ্টা। কালক্রমে টেস্ট আঙ্গিনায় যোগ হয় নতুন কিছু দেশ নিউজিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত ও পাকিস্তান। ‘টাইমলেস’ যুগ থেকে পাঁচ দিনের জমানায় ঢোকে অভিজাত এই খেলাটি। তবু বিশ্বকাপ আয়োজন দুঃসাধ্য হয়ে ছিল দীর্ঘ সময়। একেকটি খেলাই যদি হয় পাঁচ দিন করে, তাহলে যে বিশ্বকাপ শেষ করতে লেগে যাবে দীর্ঘ সময়।
ওই সমস্যার সমাধান নিয়ে এল ওয়ানডে ক্রিকেট। ১৯৭১ সালের ৫ জানুয়ারি এক দিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ চালু হল বলেই না এর চার বছরের মধ্যে শুরু হতে পারলো ক্রিকেট বিশ্বকাপ।
ওয়ানডে ক্রিকেট চালু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যে সবাই সেদিকে, ব্যাপারটি মোটেই তেমন ছিল না। ১৯৭১ সালের ৫ জানুয়ারি পথচলা শুরুর পর ১৯৭৫ সালের ৭ জুন প্রথম বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচ মাঠে গড়ানোর আগ পর্যন্ত মোট ওয়ানডে হয়েছে ১৮টি। অথচ ওই সময়ে বিশ্বজুড়ে আয়োজিত টেস্ট ম্যাচের সংখ্যা ছিল ৮৪টি। ১৯৭৫ সালের ‘ইংলিশ সামার’-এর ১৫ টি দিন বিশ্ব পরিচিত হলো নতুন এক ক্রিকেট বিশ্ব মানচিত্র।
প্রথম আন্তর্জাতিক টেস্ট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হবার ৯৪ বছর পর, ১৯৭১ সালে ওয়ানডে ক্রিকেটের শুরু হওয়া ছিল একট বিপ্লবের মতই। তবে ক্রিকেটের সীমিত ওভারের এই ফরম্যাটের বানিজ্যিক সম্ভাবনা ও দর্শকদের কাছে এর আবেদনের বিষয়টি চিন্তা করেই, ১৯৭৫ সালে আরও একটি বিপ্লব দেখে ক্রিকেট বিশ্ব। প্রথমবারের মত আইসিসি আয়োজন করে বিশ্বকাপ ক্রিকেট।
এখন চলছে অস্ট্রেলিয়া-নিউ জিল্যান্ডে ১১তম বিশ্বকাপের আসর। বিশ্বকাপ আসরের আরো একটি ইতিহাস যুক্ত হতে যাচ্ছে। তবে তার আগে ফিরে দেখা যাক পূর্বের ১০টি ঐতিহাসিক ক্রিকেট বিশ্বকাপ আসরের কিছু স্মৃতি।
১৯৭৫ সালের প্রথম বিশ্বকাপ: ক্রিকেটের প্রথম বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব দেয়া হয় ইংল্যান্ডকে ১৯৭৩ সালে। ঐতিহ্য ও অবকাঠামোগত সামর্থ্য বিবেচনায় রেখেই এক্ষেত্রে দেশটি নির্বাচন করা হয়। যেমন ইংল্যান্ডে গ্রীষ্মের দিন দীর্ঘ হয় ফলে খেলার জন্য যথেষ্ঠ সময় পাওয়া যায়। ইংল্যান্ডের ৫টি শহরের ৬টি মাঠে অনুষ্ঠিত হয় ক্রিকেটের প্রথম মহাযজ্ঞ। তখনকার সময় ওয়ানডে ক্রিকেট খেলা ছিল ৬০ ওভার প্রতি ইনিংস। গ্রীষ্মে ইংল্যান্ডে যেহেতু সন্ধ্যা নামে বেশ দেরি করে- সে কারণে আইসিসির অনুমোদন পেয়ে যায় তারা। আর স্পন্সর প্রুডেনশিয়াল ইন্সুরেন্সের কাছ থেকে এক লাখ পাউন্ড পাওয়ায় ইংল্যান্ডের জন্য আয়োজনটা হয়ে যায় সহজ। ওই স্পন্সরের কারণেই প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেট আসরকে 'অফিসিয়াল' নামকরণ ‘প্রুডেনশিয়াল কাপ’ করা হয়।
তখন টেস্ট আঙ্গিনা থেকে নির্বাসিত ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা। টেস্ট পরিবারের সদস্য ৬টি দেশ ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, নিউ জিল্যান্ড, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ভারত ও পাকিস্তান। এদের সঙ্গে শ্রীলঙ্কা ও পূর্ব আফ্রিকাকে নিয়ে বসে প্রথম ক্রিকেট বিশ্বকাপের আসর। ৮টি দলকে ২ গ্রুপে ভাগ করে চালানো হয় লীগ পর্বের খেলা। দুই গ্রুপের পয়েন্ট তালিকায় ওপরে থাকা দুটি করে দল যায় সেমি-ফাইনালে। ১৯৭৫ সালের ৭ জুন শুরু হয়ে টুর্নামেন্ট শেষ হয় ২১ জুন।
ওয়ানডে ক্রিকেটের তখন ‘হাঁটি হাঁটি পা পা’ যুগ। এই খেলার ধাঁচ বুঝে উঠতে পারেনি অনেক দেশ ও ক্রিকেটার। এর মধ্যে সবচেয়ে হাস্যকর কাণ্ডটি ঘটায় ভারত; আরো নির্দিষ্ট করে বললে সুনীল গাভাস্কার। সেটি ছিল বিশ্বকাপের প্রথম খেলা। ওপেনার ডেনিস অ্যামিসের ১৮ টা চার আর ১৪৭ বলে ১৩৭ রানের ঝড়ো ইনিংস সেঞ্চুরিতে প্রথমে ব্যাটিং করা ইংল্যান্ড নির্ধারিত ৬০ ওভারে করে ৩৩৪/৪, এছাড়াও ক্লেথ ফ্লেচার করে ১০৭ বলে ৬৮ রান। এই রান টপকে জয় পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে ভারতের জন্য। ভারত তাই খেলল টেস্ট ম্যাচ ড্র করার মতো করে। নির্ধারিত ওভার শেষে স্কোরবোর্ডে তাদের তিন উইকেটে ১৩২ রান। সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে স্বীকৃত গাভাস্কার পুরো ৬০ ওভার ক্রিজে থেকে ১৭৪ বল খেলে ১টি মাত্র চার মেরে অপরাজিত থাকলেন ৩৬ রান নিয়ে। টেস্টে যেটি হতে পারত ড্র, ওয়ানডেতে সেটি হয়ে গেল ভারতের জন্য ২০২ রানের বড় ব্যাবধানের হার। এর ফলে লজ্জা ও চরম বিব্রতকর অবস্থায় পরতে হয় ভারত দলটির।
ইংল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, ভারত ও পূর্ব আফ্রিকাকে নিয়ে গড়া গ্রুপ ‘এ’ থেকে সেমি-ফাইনালে ওঠে ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ড দল। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কাকে পিছু ফেলে গ্রুপ ‘বি’ থেকে ওঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও অস্ট্রেলিয়া।
প্রথম সেমি-ফাইনালে স্বাগতিকদের স্বপ্নযাত্রা থামিয়ে দেয় অস্ট্রেলিয়া। হেডিংলির পেসবান্ধব উইকেটে আগুন ঝরান বাঁহাতি ফাস্ট বোলার গ্যারি গিলমোর ১৪ রানের বিনিময়ে ৬ উইকেটে ইংল্যান্ড অলআউট হয় মাত্র ৯৩ রানে ৩৬.২ ওভারের মধ্যেই। অস্ট্রেলিয়া দলের ৩৯ রানে ৬ উইকেট পতন ব্যাপক চাপের মধ্যে ফেলে দেয়। কিন্তুু আবার সেই হ্যারি গিলমোরের ৫টি চারের মারে ২৮ বলে ২৮ রানের বদৌলতে ৪ উইকেটের এক অসাধারন জয়ে স্বাগতিক ইংল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেটের ফাইনালিষ্টের খাতায় নাম লেখায় ইয়নচ্যাপেল আর গ্রেগ চ্যাপেলের অস্ট্রেলিয়া।
গ্রুপ পর্বের ম্যাচগুলোর মধ্যে জাভেদ মিঁয়াদাদের অভিষেক ওয়ানডে আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে। সেটি অবশ্য সর্বকালের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যানের প্রথম ম্যাচ হিসেবে না, এখনো পর্যন্ত বিশ্বকাপের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর খেলাগুলোর একটি হিসেবে।আগে ব্যাটিং করে পাকিস্তান তোলে ২৬৬/৭। এরপর ১৬৬ রানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৮ উইকেট ফেলে জয় স্পর্শের খুব কাছাকাছি চলে আসে পাকিস্থান। এক সময় ওয়েষ্ট ইন্ডিজের সংগ্রহ দাড়ায় ৯ উইকেটে ২৬৭ রান। ২০৩ রানের মাথায় নবম উইকেট তুলে নিয়ে জয়ের আরেকটু কাছাকাছি যায় পাকিস্তান। কিন্তু শেষ উইকেট জুটিতে ডেরেক মারে (৬১*) ও অ্যান্ডি রবার্টস (২৪*) মোট ৬৪ রান তুলে অবিশ্বাস্য এক জয় পায় ক্যারিবিয়ানরা। পরদিন ১৮ পূর্ণ করা মিঁয়াদাদ জন্মদিনটি কাটিয়েছেন কেঁদে কেঁদে।
দ্বিতীয় সেমিফাইনালে ওয়েষ্ট ইন্ডিজ টসে জিতে নিউজিল্যান্ডকে প্রথম ব্যাট করতে পাঠায়। পেস বোলিং এর বিরুদ্ধে ভাল ব্যাট করতে থাকে নিউজিল্যান্ড। স্কোর দাড়ায় ৯৮/১। ক্যাপটিন গ্লেন টার্নার এর ৭৪ বলে ৩৬ আর জিওফ হাওয়ার্থের ৯৩ বলে ৫১ মাধ্যমে ২য় উইকেট জুটিতে ৯০ রানের সুন্দর পার্টনারশিপ হয়। কিন্তুু হঠাৎ এই জুটির পতনের পর নিউজিল্যান্ডের ৬০ রানে ৯ উইকেট পড়ে সর্বমোট রান সংগ্রহ গিয়ে দাড়ায় ১৫৮ রান ৫২.২ ওভারে। পক্ষান্তরে ওয়েষ্ট ইন্ডিজ এলভিন কালিচরন ৭ চার ও ১ ছক্কায় ৯২ বলে করেন ৭২ রান আর গর্ডন গ্রিনিজ ৯ চার ১ ছক্কায় ৯৫ বলে ৫৫ রানের দারুন ইনিংস উপহার দেন ক্যারিবিয়ানদের। ১২৫ রানের দ্বিতীয় উইকেট পার্টনারশিপেরর ফলে ৫ উইকেটে জয় নিশ্চিত করে ওয়েষ্ট ইন্ডিজ। ফাস্ট বোলার ব্রেন্ডন জুলিয়েন ৪ উইকেট পেলেও ম্যাচসেরা হন স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান আলভিন কালিচরন তিন নম্বরে নেমে ৯২ বলে ৭২ রানের ইনিংসের জন্য। নাম লেখায় আরেক ফাইনালিষ্টের খাতায়।
আত্মবিশ্বাসের নাগরদোলায় চড়ে বসা ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলকে আর থামাতে পারেনি কেও।
অস্ট্রেলিয়ার গিলমোর ঝলসে উঠেছিলেন ফাইনালেও। কিন্তু এবার আর ঝলসে দিতে পারেননি প্রতিপক্ষকে। ক্লাইভ লয়েডের ১২ চার আর ২ ছয়ে ৮৫ বলে ১০২ রানের অসাধারণ সেঞ্চুরিতে ৬০ ওভারে আট উইকেটে ২৯১ রান তোলে ক্যারিবিয়ানরা। জবাবে অস্ট্রেলিয়া অলআউট হয় ২৭৪ রানে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের পেস ব্যাটারির মধ্যে কিথ বয়েস (৪/৫০) ছিলেন সফলতম। তবে অস্ট্রেলিয়ার পতনে সবচেয়ে বড় ভূমিকাটা তার না; সেটা ছিল রান আউটের। ইনিংসে পাঁচ-পাঁচটি রান আউট হয় অস্ট্রেলিয়নরা। এর মধ্যে তিনটি ভিভ রিচার্ডসের থ্রোতে। ১৭ রানে ফাইনাল জিতে প্রথম বিশ্বকাপ জিতে নেয় ক্যারিবিয়ান এই ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
আর সফল ওই আয়োজনের মাধ্যমে পথচলা শুরু হয় ওয়ানডে বিশ্বকাপের। এই বিশ্বকাপে কোন ম্যান অফ দা সিরিজ এওয়ার্ড ছিল না। ফাইনাল ম্যচটি হয়েছিল ২১ জুন ১৯৭৫ সালে লন্ডনের বিখ্যাত গ্রাউন্ড লর্ডসে। আনুমানিক ২৫ হাজার দর্শক মাঠে ফাইনাল উপভোগ করেছিল। লাল বল আর সাদা পোশাকে ম্যাচগুলো হয়েছে দিনের আলোতে।
পরিসংখ্যান
সবচেয়ে বেশি রান:
গ্লেন টার্নার (নিউ জিল্যান্ড): ৩৩৩ বেষ্ট ১৭১*
ডেনিস অ্যামিস (ইংল্যান্ড): ২৪৩ বেষ্ট ১৩৭
মাজিদ খান (পাকিস্তান): ২০৯ বেষ্ট ৮৪
কিথ ফ্লেচার (ইংল্যান্ড): ২০৭ বেষ্ট ১৩১
অ্যালেন টার্নার (অস্ট্রেলিয়া): ২০১ বেষ্ট ১০১
সবচেয়ে বেশি উইকেট:
গ্যারি গিলমোর (অস্ট্রেলিয়া): ১১ বেষ্ট ৬/১৪
বার্নার্ড জুলিয়েন(ওয়েস্টইন্ডিজ):১০বেষ্ট ৪/২০
কিথ বয়েস (ওয়েস্ট ইন্ডিজ): ১০ বেষ্ট ৪/৫০
রিচার্ড হ্যাডলি (নিউ জিল্যান্ড): ৮ বেষ্ট ৩/২১
অ্যান্ডি রবার্টস (ওয়েস্ট ইন্ডিজ): ৮ বেষ্ট ৩/৩৯
ডেনিস লিলি (অস্ট্রেলিয়া): ৮ বেষ্ট ৫/৩৪
* বিভিন্ন লেখা থেকে সংগ্রহীত *

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


