শুকনো পাতা মাড়িয়ে গুটি গুটি পায়ে কেউ একজন হেটে আসছে।সময়টা অগ্রায়ন মাসের শেষের দিকে। মানে শীত একটু একটু করে আসি আসি করছে।হালকা বাতাসে তাই পাওয়া যাচ্ছে শীতলতার স্পর্শ।এই সময় মফস্বল শহরে ঝুপ করে যেন সন্ধ্যা নামে। সারাদিনের ক্লান্ত পাখিগুলো ব্যাকুল হয়ে ডানা মেলে ঘরে ফেরার আসায়।
দিনের শেষের সূর্যটার সব আলোটুকু শুষে নেয় গাঢ় অন্ধকার।মেঠো পথের দুপাশে থাকা গাছগুলো ও যেন একটা ভূতুরে আকার নিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে থাকে।এই পরিবেশকে আরো একটু অন্য রকম মনে হয় যখন জোনাকিরা জ্বলে ওঠে।এই অদ্ভুদ রকম একটি পরিবেশের মধ্যে আবারও শোনা যায় সেই হেটে চলার শব্দ।অন্ধকারটা চোখে একটু সয়ে গেলেই বোঝা যায়-গাঢ় অন্ধকার আর কালো চাদর দুটোই একসাথে বেঁধে নিয়ে একটি মেয়ে সামনের পথে এগিয়ে যেতে থাকে। কোনদিন মনে হয় একা অন্ধকারের পথে পা বাড়ায়নি, তাই রাতের কীট পতঙ্গের আওয়াজও তার কাছে ভীষন তীব্র মনে হতে থাকে।
বেশ দূর থেকেই মেয়েটি দেখতে পেল ট্রেনের প্ল্যাটফর্মটা।কালো চাদরটা দিয়ে আরো ভালো করে জড়িয়ে নেয় সে নিজেকে, হাতের ছোট্ট ব্যাগটাকে আরো শক্ত করে ধরে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে। আজ খুববেশি একটা লোকজন নেই, সবাই যার যার মনে গল্প করছে অথবা চায়ের কাপে ঝড় তুলছে। মেয়েটি সবাইকে কোনরকম পাশ কাটিয়ে এক কোনার এক অন্ধকার একটা বেঞ্চিতে বসে পড়ল।হ্যাঁ- তার তো এখানেই থাকার কথা ছিল।
সে তার কথা রেখেছে- বাবা-মা, আত্নীয়-স্বজন, সবার ভালবাসা আর আদর কে উপেক্ষা করে সে তার ভালবাসার জন্য সবকিছু ছেড়ে একা চলে এসেছে এই অনিশ্চতার পথে। চোখে তার রঙ্গিন স্বপ্ন।তার প্রিয় মানুষটি আজ যে তাকে নিতে আসবে। আনন্দ আর অপেক্ষা দুটোই বাড়তে থাকে। একটা সময় তার মনে হয় সময়ও বুঝি থমকে গেছে। এত নীরবতা কেন চারিপাশে?
হঠাৎ কারো একজনের হাতের স্পর্শে সে চমকে ওঠে। মুহুর্তেই তার পৃথিবীটা যেন আরো রঙ্গিন হয়ে ওঠে। লোকজনের কোলাহল, চায়ের কাপের ঢুং ঠাং শব্দ, রাতের ঝিঝি পোকার ডাক সব তার কাছে অনেক আনন্দের মনে হয়।এত কিছুর মধ্যেও সে শুনতে পায় তার প্রিয় মানুষের কন্ঠ।
উফ্, যা ভয় পাইছিলাম, ভাবছিলামতো তুমি বুঝি আইতেই পারবানা। যাক-বাঁচাইলা আমারে। এহন আমারা সারাজীবন একলগেই থাকুম।চল চল- ট্রেন মনে হয় আইতেছে-ঐ যে শুনছো,হুইসেলের শব্দ শোনা যাইতেছে। কি হইল-চল।
মেয়েটি যেন কেঁপে ওঠে আনন্দ আর উত্তেজনায়। আজ তার জীবন আবার নতুন করে শুরু হবে। ওরা এগিয়ে যায় ট্রেনের দিকে- জীবনের একটা অংশকে পিছনে ফেলে নতুন স্বপ্নকে সাথে নিয়ে অন্ধকারের বুক চিরে একটা সময় কু ঝিক ঝিক করে ট্রেন চলতে থাকে।
সময় কেটে য়ায়-একটা সময় ভোর হয়, পাখি ডাকে আবারও নতুন সূর্য ওঠে, একটা সময় সূর্য ডুবেও যা্য়।নেমে আসে গাঢ় অন্ধকার, মেয়েটি তখনও অচেতন হয়ে ঘুমিয়ে থাকে।ট্রেন তখনও ছুটে চলছে তার নিজের পথে
সময় গড়িয়ে যায়-ট্রেনও একসময় থেমে যায়। যান্ত্রিক শব্দ আর কোলাহলের কারণে এক সময় মেয়েটি ঘুম ভরা চোখে খুঁজতে থাকে তার প্রিয় মানুষটির।না-কোথাও তো তাকে দেখা যাচ্ছে না, সহসাই মনে হয় তার মাথায় বাজ ভেঙে পড়লো। এ কি দেখছে সে? এই লোকটি কে? এত লোলুপ চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে? ভয়ে মেয়েটি নিজেকে গুটিয়ে নেয়-ভয়ার্ত চোখে, উদ্বিগ্ন কন্ঠে প্রশ্ন করে, আপনি কে? লোকটি যেন মজার কোন কথা শোনে-বিকট অট্ট হাসি দিয়ে বলে-
এখন আমিই তো তোমার সবকিছু। তোমার পেয়ারের মানুষতো তোমারে বেইচ্যা দিছে। নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা গুইন্যা লইয়া বিদায় হইছে। তুমি কি মনে করছো-তুমি ছাড়া হের কেউ নাই? আরে বোকা মাইয়া, তোমার মত কত ময়না পাখিরে সে ভুলাইয়া আনছে আর টাকা গুনছে সেই খবর তো আর জাননা।চল-চল তোমার জন্য ভাল খাতিরের ব্যবস্থা আছে।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৬ দুপুর ২:৩৫