somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উইঘুর নির্যাতিত মুসলিম জাতি

০১ লা জানুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৫:৪১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


চীনের জিনজিয়ানে বসবাসকারী মুসলিম সম্প্রদায় উইঘুর জাতি হিসেবে পরিচিত। অতীতে উইঘুররা ছিল স্বাধীন, তাদের দেশের নাম ছিল উইঘুরিস্তান। কিন্তু সমাজতান্ত্রিক চীনারা এই মুসলিমদের কাছ থেকে স্বাধীনতা কেড়ে নেয়ার পাশাপাশি বঞ্চিত করছে তাদের ধর্ম পালনের অধিকার থেকে। উইঘুর মুসলিমদের নামাজ আদায় ও রোজা পালনে রয়েছে সরকারি নিষেধাজ্ঞা। এমনকি এখানে মুসলিম পুরুষদের দাড়ি রাখা এবং নারীদের হিজাব পড়ার অধিকারটুকু কেড়ে নিয়েছে চীন সরকার। পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত মানব সম্প্রদায় হিসেবে বর্তমানে উইঘুর মুসলিমদেরকেই বিবেচনা করা হয়।

মধ্য এশিয়ায় বসবাসরত তুর্কি বংশোদ্ভোত একটি মুসলিম গোষ্ঠী উইঘুর মুসলিম জাতি। বর্তমানে উইঘুররা মূলত চীনের জিনজিয়ানে বসবাস করছে। জিনজিয়ান চীনের সর্ববৃহৎ অঞ্চল, এর রাজধানীর নাম উরুমুকি এবং অন্যতম একটি বড় শহর কাশগড়। এর আয়তন ১৬,৪৬,৪০০ বর্গ কিলোমিটার। এটি বাংলাদেশের আয়তের প্রায় ১২ গুন। জিনজিয়ান সুপরিচিত চীনের প্রধান ফসল উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে। এছাড়াও এখানে বিপুল পরিমান খনিজ ও তেল সম্পদ মজুদ রয়েছে। এ অঞ্চলে প্রায় ৫৮ শতাংশ মানুষ মুসলিম। কিন্তু এই অঞ্চলে হাজার বছর ধরে বাস করে আসা মুসলমানদের নানাভাবে মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।


মধ্য যুগে তুর্কিদের হাতে তান সাম্রাজ্যের পতনের মাধ্যমে জিনজিয়ানে বিপুল সংখ্যক মানুষ ইসলাম ধর্মের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠে। সে সময় এই অঞ্চলে ধীরে ধীরে ইসলাম এবং আরব সংস্কৃতির প্রভাব বাড়তে থাকে, তখন স্থানীয় উইঘুর জনগোষ্ঠীর সিংহভাগ মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। চীনের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলিমরা হুই নামে পরিচিত। তাই বর্তমানে উইঘুর শব্দটি দ্বারা জিনজিয়ানে বসবাসরত মুসলিম জনগোষ্ঠীকেই বোঝানো হয়।

চীনের জিনজিয়ান প্রদেশটি প্রাকৃতিক গ্যাস, তেল ও নানা খনিজ সম্পদে ভরপুর হওয়ায় চীন সরকার কিছুতেই এই শহরটি হাত ছাড়া করতে চায় না। সুদীর্ঘ কাল যাবৎ এই এলাকায় বসবাস করে আসা উইঘুর মুসলিমদের কৌশলে উচ্ছেদ করতে চায় চীন সরকার। উইঘুরদের পৈতৃক সম্পদ থেকে বঞ্চিত করে সেখানে চীনা হানদের প্রতিষ্টিত করতে সক্রিয় সহায়তা করছে দেশটির প্রশাসন। আর সেজন্য তারা বেছে নিয়েছে কঠোর দমন পীড়নের পথ। তাদের নৈতিকভাবে দুর্বল করে দিতে চীনা সরকার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে উইঘুরদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় অন্যায্য হস্তক্ষেপ করছে। সেখানে ১৮ বছরের নিচে কোনো উইঘুর বালক মসজিদে যেতে পারে না এবং ৫০ বছরের কম বয়সী কেউ প্রকাশ্যে নামাজ পড়তে পারে না। উইঘুরদের রোজা রাখাও সম্পূর্ণ নিষেধ। কেউ রোজা রাখলে তাকে রোজা ভাঙতে বাধ্য করা হয়। সীমিত কিছু ক্ষেত্র ছাড়া সব ক্ষেত্রেই কোরআন শরীফ তেলাওয়াত করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। কোরআন শরীফ শিক্ষা বা শিখানোও এখানে বন্ধ। এখানে নারীদের হিজাব পড়াও নিষিদ্ধ। কোনো হিজাব পড়া নারীকে ট্যাক্সিতে উঠলে চালককে মোটা অংকের জরিমানা করা হয়। হিজাব পড়া নারীদের চিকিৎসা সেবা প্রদান করার ক্ষেত্রেও ডাক্তারদের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। মুসলিম সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের টুপি থেকে শুরু করে সব ধরণের ইসলামিক পোশাক এখানে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। চীনের কোনো নাগরিক যদি ফ্যাশনের জন্য দাড়ি রাখেন তাতে কোনো সমস্যা নেই কিন্তু কোনো উইঘুর মুসলিম যদি দাড়ি রাখেন তাহলে তাকে ধর্মীয় উগ্রপন্থী হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

জিনজিয়ানে এক সময় ২০০০টি মসজিদ ছিল ,কিন্তু কালের পরিক্রমে সেই সংখ্যা অতি দ্রুত কমে যাচ্ছে। কারণ মসজিদ গুলো গুড়িয়ে দিয়ে সেখানে স্থাপন করা হচ্ছে পর্যটন কেন্দ্র। অতীতে জিনজিয়ান চীনের অধীনে ছিল না, বরং এটি ছিল মুসলিমদের এক স্বাধীন দেশ। মুসলমানদের শাসনামলে এই অঞ্চলের নাম ছিল উইঘুরিস্তান বা পূর্ব তুর্কিস্তান। ১৬৬৪ সালে চীনের মাংচু শাসকরা কিং সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার পর অন্যান্য এলাকার সাথে মুসলমানদের এই স্বাধীন এই এলাকাটিও দখল করে নেয়। এই এলাকার স্বাধীন চেতা মুসলমানেরা অব্যাহত স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে ২০০ বছর পর কিং শাসকদের বিতাড়িত করে আবারো স্বাধীনতার পতাকা উড়ায়। কিন্তু চীন স্বাধীনতাকামী এই মুসলিম জনগোষ্ঠীকে পুনরায় আক্রমণ করে। চীন সমাজ তন্ত্রের ছোবলে আক্রান্ত হয়ে দ্বিতীয়বার স্বাধীনতা হারায় উইঘুরিস্তান। উইঘুর সাম্রাজ্য দখল করে চীন এর নাম দেয় জিনজিয়ান, এর অর্থ নতুন ভূখণ্ড। সেই থেকেই পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ হয় উইঘুর মুসলিমরা। এর পর থেকে কেড়ে নেয়া হয় তাদের মৌলিক নাগরিক অধিকার। আর্থ-সামাজিক ভাবে চরম বৈষম্যের শিকার হতে থাকে এই জাতি। সরকারি চাকরিতে তাদের উপস্থিতি অতি নগণ্য। আর যারা চাকরিতে আছেন তারাও বেতনের ক্ষেত্রে হানদের তুলনায় বৈষম্যের শিকার হয়।


সাংস্কৃতিক দিক থেকে উইঘুররা তুর্কি ও আরবি দ্বারা প্রভাবিত , উইঘুরদের ভাষা যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়েছে। সেখানকার মানুষেরা সাকা, তোচারিয়ান এবং গান্ধারী সহ বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতো। বর্তমানে তাদের ভাষার নাম কোনা ইয়াজিক। নবম শতকে তুর্কিদের আগমনের ফলে তুর্কি ভাষা ঢুকে পরে। পরবর্তীতে ইসলাম ধর্মের সাথে সাথে আরবি বর্ণমালা উইঘুরদের ভাষায় স্থান করে নেয়। উইঘুরদের নিজস্ব সংগীতের ধরণকে মোকাম বলা হয়। ১২টি মোকামকে উইঘুররা তাদের জাতীয় কাব্যগ্রন্থের রূপ দিয়েছে। উইঘুর জাতিদের মধ্যে স্থানভেদে মোকামের ভিন্নতা রয়েছে। উইঘুরদের এই মোকামকে ইউনেস্কো মানব সভ্যতার অন্যতম অধরা ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। উইঘুরদের সংস্কৃতির আরেকটি উল্লেখযোগ্য অংশ হলো নাচ। দাব নামের একটি ঢোলের বাদ্যের সাথে সানাম ও সামা নামের লোকনৃত্য উইঘুরদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়।

উইঘুর মুসলিম সমাজ চীন সরকারের কাছ থেকে মৌলিক অধিকারগুলো পাওয়ার আসা করেছে।ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকার হারিয়ে যাওয়ার পর তারা বুঝতে পারে মাতৃভূমির স্বাধীনতা পাওয়া ছাড়া অধিকার পাওয়া সম্ভব নয়। তখন তারা পরিকল্পনা করে জিনজিয়ান প্রদেশে আবারো উইঘুরিস্তান নামে এক স্বাধীন ভূখণ্ড প্রতিষ্টা করবে তারা। কিন্তু গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের প্রবক্তা কোনো পশ্চিমা দেশ কিংবা বর্তমান পৃথিবীতে থাকা অর্ধশতক মুসলিম রাষ্ট্র উইঘুরদের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসেনি। চীন সরকার উইঘুর মুসলিমদের স্বাধীনতা আন্দোলনকে বিচ্ছিন্নতাবাদ, সন্ত্রাসবাদ ও ধর্মীয় উগ্রতা হিসেবে আখ্যা দিয়ে তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতির উপর বিধি নিষেধ আরোপ করে দিয়েছে। ফলে ধর্মীয় নিপীড়ন ও নৃতাত্ত্বিক বৈষম্যের শিকার উইঘুর তরুণরা নিরুপায় হয়ে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছে। চীনের জিনজিয়ান নীতির ফলেই সেখানে সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্ম নিচ্ছে। চীন সরকার এই বিপ্লবকে রুখে দেয়ার জন্য অত্যন্ত সুকৌশলে পুণশিক্ষার অজুহাত দিয়ে প্রায় ১০ লক্ষ উইঘুর মুসলিমকে বিভিন্ন ক্যাম্পে আটকে রেখেছে। এই ক্যাম্পগুলোতে সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীদের প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। চীন সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী তারা উইঘুরদের আধুনিক শিক্ষা দিচ্ছে। অপরদিকে এসব ক্যাম্প থেকে পালানো উদ্বাস্তুরা তাদের উপর চলা অমানবিক শারীরিক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছে। এছাড়া এসব ক্যাম্পে চীনের কমিনিস্ট সরকারের গুণগানসহ সরকারি বিভিন্ন মতের অনুসারী করার জোরপ্রচেষ্টা চালানো হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। চীন সরকার এসব অভিযোগকে মিথ্যা আখ্যা দিয়ে যেকোনো ধরণের তদন্তের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিয়েছে।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জানুয়ারি, ২০২০ বিকাল ৫:৪২
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাফসান দ্য ছোট ভাই এর এক আউডি গাড়ি আপনাদের হৃদয় অশান্ত কইরা ফেলল!

লিখেছেন ব্রাত্য রাইসু, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫২

রাফসান দ্য ছোট ভাইয়ের প্রতি আপনাদের ঈর্ষার কোনো কারণ দেখি না।

আউডি গাড়ি কিনছে ইনফ্লুয়েন্সার হইয়া, তো তার বাবা ঋণখেলাপী কিনা এই লইয়া এখন আপনারা নিজেদের অক্ষমতারে জাস্টিফাই করতে নামছেন!

এই... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×