মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন মূলত ভারত ও চীনের মাঝে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় একটি গণভোট হিসাবে প্রমাণিত হয়েছে। নির্বাচনের ফলাফল ছিলো ভারতের জন্য বড় ধাক্কা । কারণ ভারতপন্থী বর্তমান রাষ্ট্রপতি ইব্রাহিম সোলিহকে পরাজিত করে চীন সমর্থিত প্রার্থী মোহাম্মদ মুইজ্জু রাষ্ট্রপতি পদে বিজয়ী হয়েছেন।ছোট দ্বীপ দেশটির নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতা পূর্ণ হয়েছে। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রথম ধাপে কোনো প্রার্থী শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ভোট না পাওয়ার কারণে দিত্বীয় ধাপের নির্বাচন আয়োজন করা হয়। চীন সমর্থিত প্রার্থী মোহাম্মদ মুইজ্জু চুয়ান্ন শতাংশ ভোট পেয়ে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হন। দুই লক্ষ বিরাশি হাজার ভোটারের মাঝে পচাশি শতাংশ ভোটার ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে ভোট প্রদান করেছেন।
মোহাম্মদ মুইজ্জু পয়তাল্লিশ বছর বয়সে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি ইউনাইটেড কিংডম থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডক্টরেট করেছেন। রাজনীতিতে যোগদানের আগে বেসরকারি খাতে একজন প্রকৌশলী হিসেবে কাজ করেছেন। নির্বাচনের পূর্বে তিনি রাজধানীর মেয়র হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলেন।এছাড়াও ইয়ামিন প্রশাসনে তিনি আবাসন ও অবকাঠামো মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন।
মালদ্বীপ ছাব্বিশটি প্রবাল প্রাচীর এবং এগারোশো বিরানব্বইটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত। দেশটির মোট জনসংখ্যা পাচ লক্ষ। দেশটির অর্থনীতি মূলত পর্যটন খাতের উপর নির্ভরশীল। জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্বক প্রভাব পড়ায় ঝুঁকিতে রয়েছে দেশটি । মালদ্বীপে ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল ক্ষমতায় ছিল চীন সমর্থিত রাষ্ট্রপতি ,২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল ক্ষমতায় ছিল ভারত সমর্থিত রাষ্ট্রপতি ,এইবার ২০২৩ সালের নির্বাচনে আবারো চীন সমর্থিত রাষ্ট্রপতি বিজয়ী ।ছোট দ্বীপ দেশটি ভাগ্য এখন নির্ভর করছে ভারত ও চীনের পররাষ্ট্র নীতির উপর।চীন বা ভারত সমর্থিত কোনো প্রার্থী পরপর দুই বার নির্বাচনে জয়ী না হবার কারণে এতে স্পষ্ট
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে জাহাজ চলাচলের জন্য শিপিং লাইনগুলো যে রুট ব্যবহার করে তার ঠিক মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছে মালদ্বীপ।ভোগোলিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ স্ট্রাটেজিক অবস্থানে থাকায় ভারত মহাসাগরের গুরুত্বপূর্ণ অংশ গুলোতে নজরদারি বা মনিটরিংয়ে মালদ্বীপ গুরুত্বপূর্ণ। সেই কারণে ছোট দ্বীপ দেশটিতে নিজেদের উপস্থিতি বাড়াতে ভারত ও চীনের মাঝে প্রবল আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছে।
ভারত মহাসাগর ও তার আশেপাশের অঞ্চল গুলোতে প্রভাব বলয় তৈরীতে চীন নানা রকম কৌশল প্রয়োগ করছে। ইতিমধ্যে পাকিস্তান ও শ্রীলংকাকে বন্দররের অবকাঠামো তৈরীর জন্য বিলিয়ন ডলার ধার দিয়েছে চীন। ঋণ পরিশোধ হওয়ার আগ পর্যন্ত বন্দরের কার্যক্রম পরিচালনার দিয়িত্বে থাকবে চীন। একের পর এক ভারতের চারপাশে চীনা-সমর্থিত বন্দর তৈরী হওয়াতে ভারত নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত। হয়তো সেই কারণেই মালদ্বীপে চীনের আগ্রাসন ঠেকাতে ভারতও তৎপর হয়ে উঠছে ।
দুই হাজার তেরো থেকে দুই হাজার আঠারো সাল পর্যন্ত মালদ্বীপের প্রেসিডেন্ট ছিলেন আবদুল্লা ইয়ামিন। ইয়ামিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ওঠায় ভারত ও পশ্চিমা দেশগুলো তখন মালদ্বীপকে ঋণ সহায়তা দিতে অস্বীকার করে। ইয়ামিন তখন চীনের শরণাপন্ন হন এবং বেইজিং কোনও শর্ত ছাড়াই মালদ্বীপে অর্থ ঢালতে থাকে। যেহেতু ইয়ামিনের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক তিক্ত ছিল তখন বিরোধী শিবিরও যথারীতি সমর্থনের জন্য চীনের দিকেই ঝুকে পড়ে। তেরো সালের পূর্বে মালদ্বীপের মতো ছোট রাষ্ট্র নিয়ে চীনের বিন্দু মাত্র আগ্রহ ছিল না। এমনকি দুই হাজার বারো সাল পর্যন্ত মালদ্বীপে কোনো চীনা দূতাবাস পর্যন্ত ছিল না। ইয়ামিনের সরকারের অধীনে এটি পরিবর্তিত হয় দুটি দেশ একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) স্বাক্ষর করে, মালদ্বীপের বেশিরভাগ মাছের রপ্তানির উপর শুল্ক দূর করে এবং দ্বীপপুঞ্জকে চীনা পণ্য ও পরিষেবার জন্য উন্মুক্ত করে। মালদ্বীপ তার রাজস্বের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আহরণ করে পর্যটকদের কাছ থেকে আর সে সময় পযটকদের অধিকাংশ ছিল চীনা নাগরিক। এছাড়াও মালদ্বীপের পর্যটন খাতে বেইজিং বড় বিনিয়োগ করে। সে সময় চীন মালদ্বীপের মেগা-প্রকল্পগুলোতে অর্থায়ন করে যার মাঝে অন্যতম ছিল দুই কিলোমিটার লম্বা একটি চার লেনের সেতু, যা রাজধানী মালের সঙ্গে পাশের একটি অন্য দ্বীপে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরকে সংযুক্ত করে ।সে সময় মালদ্বীপ চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে’ যোগ দেয়, যে পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল চীনের সঙ্গে সারা বিশ্বের রেল, সড়ক ও নৌ-যোগাযোগ গড়ে তোলা। ইয়ামিন এখন দুর্নীতির দায়ে এগারো বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন, সে কারণে তিনি এবারের ভোটে লড়তেও পারছেন না। তবে বিরোধী শিবিরের প্রার্থী মোহাম্মদ মুইজ্জু ইয়ামিনের ‘প্রক্সি’ প্রার্থী হিসেবেই দেখা হচ্ছে।
দুই আঠারো সালে অপ্রত্যাশিতভাবে ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসার পর মালডিভিয়ান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির (এমডিপি) নেতা ইব্রাহিম সোলিহ চীনকে উপেক্ষা করে দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার দিকেই ঝুঁকেন – যে নীতিকে বলা হয় ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ পলিসি। পরবর্তী সময়ে ‘ইন্ডিয়া ফার্স্ট’ পলিসি নিয়ে মালদ্বীপে অনেকেই ক্ষুব্ধ ছিল তার একটা বড় কারণ হল দিল্লির দেওয়া কিছু ‘উপহার’।এই উপহারকে কেন্দ্র করে মালদ্বীপে তীব্র বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। দুই হাজার দশ ও দুই হাজার তেরো সালে ভারত মালদ্বীপকে দুটি হেলিকপ্টার উপহার দিয়েছিল। এরপর দুই হাজার বিশ সালে তাদের একটি ছোট এয়ারক্র্যাফট-ও দেওয়া হয়।বলা হয়েছিল, মালদ্বীপে উদ্ধার ও ত্রাণ অভিযান চালাতে এবং আপদকালীন মেডিকেল ইভ্যাকুয়েশনে এগুলো ব্যবহার করা হবে।কিন্তু দুই হাজার একুশ সালে মালদ্বীপের প্রতিরক্ষা বাহিনী জানায় যে ভারতের দেওয়া বিমান চালানো ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে পচাত্তর জন ভারতীয় সেনা সদস্য সে দেশে অবস্থান করছেন। বিষয়টি মালদ্বীপে একটি বড় নির্বাচনী ইস্যুতে পরিণত হয়েছে।
ইব্রাহিম সোলিহ সরকার গঠন করার পর চীনের ঋণের ফাঁদে দেশকে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় নেওয়ার জন্য ইয়ামিনকে অভিযুক্ত করেন। চীনকে সরিয়ে ভারত মালদ্বীপের প্রধান আর্থিক সাহায্যকারী হিসাবে চীনের স্থান নেওয়ার চেষ্টা করেছে, তবে তা প্রমানে ভারতকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হবে। ইয়ামিনের অধীনে আর্থিক সহায়তার জন্য চীনের উপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতা ভারতের ক্ষোভের কারণ হয়েছিল, যা ঐতিহাসিকভাবে মালদ্বীপের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে ভূমিকা পালন করেছিল।
এছাড়াও ইয়ামিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে ভিন্নমতের বিরুদ্ধে ক্র্যাকডাউনের নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। প্রায় সমস্ত বিরোধী নেতাদের জেলে ঢুকিয়েছেন ,বিরোধী মতের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছেন এবং বিশাল দুর্নীতি কেলেঙ্কারি সাথে ইয়ামিন প্রশাসন নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছেন । যেখানে জনসাধারণের কোষাগার থেকে কয়েক মিলিয়ন ডলার চুরি করা হয়েছিল যা পরবর্তী সময়ে বিচারক, বিধায়ক এবং ওয়াচডগ প্রতিষ্ঠান গুলোকে ঘুষ দেওয়ার জন্য ব্যবহার করা হয়েছিল। একজন তরুণ সাংবাদিক এবং একজন ব্লগারকে হত্যার পরও তিনি আল-কায়েদা এবং আইএসআইএল (আইএসআইএস) এর সাথে যুক্ত গোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির প্রতি অন্ধ দৃষ্টি রেখেছিলেন।
এবারের নির্বাচনে বিরোধী জোট গুলো দাবী করে ভারতের ওপর ইব্রাহিম সোলিহ প্রশাসনের অতি-নির্ভরতার ফলে মালদ্বীপের সার্বভৌমত্ব খর্ব হচ্ছে। বিরোধী জোট আরও যুক্তি দিচ্ছেন, মালদ্বীপের প্রায় প্রতিটি প্রকল্পই ভারতের অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে এবং ভারতীয় সংস্থাগুলোই সেই কাজ করছে। বিরোধী শিবিরের ‘ইন্ডিয়া আউট’ ( অর্থাৎ ভারত মালদ্বীপ ছাড়ো ) ন্যারেটিভের মোকাবিলায় শাসক দল এমডিপি হিমশিম খাচ্ছে, এটা বুঝে বিরোধী অ্যালায়েন্সও এখন তাদের আক্রমণ আরও তীব্র করছে।
গুরুত্বপূর্ণ স্ট্র্যাটেজিক অবস্থানের কারণে ভারত ও চীন এর মতো বড় রাষ্ট্র মালদ্বীপের মতো ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রের বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছে । ভারত বা চীন সমর্থিত প্রার্থীরা কেউ পরপর দুই বার ক্ষমতায় আসতে পরে নাই। এতে স্পষ্ট বুঝা যায় মালদ্বীপের জনগন ভারত কিংবা চীনের নাক গলানো খুব একটা পছন্দ করছে না । ছোট দ্বীপ দেশ হওয়া সত্বেও কিছু বিষয় শিক্ষণীয় যেমন নির্বাচনে খুব একটা সংঘাত হয় নি , ক্ষমতাসীন দল নির্বাচন পরিচালনা করেছে সততার সাথে , নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর সব প্রার্থী তা মেনে নিয়েছে , কোনো বাধা না থাকায় ভোটার উপস্থিতি ভালো ছিল ।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০২৩ রাত ১০:৫৮