somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জন্ম আর মৃত্যুর মাঝখানে ক্ষমতা বলতে কিছুই নেই। কেবল নিষ্ফল লম্ফঝম্ফ।

২২ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ৯:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

নীলা শক্ত করে আমার হাত ধরে মৃদু কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, জয় আমি বাঁচব তো?
আমি ঠোঁট কামড়ে ধরে বললাম, বাঁচবে, অবশ্যই বাঁচবে। মরবে না ইনশাআল্লাহ। আমি আছি।
নীলা বলল, কথা দিচ্ছো তো? আমার বাচ্চাও যেন বাঁচে। বাচ্চা না বাঁচলে আমি বেঁচে থেকে কি লাভ?
নীলার চোখের কোণা দিয়ে পানি পড়ছে।
- তোমার বাচ্চাও বাঁচবে। কথা দিচ্ছি।
আমার গলা কেঁপে উঠল।
নীলা চোখ বন্ধ করে বলল, আচ্ছা।
কিন্তু আমি আমার কথা রাখতে পারি নি। নীলা মৃত বাচ্চার জন্ম দিয়ে মারা গেল। আমার অবশ্য করার কিছু ছিল না। আমি কেবল এনেসথেশিয়া দিয়েছি। এনেসথেশিয়াতে ডিপ্লোমা করছি। এখনো জুনিয়র। এনেশথেশিয়া দেয়ার বাইরে আমার কিছুই করার ছিল না। সঙ্গত কারণেই আমি অপারেশন করি নি। যারা অপারেশন করেছেন তাদেরকেও দোষ দেয়া যায় না। অবস্থা শুরু থেকেই জটিল ছিল। বাচ্চার পজিশন ছিল ভয়ানক। হাসপাতালে নিয়ে আনতেও দেরি করা হয়েছে। হাসপাতালে আনার পর দেখা গেল রক্ত লাগবে। রক্তের গ্রুপ এবি পজেটিভ। রক্ত দেয়ার মতো কেউ নেই।
সিনেমায় এসব ক্ষেত্রে দেখা যায় এ পরিস্থিতিতে নায়কের রক্তের সাথে নায়িকার রক্তের গ্রুপ মিলে যাবে। নায়ক রক্ত দেবে, নানান নাটকীয়তার পর যেভাবেই হোক নায়িকা বেঁচে যাবে। আমি নায়ক নই, বাস্তব জীবন সিনেমা নয়। রক্ত যোগাড় করতে গিয়ে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল। এমন পরিস্থিতিতে মাঝে মাঝে ভাগ্য খুব পরিহাস করে। দেখা গেল পরিচিতদের মধ্যে সব গ্রুপ আছে কিন্তু এবি পজেটিভ কেউ নেই। রক্ত পাওয়া গেল দেড় ঘন্টা পর।
ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
নীলা আর নেই।
রাত সাড়ে দশটা।
আমি আমার রুমে বসে আছি। লাইট নিভিয়ে দিয়ে বসেছি।
আলো ভালো লাগছে না। কেবল মনে হচ্ছে নীলা এই পৃথিবীতে নেই। তার চোখ পৃথিবীর কোন আলো দেখছে না, তার কন্ঠ কোন শব্দ করছে না, সে হাসছে না, হাঁটছে না, কথা বলছে না...সে নিথর..সে শুয়ে আছে শব্দহীন অন্য জগতে।
আমার চোখ আটকে আছে একটা স্ট্রেচারের উপর। সেখানে নীলা নামের এক তরুণী শুয়ে আছে। সে মৃত, সে স্থির। অথচ কিছুক্ষণ আগেও জীবিত ছিল, আমার হাত ধরে বাঁচার আকুতি জানিয়েছিল।
নীলা আমার কেউ নয়। দেয়ার মতো কোন পরিচয় অবশিষ্ট ছিল না। পুরো পৃথিবীর কাছে কোন ভাবেই প্রমাণ করতে পারব না আমি নীলার এমন কেউ যার মৃত্যুতে আমি কাঁদতে পারি,ভাবতে পারি, মন খারাপ করে বসতে পারি।
আমি তার অপারেশনের আগে তাকে অজ্ঞান করেছি। এরকম অজ্ঞান কম করি নি। অজ্ঞান করার পর মারা গেছে এরকম নয়জন। সবার মৃত্যুই আমার মন খারাপ করিয়েছে, কিন্তু কাঁদাতে পারে নি।
নীলা আমার কেউ নয়, কিন্তু অনেক কিছুই হতে পারতো। সাড়ে তিন বছরের প্রেম ছিল আমাদের। কেবল প্রেম নয়, ছিল আস্থা, ছিল বিশ্বাসের সম্পর্ক। প্রেমে পড়ার সময় পৃথিবীর কোন মানব মানবী ভবিষ্যতের কথা খুব একটা ভাবেনি। আমরাও ভাবি নি। না ভাবার ফলাফল পেলাম সাড়ে তিন বছর পর।
আমি তখন সদ্য পাশ করেছি, নীলা ফিজিক্সে অনার্স শেষ করেছে। হুট করে নীলার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল।
আমার মাথায় পুরো সৌরজগৎ ভেঙে পড়ল।
নীলা তার বিয়ের খবর দিয়ে বলল, চলো পালিয়ে যাই। অন্য কারো সাথে সংসার করতে পারব না।
আমি বললাম, তোমাকে নিয়ে এনে রাখব কোথায়? আমি এখন পুরোপুরি বেকার। নিজের পা রাখার জায়গা নেই।
ইন্টার্ণের সময় তাও কিছু টাকা হাতে ছিল, এখন তাও নেই।
নীলা বলল, তোমার গ্রামে তো বাড়ি আছে? সেখানে রেখে আসো।
আমি বললাম, তুমি বুঝতো পারছো এটাও অসম্ভব। তোমার পরিবার- আমার পরিবার কোনটাই মানবে না। তুমি শহরের মেয়ে, গ্রামে গিয়ে টিকতে পারবে না। সব মিলিয়ে আমাদের অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যাবে।
নীলা বলল, তবে আমার হাতে অপশন থাকল দুইটা। এক, আমি অন্য একজনকে বিয়ে করে রোজ তার সাথে ঘুমাবো। আর দুই আমি বিষ খাবো।
কোনটা করব বুদ্ধি দাও..
আমি বললাম, নীলা প্লিজ....পাগলামি করো না।
- আমি পাগলামি করছি না। আমার কথায় যুক্তি আছে।
পরের কয়েকদিন খুব দ্রুত কেটে গেল। রাজ্যের যত সম্ভব-অসম্ভব চিন্তা মাথায় ভর করল। একবার মনে হলো নীলাকে নিয়ে বাড়িতে চলে যাই। পরে যা হয় হবে। কিন্তু আমার বড় ভাই এখনো অবিবাহিত। পরিবারের প্রতি এত দায়িত্বের মাঝে এ কাজ সম্ভব না। আরেকবার মনে হলো নীলার বাড়ির সামনে আমরণ অনশন শুরু করি। নীলার বাবার পায়ে পড়ে বলি, প্লিজ আপনার মেয়েকে বিয়ে দেবেন না। আমি মরে যাব।
আরেকবার ভাবলাম নীলাকে নিয়ে অজানা কোথাও চলে যাই। সেখানে কেউ আমাদের চিনবে না। দরকার হলে মাটি কেটে খাবো, রিকশা চালাব। তারপরও তাকে হারাতে দেয়া যাবে না।
সবচেয়ে ভয়ংকর চিন্তা আসল তখন যখন ভাবলাম নীলার হবু বরকে খুন করে ফেলব। তাকে খুন করতে পারলে ঝামেলা মিটে যাবে। ঘরের সবজি কাটা ছুরিটা হাতে নিয়ে বার কয়েক কল্পনায় লোকটার পেটে ছুরি ঢুকিয়ে আনন্দ পেয়েছি।
কিছুই হয়নি, কিছু করতে পারি নি। নীলার বিয়ে যথাসময়ে এক বড় মাপের ব্যবসায়ীর সাথে হয়ে গেল।
তারপর কেটে গেছে প্রায় তিন বছর। চেষ্টা করেও তার সাথে আর যোগাযোগ করতে পারি নি। সে কখনোই আমাকে ফোন করে নি। নীলার এমন অদ্ভূত নিষ্ঠুরতায় প্রচন্ড কষ্ট লেগেছিল প্রথম এক বছর। ইদানিং কষ্ট কমে গেছে।
কিন্তু অদ্ভূতভাবে নীলার স্বামীকে খুন করার ইচ্ছে বিন্দুমাত্র কমেনি। যদিও লোকটা পুরোপুরি নির্দোষ।
গতকাল রাত নয়টার সময় ফোন আসে।
এক ভারী পুরুষ কন্ঠ বলল, আপনি জয় সাহেব বলছেন?
- জ্বি। আপনি কে বলছেন?
- আমি রাফি। নীলার স্বামী। নীলাকে চিনতে পারছেন?
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। নীলা নামটা নতুন করে রক্তে শিহরণ তুলল। মুহুর্তের জন্য নিজেকে সুখী মনে হলো। আমি এমন একজনের সাথে কথা বলছি যে নীলার পাশেই আছে। এটাই বা কম আনন্দের?
তারপরই আমার ভেতর অভিমান জমল। একবার ভাবলাম বলি "নীলাকে আমি চিনি না, চিনতামও না কখনো"।
আমি বলতে পারলাম না।
- জ্বি নীলাকে চিনি। কি বলবেন বলুন।
ওপাশ থেকে কাঁপা গলায় লোকটা বলল, নীলার অবস্থা খুবই খারাপ। ডেলিভারি হবে। আপনি তো হাসপাতালে আছেন। আমি কি আপনার এখানে নিয়ে আসতে পারি?
আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। মাথা ঘুরতে লাগল।
সব অভিমান আর সব শিহরণ ভুলে বললাম, তাড়াতাড়ি নিয়ে আসুন। এখনই। দেরী করবেন না।
নীলা ব্যথায় চিৎকার করছিল। অসহনীয় ব্যথা। মাঝে মধ্যে অজ্ঞান হওয়ার মতো করে চুপ হয়ে যাচ্ছিল, তারপর আবার চিৎকার।
আমি তার স্বামীকে বললাম, প্রথম বাচ্চা?
- হাঁ।
- ব্যথা কবে উঠেছে?
- আজ সকালে।
আমার সাড়ে তিন বছরের ক্ষোভ জেগে উঠল।
চিৎকার করে বললাম, হোয়াট দ্য হেল! সকালে ব্যথা উঠেছে আর এখন নিয়ে এসেছেন? করেছেন কি এতক্ষণ?
লোকটা মুখ নিচু করে বলল, আমি অফিসে ছিলাম। জানতাম না এসব। কেউ জানায় নি।
- জানানোর দরকার ছিল? আপনি জানতেন না তার এ অবস্থা?
হাসপাতালে না নিয়ে এসে আপনি অফিস করেছেন?
- আসলে আমি হাসপাতালে আনতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মা আনতে দেয়নি। মা বলল ডেলিভারি বাসাতেই করা উত্তম। ধাত্রী বলেছিল কোন সমস্যা হবে না।
- রক্ত তো লাগবে। রক্ত ম্যানেজ করেছেন?
- না।
আমার মাথায় রক্ত উঠে গেল। লোকটাকে খুন করার ইচ্ছে আবার জাগ্রত হলো। আড়চোখে ওটির ছুরিগুলোর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বললাম, হাউ স্টুপিডনেস!
ব্যবসায়ীরা কি টাকা ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না?
বাচ্চার জন্ম দিতে যাচ্ছেন, রক্ত যোগাড় করতে পারেন নি? সব যদি ম্যানেজ করতে না পারেন বাচ্চা জন্ম দেয়ার মানে কি? বিয়ে....
"বিয়ে করার মানে কি" বলতে গিয়ে আটকে গেলাম। আমি এত কথা বলছি কেন? আমি কে?
মারা গেলে তার স্ত্রী সন্তান মারা যাবে। তাতে তার ক্ষতি, আমার নয়।
নীলার মৃত্যুর খবরটা দেয়ার পর লোকটা মাথা নিচু করে চোখ মুছল। তাতে আমার ক্ষোভ একটুও কমল না।
:
:
রাত সাড়ে বারোটা। আমার পকেটে একটা গোলাপ ফুল। আমি যাচ্ছি বননী কবরস্থানের দিকে। নীলার কবরে ফুল দেব। শুনেছি কবরে ফুল দেয়া নাকি ধর্মসম্মত নয়। ঠিক জানি না।
তবে খুব একটা মানতে পারি না। অনেক কিছুই অজানা।
কবর জিয়ারত কিভাবে করে সেটাও ভুলে গেছি। কবরস্থানে গিয়ে কোন কবরের পাশে নিশ্চয়ই লেখা দেখতে পাবো। নয়তো কারো কাছ থেকে জানতে হবে।
নীলার কবরের পাশে গিয়ে আমি খানিকটা চমকে গেলাম। সেখানে ফুল হাতে আরেক যুবককে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। হালকা আলোয় পরিষ্কার চিনতে না পারলেও বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না লোকটা কে।
আমি পেছনে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে নীলার স্বামীকে বললাম, রাফি সাহেব! এত রাতে?
লোকটা ঘাড় ফিরিয়ে অবাক হয়ে বলল, আপনি যে!
আমি বললাম, আপনি যেহেতু একবার আমাকে ফোন করেছেন সুতরাং বুঝতেই পারছেন কেন এসেছি। নাকি বলতে হবে এটাও?
- না, আমি বুঝতে পারছি। আসুন কোথাও বসে চাই খাই।
চায়ে চুমুক দিয়ে চুপ করে টং দোকানের বেঞ্চে বসে আছি। বেঞ্চ বাঁশ দিয়ে বানানো। অদ্ভূতভাবে একটু দূরে নীলা বাঁশের চালার নিচে শুয়ে আছে।
আমি রাফির পকেটে রাখা ফুলের দিকে তাকাচ্ছি, রাফি তাকাচ্ছে আমার ফুলের দিকে।
অনেকক্ষণ পর রাফি বলল, আপনার ব্যাপারে আমি সবকিছুই জানতাম। বিয়ের প্রথম দিনই নীলা আমাকে সব জানিয়ে দিয়েছিল।
- ও আচ্ছা। জেনে আপনি কি করলেন? কষ্ট পেয়েছেন নাকি আনন্দিত হয়েছেন?
- পৃথিবীর কোন সাধারণ স্বামী তার স্ত্রীর প্রেমকাহিনী শুনে আনন্দিত হবে না। মহামানব ধরণের কেউ হলে ভিন্ন কথা। আমিও কষ্ট পেয়েছিলাম, ক্ষোভ জন্মেছিল।
- তারপর..
- তারপর দেখলাম নীলা খুব দ্রুত সবকিছু সামলে নিল। এই প্রসঙ্গটা আমাদের সামনে কখনো সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি।
আমি চুপ করে শুনছি। "সমস্যা হয়নি" মানে?
আমি এতটাই তুচ্ছ ছিলাম তবে? রাফি কি আমাকে অপমান করার চেষ্টা করছে?
খানিক পরে রাফি বলল, তবে আপনাকে নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হতো। নীলা এই পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার একটা মেয়ে। সে আপনাকে হারাতে দেয়নি, আবার আমারও বিরাগভাজন হয়নি।
- ও আচ্ছা।
রাফি বলল, জয় সাহেব। আমি জানি আপনি আমার রাগ করে আছেন। রাগ কি এখনো আছে?
আমি বললাম, সত্য বলব?
- অবশ্যই।
- কমেনি। বরং বেড়েছে। নীলার মৃত্যুর জন্য আপনি দায়ী। অবশ্য আপনার স্ত্রী মারা গেছে। আপনি আপনার স্ত্রীকে মারবেন নাকি বাঁচিয়ে রাখবেন এটা আপনার ব্যাপার। আমি কেউ নই।
রাফি মুচকি হেসে বলল, তবে আমার স্ত্রীর কবরে আপনি ফুল দিতে এসেছেন কেন? আপনি তো কেউ নন।
আমি চুপ করে গেলাম।
রাফি বলল, জয় সাহেব। আসুন প্র্যাক্টিক্যাল আলোচনা করি। আপনি আমার উপর রাগ করে আছেন। রাগ করা খুবই স্বাভাবিক। আমার প্রেমিকা অন্য কেউ বিয়ে করলে আমিও রাগ করতাম।
কিন্তু আপনার উপর আমারও রাগ করা উচিত নয় কি?
আমার স্ত্রীর প্রেমিকের উপর তো আমারও রাগ করা উচিত।
আমি বললাম, আমার রাগ এ কারণে না। নীলার মৃত্যু আপনার অবহেলায় হয়েছে। স্বামী মানে কেবল স্ত্রীকে দিয়ে সন্তান উৎপাদন নয়, তার দায়িত্ব নেয়ার নামও স্বামী।
আমরা চায়ের কাপ ফেরত দিলাম।
রাফি বলল, এই রাগ আপনি হাসপাতালেও আমার সাথে করেছেন। কিন্তু আমি যদি বলি নীলার মৃত্যুর জন্য আপনিও দায়ী তবে আপনি কি সেটা স্বীকার করবেন?
আমি চমকে গিয়ে বললাম, আমি দায়ী!
- অবশ্যই। পরোক্ষভাবে নীলার মৃত্যুর জন্য আমার চেয়ে আপনি বেশী দায়ী ছিলেন। আপনার ব্যাপারটা আমার মা জেনে যান। জানার পর থেকেই তিনি নীলাকে পছন্দ করতেন না। এর প্রভাব পড়েছে তার ডেলিভারীর সময়। মা নীলাকে পছন্দ করতেন না বলেই প্রথমে হাসপাতালে নিতে দেন নি।
- এটা আপনার মায়ের সমস্যা। আমার নয়।
রাফি মুখ শক্ত করে উচ্চস্বরে বলল, এটা আপনার সমস্যা। একটা মেয়ের সাথে আপনি এত বছর প্রেম করেছেন, বিয়ে করতে পারেন নি কেন?
কেন, পালিয়ে বিয়ে করতে পারতেন না? ওর বাবার উপর জোর করতে পারতেন না?
- আমার সে অবস্থা ছিল না।
- অবস্থা সৃষ্টি করতে হয়। আপনি রাস্তার ছেলে নন। একজন ডাক্তার। গ্রামে আপনার বাড়ি আছে। আর রাস্তার ছেলে হলে আপনার প্রেমিকা রাস্তাতেই থাকত। আপনি ছেড়ে দিলেন কেন?
কারণ আপনার মেরুদণ্ড শক্ত নয়।
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি।
রাফি বলল, আপনি জানেন নীলা আপনাকে কতটা ভালোবাসত? আপনার প্রতিটা জন্মদিনে সে কেক কাটতো, একা একা। আপনি এটা করেছেন কখনো?
আপনি কদিন তার কথা ভেবেছেন?
আমি কিছুই বলতে পারছি না।
রাফি বলল, আপনি অপারেশনের রক্ত যোগাড় করেছেন। আপনি ভাবছেন এতেই অনেক কিছু করে ফেলেছেন। বাকি তিন বছর কোন খবর নিয়েছেন নীলার?
জানতেন মেয়েটা কেমন আছে? সে বিয়ে করেছে এজন্য তার উপর আপনার রাগ। অথচ তার রাগ করা উচিত ছিল আপনার উপর।
আমি এখনো চুপ।
এতদিনের আমার সব যুক্তি পাল্টে যাচ্ছে। আমার চিন্তা বদলে দিচ্ছে এই যুবক। লোকটাকে প্রথমে বোকা মনে হয়েছিল। এখন সেটা মনে হচ্ছে না। লোকটা বিরাট বুদ্ধিমান।
রাফি বলল, আমার সময় কাটত অস্থিরতায়। স্ত্রী আনমনে অন্য কারো কথা ভাবছে এটা কোন স্বামীর জন্য সুখের না। নীলা আমাকে কখনো কোন কিছুতে বঞ্চিত করেনি। কিন্তু অধিকার নিতেও দেয়নি পুরোপুরি। তার কারণ আপনি।
আমি বললাম, অধিকার নিতে পারার ব্যর্থতার দায় আপনার, আমার নয়।
- আপনার কারণে আমি অসুখী ছিলাম, নীলাও অসুখী ছিল। আমাদের একটা অসাধারণ সাংসারিক জীবনের মাঝখানে অদৃশ্য দেয়াল হিসেবে আপনি ছিলেন।
আমি যুক্তির ভীড়ে পুরোপুরি কোণটাসা হয়ে পড়েছি।
চুপ থাকাটাকেই শ্রেয়তর ভাবলাম।
রাফিও চুপ হয়ে গেল।
সে কাঁদছে। তার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। আমি তার কাঁধে হাত রাখলাম।
রাফি বলল, জয় সাহেব স্যরি। আপনার প্রতি অনেকদিনের ক্ষোভ থেকে একটু বেশি বলে ফেলেছি। আমার শোক কম নয়। আপনার প্রিয় একজন মারা গেছে। আপনার প্রেমিকা। আমার প্রিয় দুইজন গেল। স্ত্রী আর সন্তান।
আপনার পকেটে একটু ফুল, আমার পকেটে দুইটা।
পার্থক্যটা বুঝতে পারছেন?
- হু।
- জয় সাহেব, প্রেমিক হওয়াটা আবেগের। প্রেমিক হতে কষ্ট করতে হয়না। স্বামী হওয়াটা কঠিন। আপনি প্রেমিক থেকে স্বামী হতে পারেন নি। হতে পারলে আজকে চারটা জীবন নষ্ট হতো না। আপনার-আমার-নীলার-আমার সন্তানের।
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছি। এতদিন পর নিজের অপরাধ এই লোকটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।
অপরাধী মন ভারী হওয়ার কথা, আমার হালকা লাগছে কেন?
নাকি নীলাকে এই লোক একা মারতে পারেনি, আমিও মেরেছি। আত্মতৃপ্তির কারণ এটাই?
হতে পারে। মানব মন জটিল।
রাফি সিগারেট কিনল। চা-সিগারেটের দাম সে দিয়েছে।
আমার পালা অন্যদিন।
সে চলে যাচ্ছে। তার পা পড়ছে এলোমেলোভাবে।
যাওয়ার আগে বলল, রাগ পুষবেন না। ভালো থাকার চেষ্টা করুন।
আমি নীলার কবরের দিকে তাকিয়ে আছি।
বহুবছর আগে তার হাত ধরতে গেলে সে হাত সরিয়ে বলেছিল, জয়! ভালোবাসায় আমি হাত ধরাধরিতে বিশ্বাস করি না।
এসব ভালোবাসা বাড়ায় না, কমায়। আমি তোমার হাত ধরে প্রেম নয়, হাত ধরে মরতে চাই।
আমি বলেছিলাম, এসব সিনেমা মার্কা ডায়লগ আমার পছন্দ না। পৃথিবীর অসংখ্য প্রেমিকা প্রেমিকা প্রেমিকের হাত ধরে মরার শপথ করেছিল। কেউ মরেছে বলে খবর পাইনি।
নীলা হাসতে হাসতে বলেছিল, চিন্তা করো না। প্রথম প্রেমিকা হিসেবে আমি মরব। কথা দিলাম।
অদ্ভূতভাবে নীলা তার কথা রেখেছে।
মরার আগে সে আমার হাত ধরেছিল। হাত ধরে বাঁচার আকুতি জানিয়েছিল। আমি কথা দিয়েছিলাম তাঁকে বাঁচাব। আমার কথা আমি রাখতে পারি নি।
আমি রাস্তা ধরে হাঁটছি। সোডিয়াম লাইটের হলুদ আলোয় সবকিছু হলুদ লাগছে।
হঠাৎ করেই আমার কাছে সবকিছু শূন্য মনে হচ্ছে।
বুকের ভেতরটা শূন্য, পৃথিবী শূন্য, আবেগ শূন্য, ক্ষমতা শূন্য।
মানুষ বলে মানুষের ক্ষমতা প্রবল।
আসলে কোন ক্ষমতাই নেই। মহাবিশ্বে ক্ষমতা কেবল দুইটা। জন্ম দিতে পরা, আর মৃত্যু নির্ধারণ করা। দুটো ক্ষমতাই সৃষ্টিকর্তা নিজের হাতে রেখে দিয়েছেন।
জন্ম আর মৃত্যুর মাঝখানে ক্ষমতা বলতে কিছুই নেই।
কেবল নিষ্ফল লম্ফঝম্ফ।
রাত গভীর হয়ে গেছে। একটা ট্রেনের হুইসেল শুনতে পাচ্ছি।
নীলা কি সেটা শুনতে পাচ্ছে?
জগতের কি অদ্ভূত রীতি।
যার সাথে পুরো এক জগতের ব্যবধান হয়ে গেছে তার অস্তিত্ব বুক বা মস্তিষ্কে গেঁথে গেছে আরো বেশি।
সে সরে গেছে, অস্তিত্ব এসেছে আরো কাছে।
অস্তিত্বের নিজস্ব শক্তি অসম্ভব।শক্তি থাকলে পৃথিবী জয় করা যায়। কিন্তু পৃথিবীর কোন শক্তি দিয়ে অস্তিত্ব মুছে দেয়া যায় না।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০১৬ রাত ৯:২৮
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ঋণ মুক্তির দোয়া

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৪৯



একদিন রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদে নববিতে প্রবেশ করে আনসারি একজন লোককে দেখতে পেলেন, যার নাম আবু উমামা। রসুল সাল্লাল্লাহু আলইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, ‘আবু উমামা! ব্যাপার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×