প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন তিমি হত্যা করেছে! কল্পনা করা যায়; এমন দুর্দান্ত বৃহত্তম ও বুদ্ধিমান ৩০ লক্ষ প্রাণীকে মানুষ উত্তর আর দক্ষিন গোলার্ধ তন্ন তন্ন করে খুঁজে আটলান্টিক আর প্রশান্ত মহাসাগর থেকে শুরু করে পৃথিবীর সব সাগর উপসাগরের গভীরে হানা দিয়ে নিঃশ্বংসভাবে হত্যা করেছে। এর জন্য দায়ী কারা? ফিনল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, নরওয়ে, জাপান থেকে শুরু করে বিশের সবচেয়ে শান্তির পক্ষে কথা বলা অন্যতম সভ্য দেশগুলো!!
আজকের সংবাদে প্রকাশ, জাপান ICJ ও সারাবিশ্বের সব পরিবেশবাদী সংগঠনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ফের ঘোষনা করল তারা ঐতিহ্য রক্ষার্থে ফের তিমি শিকার করার অনুমতি দিচ্ছে। তবে এই তিমিদের মূলত; গবেষণার জন্য হত্যা করা হলেও গবেষণা শেষে তাদের মাংস বাজারে বিক্রি করা হবে!!
আসুন তবে দেখে আসি জাপানের তিমি মাছ গবেষণার রূপ কেমন?
জাপান, যদিও প্রাথমিকভাবে স্থগিতাদেশের বিরোধিতা করেছিল এবং তাদের সম্পূর্ণ নৌবহর সরিয়ে নিয়েছিল। পরে ICJ এর কাছ থেকে শুধুমাত্র গবেষণার জন্য কিছু তিমি হত্যার অনুমতি নিয়ে ২০০৫ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে, জাপানি নৌবহর প্রায় ৪০০০ মিঙ্ক তিমি এবং ১৮ ফিন তিমি (যা বিপন্ন) হত্যা করেছিল। (আপনি ভাবতে পারেন জাপানের মত দেশ এমন করতে পারে???)
"গবেষণার" যুক্তি অনেকের কাছে ফাকা-বুলি বলে মনে হয়েছিল। বাকি বিশ্বের তিমি বিজ্ঞানীরা প্রাণঘাতী পদ্ধতি ছাড়াই তিমি গণনা বা তিমি বিষয়ক গবেষণা খুব ভালভাবেই করছেন।১৯৮২ সাল থেকে গবেষণার উদ্দেশ্যে হত্যা করা ১৪৪১০ তিমির মধ্যে ৯৫ শতাংশের জন্য জাপান দায়ী। উপরন্তু, জাপান এর মধ্যে খুব বেশি মূল্যবান বৈজ্ঞানিক তথ্য তৈরিও করে নি: ২০০৫ সাল থেকে, দেশটি তিমি গবেষণার জন্য জন্য শুধুমাত্র দুই পিয়ার-পর্যালোচিত কাগজ রয়েছে।
~ জাপানের গবেষণার আড়ালে তিমি শিকারের জাহাজ!!!
জাপান পরিবেশবাদী ও ICJ-এর চাপে পরের মরসুমের জন্য এই প্রোগ্রামটি বাতিল করে, কিন্তু এরপর ফের শুরু করে যুক্তি দেয় যে তিমি শিকারের উপর ICJ-এর এখতিয়ার নেই। দেশটি তখন থেকে একটি নতুন গবেষণা পরিকল্পনা তৈরি করেছে; সেখানে বলা হয়েছে তাদের গবেষনার জন্য পরিচালিত তিমি শিকারের জাহাজগুলিকে পরবর্তী ১২ বছরে প্রায় ৪০০০ মিঙ্ক তিমি মারার অনুমতি দেবে।
ভাবা যায় এই সভ্য পৃথিবীতে এখন আমরা আজ কোথায় আছি???
~ মিঙ্ক তিমি
~ ফিন তিমি
***
২০১০ সালে ব্রিটেনের সানডে টাইমসের সাংবাদিকদের গোপন তদন্তে দেখা গেছে যে, অনেক উন্নয়নশীল দেশের কর্মকর্তারা সিবিআইকে তাদের সমর্থনের জন্য জাপানের কাছ থেকে আর্থিক অনুদান বা উৎকোচ গ্রহণ করেছে। লক্ষ লক্ষ বিদেশী উন্নয়ন সহায়তা ছাড়াও, সদস্যতা ফি, বিমান ভাড়া, হোটেলে থাকার খরচের অর্থ সবই সিবিআই-এর প্রতিনিধিদের সমর্থন পেতে জাপান সরবরাহ করেছিল। কিছু ক্ষেত্রে, নগদ অর্থও জাপানি কর্মকর্তাদের দ্বারা খামে উপস্থাপন করা হয়েছিল। তদন্তের রেকর্ড থাকা সত্ত্বেও, প্রতিবেদনের সাথে জড়িত কর্মকর্তারা ভোটের বিনিময়ে ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
~ গবেষণার নামে 'আই সি আর ডাব্লিউ' এর ব্যানারে জাপানের তিমি হত্যা।
সংরক্ষণবাদীদের হয়রানির কথা উল্লেখ করে জাপান অকালেই ২০১০ থেকে ২০১১ পর্যন্ত তার অ্যান্টার্কটিক শিকার শেষ করে। যাইহোক, ২০১১ সালের অক্টোবরে ঘোষণা করা হয়েছিল যে ২০১১-২০১২ তিমি শিকার পরিকল্পনা অনুযায়ী চলতে থাকবে।
***
জাপান সরকারের প্রতিক্রিয়া হল যে তিমি শিকার জাপানী সংস্কৃতির একটি প্রাচীন অংশ, যে জেলেরা বহু শতাব্দী ধরে তিমি শিকার করে আসছে, এবং জাপান কখনই বিদেশীদের তাদের লোকেদের বলতে দেবে না যে তারা কী খেতে পারে এবং কী খেতে পারে না৷
... অথচ গবেষণায় উঠে এসেছে যে , জাপানে তিমির মাংস কখনোই জনপ্রিয় ছিল না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, যুদ্ধের কারণে দেশটি বিধ্বস্ত হয়েছিল এবং মানুষ ক্ষুধার্ত ছিল, মার্কিন জেনারেল ডগলাস ম্যাকআর্থার জাপানকে খাদ্যের জন্য বৃহৎ আকারের তিমি শিকার পুনরায় শুরু করার আহ্বান জানান। যুদ্ধোত্তর যুগে তিমির মাংস স্কুলের মধ্যাহ্নভোজের প্রধান উপাদান হয়ে উঠেছিল এবং তিমি শিকার শিল্পটি উপকূলীয় বিভিন্ন সম্প্রদায়কে তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য সহায়তা করেছিল।
কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। বেশিরভাগ মানুষ এখন গরুর মাংস এবং শুয়োরের মাংস পছন্দ করে এবং তিমির মাংসের চাহিদা কমে গেছে। জাপান সরকারকে এখন শিল্পটিকে বছরে প্রায় ১০ মিলিয়ন ডলারে ভর্তুকি দিতে হবে।
~ জাপানের টোকিওতে সুকিজি মাছের বাজারে তিমির মাংস বিক্রি হচ্ছে।
২০০৯ সালে, জাপানের ১.২ মিলিয়ন টন সামুদ্রিক খাবারের মধ্যে প্রায় ৫০০০ টন তিমির মাংস অন্তর্ভুক্ত ছিল। খোলা বাজারে তিমির মাংস আশানুরূপ বিক্রি না হওয়ায় ২০০৫ সালে, জাপান সরকার দেশের মজুদ কমানোর একটি উদ্যোগের অংশ হিসেবে পাবলিক স্কুলকে স্কুলের খাবারে তিমির মাংস পরিবেশন করতে উৎসাহিত করা শুরু করে। একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ১৮ শতাংশ সরকারি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যাহ্নভোজ প্রদান করে। ২০০৯/২০১০ আর্থিক বছরে অন্তত একবার তিমি মাংস পরিবেশন করার আদেশ প্রদান করে।।
তিমির মাংসে মিথাইলমারকিউরির বিষাক্ত মাত্রার অভিযোগের কারণে স্কুলছাত্রীদের তিমি মাংস পরিবেশন করার সমালোচনা হয়েছে।
একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে লাল তিমির মাংসে পারদের মাত্রা খাদ্যের জন্য মার্কিন এফডিএ-এর সীমার চেয়ে ছয় গুণ বেশি। তিমির মাংস পলিক্লোরিনযুক্ত বাইফেনাইল দ্বারাও দূষিত হতে পারে। সমালোচকরা বলছেন যে দূষণের কারণে এটি স্বাস্থ্যের ঝুঁকি তৈরি করে। শিশু এবং গর্ভবতী মহিলাদের তাই তিমির মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়।
***
আপনি জেনে আশ্চর্য হবেন, একটা বিড়ালের মৃত্যুতে যেই জাতি শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ে অথচ তাদেরই সিংহভাগ মানুষ তিমি হত্যার প্রতি সায় দেয়। একটা জরিপে দেখা গেছে জাপানের ৫৪ ভাগ মানুষ তিমি হত্যার পক্ষে!
~ মিঙ্ক তিমি হত্যা।
***
জাপানের রয়েছে পেলাজিক তিমি শিকারের জাহাজ বহর, যা প্রতি বছর দক্ষিণ মহাসাগরে বড় তিমি শিকার করে। এই বহরে বেশ কয়েকটি জাহাজ রয়েছে যা তিমি শিকারের শিকার এবং প্রক্রিয়াকরণের পাশাপাশি প্রতিবাদের বিরুদ্ধে শিকারকে সুরক্ষিত করে। ২০০৯-২০১০ মৌসুমে, জাপানি বহরে একটি জাহাজে প্রক্রিয়াকরন কারখানা, চারটি তিমি শিকারী জাহাজ এবং দুটি নিরাপত্তা টহল নৌকা অন্তর্ভুক্ত ছিল। কোন আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে জাপানি স্ব-আরোপিত কোটায় ৯৩৫টি মিঙ্ক তিমি, ৫০ ফিন তিমি, এবং ৫০টি হাম্পব্যাক তিমি প্রতি মৌসুমে অন্তর্ভুক্ত করেছে।
~ পেলজিক বহরের এক জাহাজে মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণের অপেক্ষায় মৃত তিমির দল।
যখন একটি তিমি বা তিমির ঝাক দেখা যায়, তখন তিমি শিকারীরা তাড়া করে। গ্রেনেড-টিপড হারপুন দিয়ে সজ্জিত একটি হারপুন বন্দুক তিমিকে লক্ষ্য করে ট্রিগার করা হয়। হারপুনে একটা দড়ি জোড়া থাকে যাতে তিমিটি হারিয়ে না যায়। যদি বিস্ফোরক-টিপড হারপুন দ্বারা তিমিটিকে আঘাত করা হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে সেটা মারা না যায়, তবে একটি দ্বিতীয় হারপুন ব্যবহার করা হয় হয় এবং তিমিটি মারা না যাওয়া পর্যন্ত রাইফেল দিয়ে গুলি করা হয়। (তিমিকে ইলেক্ট্রোকিউট করার জন্য দ্বিতীয় হারপুন ব্যবহার করা একটি পুরানো পদ্ধতি এখন IWC দ্বারা নিষিদ্ধ।) পরিবেশবাদী গোষ্ঠীগুলি রিপোর্ট করেছে যে, হারপুন দিয়ে আঘাত করে তিমিগুলিকে পিছনের দিকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয় ও চুবিয়ে দম বন্ধ করে মারা হয়।
~ হারপুন দিয়ে এভাবে তিমিকে পেছন দিকে টেনে চুবিয়ে দম বন্ধ করে মারা হয়। তিমি দীর্ঘক্ষন শ্বাস না নিয়ে থাকতে পারে। সূদীর্ঘ সময়ে জন্য দুঃসহ আঘাতের শারিরিক যন্ত্রনা ও নিশ্বাস না নিতে পারার কষ্ট - এর ভয়াবহতার অনুভুতি মানুষের বোঝার ক্ষমতা নেই।
জাপান কখনো কখনো প্রয়োজনের তুলনায় এত বেশী তিমি হত্যা করেছে যে, বাধ্য হয়ে তিমির মাংস জৈব সার হিসেবে ব্যবহার করতে হয়েছে।
কিছু জাপানীয় উপকুলবাসীরা স্থানীয় শিশুদেরকে মৌসুমের প্রথম হত্যা দেখতে উৎসাহিত করে, তারপরে প্রথম তিমি হত্যা উপলক্ষ্যে একটা অনুষ্ঠানে সবাইকে তিমির মাংস পরিবেশন করা হয়। জাপান শুধু তিমি নয়, প্রতি মৌসুমে প্রায় বিশ হাজার (২০০০০) ডলফিন হত্যা করে।
ব্রিটিশ অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপ এনভায়রনমেন্টাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি রাকুতেনকে "তিমি পণ্যের বৃহত্তম অনলাইন বিক্রেতা" বলে অভিযুক্ত করেছে।
~ যদিও রাকুতেন বেশ কিছুদিন হল পরিবেশবাদীদের চাপে অনলাইনে তিমির মাংস বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছে কিন্তু এখনো আইভরি সহ বেশ কিছু জাপানিজ কোম্পানী দেদারসে অনলাইনে তিমির মাংস বিক্রি করছে।
এক সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে জাপানের উচ্চ পদস্থ একজন সরকারী আমলা বলেন,
"আমি আপনার সাথে একমত," "অ্যান্টার্কটিক তিমি জাপানের সংস্কৃতির অংশ নয়। এটি আমাদের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির জন্য ভয়ানক এবং এই মাংসের তেমন কোন বাণিজ্যিক চাহিদা নেই। আমি মনে করি দশ বছরে জাপানের গভীর সাগরে আর কোন তিমি থাকবে না।"
"তাহলে আমরা এখন থামছি না কেন?" আরেক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলেন।
"এখানে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক কারণ রয়েছে- যেগুলি এখন বন্ধ করা কঠিন।"
তিনি আর কোন প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চলে গেলেন!!!!!!!!!!!!!!!!!!!
***
~ তিমি এখনো পর্যন্ত মানুষের জ্ঞানের সীমার মধ্যে সুবিশাল মহাবিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম স্তন্যপায়ী প্রানী!!এমন বৃহৎ, চমৎকার, সুন্দরতম, বুদ্ধিমান, বন্ধুপ্রতিম একটা প্রাণীকে পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক সভ্যতম জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষায়-সংস্কৃতিতে বহুপথ এগিয়ে থাকা মানবাতার দীক্ষা দেয়া মানুষেরা কিভাবে হত্যা করে কেটে-কুটে খেয়ে ফেলে তা আমার মত অসভ্য জ্ঞান-গম্যিতে বহুদুর পিছিয়ে থাকা মানুষ ভাবতেই পারে না???
তথ্যসুত্রঃ
https://www.vox.com/
দ্যা গার্ডিয়ান
বিবিসি সহ অন্যান্য অনলাইন সুত্র