এ কথা তো সত্যি যে বঙ্গবন্ধু একজন সেকুলার এবং প্রগতিশীল চিন্তাধারার মানুষ ছিলেন? এবং এটাতো শাহবাগীরাও স্বীকার এবং প্রচার করে। কিন্তু তিনি বুক ফুলিয়ে আঙুল উঁচু করে জোর গলায় এটাও বলতেন, 'আমি মুসলমান'। বর্তমান সেকুলারিজম এবং প্রগতিশীলতা ফেরি করা শাহবাগীরা কি বঙ্গবন্ধুর মতো আঙুল উঁচিয়ে বুক ফুলিয়ে বলতে পারবে, 'আমি মুসলমান'? কথায় কথায় যে বঙ্গবন্ধু বন্দনা করে, কিন্তু তারা কি সত্যিই বঙ্গবন্ধুকে ওন করে? তারা যদি সত্যিই বঙ্গবন্ধুকে ওন করতো, তবে দেশের আপামর জনতার সাথে তাদের বর্তমান যে দ্বন্দ্ব তা কখনোই সৃষ্টি হতো না। তাদের সাথে দেশের সাধারণ জনগোষ্ঠীর দ্বন্দ্বের মূল কারণ হচ্ছে, তারা সেকুলারিজম, প্রগতিশীলতা, এবং বাঙালিত্বের নামে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের উপর বঙ্কিমদের সেই হিন্দুত্ববাদী প্রকল্প চাপিয়ে দিতে চায়।
পূর্ব বাংলায় উর্দু চাপিয়ে তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশের মানুষের মধ্যে অন্তমিল ঘটানোর চেষ্টা যেমন পাক শাসকগোষ্ঠী সাথে সংঘর্ষের জন্ম দিয়েছিল। ঠিক তেমনই সেকুলারিজম, প্রগোতিশীলতা, এবং বাঙালিত্বের মোড়কে হিন্দুত্ববাদী সাংস্কৃতি বাংলার মানুষের উপরে চাপিয়ে দিয়ে হিন্দু মুসলিম মিলন ঘটানোন চেষ্টার ফলে শাহবাগী এবং বাংলার সাধারণ মানুষের মধ্যে দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হচ্ছে। বাংলাদেশের সকল ধর্মাবলম্বী মানুষ সহ অবস্থানে থেকে যার যার ধর্ম কর্ম করছে। কেউ কাউকে বাধা দিচ্ছে না। আমি নিজে একই ফ্লাটে হিন্দু রুমমেটদের সাথে থেকেছি, যাদের সাখে আমার এখনো খুব ভালো সম্পর্ক রয়েছে, এবং এ দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের হল গুলোতেও প্রচুর হিন্দু মুসলিম রুমমেট হিসেবে সৌহার্দপূর্ণ ভাবে বসবাস করছে। হ্যাঁ মাঝেমধ্যে কিছু কুমতলবি লোক, আন্তর্জাতিক যড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে মন্দিরে হামলা চালিয়েছে, কিন্তু বাংলার সাধারণ জনগণ কখনোই তা সমর্থন করেনি, বরং এর সমালোচনা করেছে। ইদানীং বছরগুলোতে মিডিয়ায় এমন খবরও এসেছে, যেখানে পূজা চলাকালীন মাদ্রাসার ছাত্ররাই মন্দিরে নিরাপত্তার কাজ করেছে।
সাধারণ মানুষ লেখাপড়া না করলেও তারা তাদের সাংস্কৃতির সাথে মোরাল কোডের সামঞ্জস্যতা অনুসন্ধান করবেই। যেটা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষও করবে। বাংলার মানুষ ইসলাম কম বেশি যতটুকুই পালন করুক বা না করুক, এ কথা স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশের মানুষের মোরাল কোডের অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে ইসলাম। সুতরাং তারা তাদের সাংস্কৃতির সাথে ইসলামেরও একটা অন্তমিল অনুসন্ধান করবে।
সাধারণ জনতার কথা বাদ দিলাম, যেসকল কবি সাহিত্যিকদের হাত ধরে আধুনিক বাংলা সাহিত্য বিকাশ লাভ করেছে, তারাও কি নিজের মোরাল কোডকে ছাপিয়ে যেতে পেরেছে? না, পারেনি। এর প্রামাণ পাওয়া যাবে আহমদ ছফার লেখা "যদ্যপি আমার গুরু" বইয়ে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকের বক্তব্যে, বক্তব্যটি হচ্ছে -
"আমি কইছিলাম আপনেরা বাংলায় যত উপন্যাস লেখা অইচে সব এক জায়গায় আনেন। হিন্দু লেখক মুসলমান লেখক ফারাক কইরেন না। তারপর সব উপন্যাসে যত চরিত্র স্থান পাইছে রাম, শ্যাম, যদুমধু, করিম-রহিম নামগুলো খুঁইজ্যা বাইর করেন। তখন নিজের চৌকেই দেখতে পাইবেন, উপন্যাসে যেসব মুসলমান নাম স্থান পাইছে তার সংখ্যা পাঁচ পার্সেন্টের বেশি অইব না। অথচ বেঙ্গলে মুসলিম জনসংখ্যার পরিমাণ অর্ধেকের বেশি। আরেকটা জিনিস মনে রাখবেন, উপন্যাস অইল গিয়া আধুনিক সোশিয়াল ডিসকোর্স। বেঙ্গলে হিন্দু মুসলমান শত শত বছর ধইরা পাশাপাশি বাস কইরা আইতাছে। হিন্দু লেখকেরা উপন্যাস লেখার সময় ডেলিবারেটলি মুসলমান সমাজ ইগনাের কইরা গেছে। দুয়েকজন ব্যতিক্রম থাকলেও থাকবার পারে। বড়ো বড়ো সব হিন্দু লেখকের কথা চিন্তা কইরা দেখেন। তারা বাংলার বায়ূ, বাংলার জল এই সব কথা ভালা কইরাই কইয়া গেছে। কিন্তু মুসলমান সমাজের রাইটফুল রিপ্রেজেনটেশনের কথা যখন উঠছে সকলে এক্কেরে চুপ। মুসলমান সমাজরে সংস্কৃতির অধিকার থেইক্যা বঞ্চিত করার এই যে একটা স্টাবর্ন অ্যটিটিউড হেই সময় তার রেমেডির অন্যকোন পন্থা আছিল না।
আচ্ছা অন্যসব লেখকদের কথাও বাদ দিলাম, বাংলাদেশের সেকুলার প্রগতিশীলদের প্রাণ পুরুষ রবীন্দ্রনাথ কি এর বাহিরে ছিলেন? রবীন্দ্রনাথের কাছে লেখা এক চিঠিতে আবুল ফজল রবীন্দ্রনাথকে এভাবে প্রশ্ন করেন-
"আপনি লিখেছেন 'বাঙলাদেশের আধখানায় সাহিত্যের আলাে পড়েনি,' অতি কঠোর সত্য কথা। যদি বেয়াদবি মনে না করেন তবে এ প্রসঙ্গে আমার ও আমার বন্ধুগণের দীর্ঘদিনের একটি প্রশ্ন উথাপন করি। বাঙলা সাহিত্যের অনির্বাণ ভাস্কর পর্যন্ত এ অধখানা বাঙলার দিকে ফিরে তাকাননি- রবির কিরণে বিশ্ব আলোকিত হয়েছে, কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের, বাঙলার মাটির আঙিনায় রবির আলাকপাত হলো না। এর যথাযথ কারণ আমরা ধারণা করতে পারছি না। শুনেছি গল্পগুচ্ছের অনবদ্য গল্পগুলাে শিলাইদহে আপনাদের জমিদারিতে বসেই লেখা, শিলাইদহের মুসলমান প্রজামণ্ডলীর মধ্যে আপনার কি আসন তা শ্রীযুক্ত সুধাকান্ত রায় চৌধুরীর প্রবন্ধ না পড়েও আমরা আন্দাজ করতে পারি, অথচ এদের জীবন আপনার কোনো সাহিত্য প্রচেষ্টার উপাদান হতে পারল না?
না, মোরালিটির প্রশ্নে নিজ ধর্মের গন্ডি ছাড়িয়ে যেতে না পারার কারণে আমি রবীন্দ্রনাথ বা অন্যান্য লেখকদের কোন সমালোচনা করছি না। আমি কেবল এটাই বলতে চাই মানুষের সাংস্কৃতিতে মোরাল কোডের একটা কোর ভূমিকা রয়েছে, এবং মোরল কোডের গঠনে ধর্মের একটা কোর ভূমিকা রয়েছে। মানুষ সহজে এর বাহিরে যেতে পারে না। রবীন্দ্রনাথ কিংবা বাংলা সাহিত্যের বড় বড় লেখকরাও যে সেটা পারেনি, তা তাঁদের লেখা থেকেই প্রতিয়মান হয়।
বর্তমানে সেকুলারিজম, প্রগতিশীলতা, বা বাঙালিত্বের মোড়কে বলপূর্বক এমন কিছু ঢুকিয়ে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে, যা বাংলাদেশর মানুষের মোরাল কোডের সাথে সাংঘর্ষিক, তাই বেধে যাচ্ছে সংঘর্ষ। উদাহরণ দেই, দূর্গা পূজা এলেই একটা কথা শোনা যায়, ধর্ম যার যার উৎসব সবার। এটা নিয়ে আবার সেকুলার এবং মুসলিম সমাজে চলতে থাকে বিতর্ক। দেখুন, সমস্যা তো উৎসব নিয়ে নয়, সমস্যা হচ্ছে মূর্তি নিয়ে। মুর্তি বিষয়টা ইসলাম ধর্মের মোরালিটির সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক! যারা দুর্গা পূজায় স্লোগান দেয় "ধর্ম যার যার উৎসব সবার", তারা কি কোরবানির ঈদে এই একই স্লোগান দেবে? না, দেবে না, কারন কোরবানির ঈদে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সমস্যা নেই, তাদের সমস্যা গরু কোরবানিতে! তথাকথিত যে পরজীবি প্রগতিশীল এবং সেকুলার সমাজ কপালে তিলক পরতে পারে কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মতো আঙুল উঁচু করে উচ্চারণ করতে পারে না 'আমি মুসলমান', তারা কুরবানিরর ঈদে এমন স্লোগান দেবে, সেটা কি সম্ভব?
একজন হিন্দুর ধর্ম বিশ্বাসের উপরেও আমার সম্মান রয়েছে, যেটা সেকুলার ও প্রগতিশীল নামধারী শাহবাগীদের নেই মুসলিম সমাজের উপর। তাই আমি বলবো না হিন্দুদের কোরবানি ঈদে দাওয়াত দিতে। কারণ এটা তার বিশ্বাসের সহিত সাংঘর্ষিক। শুধুমাত্র দুর্গাপূজা এলে যে স্লোগান তারা দেয়, " ধর্ম যার যার উৎসব সবার" বাংলার মানুষ কেন তা গ্রহণ না করে বিরোধিতা করে সেটা বোঝানোর জন্যই বলা। এবং এখান থেকে এটাও প্রতিওমান হয়, ষাট সত্তুর বছর আগের মুসলিম সমাজ সেকুলার এবং প্রগতিশীল বঙ্গবন্ধুকে গ্রহণ করলেও বর্তমান মুসলিম সমাজ কেন আজকের সেকুলার এবং প্রতিশীলদের গ্রহন করতে পারছে না।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০২৩ সকাল ১১:৪৯