বিশ্বের বিখ্যাত সব শহরগুলোর অবস্থান নদীর পাশে। কোন শহরের পাশে নদী থাকা মানে শহরটি অনেক আকর্ষণীয়। অনেক বর্ণিল। আলোর ঝলকানি পর্যটকদের টেনে নিয়ে যায় নদীর পাশে। আমার দেখা সিংগাপুরের নদীটি বেশি বর্ণিল। সন্ধ্যার পর গার্ডেন বাই দ্য বে ধরে হেটে গেলে মনে হবে স্বর্গের পথ ধরে হেটে যাচ্ছি। নদীর পাশে বড় বড় ভবনগুলো আলোকসজ্জায় উৎসবমুখর। অথচ এই নদীটা এক সময় ছিল অনেক দুষিত। আমরা জানি সিঙ্গাপুর পানির জন্য মালয়শিয়ার ওপর নির্ভরশীল। একসময় মালয়শিয়া থেকে পানি সরবরাহ অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে। এ কারণে সিংগাপুর পানির আধার তৈরির কাজে হাত দেয়। এজন্য নদীটিকে পরিস্কার করা হয়। আশির দশকে নদী পরিস্কার করার দৃশ্য ছবিতে দেখেছি। মন কে মন পলিথিনের স্তুপ, প্লাস্টিক নদী থেকে তোলা হয়। এখন ওই নদীর পানিই সিংগাপুরের মিস্টি পানির রিজার্ভ। আর নদীকে ঘিরেই শহরটাকে সাজানো হয়েছে। বিন্যাস করা হয়েছে সৌন্দর্যকে। সিংগাপুরের এক সময়ের শ্লোগান ছিলো- গার্ডেন সিটি। এখন তারা তা পাল্টে ফেলেছে। এখনকার শ্লোগান সিটি ইন দ্যা গার্ডেন।
কিছুদিন আগে চীন দেখা হলো। চীনের গুয়ানজু শহরটা দেখেও মন জুড়িয়েছে। চীনের প্রতিটি শহর যেন সিংগাপুরকে ফলো করছে। গুয়ানজু শহরের এক প্রান্তে তৈরি করা হয়েছে হারবার। সেখান থেকে পর্যটকরা প্রমোদতরীতে শহরের চারদিকে ঘুরে বেড়ায়। একই রকমের পরিবেশ। সন্ধ্যা হতেই আলোর ঝলকানি। সারা বিশ্ব যখন স্মার্ট সিটির কথা বলছে, চীন সেখানে অরো কয়েক ধাপ এগিয়ে আই সিটি (i-City)বাস্তবায়নের পথে এগিয়ে গেছে। আইসিটি মানে ইন্টেলিজেন্ট সিটি। আই সিটিতে শহর মানুষের প্রয়োজন বুঝবে। আর মানুষ শহরের প্রয়োজন বুঝবে। এই জাপানের কথা আর কী বলবো৷ সবকিছু ছবির মতো সাজিয়ে রাখা হয়েছে৷ তবে নদীগুলোর প্রতি যত্ন আরো বেশী৷ সবগুলোর পাড় বাঁধাই করে ফেলা হয়েছে৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে বিষয়টি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা হলো- নদীর দুই পাশে সুউচ্চ অট্টালিকা। সাজানো গুছানো। সবুজের সমারোহ। পার্ক। খেলার মাঠ। কী নেই! পরিকল্পনা ছাড়া এমন ভবন গড়ে ওঠা সম্ভব নয়। অনেক শহরের নদীর পাশের ভবন ভেঙ্গে পুনরায় নির্মাণ করা হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার নাম এখানে উল্লেখ করা যায়।
বিশ্বের প্রতিটি শহরেই পুরান শহর আছে। এটি পর্যটকদের আরেক আকর্ষণের জায়গা। যেসব শহরে আমার যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছে, সেখানে পুরান শহরগুলো আরো সুন্দর। কোন গাড়ি নেই। লোকজন পায়ে হেটে হেটে ঘুরে দেখে। খাবারের জন্যও বিখ্যাত এই পুরান শহরগুলো। রাস্তায় রাস্তায় খাবারের উৎসব। সিংগাপুরের শহরের সব ভাঙ্গা হলেও চায়না টাউন বা ইন্ডিয়ান টাউনে হাত দেয়া হয়নি। এজন্য একটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেখানে বিশাল দেয়ালে শহরের ছবি। হাতে ঘষলেই সেখানে আগের চিত্র ফুটে উঠে। দেখা যায়, কি পরিবর্তন আনা হয়েছে। পুরান চায়না টাউনে শুধু রঙ করেই আকর্ষণীয় করা হয়েছে। ঐহিত্যকে সবখানেই সম্মান করা হয়ে থাকে।
যাই হোক আমাদের ঢাকা শহর এর প্রতিটি দিক থেকে সমৃদ্ধ। শহরটি নদীর পাশে। আছে পুরান শহর। আমাদের পুরান ঢাকা। মোঘলদের রুচির প্রশংসা করতে হয়। ঢাকা শহর এই অঞ্চলের মধ্যে সেরা একটি জায়গা। ঢাকার পানি, আবহাওয়া এই অঞ্চলের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। সারাদেশে যখন খরা, ঢাকায় তখন বৃষ্টি হয়। ঢাকায় বসবাস করলে স্কিন সুন্দর হয়ে যায়। স্বাস্থ্যকর স্থান হিসেবে ঢাকার পরিচিতি ছিলো উপমহাদেশ জুড়ে। কালের পরিক্রমায় সেই শহরটি এখন বিশ্বের সেরা খারাপ শহরের শীর্ষে। মাঝে মাঝেই আগুনে হতাহত প্রচুর মানব সন্তান। এখন পপুলার একটি ধারণা নিয়ে সবাই বেশ আলোচনায় মত্ত হয়ে আছে। সেটা হলো কেমিক্যাল। সবার ধারণা কেমিক্যাল সরালেই পুরান ঢাকার বিপর্যয় দূর হবে। আমার মনে হয়, এটা সদূর পরাহত। একটা বিপদ গেলেও কয়েক হাজার বিপদ পুরানো ঢাকার মাথার উপর ঝুলছে। এরপরেও আগুন লাগবে। আর আগুন লাগলে বের হওয়ার রাস্তাই নেই সেখানে। মানুষ একই হারে মারা যাবে। আমরা ভূমিকম্পের বিষয়টি মাথায় আনতে চাইনা। এটা হলে ইতিহাসের বড় একটি মানবিক বিপর্যায় ঘটবে এই পুরান ঢাকায়। একারণে সময় এসেছে পুরান ঢাকা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার।
আমি ভারতের হায়দরাবাদ গেছি। হায়দরাবাদ এখন দুটি রাজ্যের ডি ফ্যাক্টো রাজধানী। একটি অন্ধ্র। অন্যটি তেলেঙ্গানা। ২০১৪ সালে তেলেঙ্গানা রাজ্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়। আর ১০ বছরের জন্য হায়দরাবাদ শহরকে অন্ধ্রপ্রদেশ ও তেলঙ্গানার যৌথ রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। তবে এর পর কে পাবে হায়দরাবাদ। তা নিয়ে টানাটানি চলে। সিদ্ধান্ত হয় হায়দরাবাদকে তেলেঙ্গনা রাজ্যে পাবে। অন্ধ্র প্রদেশের নেতা মুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রবাবু নাইডুকে নতুন রাজধানী গড়তে যত টাকা লাগে দেয়া হবে বলে কেন্দ্রীয় সরকার থেকে প্রতিশ্রুতি দেয় হয়। তিনি কৃষ্ণ নদীর তীরে অমরাবতিতে রাজধানী স্থাপনের ঘোষণা দেন। ভারত সরকারের প্রতিশ্রুতি পেয়েই নাইডু সিঙ্গাপুর চলে যান। সেখানে অনেক দিন অবস্থান করেন। সিংগাপুরের প্রতিটি বিষয় খুটিয়ে খুটিয়ে দেখেন। পরিবহন ব্যবস্থা। নিরাপত্তা। এরপর সিঙ্গাপুরকে রাজি করান এই শহরের আদলেই অমরাবতিতে একটি শহর প্রতিষ্ঠার। সিঙ্গাপুর রাজি হয়। এ শহরে কোন ট্রাফিক লাইট থাকবেনা। স্বয়ংক্রীয়ভাবে গাড়ি চলবে। কোন গাড়িকে থামতে হবেনা। থাকবে পার্ক। খেলার মাঠ। লেক। সাধারণের জন্য ফ্লাট। আর বিশিষ্টজনদের জন্য বাংলো। এ শহরে ৫১ ভাগ থাকবে গ্রিণ স্পেস। ১০ ভাগ থাকবে ওয়াটার বডি। ঠিক আরেকটি সিংগাপুর। এজন্য বিশ্বব্যাংক ৫শ মিলিয়ন ডলার দেবে। ২৫০০ কোটি রুপি দিচ্ছে ভারত সরকার। আর ৭৫০০ কোটি রুপি দেবে হাডকো। সব মিলিয়ে ৩৩ হাজার কোটি রুপির বিশাল কর্মযজ্ঞ।
আমি দীর্ঘদিন ধরে চিন্তা করেছি। প্রথমেই বলে নেই, আমি নগরবিদ নই। এ বিষয়ে লেখাপড়াও আমার নেই। জ্বর হয়েছে শুনলে বাঙালি সবাই চিকিৎসক হয়ে উঠে। আমার অবস্থাও তেমনটাই। এখন যে অবস্থায় আছে পুরান ঢাকা, তাতে সেখানে দৃষ্টিনন্দন কিছুই করা সম্ভব নয়। আমাদের বুড়িগঙ্গা নদী বিশ্বের সবচেয়ে দুষিত নদীর একটি। এটাও পুরান ঢাকার কারণে। সবগুলো সুয়ারেজ লাইন নদীর সাথে যুক্ত। কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। এবার আওয়ামী লীগের নির্বাচনী মেনিফেস্টোতে নদীর পাড় ঘিরে সিংগাপুরের আদলে শহর গড়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত হয়েছে। কিন্তু কিভাবে? এটা উল্লেখ করা হয়নি। পুরান ঢাকার সমাধান হলো- ভেঙ্গে নতুন করে আবার শহর তৈরি করা। পুরানো ঢাকা ভেঙ্গে ফেলার কথা শুনে কপালে চোখ উঠে যেতে পারে! এখনি সমগ্র পুরান ঢাকাকে ৫০টি জোনে বিভক্ত করা দরকার। সেই দয়াগঞ্জ থেকে গাবতলী। জরিপ করা দরকার ভবনগুলোর। বড় বড় ভবন আর ঐতিহাসিক স্থাপনা রেখে বাকী সব ভবন ভেঙ্গে ফেলতে হবে। বিশ্বে এখন ইউলুপ দিয়ে সড়ক নির্মাণ করা হয়। একটি সড়কের উপর আরেকটি সড়ক নিয়ে যাওয়া হয়। ফলে কোন ট্রাফিক লাইটের প্রয়োজন হয়না। পরিকল্পনা করতে হবে। ৩০ ভাগ সড়ক রেখে বাকী জায়গায় তুলতে হবে সুউচ্চ ভবন। ব্যবসার জন্য এলাকা। মার্কেট। পার্ক স্থাপন করতে হবে। খেলার মাঠ তৈরি করতে হবে। লেক বানাতে হবে। করতে হবে দৃষ্টিনন্দন মসজিদ আর মন্দির। আইন করা দরকার, ঢাকায় বিশেষ করে পুরান ঢাকায় কোন ব্যক্তি জমির মালিক হতে পারবেনা। ফ্লাটের মালিক হতে পারবেন। আর সেই কারণেই পুরান ঢাকার সব জমি অধিগ্রহণ করা দরকার। জমির মালিকরা ফ্লাট পাবেন। দেশে এতগুলো বেসরকারি ব্যাংক। এর একেকটি ব্যাংককে একটি জোনের দায়িত্ব দেয়া যায়। অর্থ সমস্যার সমাধান এভাবেই সম্ভব। আমার ধারণা এ বিষয়ে ফরেন এইডও পাওয়া যাবে। পুরান ঢাকার ভবনগুলো এখনো আকাশ ছোঁয়া হয়নি। এক পাড়ায় যে মানুষের বসাবাস তা একটি দুটি ভবনেই তুলে দেয়া সম্ভব। নদীর তীরটাকে বাধাই করে ফেলা দরকার। সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনাল সরিয়ে ফতুল্লা নিয়ে যাওয়া দরকার। এজন্য একটি নতুন সরকারি সংস্থা দরকার। রাজউক বা গৃহায়ণের মতো। আমার ধারণা- সঠিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থের তালিকা করতে পারলে তাদের জমির বিনিময়ে ফ্লাট নিশ্চিত করতে পারলে জনরোষের সম্ভাবনা নেই। আমরা অনুরোধ করলেও সিংগাপুর রাজি হতে পারে- এখানে একটি শহর প্রতিষ্ঠার। বিশ্বের যেখানেই যাই, যখনি তাদের শহরকে নিয়ে গর্ব করে কোন একটি জরিপ উপস্থাপন করা হয়, সেখানেই সবার তলানিতে ঢাকা শহরের নাম। লজ্জায় আর কথা বলতে পারিনা। আমরা সিংগাপুর চাইনা। শুধু পচিশ বছর আগের ঢাকার পরিবেশ ফিরিয়ে আনলেই চলবে।
কাজী সায়েমুজ্জামান
২ মার্চ ২০১৯
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই এপ্রিল, ২০১৯ সকাল ১০:৩৫