চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷
আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন, জিবরীল (আঃ) না আসা পর্যন্ত আমি নীরব থাকবো। তিনি নীরব থাকলেন। এর মধ্যে জিবরীল (আঃ) আসলেন। তখন রাসুল দ. জিবরীল (আঃ) কে ওই প্রশ্নটি জিজ্ঞেস করলেন। জিবরীল (আঃ) উত্তর দিলেন, এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাকারীর চেয়ে জিজ্ঞাসিত ব্যক্তি বেশি কিছু জানে না। তবে আমি আল্লাহকে জিজ্ঞেস করবো।
কিছুক্ষণ পর জিবরীল (আঃ) বললেন, হে মুহাম্মাদ দ.! আমি আল্লাহর এত কাছাকাছি গিয়েছিলাম যে আর কোন দিন এত কাছে যাইনি। রাসুল দ. জিজ্ঞেস করলেন, কিভাবে? জিবরিল বললেন, তখন আমার ও তাঁর মধ্যে মাত্র সত্তর হাজার নূরের পর্দা ছিল। আল্লাহ বলেছেন, দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট স্থান হলো বাজার, আর সবচেয়ে উত্তম স্থান হলো মাসজিদ।
ইবনু হিব্বান; তাঁর সহীহ গ্রন্থে ইবনু ’উমার (রাঃ) থেকে এই হাদীসটি বর্ণনা করেছেন৷ (মিশকাতুল মাসাবীহ (মিশকাত), পরিচ্ছেদঃ ৭. দ্বিতীয় অনুচ্ছেদ - মাসজিদ ও সালাতের স্থান৷)
এবার মুত্তাফাকুন আলাইহি একটা হাদীস শুনি...
সালমান ফারসি (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ দ. বলেন, ‘তুমি যদি পারো, তবে সর্বপ্রথম বাজারে প্রবেশকারী হবে না এবং সেখান থেকে সর্বশেষ প্রস্থানকারী হবে না৷ কেননা বাজার শয়তানের আড্ডাস্থল। সেখানে সে নিজের ঝাণ্ডা গেড়ে বসে।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৬৩৪, মুসলিম, হাদিস : ২৪৫১)৷
উপরের দুটি হাদীসে স্পষ্ট হলো- দুনিয়ায় মার্কেট বা বাজার সবচেয়ে খারাপ স্থান আর মসজিদ সবচেয়ে উত্তম স্থান৷ এবার যারা দেশের প্রধান মসজিদ বায়তুল মোকাররমে গেছেন, নামাজ পড়েছেন; তারা একবার খেয়াল করুন৷ নিচে মার্কেট উপরে মসজিদ৷ আসলে আমিও কোনদিন বিষয়টা খেয়াল করিনি৷ এক বিদেশী আমাকে বলেছিলেন৷ একই স্থানে বাজার আর মসজিদের এই সম্মিলন বাংলাদেশ ছাড়া কোথাও দেখা যায়না৷ আমি পৃথিবীর অনেক দেশ ঘুরেছি৷ মসজিদের এই হাল কোথাও দেখি নাই৷ দেশের প্রধান মসজিদেরই এই দশা৷ দেশের অন্যান্য মসজিদের কথা তো বলারই অপেক্ষা রাখেনা৷
দুই.
আমি পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলায় এসি ল্যান্ড ছিলাম৷ তখনকার অভিজ্ঞতা বলছি৷ একটা জিনিস লক্ষ্য করে দেখেছি৷ কারো সরকারি খাস জমি দখল করতে হবে৷ ব্যস একটা মসজিদ তুলে দিল৷ তারপর মসজিদের ব্যয় বহনের জন্য দোকান ঘর তৈরি করা হলো৷ ওই দোকান নিজে ও আত্মীয় স্বজনদের মধ্যে ভাগাভাগি করা হলো৷ দোকানের ভাড়া বাজার দরের দশ ভাগের একভাগ নামে মাত্র নির্ধারণ করা হলো৷ জমি দখল নিশ্চিত৷ কার সাধ্য এই অবৈধ স্থাপনা ভাঙ্গতে যাবে৷
একবার এসব অবৈধ দোকানপাট ভাঙ্গতে গিয়েছিলাম৷ মুহূর্তের মধ্যে মুসুল্লিরা এসে হাজির৷ বলে এটা আল্লাহর ঘর৷ এতে হাত দেয়া যাবেনা৷ কাউকে বুঝাতেই পারলাম না৷ সরকারি জমি দখল করার কোন সুযোগ নেই৷ মসজিদ করলে জমি কিনে বা ওয়াকফ করে তাতে মসজিদ করতে হয়৷ অবৈধ দখলীয় জমিতে আল্লাহর নামে মসজিদ করার কোন সুযোগ নেই৷ আমাদের প্রিয় নবী দ. মসজিদে নববী যখন নির্মাণ শুরু করেছিলেন৷ ওই স্থানে দুজন এতিমের জমি পড়ে যায়৷ এতিমরা স্বেচ্ছায় জমি দান করতে চাইলে নবী দ. তা নিতে অস্বীকৃতি জানান৷ পরে অর্থ দিয়ে ওই জমি কেনা হয়৷ সেই জমিতেই এখন মসজিদে নববী৷ অথচ বাংলাদেশে তার উম্মতেরা দখল করা জমিতেই মসজিদ নির্মাণে সিদ্ধহস্ত৷ এখানে মার্কেট রক্ষার জন্য মসজিদ৷ এটা এমন ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট যে ওই দোকানে হাত দিতে পারিনি৷ কে মুসুল্লিদের খেপাতে যাবে!
তিন.
ঢাকার দক্ষিণখানের গাওয়াইরে একটা কওমি মাদরাসা আছে৷ মাদরাসায় একটা মসজিদ রয়েছে৷ মসজিদের পাশে একটা পুকুর ছিল৷ এলাকায় একটি মাত্র পুকুর৷ আমি নিজেও ওই পুকুরে গোসল করেছি৷ এক ব্যক্তিকে মসজিদে খুব দান করতে দেখতাম৷ মসজিদে দান করা দেখে ভালো লাগতো৷ কয়েক বছর পর গিয়ে দেখি, ওই খাস জমির পুকুরটা ভরাট করা হয়েছে৷ তার ওপর কাঁচা বাজার দোকানপাট কী নেই৷ যে ব্যক্তিকে দান করতে দেখতাম তারও দোকান৷ মসজিদে দান করার বরকতটা তিনি দুনিয়াতেই হাসিল করেছেন৷ যাই হোক, ওই এলাকার সম্পদ ছিল পুকুরটি৷ এখন আগুন লাগলে পানির কোন উৎস নেই৷ পুকুরটি থাকলে এলাকাবাসীর জন্য আশীর্বাদ হতো৷ আমি মাঝে মাঝে বলি, ওই কওমি মাদরাসায় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী৷ তাদের নাকের ডগায় পুকুরের মতো সবার একটা সম্পদ ভরাট করে দখল করা হয়েছে৷ তারা এমন শিক্ষা গ্রহণ করছেন যে তাদের শিক্ষা এই ভরাট রুখে দাড়ানোর মতো এতটুকু সচেতনতা আনতে পারেনি৷ এখানে একটা কলেজ পরের কথা স্কুল থাকলেও শিক্ষার্থীরা তা দখল করতে বাঁধা দিতো৷ কী আর বলবো৷ কিছু বললে বোধ বুদ্ধিহীন কিছু গোড়া ধর্মবিরোধী বলে চিৎকার দিয়ে উঠবে৷
মসজিদ কমিটিও একটা লাভজনক পদ৷এখন তো মসজিদের পদ দখলে খুন খারাবি পর্যন্ত হচ্ছে। আমি তখন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চুয়াডাঙ্গা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে যোগদান করেছি। প্রথম পোস্টিং৷ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের একটা মসজিদ থাকে। চুয়াডাঙ্গাতেও ছিল। নাম কালেক্টরেট মসজিদ। এই মসজিদের সভাপতি হন জেলা প্রশাসক৷ সাধারণ সম্পাদক করা হয় মসজিদের সবচেয়ে বড় মুসুল্লীকে৷ চুয়াডাঙ্গার জেলা প্রশাসক ছিলেন ভোলা নাথ দে স্যার৷ তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় এডিসি জেনারেল মজিবর রহমান স্যার সভাপতি হলেন৷ সাধারণ সম্পাদক একজন উকিল৷ পাঁচ ওয়াক্ত জামাতের সাথে নামাজ পড়েন। মসজিদের জন্য জান প্রাণ দিয়ে দেন! তিনি বিভিন্ন জনের কাছ থেকে চাঁদা তোলেন৷ তবে তিনি হিসাব দিতে অনিচ্ছুক৷ একবার তাকে চেপে ধরা হলো৷ আয় ব্যয়ের অডিট করা হলো৷ দেখা গেলো চাঁদা তোলার রশিদে গরমিল৷ যিনি পাঁচশ টাকা দিয়েছেন তার অংশে পাঁচশই লেখা হয়েছে৷ তবে মুড়ির অংশে শূন্য একটি কম৷ অর্থাৎ পঞ্চাশ টাকা৷ এক হাজার টাকা হয়ে যেতো একশ টাকা৷ ধরা পড়ার পর কয়েক লাখ টাকা পাওনা হলো৷ টাকার সঠিক অঙ্কের কথা মনে পড়ছেনা৷ এ ঘটনার পর ওই সাধারণ সম্পাদকের অভিব্যক্তিটা ছিল মনে রাখার মতো৷ তিনি বলেছিলেন, আমি তো মসজিদে সময় দেই!
চার.
ইসলামে শেষ জমানায় দাজ্জালের আগমন হওয়ার কথা রয়েছে৷ কোনদিন এদেশে দাজ্জালের আগমন হলে মসজিদ মার্কেট একাকার দেখলে সে অবাক হবে নিশ্চয়ই৷ মানুষ অবাক হলে তার চোখ কপালে তোলে৷ আর দাজ্জালের চোখ তো কপালে থাকবে। অবাক হলে তার কপালের চোখ মানুষের মতো কপালের নিচে চলে আসতে পারে!
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১১