somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কুরসি নাশিন

১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি ও বংশের মাধ্যমে৷ ভালো বংশ বা উপাধি সেকালের শাসকরাই দিতেন৷

বৃটিশ আমলেও এই প্রথা বহাল থাকে৷ তবে বৃটিশরা যেহেতু আমলাতান্ত্রিক ছিল তাদের এই অনুমতি প্রদানের বিষয়েও আমলাতান্ত্রিক রূপ দেয়া হয়৷ বৃটিশ সরকারি কর্মকর্তাদের সামনে বা কোন অনুষ্ঠানে বসতে হলে আনুষ্ঠানিক অনুমতি লাগতো৷ আর সেই অনুমতি দেয়া হতো সার্টিফিকেটের মাধ্যমে৷ এই সার্টিফিকেটের নাম ছিল কুরশি নাশিন৷ ফার্সি শব্দ কুরসি নাশিনের অর্থ হলো চেয়ারে সমাসীন৷ এই সনদের বাইরে বৃটিশ কর্মকর্তাদের সামনে বা কোন অনুষ্ঠানে একসাথে বসার সুযোগ কারো হতো না৷

দুইটা কুরসি নাশিনের সার্টিফিকেট শেয়ার করলাম৷ দুটি সার্টিফিকেটই দিল্লী জেলার জেলা প্রশাসক ইস্যু করেছিলেন৷ একটি ১৮৮৭ সালে৷ অন্যটি ১৯০৫ সালে৷ এই প্রথা ১৯৪৭ সালে বৃটিশদের ভারত ছেড়ে যাওয়া পর্যন্ত বহাল ছিল৷


২.০
দুইবার ভারতে গেছি৷ ভারতে সরকারি সেবা প্রদান কাছ থেকে দেখেছি৷ আইএএস কর্মকর্তাদের সাথে সুখ দুঃখের আলাপ হয়েছে। সাধারণ মানুষের প্রতি তাদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুভব করেছি। অন্যদিকে ভারতের প্রশাসনের প্রতি সাধারণ সেবাপ্রার্থীদের আচরণও লক্ষ্য করে দেখার সুযোগ হয়েছে৷ সেখানে সরকারি কর্মকর্তাদের সামনে সেবাপ্রার্থীদের কাচুমাচু হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখেছি৷ এর কারণ ভারতের প্রশাসন থেকে মোগল ও বৃটিশ প্রভাব এখনো হারিয়ে যায়নি৷ বৃটিশদের সবকিছুই ধরে রেখেছে আইএএস৷ শুধু আনুষ্ঠানিক কুরসি নাশিন সার্টিফিকেট ইস্যুটা হারিয়ে গেছে৷ তার বদলে এখন মৌখিক অনুমতির প্রথা চলে এসেছে৷ সরকারি কর্মকর্তা যাকে পছন্দ করবেন বসতে বলেন, পছন্দ না হলে দাড় করিয়ে রাখেন৷ বাংলাদেশেও কমবেশি এটাই প্রচলিত৷ এ অবস্থাটা কেন- সেটা ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে কুরসি নাশিন সার্টিফিকেট পেলাম৷
৩.০
আমি ব্যক্তিগতভাবে কুরসি নাশিন প্রথাকে একজন নাগরিকের চরম অপমানের বহিপ্রকাশ মনে করি৷ মাঝে মাঝে ভাবি, ইংরেজরা এদেশের মানুষকে তারা কী ভাবতো! মানুষকে তারা ঠিক দাস হিসেবে মনে করতো৷
সারাহ এফডি আনসারি তার বই ‘সুফি সেইন্টস অ্যান্ড স্টেট পাওয়ার: দি পিরস অব সিন্দ ১৮৪৩-১৯৪৭' এ লিখেছেন, ব্রিটিশরা যাদেরকে ঘনিষ্ঠভাবে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করতেন৷ জনসাধারণের মধ্যে তা প্রভাব প্রতিপত্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতো৷ এজন্য তারা কাউকে দরবারে কুরসি বা আফরিনামার মতো মর্যাদা প্রদান করেছে৷ কাউকে রুপা বা সোনার অক্ষরে লেখা প্রশংসাপত্র; উন্নত কাপড়ের লুঙ্গি, বন্দুকে ধন্যবাদ খোদাই করা সেবা, অস্ত্রের লাইসেন্স, অস্ত্রের লাইসেন্স থেকে অব্যাহতি এবং দেওয়ানি আদালতে উপস্থিতি থেকে অব্যাহতি পাওয়ার মতো সম্মান দিয়েছে৷

১৮৮৪ সালে ব্রিটিশ সেটেলমেন্ট অফিসার জে উইলসন 'ফাইনাল রিপোর্ট অন রিভিশন অব সেটেলমেন্ট অব দ্যা সিরসা ডিস্ট্রিক্ট ইন দ্যা পাঞ্জাব' শীর্ষক একটি প্রতিবেদনে লিখেছিলেন, ভারতীয়রা এই ধরনের সম্মানের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতো এবং এর জন্য আবেদন করতো৷ তিনি লিখেছেন, “একজন শাসকের সামনে একটি ইউরোপীয় চেয়ারে বসার অনুমতিকে বড় সম্মান বলে মনে করা হতো৷ বিশেষাধিকার হিসেবে কুরসি নাশিন তালিকায় নিজের নাম রাখার প্রতিযোগিতা বড় উদ্বেগ হিসেবে দেখা যেতো৷ ''

তবে কুরসি নাশীন প্রথার একটি সুবিধা ছিল৷ বৃটিশরা জানতো, বসার লোক অনেক৷ অথচ চেয়ার সীমিত৷ এ কারণে চেয়ারে বসার জন্য অনুমতির ব্যবস্থা থাকলে এ সমস্যার সমাধান হবে৷ এজন্য পুরা বৃটিশ আমল ঘেটে দেখলেও চেয়ারে বসাকে কেন্দ্র করে কেউ নিহত হয়েছে এমন কোন ঘটনা পাওয়া যাবেনা৷
৪.০
চেয়ারে বসা নিয়ে এদেশের মানুষ কতটা ক্রেজি তা সরকারি চাকরিতে আসার আগে আমার জানা ছিলনা৷ আমি সরকারি চাকরিতে প্রথম যোগ দিয়েছিলাম চুয়াডাঙ্গায়৷ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে সহকারী কমিশনারও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে৷ সেখানে বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসসহ বিভিন্ন জাতীয় ও স্থানীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো৷ সেই অনুষ্ঠানে চেয়ার সাজিয়ে রেখে কোন চেয়ারে কে বসবেন তার পদবি লিখে ট্যাগ লাগানো হতো৷ এতেও চেয়ার নিরাপদ ছিলনা৷ আমরা জুনিয়র কর্মকর্তারা সেসব চেয়ার পাহারা দিতাম৷ তারপরেও কেউ কেউ জোর করে বসে পড়তেন৷ একবার বড় অতিথির চেয়ারে একজন বসে পড়েন৷ তাকে চেয়ার থেকে তুলতে গিয়ে কী তুলকালাম ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে৷ তিনি দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। পরিস্থিতি অবনতির কথা বলার আর অবকাশ নেই৷

তবে এ বিষয়টি নিয়ে গুগলে সার্চ দিলাম৷চেয়ারে বসা নিয়ে সংঘর্ষ

দেখলাম চেয়ারে বসাকে কেন্দ্র করে এদেশে প্রচুর লোকজন হতাহত হয়েছে৷ কারণ কী! কারণ মানসিকতা৷ বৃটিশরা একসময় মানুষকে চেয়ারে বসতে দিতো না৷ যাদের বসার অনুমতি দেয়া হতো তারা নিজেদের সম্মানিত মনে করতেন৷ এই বোধটা পুরুষানুক্রমিক চলে এসেছে৷ স্বাধীনতা পেলেও এই গন্ধটা এখনো শরীর থেকে যায়নি৷ এজন্যই চেয়ারে বসা নিয়ে কামড়াকামড়ি চলে৷ এখনো যে মন মানসিকতায় এদেশের মানুষ স্বাধীন হয়নি- এটাই তার বড় প্রমাণ৷

বৃটিশদের এই প্রথা মোটেও ভালো কিছু ছিলনা৷ তবে এটা বলা যায় যে, তারা এদেশের মানুষের সাইকোলজিটা ভালোভাবে ধরতে পেরেছিলেন৷

সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪
৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শোকের উচ্চারণ।

লিখেছেন মনিরা সুলতানা, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সকাল ১০:১৬

নিত্যদিনের জেগে উঠা ঢাকা - সমস্তরাত ভারী যানবাহন টানা কিছুটা ক্লান্ত রাজপথ, ফজরের আজান, বসবাস অযোগ্য শহরের তকমা পাওয়া প্রতিদিনের ভোর। এই শ্রাবণেও ময়লা ভেপে উঠা দুর্গন্ধ নিয়ে জেগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

যা হচ্ছে বা হলো তা কি উপকারে লাগলো?

লিখেছেন রানার ব্লগ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১:২৮

৫ হাজার মৃত্যু গুজব ছড়াচ্ছে কারা?

মানুষ মারা গিয়েছে বলা ভুল হবে হত্যা করা হয়েছে। করলো কারা? দেশে এখন দুই পক্ষ! একে অপর কে দোষ দিচ্ছে! কিন্তু... ...বাকিটুকু পড়ুন

আন্দোলনের নামে উগ্রতা কাম্য নয় | সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যবাদকে না বলুন

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭



প্রথমেই বলে নেয়া প্রয়োজন "বাংলাদেশকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার সমস্ত অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে" ধীরে ধীরে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের উপর ভর করে বা ছাত্রদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোন প্রশ্নের কি উত্তর? আপনাদের মতামত।

লিখেছেন নয়া পাঠক, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:১৬

এখানে মাত্র ৫টি প্রশ্ন রয়েছে আপনাদের নিকট। আপনারা মানে যত মুক্তিযোদ্ধা বা অতিজ্ঞানী, অতিবুদ্ধিমান ব্লগার রয়েছেন এই ব্লগে প্রশ্নটা তাদের নিকট-ই, যদি তারা এর উত্তর না দিতে পারেন, তবে সাধারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকুরী সৃষ্টির ব্যাপারে আমাদের সরকার-প্রধানরা শুরু থেকেই অজ্ঞ ছিলেন

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ রাত ৯:০৭



আমার বাবা চাষী ছিলেন; তখন(১৯৫৭-১৯৬৪ সাল ) চাষ করা খুবই কষ্টকর পেশা ছিলো; আমাদের এলাকাটি চট্টগ্রাম অন্চলের মাঝে মোটামুটি একটু নীচু এলাকা, বর্ষায় পানি জমে থাকতো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×