এক
লেখাটা একটি কৌতুক দিয়ে শুরু করি। ১৯৯৫ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে শফিপুর আনসার একাডেমিতে বিদ্রোহ হয়। ৪ ডিসেম্বর পুলিশ একাডেমিতে অভিযান চালায়। এতে চারজন আনসার সদস্য নিহত হয়েছিল। এটি ছিল তখনকার সময়ে বড় ঘটনা। স্বভাবতই পত্রিকাগুলো লাল কালিতে বড় বড় হরফে হেড লাইন করে। এক পত্রিকার হেড লাইন ঘটনা ছাপিয়ে হাস্যরসের জন্ম দেয়।
কারণ পরদিন পত্রিকাটির শিরোনাম ছিল- ‘পুলিশের গু খেয়ে চারজন আনসার নিহত।’ গুলি শব্দ লিখতে গিয়ে ‘লি’টা ভুলক্রমে বাদ পড়েছিল। যদিও তখন সোস্যাল মিডিয়া ছিলনা। তারপরেও সারাদেশে বিশাল আলোড়ন তৈরি হয়। পরদিন পত্রিকাটি সংশেধনি দেয়, ‘গতকাল গুলি লিখতে গিয়ে গু লেখা হয়েছিল। এটা ছিল পাছার ভুল। এজন্য আমরা দুঃখিত।’ সংশোধনিতেও ছাপার জায়গায় পাছা হয়ে যায়। এ কারণে পরের দিন আবারো সংশোধনির সংশোধনি দেয়া হয়। এবার লেখা হয়- ‘বাবার ভুল হওয়ায় পত্রিকার কর্তৃপক্ষ অনেক দুঃখিত।’ এবারও ভুল এড়ানো যায়নি। বারবারের জায়গায় বাবার ভুল হয়ে যায়। এটা দেখে নাকি এক সিনিয়র সাংবাদিক বলেছিলেন, ঠিকই তো। পত্রিকার মালিকানা নিয়ে দুই ভাই যেভাবে লড়াই করে তাতে ভুল তাদের বাবারই। ওই ক্রণিক ভুল বাবার ভুল দিয়েই শেষ হয়েছিলো কিনা তা আমার জানা নেই।
দুই
এবারের গল্পটা সত্যি। দৈনিক মানবজমিন সম্পাদক মতি ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছি। মানবজমিনের এক রিপোর্টার অনেক খেটেখুটে ঢাকার গুলিস্তানের পকেটমারের বিষয়ে একটা রিপোর্ট জমা দিলেন। তিনি লিখেন, ঢাকার ওসমানি উদ্যানে যেটা সরকারের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ের সামনে পকেটমারা শেখানো হয়। কচি লাউয়ের উপর পাতলা কাপড় রেখে নূতন ব্লেড দিয়ে লাউয়ের ওপর কোন আঘাত না করে কীভাবে কাপড় কাটা যায় তা অভিজ্ঞ পকেটমার শিষ্যদের শেখান। চিফ রিপোর্টার ওই রিপোর্টে হেডিং দিলেন- ঢাকায় পকেটমারদের স্কুল। রিপোর্ট ছাপা হওয়ার পরে পুলিশ এটা নিয়ে কয়েকদিন দৌড়াদৌড়ি করলো। এতে সম্পাদক টেরই পাননি তার পত্রিকায় কী রিপোর্ট ছাপা হয়েছে!
সমস্যাটা হলো- ওই রিপোর্টের বরাতে পরদিন একটি বিদেশি সংবাদ সংস্থা সংবাদ প্রকাশ করে। লেখা হয়, ঢাকায় পকেটমারদের জন্য ইনস্টিটিউশন৷ পরে এটা বিশ্বমিডিয়ার হট কেক হয়ে যায়। কারণ কোনো দেশের প্রশাসনিক কেন্দ্রর সামনে পকেটমারদের জন্য এরকম প্রশিক্ষণের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা বিরাট ব্যাপার। এবার সম্পাদক মতি ভাইয়ের কাছে সারা দুনিয়ার বিভিন্ন মিডিয়া থেকে ফোন আসতে শুরু করে। তিনি রিপোর্ট খুঁজে পড়লেন। দেখলেন, পকেটমারদের ইনস্টিটিউশন লেখা বড় ধরণের ভুল হয়ে গেছে। মতি ভাই কী আর করবেন! বিদেশী সাংবাদিকদের ফোন এড়িয়ে যেতে অফিসে আসা বন্ধ করে দিলেন। তবে তারাও নাছোড় বান্দা। অফিসের টেলিফোনে না পেয়ে বাসার ফোনে কল করতে থাকেন। এ ঘটনায় ফোনের পর ফোনে কয়েকদিনের জন্য সম্পাদকের জেরবার হয়ে যায়। ঘটনা শুনে সম্পাদকের জন্য সহানুভূতি তো পরের কথা, বাসায় ফিরেও হেসেছিলাম কয়েকদিন। যাই হোক ওই রিপোর্টার এখন ঢাকার নামকরা সাংবাদিক।
তিন
এবার আর হাসির বিষয় নয়। ঐতিহাসিক সিরিয়াস বিষয়। শুনলে চমকে উঠবেন। হিরোশিমায় ও নাগাসাকিতে যে পারমানবিক বোমা নিক্ষেপ করা হয়েছিল তা পত্রিকারই ভুলের কারণে। যা শুনলেন তা একেবারেই সত্যি। ঘটনাটা খুলে বলি। এটাকে বলে মোকুসাৎসু Mokusatsu ট্রাজেডি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হয়েছিলো- মিত্রশক্তি ও অক্ষশক্তির মধ্যে। মিত্রশক্তির দেশগুলো হলো- যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, চীন। অন্যদিকে অক্ষশক্তিতে জার্মানি, জাপান, ইতালি ছিল। তখন বলতে গেলে বিশ্বযুদ্ধের শেষ সময়। অক্ষশক্তির প্রধান দেশ জার্মানি ও ইটালি পদাবনত হয়েছে। বাকী রয়েছে জাপান। এদিকে মেক্সিকোতে পারমানবিক বোমারও সফল পরীক্ষা শেষে পারমানবিক বোমা প্রস্তুত। মিত্র শক্তি তখন শক্তির মিটারে সর্বোচ্চ পারদে। ঘাড়তেড়া জাপানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ১৯৪৫ সালের ২৬ জুলাই জার্মানির পটসডাম শহরে মিত্রশক্তির রাষ্ট্রপ্রধানরা বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে জাপানকে আত্মসমর্পণ করতে যেসব শর্ত মানতে হবে তা ঘোষণা দেয়া হয়। এটাই ঐতিহাসিক পটসডাম ঘোষণা।
এটা পারমানবিক অস্ত্র ব্যবহারের আগে শেষ আল্টিমেটাম বা চরমপত্র ছিল। আত্মসমর্পণের চরমপত্র পাওয়ার পর জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিজেনোরি তোগো দ্রুত প্রধানমন্ত্রী কানতারো সুজুকি ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাকোমিজুর সাথে দেখা করেন। প্রধানমন্ত্রী সুজুকি সম্রাট হিরোহিতোর সাথে সাক্ষাত করে বিষয়টি জানান। হিরোহিতো পরিস্থিতি বুঝে পোস্টডাম ঘোষণাকে নীতিগতভাবে গ্রহণযোগ্য বলে সায় দেন। কেবিনেটেরও একই সিদ্ধান্ত। অথচ এর মধ্যেই জাপানের যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সবোর্চ্চ ফোরাম সুপ্রিম কাউন্সিল বৈঠক করে। তারা পটসডাম ঘোষণার শর্তগুলো অসম্মানজনক ধরে নিয়ে দরকষাকষি করতে সময় নিতে চাইলেন।
আর এসব ঘটনার মধ্যে জাপানের ডোমেই নিউজ এজেন্সির কোন এক সাংবাদিক কোনোভাবে প্রধানমন্ত্রী সুজুকির নাগাল পেয়ে যান। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর সাথে ওই সাংবাদিকের ব্যক্তিগত সম্পর্ক কাজে লেগেছিলো। ওই সাংবাদিক প্রশ্ন রাখেন, পটসডাম ঘোষণা নিয়ে জাপানের সিদ্ধান্ত কী? প্রধানমন্ত্রী সুজুকি এক শব্দে সারতে চাইলেন। বললেন, মোকুসাৎসু।
আমি জাপানের ভাষা শিখতে চেষ্টা করেছিলাম। কয়েকজন জাপানি এজন্য আমার পেছনে সময়ও দেন। জাপানের প্রচুর শব্দ রয়েছে যা দ্ব্যর্থবোধক। অনেক ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। যেমন- কাউকে যদি বলেন দোজো। চেয়ারে বসার জন্য শব্দটা বলা যাবে। আবার চেয়ার নিয়ে আসার জন্য জন্যও দোজো বলা যাবে। কিছু করার জন্য শব্দটা ব্যবহার করা হয়। মোকুসাৎসুরও দুইটি অর্থ। একটা অর্থ হলো- উপক্ষো করা বা কান না দেয়া। অন্য অর্থ হলো- মন্তব্য থেকে বিরত থাকা। সাধারণত স্পর্শকাতর ইস্যূতে সরকারি কর্মকর্তারা নিজের পরিস্কার বক্তব্য দেন না। তারা বলেন, মন্তব্য নেই। আমি দক্ষিণ কোরিয়ায় মাস্টার্সে নেগোশিয়েশন কোর্স নিয়েছিলাম। এই কোর্সে প্রফেসর আমাদের এ ধরণের দ্ব্যর্থবোধক প্রচুর শব্দ শিখিয়েছেন। সময় পেলে এবিষয়ে লিখবো। সবগেুলো কূটনৈতিক চালের অংশ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
আসলে প্রধানমন্ত্রী কানতারো মোকুসাৎসু শব্দ দিয়ে কোন মন্তব্য নেই বলতে চেয়েছিলেন। তবে ডোমেই নিউজের সাংবাদিক তার বক্তব্য ইংরেজি করতে গিয়ে প্রথম অর্থ বেছে নেয়। এর বরাতে রেডিও টোকিও প্রচার করে যে, মন্ত্রিসভা পটসডাম ঘোষণাকে ইগনোর করছে। এই নিউজটি তখনকার দিনে হটকেক। ডোমেই নিউজ ও রেডিও টোকিও’র বরাতে লন্ডনের টাইমস পত্রিকায় প্রধান শিরোণাম হয়। তাতে পত্রিকাটি লেখে, টোকিও টু ইগনোর অ্যালাইড টার্মস- ডিটারমিনেশন টু ফাইট অন। অর্থাৎ জাপানিরা আত্মসমর্পণের শর্তের ওপর কোন প্রকার গুরুত্ব দেয়নি, বরং তারা লড়াই চালিয়ে যেতে বদ্ধ পরিকর। আর যায় কোথায়! মিত্রশক্তি নড়েচেড়ে বসে। তারা দ্রুত জাপানকে শায়েস্তা করার পদক্ষেপ নেয়। চরমপত্র যে ফাঁকা বুলি ছিলনা- তা দেখিয়ে দেয়ার নেশায় তাদের পেয়ে বসে। অবশেষে ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা শহরে পারমানবিক বোমা লিটল বয় ও ৯ আগস্ট নাগাসাকি শহরে ফ্যাট ম্যান বিষ্ফোরণ ঘটোনো হয়। যুদ্ধে পারমানিক বোমার ব্যবহার ইতিহাসের সবচেয়ে নৃশংস ঘটনা। আর এ ঘটনার পেছনে ছিল একজন সাংবাদিকের কথিত ভুল।
চার
ভুল শুধু ভুল। এ জীবনের পাতায় পাতায়। তবে সবচেয়ে বেশি ভুল দেখা যায় সংবাদপত্রের পাতায়। সংবাদপত্রের এই ভুলের তালিকা দীর্ঘ। ফিদেল ক্যাস্ট্রো, নেলসন ম্যান্ডেলা, আর্থার সি ক্লার্ক, ইয়াসির আরাফাত জন পল বেনেডিক্টসহ অগণিত বিখ্যাত মানুষ বেঁচে থাকাকালেই মৃত্যুর সংবাদ ছাপা হয়েছিল।
সংবাদপত্রকে বলা হয় ত্বরিত সাহিত্য। এ কারণে ভুল থাকাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। যেহেতু সাংবাদিকতা করতাম এজন্য নিজের কৃত ভুলগুলোও লেখা উচিত। ঘটনাটি এর আগেও একবার লিখেছিলাম।
একবার একটা সেমিনার কাভার করে সাবেক উপদেষ্টা হোসেইন জিল্লুর রহমানের পরিচিতি লিখেছিলাম পিকেএসএফ এর নির্বাহী সভাপতি। অথচ তিনি তার নিজের সংস্থা পিপিআরসির নির্বাহী সভাপতি। তাড়াহুড়া করতে গিয়ে লিখে ফেলেছিলাম। পিকেএসএফ ও পিপিআরসি কাছাকাছি হওয়ায় সবার চোখ এড়িয়ে ছাপা হয়ে যায়। তিনি তখনো উপদেষ্টা হননি। তখন গণমাধ্যম ছিল হাতে গোণা। ফলে সবাই সংবাদপত্রের লেখা খুটিয়ে খুটিয়ে পড়তো। পরদিন অফিসে যাওয়ার আগেই পত্রিকা অফিসে হোসেন জিল্লুরের ফোন। ফোন ধরেছিলেন চীফ রিপোর্টার সারওয়ার ভাই। সারওয়ার ভাই আমাকে জানান, হোসেইন জিল্লুর রহমান ফোন করেছেন। বলেছেন, রিপোর্টার তো আমাকে সরকারি চাকরি দিয়ে দিলো। মজার কথা হলো, কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সরকারি পোর্টফলিও পেয়েছিলেন। আমার ভুল একেবারে জলে যায়নি। তবে ওই ঘটনার পর থেকে কিছু লেখার আগে খুব সতর্ক থাকতাম। সংবাদপত্রে থাকাকালে ভুল নিয়ে একটা নীতি শিখেছিলাম।
হোয়েন ইউ আর ইন ডাউট, প্লিজ চেক ইট আউট, অ্যাগেইন ইফ ইউ আর ইন ডাউট, প্লিজ চেক ইট আউট, অ্যাগেইন ইফ ইউ আর ইন ডাউট, জাস্ট কাট ইট আউট।
এই শিক্ষাটা এই সরকারি চাকরিতেও কাজে লাগছে।
পাঁচ
বলা হয়, ভুল দিয়েই মানুষ তৈরি। আরবিতে ইনসান শব্দটির মূল হলো নাসইয়ুন। এর অর্থ ভুল। এজন্য কোন এক উর্দু কবি বলেছেন,
আগার খতা হো যায়ে তো মিটা দে তেরা আতা ছে,
কেঁওকেহ ইনসান আতা হ্যায় ইয়ে খতা ছে।
যদি ভুল হয়ে যায়, ক্ষমা করো দান,
কেননা ভুল থেকেই এসেছি আমরা ইনসান।
নজরুল বলেছিলেন, ‘আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম। প্রেম পেতে এসেছিলাম।’ সে অর্থে আমিও একজন প্রেমিক। লেখালেখি করি। শত্রুতার জন্য নয়। প্রেম বিলাতে এসেছি। ভুল তো করতেই পারি। তবে প্রেমে না কি ভুল নেই। এজন্যই বলি,
ভুল স্বীকার না করা জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল।
ভুল স্বীকারে সব ঝগড়া বিবাদ হয়ে যায় ভুণ্ডুল।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:২১