২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার আগে মহাবিপদে ছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু৷ এক বছর ধরে ইসরায়েলিরা তার পদত্যাগের দাবিতে তীব্র বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন৷ আন্দোলনে তার সরকারের অবস্থা টালমাটাল হয়ে ওঠেছিল৷
আন্দোলনের প্রেক্ষাপট বলে নিচ্ছি৷ ইসরায়েলের নেসেটে নেতানিয়াহুর আরামদায়ক সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে৷ এর সুবাদে দুটি আইন পাস করে নেতানিয়াহু প্রধানমন্ত্রীর পদকে সুরক্ষিত করেছিলেন৷ নিজের চেয়ারকে নিরাপদ করার যত কৌশল রয়েছে সবই সম্পন্ন করেছেন নেতানিয়াহু।
তিনি ২০২৩ সালের জুলাই মাসে নেসেটে একটা আইন পাস করেন৷ আইনটির বিষয়বস্তু হলো, সংসদ থেকে যেসব আইন পাস করা হবে তা সুপ্রীম কোর্ট বাতিল বা সংস্কার করতে পারবেনা৷ এতে ফুসে উঠেছিল বিরোধীরা৷ সুধী সমাজ থেকে সাধারণ জনগণ পর্যন্ত বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলো। আদালতের ক্ষমতা কমানো হয়েছে বলে সংক্ষুব্ধ হয়েছিল খোদ সুপ্রীম কোর্ট৷ এরপর সুপ্রীম কোর্ট এই আইনটি স্বউদ্যোগে বাতিল করার প্রক্রিয়া শুরু করে৷ সুপ্রীম কোর্টের ১৫ জন বিচারপতি আইনটি চ্যালেঞ্জ করে শুনানি শুরু করে৷
আগে সুপ্রীম কোর্ট ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণ করতে পারতো। নেতানিয়াহু আরেকটি আইন পাস করে সেই ক্ষমতাও বাতিল করেছিলেন। এর মাধ্যমে সুপ্রীম কোর্ট ইসরায়েলের কোনো প্রধানমন্ত্রীকে অপসারণের ক্ষমতা হারায়৷ আদালত এই আইনটিও পর্যালোচনা শুরু করেছিলো।
তবে সুপ্রীম কোর্ট ওই আইন দুটি বাতিল করলে নেতানিয়াহুর বিশাল পরাজয় হতো। তার পদত্যাগ ছাড়া কোন উপায় ছিলনা৷ কারণ এই আন্দোলনে নেতানিয়াহুর বিরোধিরা যেমন রয়েছেন তেমনি ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা বিভাগে সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা, সাবেক প্রধান বিচারপতি, আইনজীবী ও শীর্ষ ব্যববসায়ীরাও ছিলেন৷ এক পর্যায়ে ইসরায়েলের নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ শত শত সামরিক ও এয়ারফোর্সের পাইলট আন্দোলনে যোগ দেন। তারা নিজেদের সার্ভিসের বিষয়ে সরকারের কাছে রিপোর্ট দেবেন না বলে হুমকিও দেন৷
ঠিক এ মুহূর্তে হামাস ইসরায়েলের ওপর আক্রমন করে৷ সাথে সাথে নেতানিয়াহু যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং সর্বশক্তি দিয়ে গাজার ওপর ঝাপিয়ে পড়েছেন। এই হামলা ব্যক্তি নেতানিয়াহুর জন্য বড় স্বস্তি নিয়ে এসেছে৷ এতে তিনি বিরোধীসহ সবার অকাট্য সমর্থন পেয়েছেন৷ সংকট উত্তোরণে সবাই একযোগে মনযোগ দিয়েছেন৷ সামরিক কর্মকর্তারা আন্দোলন ছেড়ে যুদ্ধে ফিরে গেছেন। আইন সংস্কারের আন্দোলন সাথে সাথেই চাপা পড়ে গেছে৷
এছাড়াও নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে তিনটি দুর্নীতির পৃথক মামলা চলছে। মামলা নম্বর ১০০০, ২০০০ ও ৪০০০। ২০২১ সালের ২১ নভেম্বর নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে মামলা নম্বর ১০০০ এবং ২০০০-এ জালিয়াতি এবং বিশ্বাস ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়। এছাড়াও মামলা নম্বর ৪০০০ এ জালিয়াতি, বিশ্বাসভঙ্গ এবং ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ আনা হয়।
এসব মামলায় নেতানিয়াহুকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। তবে যুদ্ধ শুরু হওয়ার এসব মামলায় সাক্ষ্য গ্রহণ ও শুনানি পিছিয়ে গেছে। যুদ্ধ নেতানিয়াহুকে দুর্নীতির মামলার ঝামেলা থেকে নির্ভার করে দিয়েছে।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তার পদত্যাগের আন্দোলন বন্ধই হয়ে গিয়েছিলো। তখন জিম্মিদের ফেরত আনার ইস্যুটাই প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল। সেই আন্দোলনেই ইসরাইলের রাজপথ প্রকম্পিত হয়েছে। তার পদত্যাগের বিষয়টি অনেকে ভুলতে বসেছিলেন। তবে বিরোধীরাও কম যায়না। তারা আবার নেতানিয়াহুর পদত্যাগের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। তবে যুদ্ধ চলাবস্থায় এ আন্দোলন সুবিধা করতে পারবেনা বলেই মনে হচ্ছে।
একটা বিষয় খেয়াল করে দেখেছি, নেতানিয়াহু রাজনৈতিকভাবে যখনি বিপদে পড়ে হামাস তখনি ইসরায়েলে হামলা করে৷ এবার হামাসের হামলা নেতানিয়াহুকে পুনর্জন্ম দিয়েছে। নেতানিয়াহু ছাড়া লিবারেল অন্যরা যখন ইসরাইলে ক্ষমতায় থাকে তখন কোন হামলা হয়না৷ এই সূত্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই প্রয়োগ করা যায়৷ এমনকি ভারত পাকিস্তানে যখনি রাজনৈতিক সংকট লাগে; তখনি যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে৷
অনেকে বলতে পারেন, নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করতে পারে। এতে তিনি বিপদে পড়বেন। তবে এসব তিনি থোড়াই পরোয়া করেন। আন্তর্জাতিক আদালত সামলানোর দায়িত্ব যুক্তরাষ্ট্রকে দিয়ে তিনি যুদ্ধে মনোনিবেশ করেছেন। বিশ্বজনমত ও আন্তর্জাতিক আদালতের আদেশ উপেক্ষা করে গাজার রাফায় হামলা চালাচ্ছেন। যুদ্ধই তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। যুদ্ধই তাকে আগামি দিনগুলোতে রক্ষা করবে। একারণে গাজার যুদ্ধ তিনি সহজে শেষ করবেন বলে মনে হয়না। এই যুদ্ধ তার ক্ষমতার চাবিকাঠি; প্রাণভোমরা। তিনি এটিকে জিইয়ে রাখবেন। এ কারণে তিনি গাজায় হামাসের সাথে ইঁদুর বিড়াল খেলছেন। সময় পার করছেন। গাজার বেসরকারি আবাসিক ভবনগুলো মাটিতে মিশিয়ে দিতেই তার আগ্রহ। দু চারজন সেনা সদস্যের মৃত্যু তার বড় পুঁজি। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে যতদিন নেতানিয়াহুর চেয়ার টেকসই না হবে: ততদিন গাজার যুদ্ধ চলবে। ততদিন সাধারণ ফিলিস্তিনিদের জীবন দিয়ে যেতে হবে।
নেতানিয়াহু ইতিহাসের সবচেয়ে বড় মৃত্যু ব্যবসায়ী।
#All eyes on Rafa
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৭