দেশের নূতন প্রজন্ম নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন৷ নূতন প্রজন্ম ও তাদের আচরণ নিয়ে কথা বলার দরকার৷ মাঝে মাঝে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকি৷ আমার প্রজন্মের সাথে তাদের পার্থক্য সুস্পষ্ট৷ আমি কিছু বলার আগে চলুন শুনে আসি প্রাচীনকালের প্রবীণরা তাদের সময়ের নূতনদের সম্পর্কে কী ধারণা করেছেন৷
গ্রিক দার্শনিক প্লেটো। তিনি দার্শনিক সক্রেটিসের ছাত্র ছিলেন। অন্যদিকে প্লেটোর ছাত্র ছিলেন এস্টিটল। প্লেটো তার পরবর্তী জেনারেশনের কর্মকান্ড নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের তরুণদের মধ্যে এসব কী হচ্ছে? তারা তাদের বড়দের অসম্মান করে, পিতামাতার অবাধ্য। আইন উপেক্ষা করে। উগ্রতার আগুনে রাস্তায় দাঙ্গা হাঙ্গামা করে। তাদের নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটছে। কী হবে তাদের?’ প্লেটোর পরের যুগ ছিল এরিস্টটলের। এরিস্টটলের জেনারেশন নিয়ে প্লেটোর এই উদ্বিগ্নতা। খ্রিস্টপূর্ব সাড়ে ৩ শ বছর আগের মানুষ প্লেটো। পরবর্তী প্রজন্মের বিষয়ে তার এই বক্তব্য দেখলে মনে হয়, আরে এতো আমারই কথা।
প্লেটোর আগের প্রজন্মও একই মত দিয়ে গেছে। সক্রেটিস কী বলেছেন দেখুন। তিনি বলেছেন, “শিশুরা এখন বিলাসিতা পছন্দ করে; তাদের আচরণ খারাপ, কর্তৃপক্ষের প্রতি রয়েছে অবজ্ঞা; তারা প্রবীণদের প্রতি অসম্মান প্রদর্শন করে এবং কাজের জায়গায় বকবক করে। শিশুরা এখন স্বেচ্ছাচারী, তারা বাড়ির প্রতি অনুগত নয়। প্রবীণরা ঘরে প্রবেশ করলে তারা ওঠে দাড়ায় না। তারা পিতামাতার বিরোধিতা করে, সঙ্গীর সামনে বকবক করে, খাবার টেবিলে আড্ডা দেয়, পায়ের ওপর পা ফেলে রাখে এবং তাদের শিক্ষকদের যাতনা করে।"
শুধু প্লেটো বা সক্রেটিস নয়৷ সক্রেটিসের সাড়ে চার হাজার বছর আগেও মানুষ এমন ভাবতো। কয়েকদিন আগে ভারতের বিখ্যাত লেখিকা সুধা মূর্তির বক্তব্য শুনছিলাম৷ সুধা মূর্তির এখনকার পরিচয় তিনি ইংল্যান্ডের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর শাশুড়ি। তিনি একবার মিশরের পিরামিড দেখতে যান। এসময় একজন হায়ারোগ্লিফিক বিশষেজ্ঞ তার সাথে ছিলেন। পিরামিডের ভেতরে হায়ারোগ্লিফিক লিপিতে অনেক বাণি লেখা রয়েছে। তিনি বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে এহুলোর অর্থ জেনে নেন। ইতিহাস শোনেন। একবার একটি বড় হায়ারোগ্লিফিকে তার চোখ আটকে যায়। তিনি বিশেষজ্ঞের কাছে জানতে চান, এতে কী লেখা রয়েছে। বিশেষজ্ঞ জানালেন, পিরামিডের প্রতিষ্ঠাতার একটি বাণী এখানে লিখে রাখা হয়েছে। পরবর্তী প্রজন্ম নিয়ে উদ্বিগ্নতার বিষয়ে লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, ''পরবর্তী প্রজন্ম সময়কে সম্মান করেনা। অর্থকে সম্মান করেনা। বড়দের সম্মান করেনা। তাদের কমনসেন্সও কম। কর্মঠ না। আমি আসলেই জানিনা তারা কীভাবে টিকে থাকবে।''
সাত হাজার বছর আগেও নবীনের প্রতি একজন প্রবীণের একই ধরণের অভিযোগ৷ সবগুলো নেতিবাচক৷ অভিযোগগুলো বহু পুরাতন। সম্ভবত সৃষ্টির শুরু থেকে চলে আসছে৷ এসব পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো- তারা বড়দের সম্মান করেনা। এ কারণে পূর্বপুরুষরা শিশুদের মননে মগজে একটা বিষয় প্রোথিত করতে চেয়েছেন। তা হলো, বড়দের সম্মানের বিষয়৷ এ কারণে শিশুরা হাতেখড়ি থেকেই শিখে, বড়দের সম্মান করতে হয়৷
এবার আপনারাই বলুন৷ এসব নিয়ে লিখবো কীভাবে? নূতন প্রজন্ম নিয়ে কিছু লেখার ইচ্ছা করলেও থমকে যাই। কারণ নবীনদের প্রতি প্রবীনদের চিরায়ত স্টেরিওটাইপে আটকে গেছি কীনা তা নিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করি।
অন্যদিকে নূতন প্রজন্ম নিয়ে যা লিখতে চাই- তার সবগুলো আড়াই হাজার বছর আগে সক্রেটিস, প্লেটো লিখে গেছেন৷ সাত হাজার বছর আগে পিরামিডের প্রতিষ্ঠাতা ভেবে গেছেন৷ এখন বললেও তার পুনরাবৃত্তি ছাড়া কিছুই হবেনা৷
এত কিছুর পরেও দেশের নূতন প্রজন্ম নিয়ে যদি একই অভিযোগ করি তা কী অমূলক হবে!
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০২৪ সকাল ১০:১৩