কোরবানি সেমিটিক ধর্মসমূহে প্রচলিত বিষয়। এটি প্রচলনের কাহিনীটিও কিছু পার্থক্য বাদে প্রায় একই। ঘটনা আমরা যেভাবে জানি, আল্লাহ হযরত ইব্রাহিম (আঃ) কে তার পুত্রকে কোরবানি করার নির্দেশ দেন। পরে তিনি তার পুত্রকে কোরবানি দিতে নিয়ে যান এবং কোরবানি করতে প্রস্তুতি নেন। এসময় আল্লাহ হযরত ইব্রাহিম (আঃ) কে থামিয়ে দেন। পুত্রের পরিবর্তে একটি পশু কোরবানি করেন। এটাই মুল থিম। আমি পবিত্র বাইবেলের বর্ণনা ও পবিত্র কোরআনের বর্ণনা উপস্থাপন করবো। আমার প্রতিটি ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা আছে। সে বিষয়টি মাথায় রেখেই জানার জন্য তুলনামূলক বিশ্লেষণ করছি। আর এতেই স্পষ্ট হয়ে যাবে কোরআন কীভাবে কোন কৌশলে শিশু অধিকার রক্ষা করেছে।
বাইবেলের বর্ণনাঃ
পবিত্র বাইবেলের আদিপুস্তক ২২:১-১৯-এ আব্রাহাম ও তার পুত্র ইসহাকের বলিদানের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। ঈশ্বর আব্রাহামকে পরীক্ষা করার জন্য পুত্র ইসহাককে বলি দিতে বলেন। ‘‘তখন তিনি বললেন, তুমি আপন পুত্রকে, তোমার অদ্বিতীয় পুত্রকে, যাকে তুমি ভালবাসো, সেই ইসহাককে নিয়ে মোরিয়া দেশে যাও; এবং সেখানে যে এক পর্বতের কথা আমি তোমাকে বলবো তার উপরে তাকে হোমার্থে বলিদান কর’’ (আদিপুস্তক ২২:১, ২)
আব্রাহাম ভোরবেলা ইসহাক, দুই দাস এবং একটি গাধা নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। পর্বতের কাছে পৌঁছে তিনি দাসদের রেখে ইসহাককে সঙ্গে নিয়ে উপরে ওঠেন।
‘‘আর ইসহাক আপন পিতা আব্রাহামকে বললেন, হে আমার পিতা। তিনি বললেন, হে বৎস, দেখ এই আমি| তখন তিনি বললেন, এই দেখুন আগুন ও কাঠ। কিন্তু বলিদানের জন্য মেষশাবক কোথায়? অব্রাহাম বললেন, বৎস, ঈশ্বর নিজেই বলিদানের জন্য মেষশাবক যোগাবেন। পরে উভয়ে একসঙ্গে চলে গেলেন’’ (আদিপুস্তক ২২:৭, ৮)|
‘‘ঈশ্বরের নির্দিষ্ট স্থানে উপস্থিত হলে; অব্রাহাম সেখানে যজ্ঞবেদী নির্মাণ করে, কাঠ সাজালেন। পরে আপন পুত্র ইসহাককে বেঁধে, বেদীতে কাঠের উপরে রাখলেন’’ (আদিপুস্তক ২২:৯)| ‘‘পরে অব্রাহাম হাত বিস্তার করে, আপন পুত্রকে বধ করতে হাতে ছুরি তুলে নেন।’ (আদিপুস্তক ২২:১০)|
ঠিক তখন প্রভুর দূত তাঁকে ডেকে থামান। ‘‘তখন তিনি বলিলেন, যুবকের প্রতি হাত বিস্তার করিও না, তার কিছুই করিও না: কেননা এখন আমি বুঝলাম, তুমি ঈশ্বরকে ভয় কর, আমাকে নিজের অদ্বিতীয় পুত্র দিতেও অসম্মত নও’’ (আদিপুস্তক ২২:১০)|
"তুমি তোমার পুত্রকে রক্ষা করেছ, তোমার একমাত্র পুত্রকে" (আদিপুস্তক ২২:১৬-১৭)। এরপর আব্রাহাম একটি ঝোপ থেকে একটি মেষশাবক পেয়ে তাকে বলিদান দেন। ঈশ্বর আব্রাহামের এই আনুগত্য দেখে তাঁকে আশীর্বাদ দেন এবং তার বংশধরকে অসংখ্যতার প্রতিশ্রুতি দেন (আদিপুস্তক ২২:১৮)।
কোরআনে যেভাবে এসেছেঃ
পবিত্র কোরআনের সুরা সাফফাতের ১০০ নম্বর আয়াত থেকে ১১০ নম্বর আয়াতে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও তার পুত্রের কোরবানির ঘটনাটি বর্ণিত হয়েছে। আমি ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত কোরআনের বঙ্গানুবাদ সাধু থেকে চলিত রূপে এখানে তুলে ধরছি।
'হে আমার প্রতিপালক! আমাকে এক সৎকর্মপরায়ণ সন্তান দান কর।'১০০। অতঃপর আমি তাকে এক স্থিরবুদ্ধি পুত্রের সুসংবাদ দিলাম। ১০১। অতঃপর তিনি যখন তার পিতার সংগে কাজ করার মত বয়সে উপনীত হলেন তখন ইব্রাহীম বললেন, 'বৎস! আমি স্বপ্নে দেখি যে, তোমাকে আমি যবেহ্ করছি, এখন তোমার অভিমত কি বল?' তিনি বললেন, 'হে আমার পিতা! আপনি যা আদিষ্ট হয়েছেন তাই করুন। আল্লাহর ইচ্ছায় আপনি আমাকে ধৈর্যশীল পাবেন।' ১০২। যখন তারা উভয়ে আনুগত্য প্রকাশ করলেন এবং ইব্রাহীম তার পুত্রকে কাত করে শায়িত করলেন, ১০৩। তখন আমি তাকে আহ্বান করে বললাম, 'হে ইব্রাহীম ১০৪। 'তুমি তো স্বপ্নাদেশ সত্যই পালন করলে!'-এইভাবেই আমি সৎকর্ম-পরায়ণদেরকে পুরস্কৃত করে থাকি ১০৫। নিশ্চয়ই এটা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা ১০৬। আমি তাকে মুক্ত করলাম এক কুরবানীর বিনিময়ে ১০৭। আমি এটি পরবর্তীদের স্মরণে রেখেছি। ১০৮ ইব্রাহীমের উপর শান্তি বর্ষিত হোক ১০৯। এভাবে আমি সৎকর্মপরায়ণদের পুরস্কৃত করে থাকি ১১০।
তুলনামূলক বিশ্লেষণঃ
পবিত্র বাইবেলে হযরত ইব্রাহিম আঃ কে আব্রাহাম উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি যে পুত্রকে জবেহ করতে নিয়ে গিয়েছিলেন তার নাম বলা হয়েছে ইসহাক। ঈশ্বর ইসহাককে সরাসরি বলিদান করতে বলেছেন। আব্রাহাম তার পুত্রকে যে বলিদান করবেন তা তিনি তাকে বলেন নি। পুত্র ইসহাক বলিদানের জন্য মেষশাবক কোথায় জানতে চাইলে আব্রাহাম বলেছেন, তা ঈশ্বর যোগাবেন। পরে আব্রাহাম বলিদানের জন্য পুত্র ইসহাককে বেঁধে ফেলেন এবং হাতে ছুরি নেন। এসময় ঈশ্বরের দূত এসে আব্রাহামকে থামান। খ্রিস্টানদের বিভিন্ন ব্যাখ্যা পড়েছি। এতে তারা উল্লেখ করেছেন, আব্রাহাম তার পুত্রকে ভুল বলেন নি। কারণ ঈশ্বর তার অসংখ্য বংশধর দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। আর একমাত্র পুত্রকে বলিদান করা হলে তো এটা সম্ভব নয়। সেকারণে তিনি যা বিশ্বাস করতেন সেটাই পুত্র ইসহাককে বলেছেন।
অন্যদিকে পবিত্র কোরআানে আব্রাহামের আরবী নাম ইব্রাহিম উল্লেখ করা হয়েছে। তবে তার পুত্রের নাম উল্লেখ করা হয়নি। মুসলমানরা মনে করেন, ইব্রাহিম আঃ এর দুই পুত্র ছিলেন। প্রথম পুত্র যাকে নিয়ে ঘটনা তিনি হযরত ইসমাইল আঃ। তার কোরবানি নিয়ে হযরত ইব্রাহিম আঃ উদ্বিগ্ন ছিলেন। কারণ তারা তখন বৃদ্ধ। আর কোনো সন্তান হওয়ার সম্ভাবনা ছিলনা। নিজের একমাত্র পুত্রকে আল্লাহকে খুশী করার জন্য উৎসর্গ করায় আল্লাহ খুশী হয়ে তাকে আরেকটি সন্তান দান করেছেন। তিনি হলেন ইসহাক। ইসমাইলের বংশধর হলেন আরবরা। আর ইহুদী ধর্মাবলম্বীরা হলেন ইসহাকের বংশধর।
যাই হোক, কোরআনের বর্ণনায় বুঝা যায়, হযরত ইব্রাহিম আঃ এর পুত্র তখন শিশু ছিলেন না। তিনি ভালোমন্দ বুঝতে পারতেন। একটু ব্যাখ্যা করি। কুরআনের শব্দ "বালাগা মায়াহু" বলা হয়েছে তাতে বালেগ বা প্রাপ্ত বয়স্ক ছিলেন মর্মে বুঝা যায়। যদিও ইসলামিক ফাউন্ডেশন এই শব্দদ্বয়ের অনুবাদ করেছে "পিতার সংগে কাজ করার মত বয়সে উপনীত হযেছেন"। কোরআনের বর্ণনায় হযরত ইব্রাহিম আঃ তার পুত্রকে নিজের স্বপ্নের কথা বলেছিলেন। আর নবীদের স্বপ্ন বাস্তব। এটা ওহীরও মাধ্যম। এটা হযরত ইসমাইল আঃ জানতেন। সে কারণে তিনি কোরবানি হতে রাজি হয়েছিলেন। কোরআনের বর্ণনায় ইব্রাহিম আঃ তার পুত্রকে সঠিক বিষয়টি জানিয়ে মতামত চেয়েছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। পরে তার পুত্রকে কাত করে শুইয়ে দিয়েছিলেন। হাতে ছুরি নেয়ার বর্ণনা নেই। তাকে বেঁধে ফেলার বর্ণনা নেই। অর্থাৎ বাইবেলে যেভাবে আব্রাহামকে তার পুত্রকে বেঁধে বলিদানের জন্য ছুরি হাতে উদ্যত এক পিতা হিসেবে চিত্রিত করেছে; কোরআন সেভাবে তাকে চিত্রিত করেনি। কোরআনে ইব্রাহিম (আঃ) কে নিজ পুত্রকে নৈবেদ্যের বেদীতে শুইয়ে দিয়ে আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করছেন- এমন চিত্র আঁকা হয়েছে।
কোরআনের কৌশলগত বর্ণনাঃ
কোরবানির যে প্রেক্ষাপট পবিত্র কোরআনে বর্ণনা করা হয়েছে তা দেখলে বুঝা যায় কত হেকমতের সাথে এই হৃদয় বিদারক ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে। কোরআন প্রায় সাড়ে চৌদ্দশ বছর আগে নাজিল হয়েছিলো। তখনকার দিনে মানবাধিকার ও শিশু অধিকারের ধারণা আবিস্কৃত হয়নি। তখন পবিত্র কোরআনে এই কোরবানির ঘটনাটি যদি শিশু পুত্রকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গিয়ে হাত পা বেঁধে ছুরি গলায় চালিয়ে দেয়ার বর্ণনা থাকতো; তা স্বাভাবিক বর্ণনা হতো। তবে সেই বর্ণনা বর্তমান যুগে এসে কী ব্যাখ্যায় দাড়াতো চিন্তাও করা যায়না!
১৯৮৯ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে শিশু অধিকার সনদ সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। ১৯৯০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে এটি আন্তর্জাতিক আইনের অংশে পরিণত হয়। শিশু অধিকার সনদ জাতিসংঘের সবচেয়ে ব্যাপকভাবে গৃহিত মানবাধিকার চুক্তি যা জাতিসংঘের প্রায় সকল রাষ্ট্রই অনুমোদন করেছে। আমাদের দেশও শিশু অধিকার সনদে স্বাক্ষর করেছে।
আমাদের পবিত্র কোরআনে শিশুর অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে এমন কিছু নেই। বর্ণনার ক্যারিশম্যাটিক ক্ষমতায় বিতর্কগুলোকে এড়িয়ে গেছে। কোরআনে এই ধরণের শিশু নির্যাতনের বিষয়টি থাকলে কী হতো ভাবতে পারেন! তখন কোরআনকে শিশু অধিকার পরিপন্থী হিসেবে প্রচার করা হতো। এই আধুনিককালে এসেও কোরআনের কৌশলগত বর্ণনায় সেটি সম্ভব হচ্ছেনা। এমনকি হত্যার বিচারে হত্যার বর্ণনাও যেখানে এসেছে সেখানেও বলা হয়েছে, এটা আসলে জীবন রক্ষা।
কোরআনের যে কয়েকটি দিক আমাকে বিস্মিত করেছে কোরবানির প্রেক্ষাপট বর্ণনা তার একটি। কোরআন বুঝতে পারলে বিস্ময়ের পর বিস্ময় জাগে।
কাজী সায়েমুজ্জামান
ঢাকা।
ঈদুল আজহার ১ম দিন
০৭ জুন ২০২৫
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুন, ২০২৫ সকাল ৯:৩৭

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




