ভাইরাস কি?
ভাইরাস হল পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে ছোট জীব। এরা ব্যাকটেরিয়ার চেয়ে ছোট। আকারে মোটামুটি ১০-৩০০ ন্যানোমিটার হয়ে থাকে। সবচেয়ে বড় ভাইরাস এর নাম মিমি ভাইরাস, আকারে এরা ৪০০ ন্যানোমিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। আমরা খালি চোখে ১ মিলিমিটার এর দশ ভাগের একভাগ পরিমান বস্তু দেখতে পারি, আর ১ ন্যানোমিটার হল ১ মিলিমিটার এর ১০ লক্ষ ভাগের এক ভাগ। বোঝাই যাচ্ছে যে আমরা খালি চোখে ভাইরাস দেখতে পারি না। একমাত্র ইলেকট্রন অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে এদেরকে দেখা যায়। পৃথিবীতে কম করে হলেও ১০ লক্ষের বেশি ভাইরাস আছে [1]। এরা সবজায়গায় আছে- আমাদের শরীরের ভিতর থেকে শুরু করে ঘরে বাইরে- সব জায়গায়। কিন্তু আমরা সব ভাইরাস নিয়ে চিন্তিত না, শুধু মাত্র যেই ভাইরাস গুলো আমাদের রোগ সৃষ্টি করতে পারে সেইগুলো নিয়ে আমরা চিন্তিত। এর মধ্যেও কিছু আছে যেগুলো সাধারন ঠাণ্ডা জ্বর কিংবা প্রাণঘাতী নয় সেগুলো নিয়েও খুব বেশি চিন্তিত না, আমাদের দুশ্চিন্তার কারন একমাত্র প্রাণঘাতী ভাইরাস নিয়ে।
ভাইরাস কি কি ধরনের?
ভাইরাস দেখতে বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে, যেমন- কিছু আছে দেখতে গোলাকার আবার কিছু দণ্ডাকার। কিছু ভাইরাস উদ্ভিদ এর ভিতরে থাকে আবার কিছু ভাইরাস প্রাণীর ভিতরে থাকে। তবে এই আলোচনার জন্য ভাইরাসকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি, আর সেটা ভাইরাস এর Genome এর উপর নির্ভর করে। Genome হল পৃথিবীর সব প্রাণীর প্রতিটি কোষের ভেতরের সেই জিনিস যা আমাদের ভিন্ন ভিন্ন আকৃতি এবং বৈশিষ্ট দেয়। আর কোষ হল প্রতিটি প্রাণীর গঠনগত মূল ভিত্তি। ভাইরাসের দুটি ভাগ হল- DNA ভাইরাস এবং RNA ভাইরাস। DNA এবং RNA হল সুতার মত একটা বস্তু যা প্রতিটি কোষ এ থাকে এবং কোষকে সব ধরনের কাজ করতে নির্দেশনা দেয়। অনেকটা আমাদের মাথার মত, যেমন মাথা আমাদের শরীরকে চালায় তেমনি DNA/RNA আমাদের প্রতিটি কোষকে চালায়।
করোনা ভাইরাস সম্পর্কে যা জানা দরকারঃ
এই নতুন করোনা ভাইরাস ( Novel Corona virus) কে COVID-19 (Corona virus disease 19) কিংবা SARS-CoV-2 (Severe acute respiratory syndrome Corona virus-2) নামেও ডাকা হয়। (ছবি-CDC) ভাইরাসটি দেখতে গোলাকার বলের মত এবং এই বলের চারদিকে মুকুটের মত বর্ধিত অংশ থাকায় এই ধরনের ভাইরাসের নাম দেয়া হয়ে “করোনা” যেটা ইংরেজি Crown বা মুকুট থেকে এসেছে। এটার size ৬০-১৪০ ন্যানোমিটার [2]। এটা মানুষের ফুসফুসে আক্রমন করে, সাধারন ঠাণ্ডা কাশির মত symptom থেকে শুরু করে শ্বাসকষ্ট [3] এবং পরিশেষে মৃত্যুও ঘটাতে পারে। ভাইরাসটি পূর্বের SARS (Severe acute respiratory syndrome) যা ২০০০ সালে ছড়িয়ে ছিল, ৮০০০ এর বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল এবং MERS (Middle East respiratory syndrome) যা ২০১২ সালে ছড়িয়ে পরে ছিল, ৮০০ এর বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল- এর জ্ঞাতি ভাই। করোনা ভাইরাস প্রথম ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯ এ চীনএর হুবেই প্রদেশে আবিষ্কৃত হয়। ধারনা করা হয় এটি বাদুর থেকে বনরুই এ আসে এবং এই বনরুই থেকে চীনের একজন প্রাণীবিক্রেতার মাধ্যমে এটি ছড়ায়। এই article টা লেখার সময় পুরো পৃথিবীতে ১২ লক্ষ লোক এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে এবং ৬৫ হাজারের বেশি মানুষ মারা গিয়েছে। যেহেতু ভাইরাসটি বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায়, তাই আক্রান্ত মানুষের হাঁচি, কাশি, কথা বলা এবং সাধারন শ্বাসপ্রশ্বাস থেকে ৬ ফুট পর্যন্ত দূরে থাকা সুস্থ মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। যদিও প্রতিনিয়ত নতুন নতুন গবেষণার মাধ্যমে আমাদের ধারনা পরিবর্তন হচ্ছে, তবে নিঃসন্দেহে এটি এর জ্ঞাতি ভাই SARS এবং MERS থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী। ভাইরাসটি বিভিন্ন surface এ ৩-৭২ ঘণ্টা কার্যকর থাকতে পারে। আক্রান্ত রুগির নাকের ভিতর থেকে নমুনা নিয়ে RT-PCR এর মাধ্যমে এই ভাইরাস পরীক্ষা করতে হয়। এখন পর্যন্ত এই ভাইরাস এর কোনও ওষুধ কিংবা ভ্যাক্সিন নেই। তাই রোগমুক্তির সবচেয়ে ভাল পদ্ধতি হল আক্রান্ত মানুষ থেকে দূরে থাকা, যাকে আমরা social distancing বলছি (যেহেতু ভাইরাসটি বাতাসের মাধ্যমে ছড়াচ্ছে)। এছাড়া, বার বার সাবান দিয়ে হাত ধোয়া, হাঁচি কাশি দেয়ার সময় কাপড়, বাহু কিংবা টিস্যু ব্যবহার, আমাদের হাতদুটি আমাদের মুখ, নাক এবং চোখ থেকে দূরে রাখা- এই ভাইরাস এর বিস্তার অনেক কমিয়ে দিতে পারে (যেহেতু ভাইরাসটি যে কোনও surface এ লেগে থাকতে পারে)। বাইরে বের হতে হলে অবশ্যই mask পরে বের হতে হবে। যদিও কোন mask কার্যকর তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে কিন্তু mask অবশ্যই কিছু protection দেবেই। আশা করি ভাইরাস সম্পর্কে এই জ্ঞান আমাদের আরও বেশি সতর্ক হতে সাহায্য করবে এবং আমরা সকলে মিলে বাংলদেশ থেকে এই ভাইরাসকে চিরতরে বিদায় করে দিতে পারব।
করোনা ভাইরাস এ কারা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ?
করোনা ভাইরাস এ সবচেয়ে বেশি ঝুকিতে আছে যারা বৃদ্ধ, যাদের হৃদরোগ আছে, যাদের উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুসের সমস্যায় ভুগছেন, কিডনি সমস্যায় ভুগছেন, ধূমপান করছেন, যাদের immunity দুর্বল, এবং যাদের ক্যান্সার আছে তারা। CDC এর একটি সাম্প্রতিক সাপ্তাহিক রিপোর্ট থেকে দেখা যায় (৩ এপ্রিল, ২০২০ এ প্রকাশিত) USA এর যে সব মানুষ করোনাতে আক্রান্ত হয়েছে তাদের যদি উপরে বর্ণিত যেকোনো একটি বা একের অধিক রোগ থাকে তাহলে তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজনীয়তা কয়েকগুন বেশি [4], তার মানে হচ্ছে তারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। Italy তে দেখা গেছে [5], যারা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন এবং বয়স ৭০-৯০ বছরের মধ্যে, তাদের ক্ষেত্রে মৃত্যুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। যারা পুরুষ তাদের মৃত্যুর সংখ্যা মহিলাদের চেয়ে বেশি। করোনা আক্রান্ত এবং উপরোক্ত রোগগুলির মাঝে যাদের উচ্চরক্তচাপ আছে তারা সবচেয়ে বেশি মারা গেছে অন্য রোগগুলোর তুলনায়। যাদের যত বেশ সংখ্যক উপরোক্ত রোগ আছে তাদের মৃত্যুর সংখ্যা তত বেশ, যেমন কারও যদি শুধু ডায়াবেটিস থাকে তার চেয়ে যার একই সাথে ডায়াবেটিস এবং উচ্চরক্তচাপ আছে তার মৃত্যুর সম্ভাবনা বেশি।
প্রথমবার করোনা রুগী সুস্থ হলে কি দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে?
এই প্রশ্নটার উদ্ভব হয়েছে যখন চীন, জাপান এবং সাউথ করিয়ার কিছু মানুষ করোনা positive হওয়ার পরে মনে করা হয়েছিল সুস্থ হয়ে গেছে কিন্তু পরবর্তীতে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে এবং করোনা positive হয়েছে। তাহলে কি এই রোগীগুলো দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হয়েছে? এই প্রশ্নের উত্তর জানাটা এখন খুব এ জরুরী। কিন্তু যেহেতু করোনা খুবই নতুন ভাইরাস তাই এই প্রশ্নের ১০০% সঠিক উত্তর এখনও নেই, দরকার আরও গবেষণার। তবে কিছু ধারনা পাওয়া যায়, যেমন করোনা ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরে প্রথম ৭-১০ দিনের ভিতরে যে Antibody তৈরি হয় তা কমপক্ষে ১-২ বছর সুরক্ষা দিতে পারে এমন সম্ভাবনা রয়েছে । তবে যেহেতু আমাদের প্রত্যেকের শরীরের এই Antibody তৈরি করার ক্ষমতা বিভিন্ন রকম তাই সুরক্ষা বিভিন্ন রকম হতে পারে। করোনার জ্ঞাতি ভাই SARS এবং MERS এর ক্ষেত্রে যথাক্রমে ৩ এবং ১ বছর সুরক্ষা দিতে দেখা গেছে। তবে চীন, জাপান এবং সাউথ করিয়ার এই রুগী গুলোর ক্ষেত্রে অন্যান্য সম্ভাবনার কথাও উঠে এসেছে। যেমন দ্বিতীয়বার পরীক্ষার ক্ষেত্রে টেস্টগুলো যদি false positive হয় তাহলে এ ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে। false positive হল এমন অবস্থা যখন নির্দিষ্ট রোগ থাকে না কিন্তু টেস্ট করার পর তা positive result দেয়। তাছাড়া এক্ষেত্রে রোগীর কোন ধরনের স্যাম্পল ব্যবহার করে টেস্ট করা হয়েছিল এত গুরুত্বপূর্ণ। এমনও হতে পারে রোগীর শরীরে করোনা ভাইরাস এর RNA রয়ে গিয়েছিল যা পরে টেস্ট করে positive এসেছে কিন্তু শরীরে জীবিত ভাইরাস ছিল না। RNA ভাইরাস এর ক্ষেত্রে এমনটা সাধারণত দেখা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, দ্বিতীয়বার টেস্ট করা এই রোগীগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কোনও symptoms প্রকাশ করে না [6]
বাংলাদেশে করোনা রোগীর সংখ্যা বা অবস্থা কোথায় যাচ্ছে?
আমরা প্রতিদিন সংবাদ পাচ্ছি যে নতুন নতুন মানুষ করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে। এভাবে কতদিন চলবে আর প্রতিদিন আর কত মানুষ আক্রান্ত হবে? এটা বোঝার জন্য একটা ছোট্ট একটা graph বোঝা দরকার।
এই graph টাতে দেখা যাচ্ছে প্রথমে রোগীর সংখ্যা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। তারপর এক পর্যায়ে সমতল হয়ে যায় এবং শেষ পর্যায়ে কমতে শুরু করে। আমাদের বাংলাদেশ এখন প্রথম ধাপে আছে, আস্তে আস্তে সংখ্যায় বাড়ছে। আমরা পরবর্তী ধাপের জন্য অপেক্ষা করব, সেটা হচ্ছে সমতল বা flattening the curve। এই ধাপটার জন্য প্রতিটি আক্রান্ত দেশ অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে, আমরাও অপেক্ষা করছি। কারন এই ধাপে পৌঁছানো মানে হল “রোগীর সংখ্যা গতকালের চেয়ে বাড়েনি”! তারও চেয়ে বড় কথা হল নিকট ভবিষ্যতে রোগীর সংখ্যা কমতে যাচ্ছে। কিছু website ও আছে যেখানে বিভিন্ন দেশ কত সময়ে এই সমতল জায়গাটাতে যেতে পারছে অথবা বর্তমানে কোথায় আছে তার গ্রাফ দেয়া আছে [7]। এই সমতল অংশটা কত দ্রুত আসবে সেটা নির্ভর করে আমরা কত ভালভাবে করোনার মোকাবেলা করছি। চায়না, সাউথ করিয়া ৩০-৬০ দিনের ভিতরে গ্রাফটাকে সমতল করতে পেরেছে, অন্যান্য দেশ চেষ্টা করে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সময়টা বেশি লাগতে পারে। বেশি পরিমান টেস্ট, দ্রুত isolation এ নিয়ে যাওয়া সহ মানুষের ভিতর ব্যক্তিগত সচেতনতা গ্রাফটাকে সমতল করতে খুবই জরুরী ভুমিকা পালন করে। আমরা যদি বাংলদেশের অবস্থান অন্যান্য সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে আছে এমন দেশের সাথে তুলনা করি তাহলে একটা ধারনা পাওয়া যেতে পারে যে আমরা কতটুকু ভাল অথবা খারাপ অবস্থানে আছি [8]। গ্রাফ A তে দেখা যাচ্ছে মোট আক্রান্ত মানুষের সংখ্যার গ্রাফ, এখানে আমরা অনেক ভাল আছি। যদিও আমরা এইসব দেশ থেকে সময়ের দিক থেকে পরে আক্রান্ত হয়েছি। গ্রাফ B তে দেখা যাচ্ছে মোট মৃত্যুর সংখ্যা, এখানেও আমরা ভাল অবস্থানে আছি এখন পর্যন্ত। গ্রাফ C তে দেখা যাচ্ছে মোট কতগুলো টেস্ট করা হয়েছে। এখানে আমাদের অবস্থান খুবই খারাপ। গ্রাফ D তে দেখা যাচ্ছে যতজন করোনা positive হয়েছে তাদের ভিতর কি হারে মারা গিয়েছে। এই গ্রাফ ও বলছে আমরা ভাল অবস্থানে নেই। এই মারা যাওয়ার হার USA, Germany, China এর মত। তবে এখনও আমরা আশা করি বাংলাদেশের পরিস্তিতি খুব খারাপ হবে না। আমরা কোন না কোনও ভাবে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারব।
(পরিমার্জন চলবে- ৩য় এডিট ১৬ এপ্রিল, ২০২০; ২য় এডিট ৭ এপ্রিল, ২০২০; ১ম এডিট ৫ এপ্রিল, ২০২০)
1. Breitbart, M. and F. Rohwer, Here a virus, there a virus, everywhere the same virus? Trends Microbiol, 2005. 13(6): p. 278-84.
2. Yang, P. and X. Wang, COVID-19: a new challenge for human beings. Cell Mol Immunol, 2020.
3. WHO, WHO: Symptoms of COVID-19. 2020.
4. Team, C.C.-R., Preliminary Estimates of the Prevalence of Selected Underlying Health Conditions Among Patients with Coronavirus Disease 2019 - United States, February 12-March 28, 2020. MMWR Morb Mortal Wkly Rep, 2020. 69(13): p. 382-386.
5. Onder, G., G. Rezza, and S. Brusaferro, Case-Fatality Rate and Characteristics of Patients Dying in Relation to COVID-19 in Italy. JAMA, 2020.
6. LEUNG, H., Can You Be Re-Infected After Recovering From Coronavirus? Here's What We Know About COVID-19 Immunity. APRIL 3, 2020.
7. Routley, N., Infection Trajectory: See Which Countries are Flattening Their COVID-19 Curve. 2020.
8. COVID-19 CORONAVIRUS PANDEMIC. 2020.
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০২০ দুপুর ২:৫৯