somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিশিষ্ট দার্শনিক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী আবু আলি সিনা বা ইবনে সিনা

২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ইরানের প্রাচীন সভ্যতা ও ঐতিহ্য বিশ্বের সকল ইতিহাসবিদকে তো বটেই পুরাতাত্ত্বিক গবেষকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কেননা ইরানের এই প্রাচীন ঐতিহ্য ও সমৃদ্ধি শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতিসহ সকল ক্ষেত্রেই ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এই সমৃদ্ধ ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ হলো ইরানের হামেদান শহর। এই শহরে রয়েছে তিন হাজার বছরের প্রাচীন অনেক নিদর্শন। রয়েছে ইসলামি যুগের বহু স্থাপনা যেমন মসজিদ, কবরস্থান, বিখ্যাত মনীষীদের সমাধি স্থাপনা ইত্যাদি। বিশিষ্ট দার্শনিক ও চিকিৎসা বিজ্ঞানী আবু আলি সিনা বা ইবনে সিনার মাযার, বিখ্যাত কবি বাবা তাহের উরিয়নির মাযারও রয়েছে এই হামেদান শহরেই।


ইবনে সিনাঃ ৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে বোখারা শহরে একটি শিশুর জন্ম হয় যে শিশুটি বড় হয়ে মানব জ্ঞানের মশাল হাতে নিয়ে সমগ্র বিশ্বকে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছেন। এই অসাধারণ শিশুটি হলেন বিখ্যাত চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও দার্শনিক আবু আলি সিনা। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে বোখারা শহরটি সে সময় ছিল ইরানের অন্তর্ভুক্ত। মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আলকুরআনের জ্ঞান হলো ঐশীজ্ঞান। ওই জ্ঞানের আলোতে অবগাহন করেই ইবনে সিনা তাঁর দর্শন চর্চা করেছেন, বিজ্ঞান চর্চা করেছেন, জোতির্বিজ্ঞান থেকে শুরু করে যুক্তিবিজ্ঞান, হিসাব বিজ্ঞান, অংক ইত্যাদি সকল জ্ঞান চর্চা করেছেন। ঐশী জ্ঞানের মাহাত্ম্যে তাঁর সকল অবদানই তাই কালোত্তীর্ণ মহিমায় উদ্ভাসিত হয়েছে। তিনি মাত্র ষোলো বছর বয়সে সমকালীন জ্ঞানী গুণী চিকিৎসক এবং মনীষীদের পড়িয়েছেন। ফলে সহজেই বোঝা যায় তিনি ছিলেন সে সময়কার সবচেয়ে বড় চিকিৎসক।



ইবনে সিনা ইসলামী সভ্যতার স্বর্ণযুগের চিকিৎসাবিদ্যার ইতিহাসে সবচেয়ে উজ্জ্বলতম ব্যক্তিত্ব ছিলেন। চিকিৎসাবিদ্যায় তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে ‘আলকানুন ফিত তিব’। এতো নির্ভরযোগ্য কোনো গ্রন্থ সে সময় অন্তত চিকিৎসাশাস্ত্রে ছিল না। এই বইটি অনূদিত হবার পর পশ্চিমারা ব্যাপকভাবে বইটির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ে এবং তাদের চিকিৎসা সংক্রান্ত বিদ্যালয় মহাবিদ্যালয়গুলোতে বইটিকে পাঠ্য করে দেয়। গ্রিক চিকিৎসাবিদ জালিনূসের বই যেসব ইউরোপীয় চিকিৎসকদের কাছে দুর্বোধ্য ছিল তাঁরাও ইবনে সিনার কানুন গ্রন্থটির শরণাপন্ন হন। এর একটি কারণ ছিলো ইবনে সিনা তাঁর কানুন গ্রন্থে জালিনূসের দৃষ্টিভঙ্গিগুলোকেও বিশ্লেষণ করেছেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে কানুন গ্রন্থটির বেশিরভাগ অনুবাদ হয়েছিল খ্রিষ্টীয় ষোল শতকে।

ইবনে সিনা পাশ্চাত্যে ‘চিকিৎসক নেতা’ হিসেবে দীর্ঘকাল সুপরিচিত ছিলেন। প্রাচ্যেও ইসলামি চিকিৎসা বিজ্ঞানের ওপর ইবনে সিনার প্রভাব আজ পর্যন্তও অক্ষুণ্ণ রয়েছে। ইবনে সিনা খুব সফর করতেন। বিভিন্ন শহর সফরকালেই তিনি তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ ‘কানুন’ রচনা করেন। চিকিৎসা শাস্ত্র এবং চিকিৎসা বিদ্যার ক্ষেত্রে তাঁর সমকালে এই গ্রন্থটিই ছিল সবচেয়ে সুশৃঙ্খল এবং গোছানো। সেই কারণে চিকিৎসা ব্যবস্থাতেও এই গ্রন্থটি একটা সুশৃঙ্খল আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছিল। কানুন পাঁচটি গ্রন্থের সমন্বিত সংকলন। এর প্রথম খণ্ডে রয়েছে মানুষের শরীর,রোগ এবং সুস্থতার জন্যে বিভিন্ন ঔষধের বর্ণনা। ১৯০৫ সালে এ বইটি ফ্রান্সে এবং ১৯৩০ সালে ব্রিটেনে অনূদিত হয়।

কানুনের দ্বিতীয় খণ্ডে রয়েছে হার্বাল মেডিসিনের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা। ইতালীয় ভাষায় এই গ্রন্থটি অনূদিত হয় এবং ১৫৯৩ সালে রোমে গ্রন্থটি ছাপা হয়। কানুনের তৃতীয় খণ্ডে ইবনে সিনা শরীরের প্রতিটি অঙ্গের রোগ সম্পর্কে লিখেছেন। চতুর্থ খণ্ডেও জ্বরের বিভিন্ন প্রকার. রোগের বিচিত্র লক্ষণ,অপারেশন এবং দৃষ্টিশক্তির সমস্যা নিয়ে লিখেছেন। কানুনের পঞ্চম এবং সর্বশেষ খণ্ডে বু আলি সিনা ঔষধ তৈরি,এগুলোর মিশ্রণ এবং তার উপায় সম্পর্কে লিখেছেন। এছাড়াও ইবনে সিনা তাঁর কানুন গ্রন্থে নিজের ব্যক্তিগত বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও অর্জন সম্পর্কে লিখেছেন। সর্বোপরি বলা যায় ইবনে সিনা তাঁর কানুন গ্রন্থটিতে তাঁর সময়কার গ্রিক এবং আরব চিকিৎসাবিদ্যার খুঁটিনাটিও সামগ্রিকভাবে সংকলিত করেছেন। যার ফলে এই গ্রন্থটি হয়ে উঠেছিল চিকিৎসা শাস্ত্রের জন্যে একটি আকর বা অবশ্য পাঠ্য একটি গ্রন্থ। বইটির ঐ বৈশিষ্ট্য আজো বিদ্যমান।

চর্ম এবং মনোরাগ সম্পর্কেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ব্যক্ত করে গেছেন। কানুন গ্রন্থটি ছাড়াও ইবনে সিনা চিকিৎসা বিষয়ক আরো কয়েকটি বই লিখেছেন। তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা ১৮০ টিরও বেশি। এগুলোর মধ্যে অন্তত ১৫টি গ্রন্থই চিকিৎসাশাস্ত্র বিষয়ক। কানুন এগুলোরই একটি। মুসলিম বিশ্বে চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই বইটির প্রভাব নিঃসন্দেহে আজও অম্লান রয়েছে। চিকিৎসা বিষয়ক এই বিশ্বকোষটিতে ফিজিওলজি, স্বাস্থ্য সুরক্ষা, রোগব্যাধি, চিকিৎসা এবং বিভিন্ন ভেষজের ওষুধি গুণ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।

‘পনেরো শতকের শেষদিকে এই বইটি ইউরোপে অন্তত ষোলোবার ছাপা হয়েছে। পনেরো বার ছাপা হয়েছে ল্যাটিন ভাষায় আর একবার ছাপা হয়েছে হিব্রু ভাষায়। ষোলো শতকে বিশবার ছাপা হয়েছে এই বইটি। এ থেকেই ইবনে সিনার বইটির অপরিসীম গুরুত্বের বিষয়টি সহজে অনুমান করা যায়’। ইবনে সিনার বইগুলো বিশ্বের প্রায় সকল গুরুত্বপূর্ণ ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে। অন্তত ছয় শ’ বছর ধরে তার বইগুলোই চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে মৌলিক উৎস ও ভিত্তি হিসেবে গৃহীত ছিল। ফ্রান্স এবং ইতালির বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ইবনে সিনার বইগুলো পড়ানো হতো’।





৫৮ বছর বয়সে এই মহান মনীষী মারা যান। সে সময়কার জ্ঞানের শহর খ্যাত হামেদান শহরে তাঁকে দাফন করা হয়। হামেদান শহরের কেন্দ্রটি এখন বু আলি সিনা স্কোয়ার নামেই প্রসিদ্ধ। তাঁর সমাধি স্থাপনাটিও দেখার মতো। এটি ১৯৯৭ সালে ইরানের জাতীয় ঐতিহ্য ও নিদর্শনের তালিকাভুক্ত হয়েছে। বেশ উঁচু পাথরের ওপর বারোটি পিলার উঠে গেছে অনেক উপরে। ওই পিলারগুলোর মাথায় টোপরের মতো একটি গম্বুজ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ রাত ১০:৪৮
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×