somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

Batch 74…দিনগুলি মোর

২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

‘Batch 74’...গত দুই সপ্তাহ ধরে এই নামটা পরিচিতি পেয়েছে গুটি কয়েকজন মানুষের কাছে, যাদের মধ্যে আমিও আছি। বদিউজ্জামান, যাকে বদি বলে জানি, আমার স্কুল জীবনের বন্ধু। আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে আজ দুই বছরের বেশি হয়ে গেছে। একদিন ওর ফোন পেয়ে প্রথমে চিনতে পারিনি। পরিচয় দিলে বুঝলাম স্কুলে এক সঙ্গে পড়তাম। চিনবো কি করে! দু’এক জন বাদে আর কার সঙ্গে যোগাযোগ আছে? নিজেই দেখা করতে চাইলো, আমিও রাজি। অনেক দিন পর দেখা হবে। আমার অফিসের এদিকেই নাকি আসে মাঝে মাঝে। একদিন এলো, দেখলাম আমার মত চুলে পাক ধরেছে। বসে চা’য়ের সঙ্গে অনেক কথা হলো। কিছু মনে করতে পারলাম, কিছু পারলাম না। বিচ্ছেদটা যখন লম্বা হয় এবং অনেক ঘটনাক্রমের ভেতর দিয়ে হয়, তখন সম্ভবতঃ পুরনো অনেক স্মৃতিই মলিন হয়ে যায়। আমার জীবনের বাঁকের ফাঁদে পড়ে এবং পরবর্তীতে প্রবাস জীবনের দীর্ঘ ১৬ বছরের ব্যবধানে আমার স্কুল জীবনের অনেকের সঙ্গেই আর সংযোগ থাকেনি। কিন্তু অনেকেই অনেকের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে। সবাই এক রকম নয়, কিন্তু কেউ কেউ তো এক রকম। যেমন বদি অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ রেখেছে এবং রেখেছে বলেই ও চায় আমরা যারা ’৭৪-এ মেট্রিক বা মধ্যমিক পাশ করেছি তাঁদের নিয়ে একটা স্মৃতিময় সংগঠন গড়তে। উদ্দেশ্য তেমন কিছুই নয়, মাঝে মাঝে দেখা-সাক্ষাৎ করা, আড্ডা দেওয়া আর স্মৃতিচারণ করা। অনেকেই করে থাকে, যেমন আমার বড় ভাই করে থাকেন তাঁদের স্কুল জীবনের বন্ধুদের নিয়ে, প্রতি বছর ঈদের ছুটিতে।

বদি’র ইচ্ছাতে আর উদ্যোগে এবং আরও অনেকের আগ্রহে গত শুক্রবার (০৪/০৯/২০১৫) টাঙ্গাইল-এ হলো আমাদের মিলন মেলা। যারা ছিলাম একসময় কিশোর-তরুণ, আজ একজন আরেকজনকে চিনতে হলে স্মৃতি খোঁড়াখুঁড়ি করতে হয়। সবাই প্রায় বুড়োদের খাতায় নাম লিখিয়েছি। এই কথাটা যদিও আমি এখনও মানতে নারাজ, কিন্তু অনেককেই দেখলাম বুড়ো হওয়াটাও বেশ পছন্দ করে।
জুবায়ের খান, যাকে আমরা স্কুলে জেবু বলে ডাকতাম। আমাদের মধ্যে সম্ভবতঃ জেবুই ছিল সবচেয়ে সুন্দর দেখতে। ওর বাসা ‘কাঞ্চন কুটির’-এ পরিচিতি সভার মধ্য দিয়ে শুরু হলো আমাদের মিলন মেলা। আমি যেতে যেতে আধা ঘণ্টা দেরি করে ফেললাম। অনেকেই ঢাকা থেকে গিয়েছিল। কেউ পটুয়াখালী-বরিশাল থেকে, আরও কোথা থেকে মনে নেই। বাকি সব টাঙ্গাইলেই থেকে গেছে, বের হয়নি। পরিচয় পর্বে আমার পালা এলে আমি প্রথমেই ক্ষমা চেয়ে নিলাম কারন সবাইকে চিনতে পারছিলাম না বলে। আমাকে পেয়ে প্রায় সবাই উৎফুল্ল হলেও আমি অনেককেই চিনতে পারছিলাম না বলে একটু বিব্রত লাগছিল। জেবুকে খুঁজছিলাম অথচ জেবু আমার পাশেই বসা ছিল। জেবুর সঙ্গে আমার একবার দেখা হয়েছিল এলিফ্যান্ট রোড-এ ‘৯৩তে যখন আমি প্রথম আফ্রিকা থেকে দেশে আসি ছুটিতে। তখন ওর গোঁফ ছিল আর এখন নেই। ধন্দটা ছিল ওখানেই। পরিচয়পর্ব আর চা পর্ব শেষে বাইরে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে কথা হলো খোলামেলা। আমি কাউকে মনে করতে পারি, কাউকে পারি না। কেউ কেউ মনক্ষুন্ন হলো। সত্যিই তো ওরা এতকিছু বলছে আর আমি কিনা মনে করতে পারছি না! আবার যাদের কথা মনে আছে তাঁদের নিয়ে কত স্মৃতিকাতরতা!

লাঞ্চের ব্যবস্থা ছিল শহরের ‘ভিক্টোরিয়া ইন’-এ। চমৎকার একটা রেস্তরাঁ, আমার ধারনাই ছিল না এমন একটা সুন্দর প্রশস্ত রেস্তরাঁ টাঙ্গাইলে আছে। খাবারের পর ফটো সেশন হল। একসময় জুবায়েরকে দেখলাম রেজিস্ট্রি খাতায় উপস্থিতির রেকর্ড লিখছে। আমি কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তোমার হাত কি এখনও ঘামে’? ও সুন্দর করে হেসে জানালো, ‘হ্যাঁ, এখনও সেই রকমই’। স্কুল জীবনে জুবায়েরকে দেখতাম লেখার সময় হাতের নিচে রুমাল নয়তো ব্লটিং পেপার রেখে লিখছে। লেখার সময় ওর হাত খুব ঘামতো। রীতিমত চুইয়ে চুইয়ে পড়তো। এখনও সেই রকমই আছে বললো।

কতজনের কত রকম কাহিনী জমা হয়ে গেছে! হিটলু’র ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে বছর দুই আগে। তবুও দেখলাম সিগারেট ফুঁকছে। আরেকটি দুঃখজনক ঘটনা ঘটে গেছে ওর জীবনে। ছেলেকে মালয়েশিয়ায় পাঠিয়েছিল কম্পিউটারে লেখাপড়া শিখতে। ছ’মাস আগে তাঁর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। বলা হয়েছে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে। কিন্তু হিটলু’র বিশ্বাস ওকে মেরে ফেলা হয়েছে। কিন্তু ঘটনা যাই হোক ওকে চরম সত্যটাকেই মেনে নিতে হয়েছে। পরিচিতি সভায় কষ্ট লুকিয়ে রেখে এই বেদনার কথা সে আমাদের জানালো যারা জানি না।

নজরুলের বাঁ হাতের চারটে আঙ্গুল কাটা পড়েছে, দেখালো। কেবল অনামিকাটা বেঁচে গেছে। ইন্ট্রাভেনাস এন্টিবায়োটিক নিতে যেয়ে যে বিপত্তি ঘটেছিল তারই ফলশ্রুতিতে এই করুণ দুর্ভোগ! ও ঘটনাটা যেভাবে বললো তাঁর কিছুই বুঝলাম না।

আওলাদ মানে বাবন-এর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল অনেক। সেই কেজি স্কুল থেকেই ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব। (টাঙ্গাইলে তখন একটা স্মার্ট কেজি স্কুল ছিল, ষাটের দশকের কথা)। এখন সে দাঁড়ি রেখেছে, পান খাচ্ছে সেই আগের মতই, মুখ লাল করে। রীতিমত হুজুর বনে গেছে।

বাবন, হিটলু, নজরুল, সাদিকুল, কাইউম, সালাম এরা সবাই টাঙ্গাইলেই থাকে। ব্যবসা করছে।

অনেক মুখ, যাদের সঙ্গে আমি একসঙ্গে স্কুলে পড়েছি, মনে করতে পারলাম না। ওরা হড়বড় করে কত কথা বলছে অথচ আমার কিছুই মনে পড়ছে না। আমি অপ্রস্তুত হচ্ছিলাম। হতে পারে ওরা আমাকে যেভাবে দেকেছে আমি হয়তো সেভাবে দেখিই নি। কে একজন ঠিক কথা বললো, ‘হিমু তো ক্লাসে চুপচাপ থাকতো, আমাদের মতো এত জড়াতো না’। সেই সঙ্গে অনেকেই সায় দিল। আমিতো কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত, আত্মকেন্দ্রিক ছিলামই। কিন্তু ঐ একজন বাদে কেউ মনঃক্ষুণ্ণতা প্রকাশ করেনি। বন্ধুত্ব নিশ্চয়ই সবার সঙ্গেই হয় না, গুটি কয়েকজন যাদের সঙ্গে মনের মিল হয়, ওঠা-বসায়, ভাগবাটোয়ারায় যাদের সঙ্গে সবস্যা হয় না তাঁদের সঙ্গেই হয় বন্ধুত্ব। বাকি যারা থাকে তাঁরা সহপাঠী হিসেবেই থাকে। আমি কি শুধুই আমার অনেক সহপাঠীদেরই চিনতে পারছিলাম না? আমার স্কুলটাকে কি আমি চিনতে পারি? ওরাও কি পারে? আমার চোখ বন্ধ করলে দেখতে সেই বিশাল মাঠ যার দু’দিকে দু’টি গোলবার। ইংরেজি ‘এল’ অক্ষরের স্কুল আমাদের, উত্তর-দক্ষিন আর পূর্ব-পশ্চিম। উত্তরপূর্ব কোণে ছিল সাইয়েন্স ল্যাব বিল্ডিং, দক্ষিনে ছিল আলাদা আরেকটি দালান। সবই ছিল একতলা। দক্ষিন-পশ্চিম কোনটা ছিল ফাঁকা। মাঠে দাঁড়িয়ে দেখা যেতো সেই পুল বা সেতু যার নিচ দিয়ে বয়ে গেছে বহমান খাল। বর্ষায় দেখা যেতো কত মাঝি তাঁর নৌকা বেয়ে চলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে দেখা যেতো ঠিক মাঠের কোণে দু’একটা নৌকা ভিড়ে আছে। আমি দাঁড়িয়ে দেখতাম সে দৃশ্য। আজ কোথায় সে খাল? আমরা সবাই মিলে তাকে মেরে ফেলেছি। একটা শহরের বুক চিরে যে জলপ্রণালী বয়ে গেছে তাকে আমরা এই স্বার্থপর শহরবাসী মেরে ফেলেছি। স্কুলের পুড়নো দালান ভেঙ্গে নতুন দোতলা দালান উঠেছে। চারিদিকে ইটের দেয়ালে ঘের দেওয়া হয়েছে। আমাদের সময় পুরোটাই ফাঁকা ছিল, সামনের বড় রাস্তা থেকে স্কুলের সব দেখা যেতো। এখন কিছুই তো চেনা যায় না। তো আমি যদি এই চল্লিশ বছর পর অনেককেই না চিনি তবে খুব কি দোষের!

বিকেল হয়ে আসে, ফেরার পালা। আমার মতো অনেকেই ঢাকা থেকে গিয়েছে। আজই ফিরতে হবে। এক এক করে বিদায় নিলাম। তাঁর আগে সিদ্ধান্ত হলো আসছে ডিসেম্বরে আবার মিলবো কোন বনবাদাড়ে, গাছ-গাছালির ছায়ার নয়তো নদীর ধারে।

ফিরে আসার আগে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম দুপুরের খাবারের আয়োজন করেছিল টাঙ্গাইলের বন্ধুরা আমাদের ঘরছাড়া বন্ধুদের সৌজন্যে। স্কুল জীবনের মতো এবার আর ভাগাভাগি করা গেল না। ওরা আমাদের এবারের মতো অতিথি হিসেবেই দেখলো। হৃদয়ের গভীরে কতজনার কত ভালবাসা, কত রঙিন অনুভূতি লুকিয়ে থাকে...চার দশকের রঙচটা দালানটাও যেন কিসের এক পরশে চক্‌চক্‌ করে ওঠে আর সেই বিচ্ছুরণে চোখ দু’টো জলে ভিজে যায়।

পড়ন্ত বিকেলে ওদের ছেড়ে আমি রিক্সায় উঠে বসি।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:১৮
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×