একটি তুলসী ঘাঁসের কাহিনী!
বরুড়া কলেজ সাংস্কৃতিক ক্লাব।
অনেকদিন হইল কলেজে কোন প্রিন্সিপাল নাই।
আমরা তো একেবারে হাত-পা হেলাইয়া কলেজ জুড়িয়া বসিয়া আছি। কিন্তু আমাদের এই প্রকার সুখ কর্তৃপক্ষ বেশিদিন সহ্য করিতে পারিলেন না। একদিন যাইয়া কোথা হইতে এক প্রিন্সিপালকে ধরিয়া আনিলেন। আমরা কয়েকজন মিলিয়া সেই বস্তুটাকে দেখিতে গেলাম। আলাপে শুনিলাম তিনি ছাদের উপরে আছেন। গিয়া দেখি, মশাই লুঙ্গি হাঁটুর উপরে তুলিয়া, ইচ্ছামতো তাহাতে গিঁট লাগাইয়া, রাতের তারা গুলির দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকাইয়া আছেন; মনেহয় তারাগুলি যেন তাহার ভাজামাছ চুরি করিয়া খাইয়াছে। আমরা বিড়ালের মতো আরো একটু সম্মুখে গেলাম, দেখি বাঁশের কঞ্চির মতো দুইখানি পা, লুকানো দুইখানি হাত, আগাগোড়া মিলাইয়া দেড়-কেজি ওজনের এক কুচকুচে ভদ্রলোক!....?
আমি সালাম দিয়া উত্তরের জন্য তাহার মুখের দিকে তাকাইলাম। মশাই এমনভাবে মুখ বাঁকাইলেন যাহাতে বুঝিতে দেরি হইল না যে, তিনি হিন্দু।
রাশেদ কিছু বলিবার পূর্বেই তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, এইখানে কি?
আমরা বলিলাম, আপনার সহিত আলাপ করিবার নিমিত্তে আসিয়াছি।
তিনি কেমন জানি এক প্রকার হাসি দিলেন এবং যাহা বলিলেন তাহার মর্মার্থ এইঃ আমাদের যখনই কোন প্রয়োজন হইবে, তখনই তাহার কাছে যাইতে পারিব। এমনকি প্রয়োজন না থাকিলেও যাহাতে সপ্তাহে অন্তত দুই একদিন তাহার সহিত সাক্ষাত করি - এই তাহার একমাত্র আশা।
আলাপ করিয়া খুশি না হইয়া পারিলাম না। এইখানে একটু বলিয়া রাখি বাঙলা দেশে এইরুপ অনেক মহৎ ব্যক্তিকে দেখিয়াছি যাহারা দাওয়াত দিয়া নিজেরাই পলায়ন করেন। কিন্তু আমাদের প্রিন্সিপাল নিজে পলায়ন করেন নাই, আমাদেরকে পলাইতে বাধ্য করিয়াছেন। কিন্তু সেই কথা পরে হইবে। যতোদিন ভালো ছিলাম, ততোদিন ভালোই কাটিতে লাগিল। কিন্তু এই ভালো আর লাগিতে চাহিল না। সুখে থাকিলে ভুতে কিলায়-একটা কথা আছে আপনারা জানেন। আমাদেরকে ভূতে একেবারে ঘুষি মারিতে লাগিল! এই ঘুষি খাইয়া একদিন মশাইকে গিয়া বলিলাম- বাণিজ্যিক ভূগোলের টিচার নাই। তিনি মিষ্টহাস্যে বলিলেন-ব্যবস্থা করিব, দুই-তিন দিন সময় দাও।
আমরা চলিয়া আসিলাম। সপ্তাহ চলিয়া গেল। শুনিতে পাইলাম নোটিশ বোর্ডে নতুন একটা রুটিন লাগানো হইয়াছে। আগ্রহ নিয়া দেখিতে গেলাম। দেখি যে ‘বাণিজ্যিক ভূগোল’ ক্লাসটাকে ইচ্ছেমতো কান মলিয়া রুটিনের শেষপ্রান্তে নিয়া ফেলিয়াছে। এখানে আপনাদের জানা আবশ্যক যে, আমাদের মতো গ্রামের কলেজ গুলোতে শেষের দিকের ক্লাস গুলোর সময়, দুই একটা ভাঙা টুল-টেবিল ব্যতিত কোন মানুষ জন্তুকে খুঁজিয়া পাওয়া দায়। আমাদের ঘাড়ের ভূতে আবার আছর শুরু করিল। এইবার আমরা ছোটোখাটো একটা দল বানাইয়া একেবারে প্রিন্সিপালকে ঘিড়িয়া ধরিলাম। বেচারা এদিক ওদিক চাহিয়া হাসিতে চেষ্টা করিলেন। কিন্তু আমাদের বীরত্বপূর্ণ বক্তৃতায় শেষ পর্যন্ত থ হইয়া গেলেন। আমরা রাজ্য জয় করিবার মতো উৎসাহ নিয়া ক্লাসে ফিরিলাম। ঐদিন যাহারই সহিত দেখা হইল তাহারই নিকটে এই কাহিনী সবিস্তারে বর্ণনা করিলাম। সবাই এতো এতো প্রশংসা করিল যে মনে হইল আগামি নির্বাচনে তাহারা আমাকেই প্রার্থী হিসেবে দেখিতে চায়!!
আরো দুই দিন পরে একবার স্টাফরুমে কি একটা দরকারে ঢুকিয়াছিলাম। যাহা না ঘটিবার তাহাই ঘটিল। গিয়া পড়িলাম একেবারে প্রিন্সিপালের মুখ বরাবর। আমাকে দেখিয়াই তিনি চিনিতে পারিয়াছিলেন। এইবার তাহার বীরত্বের পরিচয় দিলেন। স্টাফ ভরা শিক্ষকের সম্মুখে অপরাধীর মতো দাঁড় করাইয়া বলিলেন, আমি কি কানে শুনিতে পাইনা নাকি? অত জোড়ে জোড়ে বক্তৃতা দিবার কি দরকার ছিল, অ্যাঁ?
কি দরকার ছিল কি তিনি তাহা বুঝেন নাই? বুঝিয়াছেন। হাজারো বিদ্রোহী জনতার সম্মুখে দাঁড়াইয়া কি কেহ মন্ত্র পাঠ করে? কিন্তু এই সব যুক্তি সেখানে উপস্থাপন করিতে গেলে কপালে যাহা জুটিবে, তাহা নিয়া কলেজে ক্লাস করা যাইবে না। আমিও তাই নিতান্ত ভদ্র ছেলের মতো কথা গিলিতে লাগিলাম। কি জন্য আসিয়াছি তাহাও ভুলিয়া গেলাম। তাহার চোখ-মুখের দিকে তাকাইয়া বুঝিতে পারিলাম অনেকদিন পর তিনি মনের ঝাল ঝাড়িয়াছেন। আমি আর দেরি করিলাম না।
তাহার নাম ছিল তুলসী দাস।
আমরা পিছনে পিছনে ব্যঙ্গ করিয়া ডাকিতাম- ‘তুলসী ঘাঁস!!’
আর সামনে পড়িলে সালাম দিয়া একেবারে রাগাইয়া দিতাম!
কিছুদিন মশাইয়ের আর কোন প্রকার অদ্ভুত ঘটনা শুনিতে পাই নাই। কান কি রকম ঝালা-পালা করিতে লাগিল। একদিন শুনিলাম বাকের নামের এক ছেলেকে প্রিন্সিপাল তাড়া করিয়াছেন। আমরা সাগ্রহে দেখিতে গেলাম-কান্ডটা কী!
যাহা শুনিলাম তাহার মতো সম্বোধন আর হয়না! প্রিন্সিপালের তাড়া খাইয়া নিজের সম্মান রক্ষা করিতে বাকের চিল্লাইয়া প্রিন্সিপালকে বলিল, কুত্তার বাচ্চা!
বেচারা প্রিন্সিপালও নাছোড়বান্দা। তিনি কি এই রূপ শব্দ জানেন না? আলবৎ জানেন! এইবার তিনিও সরোষে বলিলেন, তুই কুত্তার বাচ্চা..!! তোর চৌদ্দ গুষ্টি কুত্তার বাচ্চা...!!!!! ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমরা চিড়িয়াখানার বানর দেখার মতো আগ্রহ নিয়া অনেক্ষণ দেখিলাম। কী যে মজা সেদিন পাইয়াছিলাম, তাই ভাষায় বর্ণনা করা আমার সাধ্যাতীত!
একদিন বিকেলবেলায় কলেজে বাহির হইয়া দেখি আমার বন্ধু রাশেদের মন খুবই খারাপ। মনের জোড়ে হাসি গিলিয়া আমি তাহাকে জিজ্ঞেস করিলাম, কারণ কি?
উত্তরে জানিতে পারিলাম সেও প্রিন্সিপালের বীরত্বের পরিচয় পাইয়াছে। ঘটনাটা না শুনিবার পূর্বে তাহাকে ছাড়িতে পারিলাম না। অবশেষে সে বলিল,
রাশেদ: কলেজ মাঠের পানির অবস্থা দেখছেন, স্যার?
প্রিন্সিপাল: হ্যাঁ। এইটা তো একটা বিরক্তিকর জিনিস..!
রাশেদ: এই সামান্য....
প্রিন্সিপাল: থামো। থামো! বেয়াদব কোথাকার! কি সামান্য বল তুমি.? এটা সামান্য.? রবীন্দ্রনাথের সামান্য ক্ষতি কবিতা পড়ছ? রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী সামান্য আগুন পোহানোর জন্যে একটা গ্রাম জ্বালাইয়া দিছে! এই সামান্য..?
রাশেদ: স্যার, আমি আসলে বলতে চাচ্ছিলাম....
প্রিন্সিপাল: আর একটা কথা বলবা, থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিব..!!!!
না। রাশেদ তাহার দাঁত হারাইতে চাহেনা। তাই শেষ পর্যন্ত আর কোন কথা বলিল না। সে বলতে চাইছিল, আসলে এই সামান্য কাজের জন্য তো অনেক রাজনৈতিক নেতারা অনেক বিবৃতি দিয়াছেন, কিন্তু কাজ হইল কই? অথচ প্রিন্সিপালের
নজীর দেখিয়া শেষ পর্যন্ত দাঁত বাঁচাইতে হইল!!
ইতিমধ্যে শুনিলাম তিনি নাকি প্রায় অনেক ছাত্রদের সহিতই তাহার মর্যাদাপূর্ণ বীরত্বের পরিচয় দিয়াছেন।
সুতরাং আমাদের একটু ভালো হওয়া উচিৎ ছিল।
কিন্তু ভালো আমরা হইতে পারিলাম না। কেন পারিলাম না...
এটি আমাদের জানবার কথা নয়,
তুলসী ঘাঁসেরই জানবার কথা..!