মুখ বাড়িয়ে দেখে সে। প্রতিদিন।
মাঝে মাঝে দু’একটি গ্রাম। তার কাছে মনে হয় দু’একটি ঘরের মতো। আসে আর যায়। যায় আর আসে। কখনো কখনো থামে। তার বুকে শ্রান্তি নামে। ইচ্ছে করে দু ঢোক পানি পান করে পিয়াস মেটায়। কিন্তু তার আগেই ছেড়ে যায়। প্রতিদিন।
মধ্যে শুধু দু’একটি গ্রাম। যেন অ আ’র মতো পরিচিত তার। তবু দেখে। বিমুগ্ধ নয়নে। একবার। বারবার। পলক ফেরাতেই চলে যায়। ধান ক্ষেতের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া বকের মতো।
ছোটবেলা মায়ের কাছে শুনেছিল, লেখাপড়া করে যে-গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে। কিন্তু সে তো লেখাপড়া করেনি। আজীবন শুধু শিক্ষকের বেত চুরি করেছে এবং যেদিন আর তা সম্ভব হয়নি, সেদিন ভদ্র ছেলের মতো প্রহার সহ্য করে শিক্ষাজীবন শেষ করেছে।
অথচ তার তো গাড়ি থেকে নামার অবসরই নেই।
কুমিল্লা থেকে বরুড়া।
বরুড়া থেকে কুমিল্লা।
মাঝে মাঝে দু’একটি গ্রাম।
তারপর শহর। প্রথম প্রথম সে ঘুরতে বের হতো। এখন মাইনে হারানোর ভয়ে আর হয়না।
চোরের মতো হঠাৎ গিয়ে একটা বাঁশি, দুই টাকার চকলেট নিয়ে চলে আসে। গাড়ি ছেড়ে দেয়। সে লক্ষ করেনি। তাই পাপ হলেও সে মিথ্যা বলে। একদিন। দুইদিন। প্রতিদিন। যেদিন সম্ভব হয়না, সেদিন থাপ্পড় খায় আর শোনে জাত-বেজাতের কিছু ভাষা। তার কাছে মন্দ লাগেনা। মায়ের কাছে শেখা ছড়ার মতো মনে হয়।
নাম তার নুরু। সুন্দর নাম নূর ইসলাম। মালিকের মুখে নুরা।
এক ভাই, এক বোন আর মাকে নিয়ে তার সংসার।
ছোটভাই জন্ম থেকে হাবাগোবা। সবার কথাতেই নিশ্চিন্ত মনে সায় দেয়। এজন্য সবাই তাকে খুব সম্মানও করে। এ সম্মানের আশীর্বাদে মাঝে মাঝে বিছানা ছেড়ে উঠার মতো ক্ষমতাও থাকেনা তার।
ভাইয়ের হাতে চকলেট আর বোনের হাতে বাঁশি দিয়ে প্রতিদিনের মতো আজও দায়িত্ব শেষ করেছে নুরু।তার মা এ ঘরে ও ঘরে কাজ করে, কাঁথা সেলাই করে আর বোনে ছনের বিছানা। এভাবে সংসার চলে কোন রকমে। নুরুর আয়ের অংশটা জমা থাকে। গ্রামে গিয়ে ঘর তুলবে এ আশায়। এখানে তো আছে সাইজ-বেসাইজের একটা জায়গায়। গ্রামের বাড়িটি খুব সুন্দর। সেখানে একটি বড় ঘর তুলবে তারা। তারপর জমি চাষ করে সুখে দিন কাটাবে।
দিনটি ছিল শুক্রবার।
জুমার কারণে কিছু সময়ের জন্য ছুটি পেয়েছে নুরু। ঘরে এসে দেখে মা নেই। বোনের কাছে শুনতে পায়, মা গ্রামের বাড়িতে গেছে। তার মনে একটু আনন্দের রেখা বয়ে যায়। হয়তো অনেক কিছু নিয়ে আসবে মা।
ঐদিন আর নুরু কাজে গেলনা, মাও আসল না। আসল না তার পরের দিনও। এভাবে আটদিন চলে গেল।
আর অপেক্ষা করতে না পেরে এবার বাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল তারা।
নুরু, তার এক ভাই ও বোন।
সকাল সকাল রওনা দিয়েছে তারা । গাড়ি যেন কিছুতেই এগোচ্ছে না। মাত্র তো ছয়-সাত কিলোমিটার। এতো দেরি হচ্ছে কেন? বিরক্তির ভাব ফুটে উঠে নুরুর মুখে।
আরো কিছুক্ষণ পর গাড়ি গিয়ে থামল বাজারে।
গাড়ি থেকে নেমেই দেখা হল শিবু নামে এক বাল্যবন্ধুর সাথে। নুরু তাকে জড়িয়ে ধরতেই সে কোনমতো ছাড়িয়ে নিয়ে প্রশ্ন করল, আপনি কে?
- নুরু।
-কোন নুরু?
প্রশ্নটায় খুব আঘাত পেয়েছে নুরু। এই শিবু আজ কত বড়ই না হয়েছে! এখন কিছুই মনে নেই। অথচ তার সাথে কত বেত’ই না চুরি করেছে সে! আর খেয়েছে একসাথে মার। কিন্তু আজ কিছুই মনে নেই শিবুর। না থাক্ । মনে থাকা উচিতও নয়।
তিন ভাই-বোন গিয়ে উঠল গ্রামের বাড়িতে। একি? ঘরগুলো এমন ভাবে তোলা হয়েছে যে বাড়িতে ঢুকার রাস্তাটি পর্যন্ত বন্ধ। কোনরকমে চাচার ঘরে ঢুকেই যেন প্রাণ পেল তারা। বড়ো চাচার ঘর। চাচা খুব আরাম করে খাওয়ালেন তাদের। কই! এই আদর তো তখন করেননি, যখন তারা খেতে না পেয়ে শহরে কাজ খুঁজতে গিয়েছিল। নিজেকে সম্মানিত অতিথির মতো মনে হয় নুরুর কাছে। খাওয়ার পর সে তার চাচাকে জিজ্ঞেস করল, চাচা, মা কই?
-তোর চোড চাচার গরে।
ছোট চাচার ঘরে গিয়ে দেখে সেখানে নেই, আছে নাকি উত্তরের বাড়িতে। উত্তরের বাড়িতে গিয়ে শুনে দক্ষিণের বাড়িতে। দক্ষিণের বাড়িতে গিয়ে জানতে পারে ‘আমিনের বউয়ের বাড়িতে, আমিনের বউ বলে, সে এই মাত্র বাপের বাড়ি থেকে নিজের বাড়িতে এসেছে। সুতরাং তার ঘরে আসার প্রশ্নই উঠেনা। এভাবে সারাদিন এ ঘর থেকে ওঘরে যায় নুরু, পায় মায়ের আস্তানা সম্পর্কে নতুন নতুন সব তথ্য, কিন্তু সন্ধান মিলেনা ।
বিকেলের দিকে, খালের পাড়ে বসে দুটি ছেলের মাছ ধরা দেখছিল নুরু। বরশিতে খাওয়ার মতো কিছু একটা লাগিয়ে মাছ ধরছিল তারা। বোকা মাছ একটু খানি খাওয়ার লোভে একের পর এক জীবন দিচ্ছে অকাতরে। শুধু কি মাছই এই ফাঁদে পড়ে? মানুষের ফাঁদে মানুষও পড়ে একটুখানি খাওয়ার লোভে। অবশেষে এই ফাঁদেই খাওয়া জীবনের মতো মিটে যায়।
ও মা। কি আজেবাজে চিন্তা করছে সে? সে কি দার্শনিক? না দূর!
একজনের বরশিতে একটি বড়ো মাছ লেগেছে।
অন্যজনের কি কষ্ট! ‘শালার মাছ আমার বরশিটা চোখে দেখেনি?’ এতো কষ্ট করে সে পোকা জোগাড় করে এনেছিল বড়ো মাছ ধরার জন্য। তার বুকে আশা জাগে। মাছটা বোধহয় ভুল করেই ওই বরশিতে গিয়েছে। কিন্তু সে বোকা নয়। অমনি তার বরশিটা নিয়ে ঠিক ঐ স্থানে ফেলে, যেস্থানে বড়ো মাছটি এসেছিল। প্রথমজনের দৃষ্টিতে বিরক্তির ভাব। একটু পর দুটো বরশিতে লাগে এক অসমাধানযোগ্য গিঁট। কিছুক্ষণ তারা নিজেদের ছিপ নিয়ে টানাটানি করেছিল, এখন মারামারি করছে।
হঠাৎ সবাই শুনতে পেল দক্ষিণ দিক থেকে একটা রৈ রৈ আওয়াজ আসছে। বরশি-টরশি ফেলে সবাই দিল দৌড়। কি কান্ড, দেখার জন্যে। নুরুও গেল পিছু পিছু। কাছাকাছি পৌঁছতেই শুনতে পায় ছালাম মিয়ার জালে মস্তবড় কি যেন একটা আটকা পড়েছে। খালের দুই পাড়ে অনেক মানুষ ভিড় জমিয়েছে। খালে এরকম অদ্ভুত অদ্ভুত ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। তবু তারা মজা পায়। আওয়াজ শুনলে ছুটে আসে সব কাজ ফেলে।
ছালাম মিয়ার ভাগ্যটা এতো ভালো কি করে হলো সে বুঝতে পারছে না। হ্যাঁ, মনে পড়েছে। সে গতকাল মাজারে প্রদীপ জ্বেলেছিল, এর পুরস্কারই হয়তো হবে।
আরো দুইজন এসেছিল জালটাকে টেনে তোলার জন্য। কিন্তু সে তার সম্পদে কোন ভাগিদার রাখতে চায়না, গালি দিয়ে তাড়িয়ে দিয়েছে তাদের। জালটা এতোই ভারী ছিল যে তা টেনে তোলা তিনজনের পক্ষেও সম্ভব ছিলনা। অবশেষে আট-দশজন পানিতে নেমে ডুব দিয়ে কোনমতো জালটাকে পাড়ে তোলে।
সবাই হতবাক!
এ কি?
দুই পাড়ের দাঁড়িয়ে থাকা জনতার পায়ের মাটি যেন সড়ে পড়েছে। এখন তারা একেবারে খালের ভিতরে ঢুকে পড়েছে। কারো মুখে কোন কথা নেই। নুরু ছেলেটা এতোক্ষণ পাড়ে ছিল। এখন আর তাকে দেখা যাচ্ছেনা।
একটা লাশ!
পাঁচ-সাতদিন আগের মরা।
দেখে চেনা যায়না।
কেউ কেউ বলে কোন বৃদ্ধ মহিলার লাশ!
কেউ কেউ মহিলাটিকে চিনে কিন্তু নাম জানেনা।
কেউ কেউ জানে যে, মহিলাটি এ গ্রামেরই । তবে গ্রামে বেশি একটা থাকেনা। শুনেছে শহরের কোন এক বস্তিতে না কোথায় থাকে।
এবার একটু ভয় পেয়ে যায় সকলে। পুলিশের লোক জানতে পারলে মামলা-টামলা দিতে পারে।
এবার আর ছালাম মিয়া তার সম্পদের ভাগ নিতে চায়না। সবাইকে দিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আস্তে আস্তে সরে পড়ে অনেকেই। থাকে শুধু পাঁচ-ছয় জন বয়স্ক লোক। তারা সিদ্ধান্ত নিয়ে কাছেই একটা গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দেয় লাশটি।
যাওয়ার পথে সবার নজরে পড়ে নুরু ছেলেটির প্রতি। আহা! কার ছেলে জানি মার খেয়ে পড়ে আছে। এরকম ঘটনা প্রায় প্রতিদিনই ঘটে। তাই প্রতিদিনের মতোই তারা অন্যান্য ছেলেদের চৌদ্দ গুষ্টির নামে গালি দিয়ে নুরুর জ্ঞান ফিরানের চেষ্টা করে। জ্ঞান ফিরলে নুরু দেখতে পায় সে তার চাচার খাটে শুয়ে আছে। চাচা ডাক্তার এনে নুরুর শরীর পরীক্ষা করাচ্ছেন। নুরু কোন কথা বলছে না । চারদিকে কিছু একটা যেন খুঁজছে। না পেয়ে হতাশভাবে তাকিয়ে আছে।
রাত্রি বেশি হলে সে তার চাচাকে বলে, এ বাড়িত ত আব্বার জাগা আচিল, কিন্তু কোন জাগায়ে ত খালি নাই, আমরা গর তুইল্যুম কই?
চাচা কোন উত্তর দেয় না। শুধু বলে,
-তোর মারে পাইচত? একদিন তোরেও মানুষ খুঁজবো, পাইবোনা।
আবার বিমূঢ়ের মতো চেয়ে থাকে সে। মাথাটা কেমন জানি ঘুর ঘুর করছে।
রাত্রে চাচার বাড়ি থেকে লুকিয়ে চলে এসেছে সে। বাকিদের কথা ভাববার সময় নেই। আবার যোগ দিয়েছে বাসের হেলপাড়ি’তে।
কুমিল্লা থেকে বরুড়া ।
বরুড়া থেকে কুমিল্লা।
নিজের অজান্তেই দরজা থেকে ছিটকে পড়ে যায় নুরু। বিপরীত দিক থেকে একটি ট্রাকের ধাক্কা লাগে প্রচন্ড ভাবে। কয়েকজন তাকে ধরাধরি করে রাস্তার পাশে নিয়ে যায়। হাসপাতালে নেওয়ার কোন প্রয়োজন ছিলনা।
সে শুধু একবার দুটি চোখ খুলে।
মুখ বাড়িয়ে দেখে সে।
মাঝে মাঝে দু’একটি গ্রাম। তার কাছে মনে হয় দু’একটি শহর যেন। হাজার কিলোমিটার বেগে যেন গাড়ি চালাচ্ছে সে। কিন্তু এ পথ কিছুতেই শেষ হচ্ছেনা।
কি নিকৃষ্ট এ পৃথিবী!
কি অসীম এ যাত্রা!
এর বুঝি কোন দিনও শেষ নেই