somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চুয়েটের স্মৃতি (১৯৮২-৮৮) পর্ব – ০৪

২২ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ৮:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


.
জিন ভূত আছে কি নেই, তা নিয়ে বিস্তর তর্ক হতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ মানুষের মনে অবচেতন ভাবে জিন-ভূতের ভয় বাস করে। পরিবেশ-পরিস্থিতি সেরকম হলে তা মনে আরো চেপে বসে। এক সময় একটা ভূতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
.
আশীষের সৎকার শেষে সেদিন আর কেউ ডাইনিংয়ে খেতে গেল না। আমাদের হোস্টেল সুপার জামসেদ স্যার সবার রুমে রুমে খাবার পৌঁছে দিতে বললেন সেলিমকে; সেলিম আমাদের ডাইনিং চালাতো। তাঁর একটা গুণ এখনো আমার মনে আছে। ছাত্ররা খাওয়ার মান নিয়ে যতোই অভিযোগ করুক, সে কখনো উত্তেজিত হতো না। খুব নরম ঠাণ্ডা ভাবে অভিযোগ শুনতো এবং ডাইনিংয়ের বয়দের ডেকে সমাধানের চেষ্টা করতো। তার বিনয় বিগলিত স্বভাব ও কৌশলী মনোভাবের কারণে আমরা পাশ করা পর্যন্ত উনি ডাইনিং চালিয়ে যেতো পেরে ছিলেন; যদিও তার বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত ছিল না। জামসেদ স্যার ছাত্রদের প্রতি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিলেন। হোস্টেল সুপার হিসেবে উনাকে পেয়ে তাই আমরা সবাই খুব খুশি ছিলাম। উনি রাশিয়া থেকে যন্ত্রকৌশলে ডিগ্রি নিয়ে এসে ছিলেন। আমাদের মেশিন ডিজাইনের ক্লাস নিতেন। প্রথম দিকে ক্লাসে খুব কড়া ভাব দেখাতেন। তারপর আস্তে আস্তে ছাত্রদের বিভিন্ন ইস্যুতে উনি ছাত্রদের পক্ষে কথা বলায় অচিরেই ছাত্রদের প্রিয় শিক্ষক হয়ে উঠে ছিলেন। এবং একই সাথে শিক্ষকদের বিরাগভাজন হয়ে ছিলেন। মেশিন ডিজাইনের পরিক্ষা ওপেন বুক সিস্টেমে হবে শুনে আমরা ২য় বর্ষ যন্ত্রকৌশলের ছাত্ররা যে কি খুশি হয়েছিলাম, তা আজও মনে পড়ে। রাশিয়ায় নাকি ওপেন বুক পরিক্ষা হয়। পরিক্ষার হলে বই নিয়ে যাওয়া যাবে। আবার সেই বই খুলে প্রশ্নের উত্তরও লেখা যাবে। আহা! সোনায় সোহাগা সিস্টেম। কিন্তু পরিক্ষার প্রশ্ন হাতে পেয়ে সবার মাথায় হাত। বইয়ের কোন পাতায় প্রশ্নের উত্তর লেখা আছে তা খুঁজে বের করতে পরিক্ষার সময় কোন দিক দিয়ে যে তিন ঘন্টা পেরিয়ে গেল, টেরই পেলাম না। পরিক্ষা খারাপ হলে আমাদের একটা কাজ ছিল। একটা দল গঠন করা হতো। সেই দলে স্যারের কয়েকজন প্রিয়ছাত্র থাকতো । তাদের সামনে রেখে আমরা আমজনতা সন্ধ্যার পরে লাইট পোস্টের মৃদু আলোয় গুঞ্জন করতে করতে স্যারের বাসার দিকে যেতাম। মঞ্জু, তৌহিদ ও মাইনুদ্দিন আসজাদ বাবু ছিল স্যারের প্রিয়ছাত্র। কে কে, উত্তর ও দক্ষিণ ছাত্রাবাসের ছাত্ররা ওদের নেতৃত্বে স্যারের বাসায় গেলাম। উনি আমাদের সবকথা শুনে বললেন, তোমরা যদি খাতায় কিছু লিখে থাকো, আমি চেষ্টা করবো নম্বর দিতে।কেউ কথা রাখে না; কিন্তু জামসেদ স্যার কথা রেখে ছিলেন। মোটামুটি সবাই উনার বিষয়ে পাশ করেছিল।
.
প্রতিদিন তো আর রুমে খাওয়া দিয়ে যাবে না সেলিমের বয়রা। পরদিন থেকে শুরু হলো হলের নিয়মিত জীবন। এর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হয়ে দেখা দিল বাথরুমে যাওয়া । অনেকেই একা একা রাতের বেলা বাথরুমে যেতে ভয় পাচ্ছে। রুমমেটকে সাথে নিয়ে বাথরুমে যাচ্ছে। কখন আশীষের প্রেতাত্মা ফিরে আসে, এই ভয়ে অনেকেই ভীত । এই ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যেই একদিন আমাদের বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মারটা প্রচণ্ড শব্দে বিস্মোরিত হয়ে সমস্ত চুয়েট ক্যাম্পাসকে প্রগাঢ় অন্ধকারে ডুবিয়ে দিল। আশে পাশে চারিদিকে গ্রাম। সেখানে টিম টিম করে আলো জ্বলে। তার মাঝে পুরো ক্যাম্পাসটা সন্ধ্যা হলেই কালো চাদরে আবৃত হয়ে শুয়ে থাকতো। মাঝে মাঝে শিয়ালের ডাক সেই অন্ধকারকে আরো ভীতিকর করে তুলতো। এই সুযোগটা আমাদের ব্যাচের কে কে-এর কিছু দুষ্ট ছাত্র লুফে নিল। কেউ বাথরুমে গেলে তারা বাথরুমের বাইরে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থেকে কখনো শিয়ালের ডাক দিতো, কখনো বিড়ালে ডাক দিতো কিংবা পায়ের স্যান্ডেল দিয়ে থপ থপ আওয়াজ করতো। অনেক সময় প্রাকৃতিক কর্ম অসামপ্ত রেখে তড়িঘড়ি করে বেচারা রুমের দিকে দৌঁড়ে পালাতো। ভয় যারা দেখাতো তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল রমা, শংকু ও নোমান। রমা ছিল এক কাঠি সরস। ও ওর রুমমেট তুহিনকে ভয় দেখাতো। ওদের রুমটা ছিল আশীষের আত্মহত্যার জায়গাটা থেকে খুব কাছে। তাই ওদের ওই বাথরুমে তুহিন যেতো না। করিডোর পেরিয়ে বিপরীত ব্লকে একটু দূরে আরো একটা বাথরুম ছিল। ওই দূরের বাথরুমে যাওয়ার আগে তুহিন রমাকে সাথে নিতে চাইতো। রমা মাঝে মাঝে পড়ালেখার কথা বলে ওর সাথে যেতো না। তুহিন রুম থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে রমাও ওর পিছু পিছু অন্ধকারে বাথরুমের দিকে গিয়ে ওত পেতে থাকতো। তারপর সুযোগ মতো কোন এক বিচিত্র শব্দ করে তুহিনের পিলে চমকে দিতো। তুহিন দৌঁড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে রুমে এসে দেখতো রমা পড়ার টেবিলে। কি হয়েছে কিছুই জানে না এমণ ভাব করে রমা তুহিন জিজ্ঞেস করতো কী হয়েছে? ওর বর্ণনা শুনে হেসেই উড়িয়ে দিতো। আর রুমমেট তুহিনকে মৃদু ভৎসনা করতো – দূর মিয়া! তোমার মতো সাহসী ছেলে এতো ভয় পেলে চলে। এসব গল্প রমা আমাদের রুমে এসে করতো। আমরা খুব মজা পেতাম। শংকু, নোমানও প্রায় একই ধরণের দুষ্টামি করতো। নোমানের রুমমেট ছিল মণি সিংহ । নোমান ভাজা মাছটা ওল্টে খেতে জানে না এমন ভাবভঙ্গি করে মণি সিংকে ভয় দেখাতো। মণি সিংহ স্বপ্নেও ভাবতে পারতো না যে ওর রুমমেট নোমান স্বয়ং বাথরুমের বাইরে অন্ধকারে লুকিয়ে থেকে শিয়াল, বিড়ালের ডাক দেয়।
.
আমাদের বাথরুম গুলোতে সাধারণত তিনটা ছোট ছোট খোপে ছোট কাজ সারা যেতো, দু’টো দরজা দেওয়া রুমে বড় কাজ সারা যেতো আর গোসলখানা ছিল তিনটা। ভূতের ভয়ে শুনলাম অনেকেই ছোট কাজ সারার সময় খোপে না বসে দাঁড়িয়েই কাজ সারছে। একদিন অন্ধকারে ঘটে গেল বিপত্তি।অন্ধকার বাথরুমে দাঁড়িয়ে ছোট কাজ সারার সময় একজনের আর্ত চিৎকারে জনৈক ছাত্র কাজ অসমাপ্ত রেখেই দৌঁড়ে পলায়ন করলো। একজন ওই খোপে বসে ছোট কাজ সারছিল। তার উপর উনি উনার কল ছেড়ে দিয়েছেন। ভুক্তভোগী সেই ভাইকে সেদিন সেই কন কনে ঠাণ্ডার রাতে গোসল করতে হয়েছিল।
.
এদিকে অন্ধকারে আমাদের রুমের আড্ডাটা আরো জমে ওঠে। রুহুল গান ধরে - ‘পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে পাগল আমার মন নেচে ওঠে’ । সাথে আমরা পড়ার টেবিলকে তবলা বানিয়ে তাল দেই । রুহুলও টেবিলে তাল ঠুকে। তারপর দল বেঁধে মনসুরের হোটেলে খেতে যাই। নিকষকালো সেই অন্ধকারের বুক চিরে কতগুলো টর্চের আলো ভূতের মতোই নৃত্য করতে করতে আমাদের পথ দেখায়। বেশ কয়েকদিন ভালোই চললো। তারপর সবাই একটু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল। কারণ ট্রান্সফর্মার যেটা পুড়ে গেছে সেটা আর ঠিক করা যাচ্ছে না। নতুন ট্রান্সফর্মার কবে আসবে ঠিক নেই। অধিকাংশ ছা্ত্র পাহাড়তলী বাজার থেকে হ্যারিকেন, কেরোসিনের তেল কিনে সন্ধ্যাবাতি জ্বেলে পড়াশোনা শুরু করে দিল। আড্ডায় আর তেমন কেউ আসে না। সুতরাং আমরা তিন রুমমেট একদিন বিকেলে পাহাড়তলী বাজারে গিয়ে হ্যারিকেন হাতে নিয়ে ফিরলাম, সাথে বোতলে কেরোসিন। প্রতিদিন সন্ধ্যায় সলতে ঠিক করে হ্যারিকেন জ্বালানো, মাঝে মাঝে হ্যারিকেনের কাঁচ পরিষ্কার করা – সব কাজ ওহাব একাই করতো। ওহাবের হাতের কাজ খুব নিঁখুত ছিল। ও ভালো রান্নাও করতে পারতো। প্রস্তুতি যত ব্যাপক, ফলাফল সে তুলনায় নস্যি। আহসান কদাচিৎ হ্যারিকেনের আলোয় পড়েছে। আমি ওহাবের কষ্টের কথা চিন্তা করে বই খুলে বসে থাকতাম।তারপর ঘন্টাখানেক পর রাতের খাওয়া সেরে পড়া শিঁকেয় তুলে তিনজন গল্পে মেতে ওঠতাম।মাঝে মাঝে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে বিদ্যাভাসে রত বন্ধুদের বিরক্ত করতে তাদের রুমে হামলা দিতাম। আমাদের কেউ কিছু বলতো না । কারণ আমাদের রুমে তো তারা কম আড্ডা দেয়নি।
.
প্রায় দুই মাস পরে আমরা আলোর মুখ দেখলাম। নতুন ট্রান্সফর্মার বসানো হলো। সামনে পরিক্ষা । পরিক্ষার ভয়ে ভূতের ভয় কোথায় উড়ে গেল।
.
চলবে...

আগের পর্ব: Click This Link

২২ আগস্ট ২০২০
মো. শামছুল ইসলাম

সর্বশেষ এডিট : ২২ শে আগস্ট, ২০২০ রাত ৮:৩৪
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সবুজের মাঝে বড় হলেন, বাচ্চার জন্যে সবুজ রাখবেন না?

লিখেছেন অপলক , ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:১৮

যাদের বয়স ৩০এর বেশি, তারা যতনা সবুজ গাছপালা দেখেছে শৈশবে, তার ৫ বছরের কম বয়সী শিশুও ১০% সবুজ দেখেনা। এটা বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা।



নব্বয়ের দশকে দেশের বনভূমি ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে লীগ আইডেন্টিটি ক্রাইসিসে জামাত

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৪৬


বাংলাদেশে রাজনৈতিক ছদ্মবেশের প্রথম কারিগর জামাত-শিবির। নিরাপত্তার অজুহাতে উনারা এটি করে থাকেন। আইনী কোন বাঁধা নেই এতে,তবে নৈতিক ব্যাপারটা তো অবশ্যই থাকে, রাজনৈতিক সংহিতার কারণেই এটি বেশি হয়ে থাকে। বাংলাদেশে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঙ্গালির আরব হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা!

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:১০



কিছুদিন আগে এক হুজুরকে বলতে শুনলাম ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে নাকি তারা আমূল বদলে ফেলবেন। প্রধানমন্ত্রী হতে হলে সূরা ফাতেহার তরজমা করতে জানতে হবে,থানার ওসি হতে হলে জানতে হবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

লিখেছেন নতুন নকিব, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৪৩

সেকালের পাঠকপ্রিয় রম্য গল্প "অদ্ভূত চা খোর" প্রসঙ্গে

চা বাগানের ছবি কৃতজ্ঞতা: http://www.peakpx.com এর প্রতি।

আমাদের সময় একাডেমিক পড়াশোনার একটা আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। চয়নিকা বইয়ের গল্পগুলো বেশ আনন্দদায়ক ছিল। যেমন, চাষীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অবিশ্বাসের কি প্রমাণ আছে?

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৬ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩১



এক অবিশ্বাসী বলল, বিশ্বাসের প্রমাণ নাই, বিজ্ঞানের প্রমাণ আছে।কিন্তু অবিশ্বাসের প্রমাণ আছে কি? যদি অবিশ্বাসের প্রমাণ না থাকে তাহলে বিজ্ঞানের প্রমাণ থেকে অবিশ্বাসীর লাভ কি? এক স্যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×