somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চুয়েটের স্মৃতি (১৯৮২-৮৮): পর্ব – ০৩

১১ ই আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


.
মানুষকে বাইরে থেকে দেখে, আমরা যা ভাবি, বাস্তবে অনেক সময়ই তা মিলে না। বাইরের শান্ত রূপ দেখে, ভিতরের আগ্নেয়গিরির কথা কেউ টের পায় না। একদিন হঠাৎ তার বিস্মোরণে সবাই অবাক হয়ে যায়।
.
আড্ডা ছাড়াও আমাদের রুমে আরো একটা কারণে সহপাঠী বন্ধুদের আগমন হতো। কারণটা খুব মহৎ । গুরুর কাছে তার শিষ্যরা বিভিন্ন জটিল বিষয়ে জ্ঞান আহরণ করতো আসতো। গুরু আমাদের স্বনামধন্য রুমমেট আহসান। গুরুর প্রচার এতো দূর পৌঁছে ছিল যে নর্থ ও সাউথ হল থেকেও বন্ধুরা সময়ে-অসময়ে গুরুর চরণের ধূলি নিতে আসতো। তাতে তাদের যে প্রভূত উপকার হতো, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু আমি ও ওহাব নিজেদের টেবিলে বসে বইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় ছিল না। হলের রুমের সাইজ সবারই জানা। সেখানে গুরু যখন শিষ্যদের কিছু বোঝান, তা দুই অধমের কর্ণকুহরে প্রবেশ না করার কোন কারণ নাই। গুরুকে দাক্ষিণ্য হিসেবে কোন কোন ভক্ত সিগারেট উপহার দিতো। সেই সিগারেট তারা অধ্যয়নের সময় টান দিয়ে প্যাকেট খালি করে তার পর যেত। সিগারেটের সেই ভস্ম হৃদয়ে আরো গভীর দহনের সৃষ্টি করতো।
.
আহসান তড়িৎ কৌশলের ছাত্র ছিল। কিন্তু যন্ত্রকৌশলের অনেক জটিল বিষয়ও আমি, ওহাব ও আমাদের অনেক যন্ত্রকৌশলের সহপাঠী ওর কাছ থেকে বুঝে নিতাম। সুতরাং রুমমেট কাম গুরুর কাছে অন্যরা আসলে আপত্তি করা অনুচিত। গাড়ি, ফ্রিজ, টিভি, ক্যামেরা – নাম বলতে থাকলে তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে, সব বিষয়ে ও পড়াশোনা করতো। ওর টেবিলে ক্লাসের পাঠ্য বইয়ের বদলে ওই সব বই গুলোই বেশি শোভা পেত। অনেক সময় আফসোস করে বলতো, ওর বাবার ইচ্ছের কারণেই ও তড়িৎ কৌশলে পড়ছে; না হলে যন্ত্রকৌশলে পড়তো। যন্ত্রকৌশল ওর কাছে খুব আকর্ষণীয় বিষয় ছিল। ওর বাবাও তৎকালীন আহসান উল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে তড়িৎ কৌশলে পাশ করা।
.
ডাইনিং, ক্যান্টিন, মনসুরের হোটেল – যেখানেই যাই। “গুরু, কেমন আছো?” কেউ না কেউ জিজ্ঞেস করবেই। উনিও একগাল হেসে কিছুক্ষণ খাজুইরা আলাপ করে তার পর আবার আমাদের সাথে মিলিত হতেন।
.
শিষ্যদের কারণে গুরুর বেশ কিছু উপকারও হতো। অধিকাংশ ক্লাসই ওর কাছে বিরক্তিকর মনে হতো। তাই ক্লাসে না গিয়ে দিবা নিদ্রা দিয়ে একটু বেলা করে ঘুম থেকে ওঠতেন। তারপর নাস্তা সেরে অধ্যয়নে মনোনিবেশ করতেন এবং বলাই বাহুল্য সেগুলো সিলেবাসের বাইরের বই। শিষ্যরা সাধ্যমত চেষ্টা করতেন গুরুর প্রক্সিটা দিতে। কারণ উপস্থিতির হার সন্তোষজনক না হলে পরিক্ষা দেওয়া যেত না। ক্লাসে কী পড়ানো হচ্ছে, শিষ্যদের থেকে জেনে যেতেন।
.
একদিন দুপুর বেলা আড্ডা বেশ জমে উঠেছে। আমরা তিন রুমমেট ও রমা বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে চলে যাচ্ছি । আমি আর ওহাব মূলত একনিষ্ঠ শ্রোতার দায়িত্ব পালন করতাম। আহসান আর রমাই ব্যাটিং (বিষয়ের বিপক্ষে) ও বোলিং (বিষয়ের পক্ষে) চালিয়ে যাচ্ছে। কখনো আহসান বোলিং করছে, রমা ব্যাট করেছে; আবার বিপরীতও হচ্ছে। দর্শক সারিতে (বিছানায়) বসে আমি ও ওহাব খেলা উপভোগ করছি। হাততালি (হু-হাহ করে) দিয়ে দুই জনকেই উৎসাহ দিচ্ছি। হঠাৎ রমা ওর নাক চেপে ধরলো। ‘এই তোরা কোন গন্ধ পাচ্ছিস?” – বলে রমা ওদিক-ওদিক তাকায়। আমরা বললাম, “না।“
ও আহসানের বিছানা থেকে নেমে চৌকির নিচে তাকালো। নাহ, কোথাও কিছু নেই।
“তোরা সিগারেট খেতে খেতে তোদের ঘ্রাণ নষ্ট হয়ে গেছে” – রমা একটু বিরক্তির সাথেই বলে ওঠে।
আহসানও ছেড়ে দেওয়ার পাত্র না। বলে, “দোস্ত, একদিন একটু একটা টান দিয়া দেখ। কী মজা তখন বুঝবি।“
রমা কিছুটা ক্ষেপে ওঠে, “ওই, ধোঁয়া আর দুর্গন্ধ ছাড়া সিগারেটে আর কী আছে?”
“দোস্ত তাই যদি বুঝতি...” আহসান কথা অসমাপ্ত রাখে।
“তোরা বুঝ, আমি গেলাম” – বলে রমা রুম থেকে চলে যায়। আমরা সিঁড়িতে ওর পায়ের আওয়াজ পাই। আমাদের পাশের রুমে হোস্টেল সুপার বসেন। তারপর সিঁড়ি ঘর। দোতলায় ওঠে রমা সোজা চলে গেল পূর্ব দিকে ওর রুমে।
.
একটু ধাতস্ত হয়ে আমরা তিনজন গন্ধটা নিতে চেষ্টা করি। হ্যাঁ, কিসের যেন একটা দুর্গন্ধ। কিন্তু দুর্গন্ধের উৎস খুঁজে পেলাম না। রুমে যেই আসে কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর বলে, “কিসের গন্ধ তোমাদের রুমে?” দু’এক দিন পর বিষয়টা এমন দাঁড়ালে যে, কষ্ট করে আর গন্ধ শুকতে হয় না। এমনি নাকে আসে। আমার মনে হলে, ইঁদুর মরা গন্ধ। আহসান-ওহাবকে বললাম। তিনজন মিলে তন্ন তন্ন করে ঘরের সব জায়গা খুঁজলাম। এমনিতেই আমাদের রুমটা খুব পরিষ্কার। আমরা তিনজন পালা করে রুম ঝাড়ু দেই। রুমে কোন হিটার নেই। রুমে কোন রান্না হয় না।যাকে বলে টিপটপ।
.
সকালের নাস্তা করে আয়েশ করে তিনজন সিগারেটা টানছি।এমনি সময়ে বাইরে হট্টগোলের আওয়াজ পেলাম। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি আমাদের সামনের রাস্তায় জটলা। বাইরে বেরিয়ে এসে ঘটনা কী জানতে চাই। দেখি একটা ছোট্ট মেয়ে ভয়ার্ত চোখে আঙুল দিয়ে কে কে (কুদরত-ই-খুদা) হলের পিছনে, পূর্বদিকে ঝোপ-জঙ্গলের দিকে দেখাচ্ছে। ওখানে পরিত্যক্ত একটা ঘর আছে। মেয়েটা লুকোচুরি খেলার অংশ হিসেবে ওর বন্ধুদের ফাঁকি দেওয়ার জন্য ওই ঘরে লুকাতে গিয়ে ছিল। তারপর যা দেখেছে, তাতে ওর কথা বন্ধ হয়ে গেছে। হল নির্মাণ কালীন সময়ে লোকজন থাকতো ওই ঘরে। কয়েকজন সাহস করে ঝোপ-ঝাড় পেরিয়ে পথ করে শ্যাওলা গাছে ঢাকা ওই ঘরের দিকে গেল। কিছুক্ষণ পর নাক-মুখে হাত চেপে তারা ফিরলো। সেই ঘরে একজন মরে পড়ে আছে। কালো হয়ে গেছে সারাদেহ-মুখ। পাশে একটা শিশি পড়ে আছে। কে জানি বললো, ওটা আশীষ। ওর পরিবারকে খবর দেওয়া হলো। হল সুপার আসলেন। পুলিশ আসলো। কয়েক দিনের পচা লাশ। বিভৎস আকার ধারণ করেছে। কেউ কেউ সাহস করে দেখতে গেল। এবং দেখে আসার পর অনেকেই দুর্গন্ধে টিকতে না পেরে বমি করে দিল। আমি আর সাহস করে আশীষকে শেষ বারের মত দেখতে গেলাম না। লাশটাকে ওখান থেকে বের করার জন্য রমা এগিয়ে আসলো। একটা গামছা দিয়ে মুখটাকে পুরো ঢেকে ফেললো, শুধু চোখ আর নাক বাদে। রবি দাও এগিয়ে আসলেন। রমা ও রবি দার তত্ত্বাবধানেই আশীষের লাশের সদগতি হলো।
.
কী এমন অভিমান, কী এমন দুঃখ ছিল ছেলেটার? কী এমন দুঃখের আগ্নেয়গিরি ওর বুকে লুকিয়ে ছিল? কেউ টের পায় নি। মা-বাবা, ভাই-বোন, ছোট্ট এই বাগান – সব কিছুকে তুচ্ছ করে, একটা নীল রংয়ের শিশিকে আপন করে নিয়ে কেন আশীষ চলে গেল? ঠিক অন্তিম মুহূর্তে কী ওর মনে হয়ে ছিল, মার কোলে মাথা রেখে বলতে, “ মা গো! বড় কষ্ট হচ্ছে। বুক-গলা জ্বলে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। আমি যাব না। আমাকে বাঁচাও।“
.
চলবে ..

আগের পর্ব: Click This Link
.
১১ আগস্ট ২০২০
মো. শামছুল ইসলাম
.
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০২০ রাত ১১:২৪
৯টি মন্তব্য ৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রোএক্টিভিটি এবং কম্পাউন্ড ইফেক্ট: আমার গুরুত্বপূর্ণ দুইটি শিক্ষা

লিখেছেন মাহদী হাসান শিহাব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১১



আমার গুরুত্বপূর্ন দুইটা লার্নিং শেয়ার করি। এই দুইটা টুল মাথায় রাখলে দৈনন্দিন কাজ করা অনেক সহজ হয়। টুল দুইটা কাজ করতে ও কাজ শেষ করতে ম্যাজিক হিসাবে কাজ করে।

এক.

স্টিফেন কোভের... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রসঙ্গ রূপান্তরঃ ট্রান্সজেন্ডার, সমকামিতা এবং যৌনতা বিষয়ক কিছু আবশ্যিক আলাপ

লিখেছেন সায়েমার ব্লগ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৩

প্রসঙ্গ রূপান্তরঃ
ট্রান্সজেন্ডার, সমকামিতা এবং যৌনতা বিষয়ক কিছু আবশ্যিক আলাপ

১।
যৌন প্রাকৃতিক, জেন্ডার নয়।জেন্ডার মানুষের সৃষ্টি (social, cultural construction)। যৌনকে বিভিন্ন সমাজ বিভিন্ন সময়ে যেভাবে ডিল করে, তাঁকে ঘিরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্মৃতির ঝলক: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুভূতি এবং মনের শান্তির খোঁজে

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০১



সরল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সংমিশ্রণে একটি ঘূর্ণায়মান পথ জুড়ে ঘুরে বেড়ানোর অবস্থানে আমি খুব শান্তি অনুভব করি। নদীর জল ছুঁয়ে পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সঙ্গে এক আন্তরিক সংযোগ অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×