।
.
স্মৃতিকথা লেখার শুরুতে আমার কোন পরিকল্পনা ছিল না। সেদিনের মাতাল করা হাওয়ায় আবেগপ্রবণ হয়ে লেখার শুরু। লেখা শেষ করে দেখলাম চুয়েটের সেই দিনগুলো ফিরে এসেছে।
তখন লেখাটা সংশোধন করে একটা শিরোনাম দিলাম চুয়েটের স্মৃতি। সময়টা বোঝার জন্য পরে যোগ করলাম (১৯৮২-৮৮)। সময়ের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে স্মৃতিচারণ কঠিন কা্জ। কারণ আমি কোন ডাইরি লিখে রাখিনি। মনের ডাইরিতে যা লিখা আছে, তাই বলে যাব। প্রতিটা পর্বই হবে স্বয়ং সম্পূর্ণ। আগের পর্ব না পড়লেও বুঝতে কোন অসুবিধা হবে না আশা করি।
.
খাচার পাখিকে বনে ছেড়ে দিলে তার মনের আনন্দ কেমন হয়, সেটা টের পেয়েছিলাম আমরা তিন রুমমেটই। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা পর্যন্ত সবাই ছিলাম বাসার একান্ত অনুগত সুবোধ বালক। সন্ধ্যে হলে বাড়ির বাইরে থাকা ছিল অচিন্ত্যনীয়। কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে চুয়েটের রাঙ্গুনিয়ার পাহাড় বেষ্টিত সবুজ ক্যাম্পাসে আমরা তিন রুমমেট যেন পাখির মতই উড়ছিলাম। মিডটার্মের পর কখন যে ফাইনাল পরিক্ষা চলে আসলো! পরিক্ষার আগে ২১ দিনের প্রিপারেটরি লিভই তখন ভরসা। আড্ডা কিছুটা স্তিমিত । কারণ অধিকাংশ ছাত্রই এই ২১ দিনকে কাজে লাগিয়ে পরিক্ষার কঠিন বৈতরণী পার হয়। ছাত্রদের পড়ার চাপের এই সুযোগটা হলের ডাইনিং পুরোপুরি কাজে লাগায়। এমনিতে হলের ডাল আর পানির পার্থক্য বোঝা মুশকিল। এই সময়টায় খাবারের মান খুব নেমে যায়। বিশেষ করে পরে যারা খেতে আসে, তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে যায় খাওয়া শেষ করা। ডাইনিংয়ের দুপুর ও রাতের খাবার ছিল তখন সম্ভবত ৫ টাকা করে; প্রতি বেলা। সকালের নাস্তা ক্যান্টিনে বা নিজ রুমে। একটু ভালো কিছু খেতে চাইলে ক্যাম্পাসের গেটের বাইরে যেতে হবে। কাপ্তাই – রাঙ্গুনিয়া সড়কের পাশে, রাস্তা পেরিয়ে মনসুর ভাইয়ের হোটেল। খরচ একটু বেশী পড়তো, ১৫ টাকা থেকে শুরু। আমি ও ওহাব, মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছি। মাসে ৫০০ টাকা দিয়ে আমার হল জীবন শুরু। তাই খাওয়া ভালো-মন্দ যাই হোক, খেয়ে নিতাম। আহসান বেশ অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলে। খাওয়া-দাওয়া খারাপ হলে অনেক সময় না খেয়েই উঠে আসতো। তাই পরিক্ষার এই সময়টায় রাতের বেলা আমরা তিন রুমমেট আর মাহবুব-পারভেজ হোটেলে খেতে যেতাম। সাথে অনেক সময় বিল্লাহ থাকতো্। পারভেজ-মাহবুব ২৬৮ তে ছিল। পূর্ব-পশ্চমে বিস্তৃত টানা হলে ওরা ছিল পশ্চিম প্রান্তের শেষে আর আমরা ছিলাম পুবে । ওদের আর আমাদের করিডোরের মাঝখানে ছিল সংযোগকারী আরো একটি করিডোর। মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায় ছিল বাগান। বাগানের মালি ছিল কিশোর আশীষ। চমৎকার স্বাস্থ্যের শ্যাম বর্ণের ছেলেটা একটা স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে দিয়ে এক মনে কাজ করতো। ওকে আমি কথা বলতে খুব কম দেখেছি। কিছু জিজ্ঞেস করলে এক-দু’কথায় উত্তর দিতো। ওর পরিচর্যায় বাগানটা ভালোই ছিল। পাতাবাহারের শোভা আর সন্ধ্যার পর হাসনাহেনার গন্ধ পেতাম। করিডোর পেরিয়ে মাহবুবদের রুমের সামনে এসে আহসান দড়াম করে দরজায় লাথি মারতো। ভিতর থেকে মাহবুবের চিৎকার শোনা যেত, “ওই শালারা আইছে।“ দরজা না খোলা পর্যন্ত আহসানের লাথি চলতো। ঘরে ঢুকেই আহসানের প্রথম কাজ ছিল ওদের পড়ার টেবিলে গিয়ে বই বন্ধ করা। কমন ডায়ালগ ছিল, “ওই ভটভট (মাহবুবের খেতাব), দরজা খোলা রাখছ না কেন?” আমাদের সরব উপস্থিতি টের পেয়ে পাশের রুম থেকে বেরিয়ে আসতো হাদি-হামিদ। কিছুক্ষণ হৈ হুল্লোড় করে রওনা হতাম মনসুর ভাইয়ের হোটেলের দিকে।আধো আলো-আধারিতে ইট বিছানো রাস্তায় হাটতে হাটতে কত গল্প হতো। সেই সব গল্পে অধিকাংশ সময় পাত্র-পাত্রীকে আসল নামে না ডেকে খেতাবী নামে ডাকা হতো। প্রায় সবারই মজার মজার নাম ছিল। আহসান পারভেজকে জামাই ডাকতো। আবার পারভেজ আহসানকে শ্বশুর ডাকতো। কেন, কী ভাবে, কখন এই নামের উৎপত্তি, কেউ জানে না। কাউকে আঘাত করার জন্য নয়, স্রেফ মজার করার জন্য এই সব খেতাব।
.
মনসুরের হোটেলে আব্বাস নামে ১০-১২ বছরের একটা ছেলে আমাদের খাবার সার্ভ করতো। ওর নিষ্পাপ চেহারাটা দেখে যে কারোরই মায়া লাগবে। খাওয়ার পর প্রায়ই কেউ কেউ ওকে বকশিশ দিতো। আমাদের মতো অনেকেই রুচি পরিবর্তনের জন্য মনসুর ভাইয়ের হোটেলে আসতো।
.
খাওয়া শেষে আমরা তিন রুমমেট তিনটা গোল্ডলিফ সিগারেট কিনে রুমে ফিরতাম। তারপর গ্রুনডিগে একটা গান চালিয়ে দিয়ে আরাম করে সিগারেটে টান দিতাম। ১২-১ টার আগে ঘুমাতে যেতাম না। এমনি একদিন সবে আমি লাইট অফ করে শুয়েছি, হঠাৎ দড়াম করে একটা শব্দ। মনে হলো শব্দটা বাগানের দিক থেকে এলো। এদিকে আহসান-ওহাব ও উঠে পড়েছে। রুমের লাইট জ্বালিয়ে বারান্দায় এলাম। বাগানের পাতাবাহার গাছটা যেন কেমন একটু দুমড়ো-মুচড়ো আছে। বারান্দার আধো আলোয় দেখি – কে একজন চিত হয়ে শুয়ে আছে। মনে হলো, বুকের কাছে রক্ত। আরো একটু কাছে গিয়ে দেখতেই বুঝলাম, রক্ত নয়, পাতাবাহারের লাল পাাতা উনার বুকের উপর। স্থির ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন আমাদের দীলিপ দা।
.
আমাদের ঠিক উপরেই, ২৫৮ তে থাকেন উনি। হঠাৎ মাঝরাতে কোন উনি দোতলা থেকে ঝাপ দিলেন, তা আমরা কেউ ঠাওর করতে পারলাম না। যাই হোক, উনাকে তুলে উনার রুমে নিয়ে যাওয়া হলে। কোথাও কোন আঘাত পাননি। তবে আঘাত যেখানে পেয়েছেন, সেটা কেউ দেখতে পায়নি। মস্তিষ্কে উনি আঘাত পেয়ে ছিলেন পড়ালেখার ভীষণ চাপে। পরে সিনিয়র ভাইদের মুখে শুনেছি, য্ন্ত্রকৌশল থেকে প্রতি বছর পরিক্ষার আগে একজন করে পাগল হয়। শুনে মুখ শুকিয়ে গেল, আমি আর ওহাব ও যে ওই কৌশলেই পড়ছি। রাতেই হোস্টেল সুপারকে খবর দেওয়া হলো। উনি আসলেন। দীলিপ দার পাগলামি তখন চরমে। লুঙ্গি ঠিক থাকছে না। পরে বাধ্য হয়ে উনাকে খাটের সাথে বেঁধে রাখা হলো।
.
দুই-এক দিনের মধ্যেই উনার আত্মীয়-স্বজন আসলেন। তাদের কাছে উনাকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো। উনাকে পরে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। উনি সেবার আর পরিক্ষা দিতে পারেননি। একটা বছর পিছিয়ে গেলেন। পরে সুস্থ হযে আবার হলে ফিরে
আসেন। পড়াশোনা শেষ করে ডিগ্রী নিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যান।
।
আগের পর্ব: Click This Link
.
চলবে..
.
৯ আগস্ট ২০২০
মো. শামছুল ইসলাম
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৪