somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

চুয়েটের স্মৃতি (১৯৮২-৮৮) : পর্ব – ০২

০৯ ই আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৬:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



.
স্মৃতিকথা লেখার শুরুতে আমার কোন পরিকল্পনা ছিল না। সেদিনের মাতাল করা হাওয়ায় আবেগপ্রবণ হয়ে লেখার শুরু। লেখা শেষ করে দেখলাম চুয়েটের সেই দিনগুলো ফিরে এসেছে।
তখন লেখাটা সংশোধন করে একটা শিরোনাম দিলাম চুয়েটের স্মৃতি। সময়টা বোঝার জন্য পরে যোগ করলাম (১৯৮২-৮৮)। সময়ের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে স্মৃতিচারণ কঠিন কা্জ। কারণ আমি কোন ডাইরি লিখে রাখিনি। মনের ডাইরিতে যা লিখা আছে, তাই বলে যাব। প্রতিটা পর্বই হবে স্বয়ং সম্পূর্ণ। আগের পর্ব না পড়লেও বুঝতে কোন অসুবিধা হবে না আশা করি।
.
খাচার পাখিকে বনে ছেড়ে দিলে তার মনের আনন্দ কেমন হয়, সেটা টের পেয়েছিলাম আমরা তিন রুমমেটই। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করা পর্যন্ত সবাই ছিলাম বাসার একান্ত অনুগত সুবোধ বালক। সন্ধ্যে হলে বাড়ির বাইরে থাকা ছিল অচিন্ত্যনীয়। কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে চুয়েটের রাঙ্গুনিয়ার পাহাড় বেষ্টিত সবুজ ক্যাম্পাসে আমরা তিন রুমমেট যেন পাখির মতই উড়ছিলাম। মিডটার্মের পর কখন যে ফাইনাল পরিক্ষা চলে আসলো! পরিক্ষার আগে ২১ দিনের প্রিপারেটরি লিভই তখন ভরসা। আড্ডা কিছুটা স্তিমিত । কারণ অধিকাংশ ছাত্রই এই ২১ দিনকে কাজে লাগিয়ে পরিক্ষার কঠিন বৈতরণী পার হয়। ছাত্রদের পড়ার চাপের এই সুযোগটা হলের ডাইনিং পুরোপুরি কাজে লাগায়। এমনিতে হলের ডাল আর পানির পার্থক্য বোঝা মুশকিল। এই সময়টায় খাবারের মান খুব নেমে যায়। বিশেষ করে পরে যারা খেতে আসে, তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে যায় খাওয়া শেষ করা। ডাইনিংয়ের দুপুর ও রাতের খাবার ছিল তখন সম্ভবত ৫ টাকা করে; প্রতি বেলা। সকালের নাস্তা ক্যান্টিনে বা নিজ রুমে। একটু ভালো কিছু খেতে চাইলে ক্যাম্পাসের গেটের বাইরে যেতে হবে। কাপ্তাই – রাঙ্গুনিয়া সড়কের পাশে, রাস্তা পেরিয়ে মনসুর ভাইয়ের হোটেল। খরচ একটু বেশী পড়তো, ১৫ টাকা থেকে শুরু। আমি ও ওহাব, মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এসেছি। মাসে ৫০০ টাকা দিয়ে আমার হল জীবন শুরু। তাই খাওয়া ভালো-মন্দ যাই হোক, খেয়ে নিতাম। আহসান বেশ অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলে। খাওয়া-দাওয়া খারাপ হলে অনেক সময় না খেয়েই উঠে আসতো। তাই পরিক্ষার এই সময়টায় রাতের বেলা আমরা তিন রুমমেট আর মাহবুব-পারভেজ হোটেলে খেতে যেতাম। সাথে অনেক সময় বিল্লাহ থাকতো্। পারভেজ-মাহবুব ২৬৮ তে ছিল। পূর্ব-পশ্চমে বিস্তৃত টানা হলে ওরা ছিল পশ্চিম প্রান্তের শেষে আর আমরা ছিলাম পুবে । ওদের আর আমাদের করিডোরের মাঝখানে ছিল সংযোগকারী আরো একটি করিডোর। মধ্যবর্তী ফাঁকা জায়গায় ছিল বাগান। বাগানের মালি ছিল কিশোর আশীষ। চমৎকার স্বাস্থ্যের শ্যাম বর্ণের ছেলেটা একটা স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে দিয়ে এক মনে কাজ করতো। ওকে আমি কথা বলতে খুব কম দেখেছি। কিছু জিজ্ঞেস করলে এক-দু’কথায় উত্তর দিতো। ওর পরিচর্যায় বাগানটা ভালোই ছিল। পাতাবাহারের শোভা আর সন্ধ্যার পর হাসনাহেনার গন্ধ পেতাম। করিডোর পেরিয়ে মাহবুবদের রুমের সামনে এসে আহসান দড়াম করে দরজায় লাথি মারতো। ভিতর থেকে মাহবুবের চিৎকার শোনা যেত, “ওই শালারা আইছে।“ দরজা না খোলা পর্যন্ত আহসানের লাথি চলতো। ঘরে ঢুকেই আহসানের প্রথম কাজ ছিল ওদের পড়ার টেবিলে গিয়ে বই বন্ধ করা। কমন ডায়ালগ ছিল, “ওই ভটভট (মাহবুবের খেতাব), দরজা খোলা রাখছ না কেন?” আমাদের সরব উপস্থিতি টের পেয়ে পাশের রুম থেকে বেরিয়ে আসতো হাদি-হামিদ। কিছুক্ষণ হৈ হুল্লোড় করে রওনা হতাম মনসুর ভাইয়ের হোটেলের দিকে।আধো আলো-আধারিতে ইট বিছানো রাস্তায় হাটতে হাটতে কত গল্প হতো। সেই সব গল্পে অধিকাংশ সময় পাত্র-পাত্রীকে আসল নামে না ডেকে খেতাবী নামে ডাকা হতো। প্রায় সবারই মজার মজার নাম ছিল। আহসান পারভেজকে জামাই ডাকতো। আবার পারভেজ আহসানকে শ্বশুর ডাকতো। কেন, কী ভাবে, কখন এই নামের উৎপত্তি, কেউ জানে না। কাউকে আঘাত করার জন্য নয়, স্রেফ মজার করার জন্য এই সব খেতাব।
.
মনসুরের হোটেলে আব্বাস নামে ১০-১২ বছরের একটা ছেলে আমাদের খাবার সার্ভ করতো। ওর নিষ্পাপ চেহারাটা দেখে যে কারোরই মায়া লাগবে। খাওয়ার পর প্রায়ই কেউ কেউ ওকে বকশিশ দিতো। আমাদের মতো অনেকেই রুচি পরিবর্তনের জন্য মনসুর ভাইয়ের হোটেলে আসতো।
.
খাওয়া শেষে আমরা তিন রুমমেট তিনটা গোল্ডলিফ সিগারেট কিনে রুমে ফিরতাম। তারপর গ্রুনডিগে একটা গান চালিয়ে দিয়ে আরাম করে সিগারেটে টান দিতাম। ১২-১ টার আগে ঘুমাতে যেতাম না। এমনি একদিন সবে আমি লাইট অফ করে শুয়েছি, হঠাৎ দড়াম করে একটা শব্দ। মনে হলো শব্দটা বাগানের দিক থেকে এলো। এদিকে আহসান-ওহাব ও উঠে পড়েছে। রুমের লাইট জ্বালিয়ে বারান্দায় এলাম। বাগানের পাতাবাহার গাছটা যেন কেমন একটু দুমড়ো-মুচড়ো আছে। বারান্দার আধো আলোয় দেখি – কে একজন চিত হয়ে শুয়ে আছে। মনে হলো, বুকের কাছে রক্ত। আরো একটু কাছে গিয়ে দেখতেই বুঝলাম, রক্ত নয়, পাতাবাহারের লাল পাাতা উনার বুকের উপর। স্থির ভাবলেশহীন দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন আমাদের দীলিপ দা।
.
আমাদের ঠিক উপরেই, ২৫৮ তে থাকেন উনি। হঠাৎ মাঝরাতে কোন উনি দোতলা থেকে ঝাপ দিলেন, তা আমরা কেউ ঠাওর করতে পারলাম না। যাই হোক, উনাকে তুলে উনার রুমে নিয়ে যাওয়া হলে। কোথাও কোন আঘাত পাননি। তবে আঘাত যেখানে পেয়েছেন, সেটা কেউ দেখতে পায়নি। মস্তিষ্কে উনি আঘাত পেয়ে ছিলেন পড়ালেখার ভীষণ চাপে। পরে সিনিয়র ভাইদের মুখে শুনেছি, য্ন্ত্রকৌশল থেকে প্রতি বছর পরিক্ষার আগে একজন করে পাগল হয়। শুনে মুখ শুকিয়ে গেল, আমি আর ওহাব ও যে ওই কৌশলেই পড়ছি। রাতেই হোস্টেল সুপারকে খবর দেওয়া হলো। উনি আসলেন। দীলিপ দার পাগলামি তখন চরমে। লুঙ্গি ঠিক থাকছে না। পরে বাধ্য হয়ে উনাকে খাটের সাথে বেঁধে রাখা হলো।
.
দুই-এক দিনের মধ্যেই উনার আত্মীয়-স্বজন আসলেন। তাদের কাছে উনাকে বুঝিয়ে দেওয়া হলো। উনাকে পরে পাবনা মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। উনি সেবার আর পরিক্ষা দিতে পারেননি। একটা বছর পিছিয়ে গেলেন। পরে সুস্থ হযে আবার হলে ফিরে
আসেন। পড়াশোনা শেষ করে ডিগ্রী নিয়ে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে যান।

আগের পর্ব: Click This Link
.
চলবে..
.
৯ আগস্ট ২০২০
মো. শামছুল ইসলাম
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই আগস্ট, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৩৪
১৪টি মন্তব্য ১৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জামাত কি দেশটাকে আবার পূর্ব পাকিস্তান বানাতে চায়? পারবে?

লিখেছেন ঋণাত্মক শূণ্য, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৭:২৮

অন্য যে কোন সময়ে জামাতকে নিয়ে মানুষ যতটা চিন্তিত ছিলো, বর্তমানে তার থেকে অনেক বেশী চিন্তিত বলেই মনে করি।



১৯৭১ এ জামাতের যে অবস্থান, তা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে... ...বাকিটুকু পড়ুন

১৯৭১ সালে পাক ভারত যুদ্ধে ভারত বিজয়ী!

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯


দীর্ঘ ২৫ বছরের নানা লাঞ্ছনা গঞ্জনা বঞ্চনা সহ্য করে যখন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বীর বাঙালী অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে দেশ প্রায় স্বাধীন করে ফেলবে এমন সময় বাংলাদেশী ভারতীয়... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইন্দিরা গান্ধীর চোখে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক: ওরিয়ানা ফলাচির সাক্ষাৎকার

লিখেছেন শ্রাবণধারা, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৫৫


১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইতালীয় সাংবাদিক ওরিয়ানা ফলাচি ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। এই সাক্ষাৎকারে মুক্তিযুদ্ধ, শরনার্থী সমস্যা, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক, আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী পররাষ্ট্রনীতি এবং পাকিস্তানে তাদের সামরিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

=যাচ্ছি হেঁটে, সঙ্গে যাবি?=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:০৬


যাচ্ছি হেঁটে দূরের বনে
তুই কি আমার সঙ্গি হবি?
পাশাপাশি হেঁটে কি তুই
দুঃখ সুখের কথা ক'বি?

যাচ্ছি একা অন্য কোথাও,
যেখানটাতে সবুজ আলো
এই শহরে পেরেশানি
আর লাগে না আমার ভালো!

যাবি কি তুই সঙ্গে আমার
যেথায়... ...বাকিটুকু পড়ুন

আগামী নির্বাচন কি জাতিকে সাহায্য করবে, নাকি আরো বিপদের দিকে ঠেলে দিবে?

লিখেছেন জেন একাত্তর, ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:১২



আগামী নির্বচন জাতিকে আরো কমপ্লেক্স সমস্যার মাঝে ঠেলে দিবে; জাতির সমস্যাগুলো কঠিন থেকে কঠিনতর হবে। এই নির্বাচনটা মুলত করা হচ্ছে আমেরিকান দুতাবাসের প্রয়োজনে, আমাদের দেশের কি হবে, সেটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×