চট্টগ্রাম এমনই এক স্থান—যেখানে চিরবিদ্রোহী কাজী নজরুল ইসলাম অন্তত তিনবার এসেছিলেন ও অবস্থান করেছিলেন কমপক্ষে ৪৭ দিন। তবে এই ৪৭ দিন অবস্থানকালীন আনুপূর্বিক কর্মকাণ্ডের বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়নি। বরং কিছু কিছু বিষয়ে ধূম্রজাল তৈরি হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলামের বাংলা সাহিত্য-জগতে আনুষ্ঠানিক অভিষেক হয় ১৯২০ সালের মার্চে করাচি থেকে কলকাতায় ফিরে আসার পর।
কলকাতায় নজরুলের সাথে কংগ্রেসের সম্মেলনের (১৯২৮) পূর্বে আর একজনের সাক্ষাত ও পরিচয় ঘটে—তিনি বিপ্লবী নেতা সূর্য সেন। এই বিপ্লবীর সাথে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা বাড়ে কংগ্রেস নেতা সুভাষচন্দ্র বসুর মাধ্যমে। সাথে ছিলেন বিপ্লবী দলের শীর্ষস্থানীয় নেতা অনন্ত সিং ও লোকনাথ বল। বিপ্লবী দলের লোকদের সাথে নজরুলের এই পরিচিতি চট্টগ্রামের তরুণ-যুবকদের মনে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। বিপ্লবী নেতা পূর্ণেন্দু দস্তিদারের স্মৃতিকথায় এর প্রমাণ মেলে। তিনি লিখেন: ‘নজরুল ইসলাম তখন আমাদের মত কিশোর ও তরুণদের প্রাণে অগ্নিবীণার প্রচণ্ড ঝংকার তুলেছেন। তাঁর বিদ্রোহী কবিতা তখন বিপ্লবী ও দেশপ্রেমিকদের অন্তরে সংগ্রামের এক তীব্র কামনা ও আবেগ সৃষ্টি করেছে। তাই তিনি যে কয়দিন চট্টগ্রামে বাহার (হাবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী) সাহেবদের নন্দনকানন বাসায় ছিলেন, সে কয়দিন তা তারুণ্যের এক বিপ্লবতীর্থে পরিণত হয়েছিল।’ নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ এক সাক্ষ্য এবং সূর্যসেনের বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সাথে স্থানীয় মুসলমানদের অংশগ্রহণের কথাও উঠে এসেছে।
এসময় হাবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রাম কলেজে বিএ ক্লাসের ছাত্র এবং তরুণ সাহিত্যানুরাগী ও ক্রীড়াবিদ। তিনি কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের সম্পাদক, ফুটবল দলের ক্যাপ্টেন ও কলেজ বার্ষিকীর সম্পাদক। চট্টগ্রামের বিপ্লবী দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের অনেকেই তাঁর বন্ধু ও সহপাঠী। কলেজে মুসলিম ছাত্রীর ভর্তি হওয়াকে কেন্দ্র করে যে উত্তেজনা দেখা দেয় হবীবুল্লাহ বাহার সে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য কলেজ অধ্যক্ষের অনুমতি নিয়ে চট্টগ্রাম সফররত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট, বিশিষ্ট কবি ও বাগ্মী বাঙালি নারী সরোজিনী নাইডুকে চট্টগ্রাম কলেজে আমন্ত্রণ জানিয়ে নিয়ে আসেন ও সংবর্ধনা প্রদান করেন। ২৪ জুলাই অনুষ্ঠিত সে সভায় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামকে আনুষ্ঠানিকভাবে সংবর্ধনা জানানো হয়। হাবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী কবিকে সে সভায় নিয়ে যান। সেদিন উপস্থিত ছাত্র পূর্ণেন্দু দস্তিদারের সূত্রে জানা যায়, কবি সেদিন গান ও আবৃত্তি শুনিয়ে সকলকে মাতিয়ে রেখেছিলেন। মুসলিম নারী সমাজের উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সেদিনের চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ, কবি নজরুল ইসলাম, হাবীবুল্লাহ বাহার ও তার বন্ধুদের ভূমিকা নিঃসন্দেহে তাৎপর্যবহ।
১৯৪৯ সালের ৫ জুন চট্টগ্রাম তমদ্দুন মজলিশের কর্মীরা ‘নজরুল জয়ন্তী’ পালন করে। চট্টগ্রামের জুবিলী সিনেমা হলে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন কথাশিল্পী শওকত ওসমান। অনুষ্ঠানে সুচরিত চৌধুরী প্রযোজিত ঐকতান বাদন অত্যন্ত শ্রুতিমধুর ও উপভোগ্য হয়। আনোয়ারা, মনোয়ারা ও শিখা’র ‘ঝুমুর নৃত্য’ দর্শক-শ্রোতাদের আনন্দ দেয়। স্থানীয় ‘দৈনিক পয়গাম’-এর মন্তব্য ছিল: ‘এই প্রকার অনুষ্ঠান চট্টগ্রামে প্রথম এবং মুসলমান মেয়েরা নাচে-গানে এই প্রকার কৃতিত্ব শুধু চট্টগ্রামে নয় অন্যত্রও দেখিয়েছেন কিনা সন্দেহ। তবে দুঃখের সাথে বলতে হয় নজরুলের ‘ছায়া ডাকা, পাখী ডাকা দেশ, সিন্ধু পর্বত গিরি দরিবন’—সেই মহান ‘রূপের দেশ’ চট্টগ্রামে কবি নজরুল বর্তমানে অনেকটাই অবহেলিত, উপেক্ষিত। নজরুল স্মৃতি এখানে কেবলই ঝাপসা হয়ে আসছে। নজরুলের বহুল স্মৃতিবিজড়িত আজিজ মনজিল দীর্ঘদিন আগে বেহাত হয়ে গেছে। কোথায় সেই তামাকুমন্ডির আজিজ মনজিল? বর্তমান প্রজন্ম কি জানেন? কবি সুফিয়া কামালের স্মৃতিকথায় জানা যায় কবি সুহূদ হাবীবুল্লাহ বাহার কবি নজরুলের নামে সেই আজিজ মনজিল লিখে দেয়ার কথা বলেছিলেন। শহরের প্রাণকেন্দ্র ডিসি হিলে স্থাপিত ‘নজরুল স্কোয়ার’ যেন উপহাস করছে। নজরুল স্কোয়ারের চাইতে ডিসি হিল নামটিই যেন বেশি লোক চেনে, জানে ও ডাকে। নজরুল স্কোয়ার নামটি জনপ্রিয়তা পায়নি। নজরুল একাডেমি স্থাপনের কথা শোনা গেলেও বাস্তবে রূপ পায়নি। চট্টগ্রামে একটি সড়কের নামকরণ করা হয়েছে নজরুলের নামে কিন্তু চট্টগ্রামের অনেক শিক্ষিত-সচেতন মানুষও বলতে পারবে না সড়কটি কোথায়? চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘নজরুল চেয়ার’ স্থাপিত হয়েছে অন্তত দু’যুগের বেশি আগে কিন্তু সে নজরুল চেয়ারের কি হাল- কি মর্যাদা, আমরা ক’জন লোক জানি? প্রথমদিকে ড. আহমদ শরীফ, ড. আলাউদ্দিন আল আজাদ ও অধ্যাপক দিলওয়ার হোসেন নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক ছিলেন। সিদ্ধান্ত ছিল নজরুল স্মারক বক্তৃতা প্রচলনের। এটাই চট্টগ্রামে নজরুল বিষয়ক প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ। কিন্তু উদ্যোগটির কোনো ধারাবাহিকতা নেই। প্রথমদিকে কিছু তত্পরতার খবর জানা গেলেও বর্তমানে নজরুল চেয়ার ও এর কার্যক্রমের তেমন খবরাখবর জানা যায় না। তবে চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক সাহিত্য-সামাজিক সংগঠন তাঁর জন্ম-মৃত্যুদিবস পালন করে থাকে। কিন্তু তা পতেঙ্গা সাগর পাড়ের মত দু’এক জায়গায় কিছু নামফলক পাওয়া যাবে—হয়তোবা। কিন্তু এসব কি যথেষ্ট? কুমিল্লার মত অন্যান্য নজরুল স্মৃতিবিজড়িত স্থান ঘুরে আসুন—দেখুন।
চট্টগ্রামে নজরুল আজ ঘুমিয়ে আছেন শান্ত হয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে আগস্ট, ২০১৬ দুপুর ১২:০৩