somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

শাওন আহমাদ
স্বপ্নপূরণই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়।তাই বলে স্বপ্নকে ত্যাগ করে নয়,তাকে সঙ্গে নিয়ে চলি।ভালো লাগে ভাবতে, আকাশ দেখে মেঘেদের সাথে গল্প পাততে, বৃষ্টি ছুঁয়ে হৃদয় ভেজাতে, কলমের খোঁচায় মনের অব্যক্ত কথাগুলোকে প্রকাশ করতে...

বদলে যাওয়া সময়ের প্রতিচ্ছবি

২৬ শে জুলাই, ২০২৫ দুপুর ২:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমার বেড়ে ওঠা মফস্বলের এক রক্ষণশীল পরিবারে। যেখানে ভোরবেলা ওঠা থেকে শুরু করে ঘুমানো পর্যন্ত রুটিনের খাঁচার বন্দী ছিল দৈনন্দিন জীবন। খাঁচার ফাঁক গলে বেরিয়ে এলেই কড়া শাসনের মুখোমুখি হতে হতো।

ভোরে মক্তব দিয়ে দিন শুরু হতো; এরপর কোচিং, স্কুল, প্রাইভেট টিউটর—এভাবেই দিন গড়িয়ে যেত। প্রতিদিন চক্রাকারে চলত এই নিয়ম। নিজের জন্য খুব একটা ফুরসত মিলত না। বিকেলে একটুখানি সময় পাওয়া যেত; কিন্তু আব্বার কড়া ভাষায় বলা থাকত, ‘যেখানেই যাই সূর্য ডোবার সাথে সাথেই যেন বাড়ি ফিরি।’

স্কুল থেকে ফিরে মাঠে গিয়ে কোনো খেলা শুরু করলে মাঝপথেই সূর্য ডুবে যেত। খেলা আর শেষ অধ্যায়ের মুখদর্শন করতে পারত না। বেদনাবিধুর মন নিয়ে খেলার মাঠ থেকে ফিরতে হতো বাড়ি। তখন সূর্যের ওপর খুব রাগ হতো, মনে মনে বিড়বিড় করতাম, ‘কেন যে তার এত তাড়া! তার বাবাও কি তাকে খুব শাসন করে? বাড়ি ফিরতে দেরি হলে বকা দেয়? হয়তো দেয়, নয়তো তার এত কীসের তাড়া?’

মাঠ থেকে ফেরার পথে পিঞ্জিরা আপাদের বাড়ির পাশ দিয়ে আমাদের বাড়ি আসতে হতো। প্রতিদিন সন্ধ্যায় তারা বাড়িতে ধূপধুনো জ্বালিয়ে ধোঁয়া দিতেন। এটা ছিল তাদের মশা তাড়ানোর কৌশল। ধূপধুনো পোড়ানোর ধোঁয়া বাতাসে ভেসে ভেসে অদ্ভুত সুন্দর এক গন্ধ ছড়িয়ে দিত আশেপাশে।

আমার বেদনাবিধুর মনের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত সে গন্ধ। শৈশবে পথের বাঁকে ফেলে আসা সেই গন্ধ আজও কোথাও একটা রয়ে গেছে আমার ভেতর। আজও বিষণ্ন হলে ধূপের গন্ধে ভেসে যায় আমার ঘর, আমার ভেতর, আমার বাহির।
আব্বা আমাদের খুব চোখে চোখে রাখতেন। এদিক-ওদিক হতে দিতেন না। তিনি যা বলতেন তাই হতো। তার মুখের উপরে কথা বলা তো দূরে থাক, 'টু' শব্দ করার সাহস আমাদের ছিল না। আমরা টেবিলে বসে উচ্চস্বরে পড়তাম, আব্বা উঠোনে পায়চারী করতেন। ভুল কিছু পড়লে শুনে সংশোধন করে দিতেন।

আমরা আব্বার চোখ দেখে, ধমকের শব্দ শুনে ভয়ে থরথর করতাম। তার ধমকের শব্দে বাড়ির কবুতরগুলো উড়ে গিয়ে কাঞ্চনদের বটগাছে চুপ করে বসে থাকত। ও বেলায় আর বাড়ি ফিরত না। পেটে টান পড়লে উড়ে এসে বড় ঘরের টিনের চালায় বসে বাকবাক্কুম করে মাথা খেত। দাদি ওদের শান্ত করতে উঠোনে ধান, গম ছড়িয়ে দিত। আমি উঠোনের এক কোণে টুল পেতে বসে মুগ্ধ নয়নে এ দৃশ্য দেখতাম।

কী সুন্দর ছিল সে দৃশ্য! কবুতরগুলো পাড়াপাড়ি করে খাবার খেত, গলা উঁচু করে ঘাড়ের পালক দাঁড় করিয়ে একজন অন্যজনকে ভয় দেখাতো। এমন চোখ জুড়ানো দৃশ্য এখন আর খুব একটা দেখা যায় না। আজকাল মানুষের এত সময় কোথায় যে কবুতর পুষবে? ভাঙনের ভিড়ে যখন সংসার টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে যায়, তখন কবুতর পোষা বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়।

আব্বার ভয়ে পাড়ার ছেলেরাও তটস্থ থাকত। পারতপক্ষে তার সামনে পড়ত না কেউ। আমাদের পড়ার ঘরের পাশেই ছিল মসজিদের মাঠ। পাড়ার ছেলেপেলেরা অবসরে ওখানেই খেলাধুলা করত। বন্ধের দিনগুলোতে সকালবেলা সবাই এসে জড়ো হতো ওখানে। এরপর শুরু হতো নানাবিধ খেলা।

পড়ার ঘরের জানালা দিয়ে সব দেখতে পেতাম, শুনতে পেতাম ওদের উল্লাস; কিন্তু আব্বার ভয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে যাওয়ার সাহস আমাদের কখনোই হতো না। মন মসজিদের মাঠে পড়ে থাকত আর এদিকে আমরা টেবিলে বসে পড়তে থাকতাম, 'আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে? কথায় না বড়ো হয়ে কাজে বড়ো হবে?'

কখনো কখনো পাড়ার ছেলেরা জানালায় উঁকি মেরে আমাদের খেলার জন্য ডাকত। সে ডাক আমাদের কানে পৌঁছানোর আগেই পৌঁছে যেত আব্বার কানে। আব্বা পাশের ঘর কিংবা উঠোন থেকে চিৎকার করে বলতেন, ‘জানালার পাশে কে রে?’ অমনি সব জানালা ছেড়ে, মাঠ ছেড়ে দৌড়ে প্রাণে বাঁচত। পরবর্তী কিছুদিন ওই জায়গায় তাদের ছায়াও পড়ত না।

আমার মাঝেমধ্যেই জোছনা রাতে বাড়ির বাইরে ভীষণ রকমের ঘুরে বেড়াতে মন চাইত। বসে থাকতে ইচ্ছে করত জলার ধারে, স্কুলের মাঠে। কখনো কখনো ফসলি জমির বুক চিরে বয়ে যাওয়া মেঠো পথ দিয়ে হেঁটে যেতে চাইতাম বহুদূর…। তবে আমার এই ভাবনাগুলো কল্পনাতেই সুন্দর ছিল। সেখানেই তারা জোছনা বিলাসের সংসার পেতে বসে ছিল। ওই সংসারের পাঁচিল টপকে বের হওয়ার সাধ্য বা সাহস কোনোটাই তাদের ছিল না।

আমাদের সময় সন্ধ্যার পর কিশোরদের বাড়ির বাইরে যাওয়ার কোনোরকম অনুমতি ছিল না। যদি কেউ এই নিয়মের বলয় ভেঙে বাইরে বের হতো, তাহলে আশেপাশের মানুষ অষ্টমাশ্চর্য দেখার মতো বিস্ময় আর কৌতূহল নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকত এবং ধমক দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিত। প্রত্যুত্তর না করে সুবোধ ছেলের মতো তারাও বাড়ি চলে আসত।

কিন্তু এখন সময় বদলেছে। বর্তমান সময়ের কিশোর-কিশোরীরা যেখানে নিজেদের বাবা-মায়ের কথাই অনেক সময় মানতে চায় না, সেখানে পাড়ার অন্য কোনো মুরুব্বি বা অপরিচিত কারো কথা শুনবে—এমনটা ভাবা প্রায় অসম্ভব।

বর্তমান সময়ে আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা আলোচিত ঘটনা, ফেসবুকের শিরোনাম কিংবা সংবাদপত্রের প্রধান খবরগুলো দেখে গা শিউরে ওঠে। একসময় যে সমাজকে আমরা মূল্যবোধের আশ্রয়স্থল ভাবতাম, যেখানে পারিবারিক বন্ধন ছিল অটুট, সেই সমাজের বুনিয়াদ আজ নড়বড়ে। নৈতিকতার চরম অবক্ষয় যেন গ্রাস করছে আমাদের মানবিক মূল্যবোধগুলোকে।

সন্তানরা আজকাল বাবা-মায়ের কাছে এমন সব অন্যায় আবদার করছে, যা পূরণ করতে গিয়ে বাবা-মায়ের সারা জীবনের সঞ্চয় নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, এমনকি ঋণের জালে জড়িয়ে তারা নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন।

শুধু অর্থ নয়, এর চেয়েও ভয়াবহ চিত্র হলো, সামান্য শাসন বা বকাঝকা করার অপরাধে নিজেদের জন্মদাতা মা-বাবাকে খুন করতেও এক মুহূর্ত দ্বিধা করছে না কিছু বিপথগামী সন্তান। সংবাদ শিরোনামে যখন এমন খবর দেখি, তখন প্রশ্ন জাগে, তবে কি আমাদের পারিবারিক কাঠামো এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে?

অন্যদিকে, শুধুমাত্র ফুর্তি করে ঘুরে বেড়ানো, দামি ব্র্যান্ডের জিনিসপত্র কেনা বা অপ্রয়োজনীয় বিলাসী জীবনে গা ভাসানোর জন্য অর্থের জোগান দিতে না পারায় বাবা-মায়ের কপালে জুটছে লাঞ্ছনা, শারীরিক নির্যাতন।

যে বাবা-মা তাদের সর্বস্ব দিয়ে সন্তানদের বড় করেছেন, তাদেরই আজ সন্তানের হাতে অপদস্থ হতে হচ্ছে। এই চিত্রগুলো কি প্রমাণ করে না যে আমরা এমন এক প্রজন্ম তৈরি করছি, যারা কেবল নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধিতেই ব্যস্ত, যেখানে শ্রদ্ধাবোধ, কৃতজ্ঞতা বা ভালোবাসার কোনো স্থান নেই?

এই অবক্ষয় শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়ের সমস্যা নয়, এটি সামগ্রিকভাবে সমাজেরই প্রতিচ্ছবি। প্রযুক্তির সহজলভ্যতা, বিশ্বায়নের প্রভাবে বিদেশি সংস্কৃতির অবাধ প্রবেশ এবং সর্বোপরি সঠিক নৈতিক শিক্ষার অভাবে আমাদের তরুণ প্রজন্ম যেন পথভ্রষ্ট হচ্ছে। পারিবারিক অনুশাসন কমে যাচ্ছে, সামাজিক মূল্যবোধগুলো হারিয়ে যাচ্ছে, আর তার ফলস্বরূপ তৈরি হচ্ছে এমন এক অস্বাভাবিক পরিস্থিতি।

এই পতন রুখতে এখনই আমাদের সচেতন হতে হবে। পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্র—সকলের সমন্বিত উদ্যোগে পারিবারিক বন্ধনগুলোকে পুনরায় সুদৃঢ় করতে হবে, মূল্যবোধের চর্চা বাড়াতে হবে, এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মানবিক ও দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য কাজ করতে হবে। না হলে এই অবক্ষয় আমাদের সমাজকে এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে ঠেলে দেবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০২৫ বিকাল ৩:৪৫
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×